mn-larma


লিখেছেন: জ্যোতিপ্রভা লারমা*

আমাদের পরিবার
আমাদের ঠাকুরদাদা চানমুনি চাকমা ও তাঁর অন্যান্য ভাইদের বাসস্থান ছিল প্রথমে ‘কেরেতকাবা’ নামক স্থানে, (রাঙামাটির) মাওরুম ছড়ার উৎপত্তিস্থল সত্তা-ধ্রুং এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে। পরে দাদুরা চলে আসেন এই মহাপুরমে (মাওরুম)। বাবারা তিন ভাই। সবার বড় কৃষ্ণ কিশোর চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা আন্দোলনের পথিকৃৎ; মেঝোভাই হরকিশোর চাকমা, তখনকার সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন; আর সবার ছোট চিত্ত কিশোর চাকমা, আমাদের পিতা। আমাদের মায়ের নাম সুভাষিণী দেওয়ান, খাগড়াছড়িস্থ খবংপয্যা গ্রামের রমেশ চন্দ্র দেওয়ানের জ্যেষ্ঠ কন্যা। আমার তিন ভাই যথাক্রমে– শুভেন্দু প্রভাস লারমা (বুলু), মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (মঞ্জু), সবার ছোট জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু) আর আমি সবার বড় বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা মিনু। আমি মঞ্জুকে আদর করে ডাকতাম ‘চিক্ক’ বলে।

আমাদের বাড়ি ও মঞ্জু’র শিশুকাল

আমাদের বাড়িটির নাম ছিল ‘অনোমা কুঠির’, বাবারই দেয়া নাম। বাড়িটি মাটির তৈরি ‘গুদোম’, ছনের ছাউনি, দোতলা। বাড়িটিতে রয়েছে বড় বড় সাতটি ঘর। ঘরের ভিতরে বাবা দোলনা টাঙিয়ে দিতেন। এই বাড়িটিতেই আমাদের জন্ম। বাবার কল্পনা বা আকাঙ্খা ছিল তাঁর তিন ছেলে হবে অনেকটা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের মত, আর মেয়ে হবে প্রকৃতি।

আমাদের আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালো ছিলো। জমিতে ধান আর শাক-শবজির চাষ হতো। বাগান-বাগিচা ছিলো। গোলাভর্তি ধান থাকতো। বার্ষিক খোরাক-এর কিছু পরিমাণ উদ্বৃত্তও থাকতো। আমাদের বাড়িতে যে ছাত্ররা থেকে লেখাপড়া করতো তাদেরও এখান থেকেই খাওয়া-দাওয়ার খরচ চলতো। যখন থেকে স্মরণ করতে পারি তখন থেকে দেখে আসছি বাড়িতে সবসময় নানা মানুষের সমাগম। সব সময় অতিথি থাকতো।

ছোটকাল থেকে মঞ্জুর স্বাস্থ্যের গড়ন ছিল নরম। খুব ছোটকালে যখন বসে থাকতে পারে না তখন তাকে বালিশের স্তূপের মাঝে রেখে আমি সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে খেলায় যোগ দিতাম। বড় হলে ঘুমোবার সময় সে বরাবর ঘুমাতো বাবার সাথে আর আমি ঘুমাতাম মায়ের সাথে। মেজোভাই বুলু আর ছোট ভাই সন্তু তারা ঘুমোতো দু’ভাই-এ একসাথে।

