(এই গল্পের সকল চরিত্র কাল্পনিক)

কুদ্দুসমিয়া একজন ধর্মপরায়ণ ভালোমানুষ বলে পরিচিত। সমাজে তাঁর নাম ডাক আছে। ফি-বছর ইলেকশনে জিতেন তিনি। এইবারো জিতে গেলেন। এই নিয়ে আল্লাহপাকের কাছে শুকুর গুজরান করেন।

মনে মনে সারাক্ষণ বেঈমান মুসলমানদের অভিশাপ দেন।আর কাফিরদের পাইলে মুণ্ডু কেটে ফুটবল খেলার প্রবল ইচ্ছে। (আহা! মাইয়া গুলান সোন্দর কি মাশআল্লাহ)

আল্লাহপাকের অশেষ রহমত শেষ বিবির একটা পুত্রসন্তান হয়েছে। চার-চারটি বিবাহ করলেন কিন্তু আল্লাহপাক তাঁকে কোন কারনে কঠিন শাস্তি দিলেন।
শেষ বিবিকে নিয়ে হজ্জ করে আসবার পর কয়েক মাস পরেই ছেলেটা জন্মায়।মাশাল্লাহ উপরয়ালার মেহেরবানীতে তিনি খুশি হলেন।

জায়নামাজে বসে কাঁদেন প্রায়ই — “ইয়া আল্লাহ আমারে শক্তি দাও যেনো তোমার সেবা করতে পারি, আর কাফের আর না ফরমান মুসলমানদের শায়েশ্তা করতে পারি “।
আনন্দে ছেলের নাম রাখলেন “মউদুদি। বড়ো হলে মাদ্রাসায় হাফেজ হবে, সবাই ডাকবে – মওলানা মউদুদি। তিনি খুশিতে আটখানা হতে থাকেন আর কল্পনায় ছেলের মেহদি রঞ্জিত দাড়ি দেখেন। আবার দেখেন ছেলেকে আরবী পোশাক পরা অবস্থায় লম্বা আলখেল্লা।পুলকিত হতে থাকেন।

কুদ্দুস মিয়ার ধারণা আল্লাহ পাকের কাছে অদৃশ্য দূরবীণ আছে। যার কারনে তিনি সব কিছুই দেখতে পান।
“ ইয়া আল্লাহ আমার যদি গুনাহ হয়ে থাকে মাফ করে দিও।“ আবার উচ্চারণ করেন তিনি।

ওদিন সকাল থেকে তিনি বড্ডো অস্থির আছেন। দেশের বাড়ি গিয়েছিলেন। নানা কাজ তাঁর।তিনি হলেন হর্তাকর্তা। হিন্দু পাড়ায় গিয়েছিলেন ভাবেন, বউ ঝি বেবাক এমন সোন্দর কেমনে হয় তিনি বুঝেন না।
যতোবার ভাবেন ভুলে যাবেন ওমনেই তাঁর শরীর আনচান করে।অস্থির হয়ে, ঘামতে থাকেন।

— কই গেলি? ছোট বউকে উদ্দেশ্যে হাঁক পাড়েন। পড়িমরি করে দৌড়ে আসে কুলসুম। দরজা বন্ধ করতে বলেন।
কুলসুম কাঁপতে কাঁপতে বলে –
–বাচ্চাডারে দুধ খাওয়াইতাসি –
–কি কইলি মাগী? তুই এক্ষুন দরজা লাগা –
পাশের ঘর থেকে ট্যাঁ ট্যাঁ কান্নার আওয়াজ আসে আওয়াজ তো নয় ক্ষুধার চিৎকার।আধা ঘন্টার পর মুক্তি পেলো কুলসুম। দৌড়ে গেলো বাচ্চাটার কাছে। বাচ্চা তখন ক্ষুধায় হেঁচকি তুলছে। কুদ্দুস মিয়ার মাথা ঠান্ডা হয় না। তিনি তখনো ঠান্ডা আগুনে পুড়তে থাকেন। আর ভাবেন –
আরে! এই মাইয়াগুলান কি সোন্দর!
এক একটা য্যান হুরপরি। সাক্ষাত বেহেশ্তের পরী। এবং মনে মনে মালাউন মেয়ের সাথে
আপোষে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন।তবে আজ যদি কুলসুম অন্যদিনের মতো গাঁই-গুঁই করতো তবে -আল্লাহর কসম – তার হাড্ডি পাছলি এক কইরা দিতাম।
আল্লাহপাক বলেছেন মনে মনে আউড়ান।যখন বলিব তোদের আসিতেই হবে। স্বামীর আগুন ঠান্ডা না কইরা আবার কিসের কাম? অতঃপর পয়পরিস্কার হয়ে নামাজে দাঁড়ান।
নামাজেও মুনাজাতের সময় দোয়া ভুল হতে থাকে। তিনি বলেন ,–
–ইয়া আল্লাহ এই মালাউন মাইয়া গুলান আমার সামনে আসিতেছে। তুনি আমারে পথ দেখাও, আমি কি করিবো।
অনেক্ষণ ধরে মুনাজাত করলেন। গভীর রাতে স্বপ্ন দেখলেন,তিনি বেহেশ্ত এবং দোজখের মাঝখানে দন্ডায়মান। বেহেশ্তের সামনে থোকাথোকা আঙ্গুর ঝুলে আছে। কুদ্দুস মিয়া
স্বপ্নে ভাবলেন তাঁর জন্য নিশচয় বেহেশ্তে জায়গা রক্ষিত আছে। কিন্তু, একী ?
তাঁর পা অচল! অসাড় তাঁর পা। মনে হচ্ছে কেউ পেরেক দিয়ে গেঁথে দিয়েছে।

