প্রকাশ্য শোক বা বিলাপ ছোটবেলা থেকেই কবি আজাদ ইলিয়াস খানের স্বভাববিরুদ্ধ। আজ তার স্ত্রী নীলিমা যখন চলে যান তখন তিনি নিঃশব্দে তার মুঠোয় ধরা স্ত্রীর অসার হাতখানি ছাড়িয়ে চলে এলেন তার প্রিয় সঙ্গী বাড়ির চিলেকোঠায়। তার বোন এবং বাবা-মা জানেন তার এই স্বভাবের কথা। তাই কবিকে একা থাকতে দিয়ে নিজেরাই ব্যবস্থা করছেন বধূর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার।

কবির চোখে ভাসছে ছোট্ট নীলিমার মুখচ্ছবি যখন ৯ বছর বয়েসী বালিকাটি প্রথম এ ঘরে এসেছিল। তার শ্বাশুড়ি, ননদ, ভাগ্নী প্রমুখ সকলেই যখন বালিকাটিকে এই সম্ভ্রান্ত খান পরিবারের উপযুক্ত করে তোলায় ব্যস্ত, তার প্রতিটি কথা, কাজ ও ভঙ্গিকে এ বংশের বধূর উপযুক্ত করে তোলায় ব্যস্ত তখন এই বিশাল এক বাড়ি মানুষের সামনে বালিকাটির বিপন্ন অবস্থা বেশ চোখে পড়ত কবির। বালিকা বধূটিকে কবিতা বা গল্প পড়তে শেখাতে তার ছিল দারুণ আনন্দ। এরপর যখন বালিকাটি আস্তে আস্তে বধূ হয়ে উঠল তখন কবি যেন একটু নির্ভরতার আশ্রয় পেলেনছেলে-মেয়েদের দেখাশোনা করা, অর্থকষ্টের সময় বিনা অনুযোগে দক্ষতার সাথে সংসার চালিয়ে নেয়া, তার স্বপ্নের স্কুলটিকে দাঁড় করাতে নিজের সমস্ত গয়না বিক্রি করে অর্থসাহায্য করা এমন সহস্র কাজের মাধ্যমে নীলিমা হয়েছিলেন কবির সাংসারিক কাজের সর্বময় সাহায্যকারী এবং নিশ্চয়তার প্রতিচ্ছবি তার নিশ্চয়তার প্রতীক যেন আজ কোন সুদূরে হারিয়ে গেল…

এমনি সময় কারো পদশব্দে কবির ভাবনায় ছেদ পড়ল। তার বড় ছেলেকে দরজায় অধোমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, ছেলেকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে নেমে গেলেন নিচে। নীলিমার লাশ নিয়ে যেতে হবে কবর দেবার জন্য।

মেয়ে নয়নের কান্না আর সইতে না পেরে চিলেকোঠায় উঠে এলেন কবিমা ই ছিল নয়নের একমাত্র সঙ্গিনী। তাই সঙ্গী হারানো এই বালিকার গুমরানো কান্না এই চিলেকোঠার নিস্তব্ধতায়ও ভীষণ হয়ে বাজছিল বুকে। আসার সময় নীলিমার ডায়েরিটি সঙ্গে করে এনেছেন। কতদিন কাজ ও দায়িত্বের চাপে, লেখালেখি করার নেশায়, তার কল্পনারীদের সাথে সময় কাঁটিয়ে তাদেরকে কবিতায় ফুঁটিয়ে তোলার অভিপ্রায়ে কত রাত নীলিমার সাথে কথা বলার সময় হয়নি। আজ স্ত্রীবিয়োগের শোক করবার জন্যই যেন সবাই তাকে ছুটি দিয়েছেতাই তিনি আজ নীলিমার না বলা কথাগুলো শুনতে বসেছেনউদ্দ্যেশ্যহীনভাবে ডায়েরির পাতা উল্টাতে গিয়ে চোখে পড়ল “কবি-বরের কাছে পত্র” শিরোনামের একটি পাতা। কৌতূহলী হয়ে পড়তে শুরু করলেন কবি।

“প্রিয়তম স্বামী,

জানিনা এ পত্র তুমি কোনদিনও পড়বে কিনা। তবু কবি-পত্নীর মনের কথাগুলো এখানে এই কাগজখন্ডকে জানিয়ে গেলাম। আমি ছিলাম ভীষণ ভাগ্যবতী। তাই তোমার মত কবিবরের স্ত্রী হতে পেরেছিলাম তোমাদের বিশাল জমিদারির সামান্য কর্মচারীর কন্যা হয়েও। আমি ভাগ্যবতী কারণ আমি নীলিমা নাম্নী হতে পেরেছিলাম, বিশাল আকাশের অসীম নীল হয়েছিলামযদিও আমার মার দেয়া শশী নামটিই আমার পছন্দ ছিল, আমি চাঁদ হয়েই থাকতে চেয়েছিলাম যেমনটি ছিলাম আমার বাবার ভাঙ্গা ঘর আলো করে। কিন্তু শশী যে তোমার মত সম্ভ্রান্ত বংশীয় কবির স্ত্রী হবার যোগ্য নয়! তাই আমি ভাগ্যবতী নীলিমা।

আমার চপলতা, গ্রাম্য ভঙ্গি ও আঁচার, একপেড়ে ডুরে শাড়ির স্নিগ্ধতা, আভরণহীন শরীর- এসবই নীলিমার মর্যাদা ক্ষুন্ন করে তাই আমি মাস্টারের কাছে ইংরেজি শিখেছি, শ্বাশুড়ি-ননদ-ভাগ্নীদের কাছে উপযুক্ত আচরণ শিখেছি, সাহিত্য সভা বা গানের আসরে মতামত দিতে শিখেছি, শিখেছি কার কত ইঞ্চি হাসি ও কত শব্দের আলাপ প্রাপ্য, আমি বেনারসী পরতে শিখেছি, জড়োয়া গহনায় শরীর জড়াতে শিখেছি–আমি ভাগ্যবতী যদিও আমি নিজে নিজে হাসতে ভুলে গেছি, কে জানে কখন ভুল হয়ে যায়? আমি ভাগ্যবতী নীলিমা হতে চেয়েছি!

তুমি আমায় অর্ধাঙ্গিনীর মর্যাদা দিয়ে তৃপ্ত হয়েছ, তোমার সকল বিপদে আমি পাশে থেকে নিশ্চয়তা দেবার চেষ্টা করেছি। আমি জানি লোকে যা বলে তাই ঠিক। আমি ভাগ্যবতী যে এই পরিবার আমাকে তাদের যোগ্য করে গড়ে নিয়েছে, তুমি এত বড় কবি, এমন সম্ভ্রান্ত বংশের মানুষ হয়েও আমায় জীবনসঙ্গিনী হিসেবে কভু অনাদর করোনি। তোমাদের মহানুভবতায়ই আজ আমি সম্ভ্রান্ত খান বংশের যোগ্য বধূ হিসেবে সম্মানিত। যদিও আমি চেয়েছিলাম তোমার কবিতার ঐ কল্পনারী হতে, চেয়েছিলাম তুমি চাঁদনী রাতে আমায় নিয়ে জ্যোস্না দেখবে আর কবিতা বুনবে শশীকে নিয়ে, চেয়েছিলাম তুমি কোন একদিন কোন একটি কবিতা লেখামাত্র আমায় শোনাবে যেমনটি শোনাও তুমি তোমায় ভাগ্নীটিকে। আমি বুঝি আমি তার যোগ্য নই, নাকি তুমি কখনো ভাবনি আমি তার যোগ্য হতে পারি? আমি ভাগ্যবতী আমাকে তোমরা যোগ্য করে তুলেছ তোমাদের। শুধু মনে ক্ষণে ক্ষণে একটি প্রশ্ন উদয় হয়, ‘তোমার সম্ভ্রান্ত পরিবারটি ভাগ্যবতী নীলিমাকে গড়ার আগে শশী নামক যে বালিকাটির বসন-ভূষণ, মন ও হাসিকে কাঁদামাটির পুতুলের মত ধ্বসিয়ে দিয়েছিল তারা কি শশীর যোগ্য হয়ে উঠতে পারত কখনো? মহামান্য কবিবর, তুমি কি শশীর যোগ্য হয়ে উঠতে পারতে, পেরেছো?জানি এ জিজ্ঞাসা বাতুলতা। কারণ তোমার জন্য আমার যোগ্য হয়ে ওঠাই নিয়ম, তোমাতেই আমার স্বর্গ ও মুক্তি। তাই আমি ভীষণ ভাগ্যবতী।

ইতি

শশী অথবা ভাগ্যবতী নীলিমা…”