আমার তিন ছোট ভাইদের মধ্যে তার কতকগুলো আলাদা ধরনের বৈশিষ্ট্য ছিল। খাওয়া-দাওয়া, পোষাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি বিষয়ে সে বেশি নিয়মানুবর্তিতার অধিকারী ছিল। তাই মঞ্জুর প্রতি বাড়ির সবাই-এর দৃষ্টি রাখতে হতো। বাড়িতে সে কোনকিছুই একাকী খোতো না কিংবা খাবার টেনে নিতো না। অল্পেই তুষ্ট হতো। কর্মজীবনে এসেও তার সেই চরিত্র অটুট থেকেছিল। সে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার এই স্বভাবের কারণে অভুক্তও রয়েছিল বেশ কয়েকবার। সে যখন হাঁটি হাঁটি পা পা শিশু তখন সে সর্বদাই মায়ের কোল ঘেঁষে থাকতে এবং মা বাইরের কাজে গেলে তার সঙ্গে যেতে চাইতো। মা তার নরম শরীরের কথা বিবেচনায় রেখে তাকে বুঝিয়ে বাড়িতে রেখে যাবার চেষ্টা করতেন, যেদিন আমি বাড়িতে থাকি। হাঁটতে চলতে তার গতি ছিল মন্থর। সে মায়ের পিছনে হেলে-দুলে চলতো। অবশ্য মাঝে মাঝে তাকে সঙ্গে না নিয়ে মায়ের কোন উপায় থাকতো না। ছোটবেলা সে ছিল সচেতন, শৃঙ্খলাপরায়ণ। তার কাজ সে রীতিমতো করতো। উচ্চ প্রাইমারিতে পড়ার সময় অন্য ভাইদের সাথে মাঝে মাঝে সেও তার সাধ্যমতো মাকে টুকিটাকি কাজে সাহায্য করতো।

মঞ্জুর স্কুলের পাঠ ও ছেলেবেলা

বাবার উদ্যোগেই গ্রামে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ছোট মহাপুরম উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়’, যেখানে পড়ানো হয় পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। এরপর ১৯৫১ সালে এটি জুনিয়র হাই স্কুলে উন্নীত হয়। বর্তমানে ইহা রামহরি পাড়ায় অবস্থিত ‘ছোট মহাপুরম হাই স্কুল’ নামে।

ছোট মহাপুরম উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়েই মঞ্জুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। তখনকার সময়ে বেশি বয়সেই শিশুরা স্কুলে যাওয়া শুরু করে। ১৯৪৮ সালেই মঞ্জু প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। বাবা আর আমার সাথে গিয়েই সে স্কুলে ভর্তি হয়। তখন আমি একই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়তাম। বাড়িতে মাও আমাদের পড়াতেন। মঞ্জু ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত এই মহাপুরম জুনিয়র হাই স্কুলেই পড়াশোনা করে। এরপর রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। এখান থেকেই ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে।

স্কুলে পড়ার সময়ে মঞ্জু বরাবরই লেখাপড়ায় ও আচরণে ভালো ছাত্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সহপাঠীদেরও পড়াশোনায় সহযোগিতা করত। অনেক সময় তার সহপাঠীরাও তার কাছে শিখতে আসত। বাবা যখন বাড়িতে মঞ্জুর সহপাঠী ও অন্যান্য ছাত্রদের পড়াতেন তখন অনেক সময় বাবা তাকে ছাত্রদের অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়ার ভার দিতেন।
তবে তিন ভাইয়ের মধ্যে মঞ্জু ছোটকাল থেকে শারিরীকভাবে ছিল দুর্বল, নরম প্রকৃতির, হালকা-পাতলা গড়ন। তার এই শারিরীক অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে প্রায় গোটা ছাত্রজীবনে। পরে অবশ্য এর কিছুটা উন্নতি ঘটে। তবে বুলু আর সন্তু ছিল ছোটকাল থেকে চটপটে, চঞ্চল আর নানা খেলাধুলায় পারদর্শী। মায়ের স্তন্যপান ছাড়ার সাথে সাথে, ৬/৭ বছর বয়স থেকে মঞ্জু বাবার সাথে ঘুমানোর অভ্যাস করে। তখন আমি আর বুলু আলাদা আলাদা কামরায় থাকতাম। আর সবার ছোট সন্তু ঘুমাতো মায়ের সাথে।

