বাংলাদেশ এর টেলিফিল্ম বা টেলিচলচ্চিত্র নিয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তিন দিনব্যাপী একটি প্রদর্শনী উৎসব ভারতের ফিল্মসিটি পুনেতে। বাংলাদেশীয় টেলিফিল্মের আন্তর্জাতিক যাত্রা শুরু হল এই উৎসব থেকেই।

পুনেতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যায় প্রায় ৭৫ এর মত। তাদেরই পরিকল্পনা ও উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে সম্পূর্ণ অর্থসাহায্য দিয়েছে ভারতীয় পররাষ্ট্র মণ্ত্রনালয়ের অঙ্গসংস্থান-ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস্ সংক্ষেপে আইসিসিআর। স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ অন্যান্য দেশের সাথে ভারতের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানকে সুগম করতে প্রতিষ্ঠা করেন এ কাউন্সিল। সেই থেকে আইসিসিআর কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানের নীতিমালাকে সামনে রেখে। প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীকে মেধাবৃত্তি প্রদানপূর্বক ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পড়ার সুযোগ করে দেয় আইসিসিআর। সেই সাথে পৃথিবীর অনেক দেশে আন্তর্জাতিকভাবে বিবিধ সাংস্কৃতিক উৎসবও পালন করে। তাই বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রীদের প্রস্তাবিত উৎসবটিকে আইসিসিআর দু’দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের অন্যতম দ্বার বিবেচনা করে।

এই বিষয়ে একটা কথা না বললেই নয়, টেলিফিল্ম হল ফিচার দৈর্ঘ্য(৪০-৯০ মিনিট) এর ফিল্মধারা যা শুধুই টেলিভিশন নেটওয়র্ক এর জন্য নির্মিত এবং প্রচারিত। মূলধারার ফিচারফিল্ম এর সাথে এর পার্থক্য এই যে টেলিফিল্ম প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়না। বাংলা্দেশে টিভিনাটক বলতে আমরা যা বুঝি তা মূলত টেলিফিল্ম।নাটকের এর চেয়েও ফিল্মের সাথে এর সম্পর্ক বেশি। দৃশ্য এখানে ক্যামেরাতে ধারণ করা হয়, মঞ্চায়ন নয়।

তিনদিনের এই উৎসবে মোট ১১টি ফিল্ম প্রদর্শিত হয়, স্থান ছিল মহারাষ্ট্র এডুকেশন সোসাইটি অডিটোরিয়াম। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ডঃ ইফতেখার আহমদ, ডীন(টেলিভিশন), ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইন্সটিট্যুট অফ ইন্ডিয়া(এফটিআইআই), পুনে।বিশেষ অতিথি ছিলেন মিঃ বীরেন্দ্র চিত্রভ, সেক্রেটারী(ওয়েস্টার্ন রেজিওন), ফেডারেশন অফ ফিল্ম সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া(এফ এফ এস আই) এবং মিঃ আর পার্থিবান, রেজিওনাল অফিসার,আইসিসিআর,পুনে। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে উৎসবে অংশ নিতে আমন্ত্রন জানানো হয় প্রখ্যাত নাট্যকার মামুনুর রশীদ, ডিরেক্টরস গিল্ড এর সহ-সভাপতি গাজী রাকায়েত এবং ডিরেক্টর সুমন আনোয়ারকে। দু’দেশের জাতীয় সংগীতের সাথে সূচনা হয় অনুষ্ঠানের। ফিল্ম মধ্যান্তরে বাংলাদেশ থেকে আগত ডিরেক্টরদের সাথে দর্শকের পারস্পরিক আলোচনার ব্যবস্থা রাখা হয়।এতে ফিল্ম এন্ড প্রডাকশন এর দৃষ্টিভংগীতে তাঁদের প্রশ্নোত্তর পর্ব বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রেক্ষাপটকে ভারতীয় বোদ্ধাদের কাছে আরো গভীরভাবে পরিচিত করে।

এই উৎসবের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ আরো দুটি আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আমন্ত্রন পেয়েছে।
১) ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল,২০১১-মুম্বাই, আয়োজনে আইএফএমসি(মুম্বাই)
২) বসুন্ধরা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল,২০১১-পুনে, আয়োজনে এফএফএসআই
এই দুটি ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বিষয়ক দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পেয়েছে পুনেতে অবস্থানরত ছাত্র-ছাত্রীরাই।

বাংলাদেশের টেলিফিল্ম ধারাটি খাস করে এই ফেস্টিভ্যালের পরে ফিল্মবোদ্ধা দর্শকদের মনে বিশেষ প্রভাব রেখেছে। এই অনুষ্ঠানটিকে বাৎসরিকভাবে নিশ্চিত করার জন্য অনেকেই অনুরোধ করেছেন।পুনের অগ্রণী সংবাদপত্রগুলিতে এই ফেস্টিভ্যাল এর উদ্দেশ্য এবং বিবরনী বেশ গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানের ২ দিন আগে পুনের পত্রকার ভবনে অনুষ্ঠিত প্রেস কনফারেন্সে এফএফএসআই সেক্রেটারি বীরেন্দ্র চিত্রভ এই উৎসবের আয়োজন ও পরিকল্পনার সমস্ত দিক সাংবাদিক মহলের সামনে তুলে ধরেন। তিনি এই বাস্তবায়নকে উপস্থিতির মাধ্যমে সামগ্রিক পরিপূর্ণতা দেওয়ার জন্য সকলকে ব্যাক্তিগতভাবে অনুরোধ করেন।উৎসবে প্রবেশ সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল। প্রধান অতিথি ডঃ ইফতেখার আহমদ ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত সমস্ত ছবি পুনে ফিল্ম ইন্সটিট্যুট লাইব্রেরীতে রাখার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। মিঃ বীরেন্দ্র চিত্রভ এফএফএসআই এর অধীন ১৮৫টি ফিল্ম সোসাইটিতে এই ছবিগুলো বিতরণে আগ্রহী।

