বাংলাদেশ কী এখন সবচেয়ে দুর্ঘটনা কবলিত দেশ? এই প্রশ্নটিই বোধহয় এখন সবচেয়ে সমসাময়িক।
এই সেদিন সামান্য ঝড়-বৃষ্টিতে বিল বোর্ড ভেঙে পড়লো মাথার ওপর। হতাহত হলেন কয়েকজন। জানা গেল, অসংখ্য অনুনোমদিত বিল বোর্ডের কারণে এমনটি হয়েছে। সিটি করপোরেশনের কর্তারা নামলেন অবৈধ বিল বোর্ডের সন্ধানে। পত্রিকায় ফলাও করে ছবি ছাপিয়ে শুরু হলো অবৈধ বিল বোর্ড উচ্ছেদ। তারপর সব আগের মতোন। করপোরেশনের নিস্ক্রিয়তার সুযোগে আবার গজাতে শুরু করেছে যত্রতত্র বিজ্ঞাপনী বিল বোর্ড। আবারো ঝড়-তুফানে ভেঙে পড়া বিশালাকায় বিলে বোর্ড দু-একটি মাথা ভাঙলে আমাদের কর্তারা তখন হয়তো আবার খানিকটা নড়েচড়ে বসবেন।
বহু বছর ধরে পুরনো ঢাকার ঘিঞ্জি আবাসিক এলাকায় মারাত্নক সব দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ মজুত করে চলছে ছোট ছোট কারখানা। এরই একটিতে আগুন ধরে মারা গেলেন শতাধিক জন। চোখের সামনে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গেল কত না তাজা প্রাণ। নিমতলী ট্রাজেডি নিয়ে সরকারি শোক প্রকাশ, দৌড় -ঝাঁপ চললো কয়েকদিন। শিল্প মন্ত্রণালয় অভিযানও চালালো পুরনো ঢাকায়। ব্যবসায়ীরাও সরকারি আদেশ মেনে রাসায়নিক পদার্থের গুদামগুলো সরিয়ে ফেললেন বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরানীগঞ্জে।
কিন্তু সেটিও তো আরেক ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। সেখানেও যে আবার নিমতলী-ট্রাজেডি হবে না, তারই গ্যারান্টি কী? পুরনো ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোই বা ভেঙে ফেলার কী হলো? সেসব ভবন ধসে আবারো যে শাঁখারিবাজার-ট্রাজেডি হবে না, তারই নিশ্চয়তা কোথায়?
ঢাকার বুক চিরে বহু বছর ধরে চলছে অল্প কয়েকটি রেল পথ। ট্রেন চলাচল নির্বিঘ্ন করতে তথা দুর্ঘটনা এড়াতে যানবাহন চালকরা এসব বাঁশকলকে গুরুত্ব দেবেন, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের এখানে নিয়ম না মানার প্রবনতাই যেনো স্বাভাবিক। রেলের এ সব বাঁশকল না মানার জন্য যান চালকদের মধ্যে বরাবরই যেনো একটি হীন প্রতিযোগিতা থাকে। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। ট্রেনের হুইসেল ও বাঁশকল উপেক্ষা করায় সায়দাবাদ রেল ক্রসিং-এ ঘটলো বাস-ট্রেন সংঘর্ষে। অকালে ঝরে পড়লো পাঁচটি তাজা প্রাণ। যথারীতি ব্যস্ত হয়ে ওঠেলেন সরকারি তদন্ত কমিটি, সরগরম হয় টিভি মিডিয়া ও সংবাদপত্র। তারপর আবার সবকিছু চলে আগের মতোই।
এসবের রেশ কাটতে না কাটতেই সাভারের তুরাগ নদীতে ৫০ জন যাত্রী নিয়ে উল্টে পড়লো বাস। দুদিন ধরে নৌ বাহিনী ও দমকল বাহিনীর চৌকষ একাধিক দল লম্ফঝম্প দিয়ে উদ্ধার করলেন মাত্র আটটি লাশ। যারা মারা গেছেন, তারা আর ফিরবেন না– এ কথা সত্যি। কিন্তু তাদের স্বজনরা একটি ছোট্ট নদীতে ডুবে যাওয়া প্রিয়জনের লাশটিও কী ফেরত পেতে পারেন না?