আমরা যে স্কুলে পড়াশুনা করেছি সেটা একসময় নিম্ন প্রাইমারি হতে উচ্চ প্রাইমারিতে উন্নীত করা হলে স্কুলের পাশেই দূরাগত ছাত্রদের জন্য বোর্ডিং চালু করা হয়েছিল। সেখানে বাবা গভীর রাত পর্যন্ত বোর্ডিং-এর ছাত্রদের পড়ালেখা তদারকি শেষ করে তবেই রাত ১১টা/১২টার দিকে বাড়ি ফিরতেন। আমরা সবাই ঘুমিয়ে গেলেও বাবা বোর্ডিং থেকে বাড়িতে না আসা পর্যন্ত সে জেগে থাকতো। বাবার কাছে পড়া দেবার প্রতীক্ষায়। কোন বিষয় বুঝতে না পারলে বাবাকে অপক্ষা করে থাকত। বাবা পৌঁছলে পড়া আদায় করে তবেই মঞ্জুকে নিয়ে ঘুমোতে যেতো। ছোটকাল থেকে সে ছিল শান্ত প্রকৃতির। একবার মাত্র সে বুলু ও সন্তুর সাথে গিয়ে বাবাকে না জানিয়ে পাশের গ্রামে যাত্রা পালা দেখতে গিয়েছিল।

প্রকৃতির পাঠ
মাওরুম পাড়ে ছিল বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ। ছিল প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বটগাছ। সেইসব বটগাছে ঘিলে লতা (এক প্রকার বন্য লতা) দিয়ে টাঙানো হতো দোলনা। অবসরে সেখানে গিয়ে দুলতো সবাই, আমরাও দুলতাম। এই দোলনা দিয়েই মাওরুম নদীর এপার-ওপারে যাতায়াত চলতো।

গ্রামেরই পাশে বড় মাওরুম নদীর উপর ছিলো বড় বড় শেকল দিয়ে তৈরি এক ঝুলন্ত ব্রীজ। তখনকার সময়ে সেটাও ছিলো এক দর্শনীয় জিনিস। আমাদের গ্রামের মধ্য দিয়ে চলে গেছে কোম্পানির কাঁচা রাস্তা। শুকনো মৌসুমে জনসাধারণের জন্য গাড়ি চলাচল হতো পঞ্চাশ দশকে। প্রথম অবস্থায় গাড়ি বলতে ছিল দুটি ‘হাফবাস’ আর একটি টেক্সি। প্রথম চালু করা এই টেক্সিটির মালিক ছিলেন নীহার বিন্দু চাকমা। গাড়ি চলত রাঙামাটি থেকে বুড়িঘাট বা নানিয়ারচর পর্যন্ত।

বুড়িঘাট বাজার সংলগ্ন ছিল এক সাঁওতাল পাড়া। দুর্গাপুজো এলেই শোনা যেতো তাদের ঢোল-তবলার তাল আর বাঁশির সুর। সঙ্গে ছিল নাচ। সাতদিন ধরে তারা সদলবলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঠোনে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নাচ দেখাতো আর বাড়ির লোকেরা তাদের খুশীমনে দিতো টাকা আর চাল। এই সাঁওতালদের পিছে পিছে নাচ দেখতে যেতো মঞ্জুরা।

সেসময় কখনো কখনো গ্রামে বা অন্যত্র বৌদ্ধমেলা, যাত্রামেলা ও বলীখেলার আয়োজন হতো। অন্যান্য ভাইদের সাথে সেসব মেলাও দেখতে যেতো মঞ্জু। গ্রামে ঐতিহ্যবাহী গেংখুলীদের আসর বসলে সেখানেও যেতো সে। আর ৬ষ্ঠ/৭ম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে সে বাঁশি বাজানোও শিখেছিল নিজে নিজে। বিকেলের পড়ন্ত বেলায় বাড়ির দোতলার বারান্দায় বসে পূর্বদিকে মুখ করে ফসলের মাঠ আর সবুজ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে প্রায়ই বাঁশি বাজাতো সে।

অনুকরণ নয়
ছোট কাল থেকেই মঞ্জু না বুঝে অনুকরণ করার পক্ষপাতী ছিল না। একবার স্কুলে বিভিন্ন শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে বসেছিলাম। কাকতালীয়ভাবে শিশু শ্রেণীতে পড়া মঞ্জুর আর আমার স্থান হলো একই বেঞ্চে। আমি তাকে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে একভাবে লিখতে পরামর্শ দিলাম। কিন্তু কিছুতেই সে সেভাবে লিখল না, লিখল নিজের মত করে।