“ ইয়া আল্লাহ ইয়া মাবুদ তাহলে আমি কি গুনাহ করেছি যে আমি বেহেশ্তে যেতে পারতেছিনা“?মনেমনে আউড়ালেন। এবং সাথে দেখলেন তাঁর কনিষ্ঠ স্ত্রীকে। মনে চঞ্চল হয়ে গেল। বদজেনানা হয়ে গেছে তাহলে? কুলসুমবিবি খারাপ হয়ে গিয়েছে তাহলে?
তখনি শুনতে পেলেন কোথায় যেন বলছে,
“ জিহাদ সমস্ত মুসলমানদের জন্য ফরজ , ইছলাম ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে যুদ্ধ করতে হবে।যারা এর বিরুদ্ধে কথা বলে তারা ভন্ড,হারামখোর,না ফরমান।

ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়লেন।আসলে মাইকের এই কথাগুলো আলোচনা হচ্ছিল। পরে বুঝতে পারলেন তিনি।
-পানি –পানি করে চিল্লাচিল্লি শুরু করলেন। স্ত্রী কুলসুম দৌড়ে জগ থেকে পানি ঢেলে দিল।
–আপনি কুনো স্বপন দেখেছেন ?

কুদ্দুস মিয়া অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।মনে মনে ভাবেন আল্লাই জানে –এই বদমাইশ মহিলা কারো
সাথে ছহবত করে কী না। কুদ্দুস মিয়াকে যে মাঝে মধ্যে অবজ্ঞা করে তা তিনি টের পান।কচি বয়স তো মেরামত করন লাগব। সেইদিন তাঁর ছোটো ভাইয়ের সাথে গুজুর-গুজুর করতে দেখেছেন।নাহ! মাইয়া মানুষকে বাড়তে দেয়া যাবে না। পুরাপুরি আমার কন্ট্রোলে আনতে হইব। ইনশাল্লাহ তাই করুম।
মনে মনে স্থির করলেন।

আবার মাইকের আওয়াজ শুনতে পেলেন। এবং কী আশ্চর্য ব্যাপার! স্বপ্নে যা তিনি দেখেছেন হুবহু তাই মাইকে বলে যাচ্ছে। ভালভাবে মনে করার জন্য তিনি কান পরিষ্কার করেন,বদনা নিয়ে কুলকুচি করার সময় চোখে পানির ঝাপ্টা দেন। আবার কান পরিষ্কার করতে গিয়ে তাঁর মনে পড়লো, এই ওয়াজ মহফিলে তিনি প্রধান অতিথি।অথচ দেরী হয়ে গেল যেতে। তাড়াতাড়ি আচকান পরলেন, চোখে সুরমা টানলেন এবং সারা শরীরে ভুরভুরে আতরের গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে দাড়িটা পরিপাটি করে আঁচড়ালেন।অতঃপর বৈঠকখানায় এসে দেখেন সব অনুগতরা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে।
বললেন -চলো
কুদ্দুস মিয়া মঞ্চের একটা বিশেষ চেয়ারে বসলেন তখন সবাই হাতে তালি দিল।
একজন বক্তা তাঁর আগমনে থেমে গেছিল।তারপর আবার শুরু করল বক্তৃতা।
— কি বলতেসিলাম যেন ?-হ্যাঁ মনে পড়তাসে –
তিনি অনেক বক্তৃতা দিয়ে হয়রান হয়ে গেলেন,
—আলহামদুলিল্লাহ – টেবিলে রাখা পানির গ্লাস হতে ঢকঢক করে পানি খেলেন।
–তাইলে কি বুজলেন ভাই সকলেরা ?
সবাই হাত উঠালো। আবার শুরু করলেন –বন্ধুগন আমি যা-যা বলতেসি মন দিয়া শুনবেন আর সেই মোতাবেক কাজ কাম করবেন,ইনশাল্লা আমরা কামিয়াব হবই।