ওই ঘটনার একদিন পরেই সিরাজগঞ্জে বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার জনসভা স্থলে রেলে কাটা পড়ে মারা গেলেন পাঁচজন বিএনপি সমর্থক। ক্ষুব্ধ জনতা পুড়ে দিল ২৩ কোটিরও বেশী দামের ট্রেনটি। যেহেতু রাজনৈতিক সভা ঘিরে এই দুর্ঘটনা, সেহেতু এটি নিয়েও যথারীতি রাজনীতি হবে বৈকি। খালেদা জিয়া বলে বসলেন, সমাবেশ বানচাল করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে এ ‘দুর্ঘটনা’ ঘটানো হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পিছিয়ে নেই। তিনি পাল্টা বলে বসলেন, তিনি (খালেদা) যমুনা রিসোর্টে বসেছিলেন লাশের অপেক্ষায়। রেলে আগুন দেওয়া হলো, যাত্রীদের কাছে থেকে মালামাল লুট করা হলো, তিনি সেখানে বসেই ছিলেন। ঘটনার পর তিনি গেলেন বক্তৃতা করতে। নাটোরে বিএনপি নেতা সানাউল্লাহ নূর বাবু হত্যাকাণ্ডেও বিএনপি জড়িত ছিলো বলে ইঙ্গিত দেন হাসিনা। তিনি বলেন, তারা খুন-খারাবি করে, আর মুখে অপরের ওপর দোষ চাপায়।
শেখ হাসিনাকে সবিশেষ ধন্যবাদ। কারণ নাটোরে পিটিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানকে মারার পর তিনি তো বলতে পারতেন, আমরা গ্রেনেড হামলা করে কোনো সাবেক অর্থমন্ত্রীকে (শাহ এএমএস কিবরিয়া) বা গুলি করে এমপিকে (আহসানুল্লাহ মাস্টার) মারিনি! আমরা একজন সামান্য উপজেলা চেয়াম্যানকে পিটিয়ে মেরেছি মাত্র!
এসব নানান ঘটনা-দুর্ঘটনা নিয়েই এখন আমাদের এই ছাপোষা জীবনে বেঁচে থাকা। একেকটি ‘মর্মান্তিক’ বা ‘দুঃখজনক’ ঘটনার পর দু-একদিন হা-হুতাশ করা, সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় বা টিভির টক-শোতে শান্তনার বাণী খোঁজার চেষ্টা… তারপর সবকিছু ভুলে নতুন নতুন ঘটনা-দুর্ঘটনা নিয়ে আবারো মেতে ওঠা, জীবনকে জীবনের নিয়মেই চলতে দেওয়া।…
তাই এখন, কেমন আছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ‘ভাল আছি’ বা ‘ভাল নেই’ আর বলি না। জবাবে বলি, ‘বেঁচে আছি’। বাংলাদেশে এখন বেঁচে থাকাই যেনো এক বিস্ময়কর বাস্তবতা।…
—
পুনশ্চ: অন্তবিহীন পথে চলাই জীবন/ শুধু জীবনের কথা বলাই জীবন …
ধন্যবাদ বিপ্লব রহমান আপনার নিরপেক্ষ বিশ্লেষনের জন্য। অবস্থা এমন হয়েছে যে আমরা নিজেরাই কোন দূঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বত্তব্য রাখি। ব্লগে ব্লগে এরকম অসংখ্য উদাহরন বিরাজমান। তার মাঝে আপনার লেখা সতন্ত্র।
@এ আর,
:yes:
@ বিপ্লব রহমান,
যে কোনো সংবাদপত্রের একটি দিন কি রয়েছে, যেদিন কোনো প্রকার দূর্ঘটনার সংবাদ আসে না। মনে হয় পাওয়া সম্ভব নয়।