সহিষ্ণুতা আর সরলতা
ছোট্ট মঞ্জুর সহিষ্ণুতা আর সরলতাও উল্লেখ করার মতো। মঞ্জু তখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। মঞ্জুসহ সব ভাইবোনরা মিলে একবার বাড়ির উঠোনে বলখেলা খেলছিলাম। এক পর্যায়ে বলটি বাড়ির উঠোন পেরিয়ে সামনের পাটেেত গিয়ে পড়ে। বলটি আনতে গেলে চার ভাইবোনের সবাই ‘বলাপুক’-এর (এক প্রকার ভীমরুল) প্রচণ্ড কামড়ের শিকার হই। এতে আমরা সবাই চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিই। কিন্তু মঞ্জু কিছুতেই চিৎকার করে না, কেবল মুখটা একটু কাঁদো কাঁদো চেহারা করে কামড়ে থাকা পোকাগুলোকে সরাতে থাকে।

আর একবার গ্রামে ঢুকে পড়ে এক বানর। এই খবর পাওয়ার সাথে সাথে গ্রামের সব বালক আর যুবকরা মেতে উঠে দুষ্টুমিতে। সবাই তাড়া করতে থাকে বানরকে। এক পর্যায়ে বুলু, মঞ্জু, সন্তু এরাও যায় সেখানে। আর এই ফাঁকে বেচারা বানরটিও ধরা পড়ে এবং বেদম প্রহারে মারা যায় যুবকদের হাতে। এই কথাটি বাবার কানে আসে। বাবা রেগে অপো করতে থাকেন কখন ছেলেরা আসবে। যেই না ছেলেরা আসলো, কেন সেখানে গিয়েছ বলে বাবা প্রহার করতে প্রস্তুত হলেন, অমনি বড় ভাই আর ছোট ভাই বাবার এই রুদ্র মূর্তি দেখে দৌড়ে পালালো। কিন্তু মঞ্জু পালিয়ে গেল না, দাঁড়িয়েই রইল। ফলে সে একাই শাস্তি ভোগ করলো।

আরেকবার গ্রামের একদল বালক আর যুবক গ্রামের পাশে জাল দিয়ে হরিণ শিকারে মেতে উঠে। আর হরিণও একটা জালে ধরা পড়লো। সেই দৃশ্য দেখতে বড় ভাই বুলুর সাথে নয়/দশ বছরের মঞ্জুও উপস্থিত হয় সেখানে। সেকালে এভাবে দলবেঁধে বুনো হরিণ বা শূকর ইত্যাদি শিকার করলে অংশগ্রহণকারী সবাই মাংসের অংশ সমানভাবে ভাগ পায়। এমনকি কেউ যদি এমনিতেও দেখতে যায় তারাও ভাগ পায়। মঞ্জুরাও এক ভাগ পায়। সেই মাংসের ভাগ নিয়ে বুলু আসতে থাকে বাড়ির দিকে আর তার পেছনে পেছনে মঞ্জু। এদিকে বুলু, মঞ্জুরা ঘটনাস্থলে গেছে শুনে বাবা রেগে আছেন। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই বুলু তা জানতে পেরে পাতায় মোড়ানো মাংসের ভাগটা বাড়ির পাশের কলাগাছের গোড়ায় লুকিয়ে রেখে দেয়। অনেকক্ষণ পরে বাবার রাগ পড়ে গেলে তবেই সে বাড়িতে আসে আর লুকিয়ে রাখা মাংসের ভাগটি মায়ের কাছে দেয়। অপরদিকে মঞ্জু সরাসরি চলে আসে বাড়িতে আর বাবার রাগের মুখে পড়ে। বাবার সব রাগ গিয়ে পড়ে মঞ্জুর উপর। কাজেই এবারেও তাকেই একা শাসানি ভোগ করতে হলো। এভাবে আরো অনেক ঘটনা আছে যেখানে সেই শৈশবেও মঞ্জুর সরলতা, সততা আর সহিষ্ণুতার পরিচয় পাওয়া যায়।