এবার আসল কথাতে আসা যাক। মুক্তমনার পাঠক অবশ্যই জানেন, তারপরও বলছি, ফিল্ম এমন একটি মাধ্যম যা আমাদেরকে বহির্বিশ্বে সামগ্রিকভাবে পরিচিত করতে পারে। বাংলাদেশের নিয়মিত মুলধারার সিনেমার চাইতে এই টেলিফিল্মগুলো সারা জাতির জীবন, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও মনস্তত্বকে অনেক বাস্তবিকভাবে প্রতিফলন করতে পারে। ইদানিংকালে বানিজ্যিক সুবিধার্থে বানানো কিছু কাজ গৌরবময় ধারাটিকে ভিন্নরুচির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যাবসায়িক হিন্দিছবি এবং সিরিয়ালের ছাঁচে তৈরী ফিল্মগুলো তরুন সমাজকে অবাস্তবিক, অতিআবেগীয় ব্যাক্তিত্বের করে তুলছে যা আমাদের মোটেও কাম্য নয়। এই স্খালন রোধের একটি উপায় হল নিজেদের ফিল্মের মুমূর্ষু ধারাটিকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করে জনপ্রিয়তার ক্ষেত্র তৈরী করা। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার প্রবাসী বাংলাদেশী তাদের নিজ নিজ স্থানে ফিল্মফেস্টিভ্যাল বা তদ্রুপ অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে এই ব্যাপারটিকে সফল করতে পারেন। এইরকম ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণের ইচ্ছা দেশীয় পরিচালকদেরকে ভাল কাজের ব্যাপারেও আগ্রহী করে তুলবে। কেবল একটি “মাটির ময়না”, “স্বপ্নডানায়” বা “আগামী” নয়, আরো অনেক ভালো কাজ হচ্ছে যেগুলো অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে আনতে পারে। অথচ আমাদের দেশে সেই কাজগুলোই পেছনে পড়ে যাচ্ছে, বানিজ্যিক এবং সস্তা হিউমার নেই বলে। নূরুল আলম আতিকের মত মেধাবী পরিচালককে সংগ্রাম করতে হয় তাঁর ছবি “ডুবসাঁতার” নিয়ে, কারণ আমাদের দেশের বড় বড় মাল্টিপ্লেক্সগুলোতেও ডিজিটাল ছবি দেখানোর প্রযুক্তি নেই বলে। দেশের সর্বপ্রথম ডিজিটাল ছবি মুক্তির পর দিনেই টিভিচ্যানেলে সম্প্রচারিত হয়ে যায়। কারণ প্রেক্ষাগৃহ তার জন্য ভাল দাম দিতে পারেনা। অর্থানুকূল্যের অভাবে শত শত কাজ থেমে যাচ্ছে গোড়াতেই। আর আমরা করে যাচ্ছি নেতিবাচক অনুকরণ। হলিউড দেখে ভারতে যখন বলিউড, তারপর একে একে কলিউড, মলিউড, টালিউড হল তো আমরাও নাম পালটে ঢালিউড করে নিলাম। সেই একই নর্তন-কুর্দন কপিকাট করে চালিয়ে যাচ্ছি বছরের পর বছর। গা বাঁচিয়ে নেওয়া শিক্ষিত ভদ্র শ্রেণী প্রেক্ষাগৃহে ছবি দেখাই ছেড়ে দিয়েছেন। ১১০০ এরও বেশি সিনেমাহল ছিল বাংলাদেশে, এখন ৭০০ তে গিয়ে ঠেকেছে।তাও চলছে কিছু ডাব করা মধ্যমানের ইংরেজীছবি এবং হিন্দি নাচের সুফলে(!)।

স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স ৪০’এ ঠেকল, আজও আমাদের দেশে ফিল্ম নিয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা নেই। যাও একখানা হল তাও ঢাবি’র সমাজবিজ্ঞান পরিষদ এর অধীনে। এইভাবে চলতে থাকলে শুধু একটা বৃত্তের মধ্যেই থাকা হবে। অপেক্ষায় থাকতে হবে কবে তারিক মাসুদ একটা মাটির ময়না বা রানওয়ে বানাবেন। ফিল্ম লাইনে প্রফেশনালের খুব দরকার এখন। অবশ্য ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং এর কাছে পিওর সায়েন্সের অনার্সই এখন এতোটা খেলো হয়ে গেছে আর ফিল্মের পড়াশোনাকে তো শিক্ষিত পিতা-মাতাগণ পাগলছাগলের কাজ বলে মনে করেন। সরকারের মনোযোগ নেই, প্রাইভেট সেকশন বানিজ্যিকতার নামে ফিল্ম নামেরই বারোটা বাজাচ্ছে। তবে কি হবে আমাদের ভবিষ্যত বিনোদন মাধ্যম?? সেই সাস-বহু সিরিয়াল, নিম্নমানের হাস্যরসাত্মক টেলিনাটক আর পূর্বনির্ধারিত, লোকদেখানো ট্যালেন্ট-হান্ট??