আপনার মতো আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন- “কেমন আছো?” উত্তর দেই- “এই তো বেঁচে আছি।”
নিচের লেখাটি পড়ুন:
সংবাদ পত্রের পাতায় প্রতিদিন মৃত্যুর খবর ছাপা হয়, শোক সংবাদ শিরোনামে। মোটর দূর্ঘটনা, প্লেন দূর্ঘটনা। ট্রেন এক্সিডেন্ট, লঞ্চডুবি, নৌকাডুবি, ডাকাতের আক্রমণে, চলন্ত ট্রাকে বাসের তলায় চাপা পড়িয়া, ছাদ ধ্বসিয়া, গাছ হইতে পড়িয়া, ছাদ হইতে পড়িয়া, জমি লইয়া দুই দলে মারামারি করিয়া, ফসল কাটা লইয়া সংঘর্ষ বাঁধিয়া, সামান্য কথা কাটাকাটি হইতে বিরাট সংঘর্ষ বাঁধিয়া, যৌতুকের দাবী পূরণ না হওয়ায়, স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যা, শ্বাশুড়ীর জ্বালা সহিতে না পারিয়া গৃহবধুর বিষপানে আত্মহত্যা, অনাহারের তীব্র জ্বালা সহিতে না পারিয়া গলায় দড়ি দিয়া ফাসিতে আত্মহত্যা করা, ঘূর্ণিঝড়ে, সামুদ্রিক জলোচ্ছাসে হাজার হাজার লোকের নিহত হওয়া, ভূমিকম্পে দালান কোটা ঘরবাড়ী ভাঙ্গিয়া সহস্র সহস্র লোকের প্রাণত্যাগ করা, প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল ছাত্রের সংঘর্ষের ফলে কয়েকটি তাজা প্রাণের অবসান হওয়া, কলেরা বসন্ত, আমাশয়ে, ডাইরিয়ায় শত সহস্র লোকের জীবনাবসান হওয়া, রাজনৈতিক মিছিলের উপর পুলিশের গুলি বর্ষণের ফলে কয়েকজনের নিহত হওয়া। উচ্ছৃংখল জনতার ইট পাটকেল নিক্ষেপে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত হওয়া, নৈশকোচের ডাকাতিতে ডাকাতের ছোড়ার আঘাতে কয়েকজন যাত্রী কিম্বা বাস চালকের নিহত হওয়া। হিংস্র জন্তুর কবলে পড়িয়া নিরীহ মানুষের জীবন অবসান হওয়া। পিতা পুত্রের কলহের পরিণতিতে পুত্র কর্তৃক পিতা নৃশংসভাবে নিহত হওয়া, পানিতে ডুবিয়া কয়েকজন বালকের মৃত্যু হওয়া, স্ত্রীর চরিত্রে সন্দিহান হইয়া স্ত্রীকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা, বিমান হইতে বোম বর্ষণে বেসামরিক লোকজনের মৃত্যু হওয়া, আধুনিক যুদ্ধে অত্যাধুনিক মারনাস্ত্রের আঘাতে হাজার হাজার সৈনিকের মৃত্যুবরণ, সামরিক অভ্যুত্থানের সময় গোলাগুলিতে বহু লোকের প্রাণহানি হওয়া, বাস উল্টাইয়া খাদে পড়িয়া বহু যাত্রীর মর্মান্তিক প্রাণবিয়োগ হওয়া। শ্যালো ইঞ্জিন চালিত দেশী নৌকা ডুবিয়া বহু লোকের সলিল সমাধি হওয়া, স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া থামাইতে গিয়া ক্রুদ্ধ স্বামীর মুষ্ঠাঘাতে স্কুল শিক্ষকের নিহত হওয়া, ক্রুদ্ধ ষাড়ের শিং এর আঘাতে কৃষকের নিহত হওয়া। সামপ্রদায়িক দাঙ্গায় শত শত লোকের মৃত্যুবরণ করা। জিনিসের মূল্য লইয়া বচসা হওয়ায় গ্রাহকের