এরপর এলো প্রধান অতিথির পালা। কুদ্দুস মিয়া ঘনঘন রুমাল দিয়ে
মুখের ঘাম মুছতে লাগলেন।গ্লাস থেকে ঠান্ডা পানি খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

—-বন্ধুগন ,ভাইয়েরা আমার –এখন মুছলমানেরা অনেক সজাগ হইতেছে।রোজার মাসে
খাবারের দোকান বন্ধ থাকে ,আগে মাইয়ালোকেরা বুক উঁচু কইরা চলত, এখন ভদ্র হইতাছে, বেশীর ভাগ গেরাম গঞ্জ,শহরের মাইয়ালোক বোরকা পরে। হিসাব কইরা দেখেন আগে যারা সারা বছর নামাজ পড়তনা তারা অহন রোমজান মাসে রোজা রাইখা নামাজের জন্যি ছুটাছুটি করে।এইডা কি ভাল লক্ষণ না? বলেন আপনারাই মুমিন মুসলমানেরা।
সবাই হাতে তালি দিল।তিনি আবার শুরু করলেন –রাজশাহী ইনভারছিটি ,চট্টগ্রাম ইনভারছিটি

ইনশাল্লাহ আমাদের জিহাদী ভাইদের দখলে।তবে কিসু লোক আসে যারা মুনাফিক। অগোর মইদ্দে শিক্ষিত কিসু তাগরে বশে আনা কুনো ব্যাপার না। কি কন জিহাদী ভাইয়েরা? আর আছে কিসু বেয়াদব সাংবাদিক,আমাগো পিছে টিকটিকির মত লাইগা থাকে। তাগো ঠান্ডা করোনের ব্যবস্থা হইতাসে –ইনশাল্লাহ না-লায়েক মুরতাদ,কাফির যতদিন থাকব ইছলাম ততদিন ঠিক মত কায়েম হইবোনা। তাই বলতাসি –জেহাদি ভাইগন এই সকল না-লায়েক ,মুরতাদ,কাফির সকলরে শায়েস্তা করতে হইলে জিহাদের বিকল্প নাই।
কী বুজতাছেন মমিন মূছলমানেরা?
সবাই মাথা নাড়াল । তিনি বলেন –আলহামদুলিল্লাহ –!
সবাই একসাথে জোরে আওয়াজ তুলল –
“নারায়ে তাকবির জিন্দাবাদ”

রাত তখন গভীর। একটা ছোট ঘরে চুপ-চাপ নিম্ন স্বরে আলোচনা চলছে। কে কী করবে সম্ভবত সেই আলোচনা। কুদুসমিয়া সবাইকে ভাগে ভাগে কাজ বুঝিয়ে দিলেন।
যার যার মত চলে গেল। তাঁর মুখে একটা আত্মতৃপ্তি ফুটে উঠল।তিনি রঙ্গিন স্বপ্ন দেখলেন,এটা অন্যরকম রাস্ট্র কায়েম হয়েছে। বাহ কী চমৎকার!
পরের দিন পহেলা বৈশাখ।
রমনা বটমূলে চলছে এক মনোরম সঙ্গীত অনুষ্ঠান, হঠাৎ দুম,দাম করে অনেকগুলো বিস্ফোরণের আওয়াজ পেয়ে সবাই ছিটকে গেল। কেউ দিক-বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে ছুটতে লাগল।অনেকগুলো লাশ পড়ে গেল মাটিতে। গানের মঞ্চে সবাই ভয় পেয়ে ছুটা-ছুটি শুরু করল। রক্তের স্রোত বয়ে গেল।

চারিদিকে একটা কোলাহল,কান্নার রোল। ভয়ার্থ মানুষজন কে কোথায় যাবে বুঝে উঠতে পারল না।
পুলিশের গাড়ির প্যাঁ পোঁ আওয়াজ। এয়্যম্বুলেন্স এর শব্দে মূখরিত চারদিক।
দূর থেকে কয়েকজন কুদ্দুস মিয়ার অনূসারিরা দেখে আত্মতৃপ্তি হাঁসি হাসলো।
-চল হুজুররে ফাইনাল খবর দিয়া আসি।
মনে মনে ওরা আবার বলে উঠল
-“নারায়ে তাকবীর-
জিন্দাবাদ-“

[শেষ ]
———-