পাঠাভ্যাস আর অনুসন্ধিৎসু মন
মঞ্জু ছিল বই পোকা। সে নিশিদিন বই হাতে নিয়ে থাকতো। স্কুলের পড়ার বাইরেও গল্প বই সব সময় পড়তো। একেবারে প্রথম শ্রেণী হতে আলাদা বই পড়ার প্রতি আগ্রহ ছিলো তার। দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময়ে বাবা কলকাতা থেকে ডাকযোগে বিভিন্ন বই ও পত্র-পত্রিকা এনে দিতেন। পত্রিকাগুলোর মধ্যে মাসিক বসুমতি, শুকতারার নাম মনে পড়ছে। এসবই মঞ্জু গভীর আগ্রহ সহকারে পড়ত। যতই বড় হয়েছে ততই বই পড়ার প্রতি মঞ্জুর আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।

একবার সে যখন পড়াশোনায় মগ্ন ছিল তখন ছোট ভাই সন্তু টেনিস বল নিয়ে খেলতে খেলতে বলটি নিচের তলার শুকনো পাটভর্তি এক কামরায় বলটি ফেলে। বলটি খুঁজে না পেলে সে একটি চেরাগ জ্বালিয়ে আনল আর পাটের স্তূপের উপর রাখল। এক পর্যায়ে পাটে আগুন ধরে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে মঞ্জু জানতে পারল যে, পাটে আগুন লেগেছে। কিন্তু তবু সে বই পড়া ছেড়ে দেয় না, দূর থেকে কেবল ছোট ভাই সন্তুকে বলে পাটের কামরা থেকে বের হয়ে আসতে। একদিকে মঞ্জুর বই পড়া অপরদিকে সন্তুর বল খোঁজা, অথচ কারো ভ্রুপে নেই এদিকে আগুন জ্বলছে। শেষ পর্যন্ত আমি অবস্থা বেগতিক দেখে সন্তুকে আগুনের পাশ থেকে টেনে এনে একপাশে রেখে মাকে আর লোকজনকে খবর দিলাম। এরপর লোক এসে আগুন নিভিয়ে দিল।

রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে বোর্ডিং-এ থাকার সময়ে ছুটি পেলেই সে বাড়ি যেত। বাড়িতে গেলেও নানা বই পড়ত আর মাকে কাজকর্মে সাহায্য করত। স্কুল হতে বৃত্তি পেলেও অন্য কিছু না কিনে কেবল বই কিনত। প্রয়োজনে বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে সে নিজেই বই সংগ্রহ করতো। এভাবে নিজের সংগ্রহে ছিল তার অনেক বই-পত্র।
ডাক টিকিট আর বিভিন্ন মুদ্রা সংগ্রহ করার ক্ষেত্রেও ছিল তার যথেষ্ট আগ্রহ। সে নানা দেশের ডাক টিকিট, বিভিন্ন দেশের মুদ্রা সংগ্রহ করে যত্ন করে রাখতো, এমনকি বিভিন্ন দেশের জাতীয় পতাকার রং, ডিজাইন, আকার ইত্যাদির বর্ণনা লিখে রাখতো। এভাবে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন আমলের রূপা, তামা, পিতলের মুদ্রার সংগ্রহ প্রায় দেড় কেজির মত হয়েছিলো।

উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও নানান বিষয়ে তার জানার আগ্রহ ছিল লক্ষ্য করবার মত। ছাত্রাবস্থায় গ্রামের নেতৃস্থানীয় নারী-পুরুষের সাাৎ পেলে সুযোগ মতো তাদের সাথে নানা বিষয়ে আলাপ জুড়ে দিত। অনেক বিষয় জানতে চাইত। সমাজ, সংস্কার, রীতিনীতি ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাইত। চাষাবাদ সম্পর্কে, গাছ-বাঁশের নাম, লতাপাতার নাম, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদি নানা বিষয়ে জানতে চাইত। বিয়ে অনুষ্ঠানের যাবতীয় খুঁটিনাটি, সন্তান প্রসবের েেত্র নানা রীতিনীতির খুঁটিনাটি প্রশ্ন করত। আসলে বাল্যকাল হতে তার জানার স্পৃহা ছিল প্রবল।

ছাত্রজীবন ও সংগ্রামের সোপান
গ্রামের স্কুলে পড়া শেষ করে মঞ্জু রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। সেখানে সরকারি হোস্টেলে থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ করে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে চলে যায়। রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে থাকার সময় সে একবার অনশন ধর্মঘট করেছিল। সে তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। তাদের তখন নিয়মিত স্কুলে ক্লাশ করতে যেতে হতো না। তাই স্কুলগামী ছাত্রদের সাথে হোস্টেল সুপার ভাত খেতে বাধ্য করলে পাল্টা প্রতিবাদে ও পরীক্ষার্থী হিসেবে তাদের সুবিধামতো খাবার নিয়ম চালু করার দাবিতে এই অনশন ধর্মঘট ডেকেছিল। সফল হলে পরে তবে সে অন্ন গ্রহণ করেছিল। সেটাই ছিল তার জীবনে সংগ্রামের প্রথম সোপান।

চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে যে হোস্টেলে সে উঠেছিল তার নাম ‘পাহাড়ী ছাত্রাবাস বিন্দু নিলয়’। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে থাকার সময় সে একবার আমার কাছে এসেছিল খুব কম সময় নিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল আইএ ফরম ফিলাপের টাকা সংগ্রহ করা। বাবা তাকে যে কোন কারণে টাকা যথাসময়ে পাঠাতে পারেননি। তখন আমি রাঙ্গামাটি ক্যাথলিক মিশনে শিক্ষকতা করতাম। রাতের মধ্যে টাকা সংগ্রহ করে তাকে চট্টগ্রাম ফেরৎ পাঠিয়েছিলাম। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএ পাস করলো। একই কলেজে বিএ পড়াকালীন সময়ে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়।

তখন চট্টগ্রাম জেলখানার এক বাঙালি দারোগার সহায়তায় কেবলমাত্র পরীক্ষা দেবার জন্য জেল থেকে জামিন লাভ করে। পরীক্ষা শেষ করে আবার তাকে কারাগারে যেতে হলো। পরীক্ষা দেবার সুযোগ না পেলে তার হয়তো বিএ পাস করা হতো না। সেই বাঙালি দারোগা ছিলেন বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সুবাদে দারোগা সাহেব মঞ্জুকে পুত্রস্নেহে দেখাশুনা করতেন।

উল্লেখ্য, বামপন্থী আইনজীবী জনাব লুৎফর হক মজুমদারের অকান্ত প্রচেষ্টায় সে মামলা থেকে খালাস পায়। মুক্তি লাভের পর চট্টগ্রামস্থ বিপ্লবী বন্ধুরা তাকে জেএম সেন হলে সম্বর্ধনা দেন। সেই তরুণ বয়সে মঞ্জু যখন জেলে ঢুকল। তখন বাবার কাছে এব্যাপারে জানতে চাইলে, কোন উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা ছাড়াই বাবা শুধু বলেছিলেন, জেলে যাওয়ার পথ যেহেতু সে জানতে পেরেছে, তাহলে বের হওয়ার পথও সে খুঁজে পাবে।

জন্মভূমি আর জাতির প্রতি গভীর মমত্ববোধ
তখন বুঝতে পারিনি সেই তরুণ বয়সেও তার জন্মভূমির প্রতি মমত্ববোধ কত গভীর! আর দেশপ্রেমটাই বা কী? কাপ্তাই বাঁধের দরজা বন্ধ করার সাথে সাথে দেখতে দেখতে বাঁধের পানি গ্রামের পর গ্রাম গ্রাস করে নিচ্ছে। আমাদের সুন্দর প্রিয় গ্রামটিও ডুবে যাবে। সবার মধ্যে এক ধরনের উৎকন্ঠা, অনিশ্চয়তা আর শোক শোক ভাব। ধীরে ধীরে আমাদের বাড়ির দিকেও ধেয়ে আসছে পানি। ঠিক এমনি সময়ে মঞ্জু আমাদের বাড়ির দেয়াল থেকে এক খণ্ড আর উঠোন থেকে আরেক খণ্ড মাটি নিয়ে কাগজে ভালোভাবে মুড়িয়ে আমার হাতে তুলে দিল। আর আমাকে বলছিল এই জিনিসগুলি প্রাণের চেয়ে সযতনে রেখে দিতে। সেদিন সেটা হাতে তুলে নিতে নিতে আমি ভাবনার সাগরে ভাসছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম। আমার ছোট ভাই আমাকে কি কোন যাদুকরের অমূল্য সম্পদ সংরণ করে দেয়ার ভার দিচ্ছে! কাগজের প্যাকেটটি খুলে মাটির খণ্ডগুলোর দিকে অনেকণ তাকিয়ে ভাবতে থাকি আর মনে মনে প্রশ্ন করি, এই মাটির খণ্ডটিতে কী স্বার্থ বা কোন স্মৃতির সাক্ষী বহন করছে কি? তখন মঞ্জুকে প্রশ্ন করেছিলাম, কেন এই মাটির টুকরো? তখন সে উত্তরে ‘এই মাটি অমূল্য জিনিস’ বলে আর কিছু না বলে কেবল একগাল হেসে চুপ করে থাকে। নানা ভেবে চিন্তে তার কথা রক্ষা করলাম মনেপ্রাণে, সযতনে তা রেখে দিলাম একটা ট্রাঙ্কে। তার সেদিনকার সেই মাটির খণ্ডগুলোর প্রতি এমন মায়া-মমতা, শ্রদ্ধাবোধ বুঝতে পারিনি। আজ এই শেষ বয়সে এসে তা গভীরভাবে উপলব্ধি করছি, সেই মাটি মানুষের কতটুকু প্রয়োজন! আজ বুঝতে পারছি, মঞ্জু সেই সময়েও নিজের জন্মভূমি, মাতৃভূমি ও বাস্তুভিটাকে কত গভীরভাবে অনুভব করেছিল, ভালোবাসতে পেরেছিল!

সেই সময়ে জাতির ভবিষ্যৎ নিয়েও তার কত চিন্তা, উদ্বেগ, উৎকন্ঠা! বাঁধের পানি আসার আগে যখন বন-বৃক্ষ কাটার কাজ চলছিল তখন প্রায়ই সে জাতির ভবিষ্যত নিয়ে হা-হুতাশ প্রকাশ করত। তখন চট্টগ্রামে আইএ ক্লাশে পড়ার সময় মাঝে মাঝে বাড়ি এলে প্রায়ই জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে তার উদ্বেগ, উৎকন্ঠার কথা জানাত। এসময় গ্রামের বয়ষ্ক ব্যক্তি ও মুরুব্বীদের সাথে আলাপে বসত; জাতির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলত; জায়গা-জমি পানিতে ডুবে যাওয়ার পর কে কী করবে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করত। আসলে সেই কৈশোর বা তরুণ বয়স থেকে তাকে কেমন অন্য ধাঁচের মনে হত। যাকে বলে ভিন্ন প্রকৃতির। নেতৃত্বের গুণাবলী ও প্রতিভা সেই স্বল্প বয়স থেকেই তার মধ্যে প্রতিভাত হচ্ছিল।

* ১০ নভেম্বর পাহাড়ের জীবন্ত কিংবদন্তি মানবেন্দ্র নারায়ন (এমএন) লারমার ২৭ তম মৃতু্যবার্ষিকী। দিবসটি স্মরণে প্রয়াতর বড় বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা এই স্মৃতিকথাটি মুক্তমনা ডটকম-এর জন্য লিখেছেন। বানানরীতি লেখিকার নিজস্ব।
—-
আরো পড়ুন: গেরিলা নেতা এমএন লারমা