ইষ্টক নিক্ষেপে দোকানীর ভবলীলা সাঙ্গ হওয়া, বিদ্রোহী অতর্কিত আক্রমণে সরকারী বাহিনীর শতাধিক সৈন্যের নিহত হওয়া, হিমালয়ের চূড়ায় আরোহনের অভিযানে তুষার ঝটিকার কবলে পড়িয়া অভিযাত্রী দলের সকল সদস্য নিহত হওয়া প্রভৃতি মৃত্যুর লাখো সংবাদ ছাপা হয় প্রতিদিনের দৈনিক সংবাদপত্রের পাতায় পাতায়। এই সমস্ত সংবাদের ১০০ ভাগই হয় হৃদয় বিদারক, মর্মান্তিক। (মোকছেদ আলীর ‘মৃত্যু কথা পাণ্ডুলিপি থেকে গৃহীত)।
@মাহফুজ,
উপায় নাই গোলাম হোসেন! 🙁
@বিপ্লব রহমান,
কেন উপায় নেই জানেন? সবকিছু আল্যাই আগে ঠিক কইরা রাইখ্যা দিছে। তার হুকুম ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ার জো নাই। উপরোক্ত মৃত্যুর তালিকায় বুঝা যায়- কুল্লু নাফসি জায়েকাতুল মাউত। কার মৃত্যু কখন কিভাবে ঘটবে কেউ বলতে পারে না।
তবে বিজ্ঞানীরা মৃত্যুকে কিছুদিন ঠেকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছে। অদূর ভবিষ্যতে আরো কিছু আবিষ্কার করবে, এতে মানুষের আয়ু বৃদ্ধি পাবে। তখন “উপায় নেই গোলাম হোসেন” ব’লে আক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। কী বলেন?
সবারই একই প্রশ্ন। দারুণ লেখা।
@আফরোজা আলম,
অনেক ধন্যবাদ। :rose:
@মাহফুজ,
হ। এই জন্যে সব কয়ডা বিজ্ঞানীরে মাইনাস, কৈষা মাইনাস! 😛
ট্রেন দুর্ঘটনা সম্পর্কে ব্লগার অনিন্দ্য রহমান ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখেছেন:
😀
লক্ষনীয়: ১। ট্রেন লাইনের বাইরে কাউকে চাপা দিতে পারে না। ২। প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে আসা ট্রেন দ্রুত ব্রেক কষে থামানো যায় না। ৩। হুইসেল দেওয়ার পরও সমাবেশের মানুষ রেল লাইন থেকে সরে যায়নি– এ সবই মানছি। কিন্তু এরপরও কথা থেকে যায় (খুব খেয়াল করে) :
কোনো সমাবেশের মানুষ সব সময়ই সুশৃঙ্খল হবেন, এমনটি আশা না করাই ভাল। তাই রেল কর্তারাই প্রথমত ওই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। সমাবেশস্থলের মাত্র ২০ গজের মধ্যে ট্রেন চলাকালে অমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তা তাদের আগেভাগেই বোঝা উচিত ছিল। অথচ যাত্রী নিরাপত্তার কথা রেল কর্তারা মোটেই আমলে নেননি। ট্রেনের সময় খানিকটা পিছিয়ে দিয়ে সমাবেশ শেষ হওয়ার পরেই তারা ট্রেন চালাতে পারতেন। তাহলে সহজেই অমন দুঃখজনক দুর্ঘটনা এড়ানো যেতো।
কোনো সভ্য দেশ হলে ওই ঘটনার জন্য যারাই দায়ী হোক না কেনো এর দায় নিজের কাঁধে নিয়ে যোগাযোগ মন্ত্রী পদত্যাগ করতেন। অথচ আমাদের মন্ত্রী বাহাদুর ঘটনা সম্পর্কে উল্টো বলেছেন:
:deadrose: