আমার একটা স্বপ্নভূক মন আছে, আছে ভালোবাসাভূক হৃদয়। এই কথাটিই মনে হয়েছিল আজ সকালে চোখ মেলে সবার আগে। আর কি কিছু আছে আমার? হুমায়ুন আজাদ স্যার তার “নারী” বইটির অবতরণিকায় লিখেছেন, অনেক তরুনী উনাকে জানিয়েছে, নারী বইটি পড়েই তারা জেনেছে, তাদের একটা শরীর আছে, শরীরে নানা প্রত্যঙ্গ আছে। এই জানাটাকে আমি ভালো চোখেই দেখি। যেকোন জানাই আমার কাছে স্বাগত। কিন্তু কথাটা পড়তে পড়তেই একবার নিজেকে জিজ্ঞেস করেছি, আমি কি জানি এই কথাটা? আমার মনে হয়েছে, আমি আমার শরীরের কথাটা এতোটা জানিনা, যতটা জানি আমি আমার মনের অস্তিত্বের কথা। কোনদিন যদি জানতেও পারি, আমার একটা শরীর আছে, তাকে মনোযোগ দেয়া দরকার, সেই জানাটা হয়ত আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে অথবা উঠবে না। বর্তমানে বসে ভবিষ্যতের কথা কইতে পারবো না। কিন্তু একটা ব্যাপার খুব নিশ্চিত ভাবেই জেনেছি, xx ক্রোমজম নিয়ে জন্মেছি বলেই, বুঝতে শেখার আগেই শরীরের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ নিয়ে আমাকে লজ্জিত হতে শিখিয়ে দিয়েছে সবাই। আজ নিজেকে শুধালাম, আমি কি আমার শরীর নিয়ে লজ্জিত? আমি খুব স্পষ্ট ভাবেই জানি, না, আমি লজ্জিত না। শালীনতার সঙ্গা একেকজনের কাছে একেক রকম হতে পারে, আমিও ধারণ করি আমার সামাজিক, সাংস্কৃতিক সহজাত শালীনতা। শালীনতা বোধকে অতিক্রম করি্নি কখনো, কিন্তু আমি আমার শরীর নিয়ে লজ্জিত নই, বরং গর্বিত। আমার এই শারীরিক গড়নের কারণেই প্রথাভেঙ্গে আমার মন হয়েছে তেজদীপ্ত, বাঁধা আছে বলেই বাঁধ ভাঙ্গার এমন নেশা আমার। আর একদিন, আমার এই শরীরের গভীরেই একটি নতুন প্রাণ একটু একটু করে প্রানচঞ্চল হয়ে উঠবে। এই শারীরিক গঠনের কারণেই সেই অসাধারণ অনুভূতিটা উপভোগ করতে পারব আমি। একটি নারী শরীর অবশ্যই কোন পুরুষ শরীরের চেয়ে উন্নত না মহত কিছু নয়। শারীরিক এই গড়নে ব্যক্তি আমার কোন হাত নেই, বিবর্তনই মানব এবং মানবী গড়েছে, সেও জানি। কিন্তু এই শারীরিক গড়নই আমাকে দিয়েছে অনন্য ব্যক্তিস্বত্তা আর দেবে মাতৃতের অনুভূতি। যদিও জানি, সেই ব্যাক্তিস্বত্তাকে তার অনন্যতার স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত নয়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সবচেয়ে নির্যাতিত মানুষটিও।

তবু নিজেকেই শুধাচ্ছি, আমি কি কোনদিন নারী হয়ে উঠব সর্বোতভাবে? নারী হবার অনেক আগেই যে আমি মানুষ হতে শিখে গেছি। আমাকে আমার পরিবার, সমাজ, বন্ধু স্বজন, সবাই তো নারীরূপেই দেখতে চেয়েছিল। তাদের চাওয়া মত নিজেকে পুতুল করে গড়ার প্রথা ভাংতে গিয়ে আমি হয়ে উঠেছি মানুষ, নারী নয়। এমন কি, লিঙ্গসর্বস্ব শব্দ, মানবী শব্দটিতেও আমার আপত্তি আছে। আমি আমার বাবা মায়ের সন্তান এবং কন্যা, কিন্তু কখনই কন্যাসন্তান নই। তারা যতবার আমাকে কন্যাসন্তান বলে মর্যাদাবোধ শেখাতে চেয়েছে, ততবারই আমি জ্বলে উঠেছি বারুদের মত, পরিণত হয়েছি অগ্নিতে। ফলশ্রুতিতে, আমি আমার বাবা-মায়ের সুযোগ্য সন্তান নই, হয়ে উঠেছি “প্রবলেম চাইল্ড!” রক্ষনশীল পরিবারের দৃষ্টিকোণ থেকেও আমার জীবন যাপনকে কোনভাবেই অমার্জিত বলা চলে না, তবু আমি জানি, আমার ঔদ্ধত্য অমার্জনীয়। কারণ, আমি কন্যাসন্তান হতে রাজি হইনি।

আমার সহপাঠিনীরা সবাই যখন এক এক চিকিৎসক হবার বাসনায় জীববিজ্ঞানকে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে নিতে শুরু করল, তখন আমি বিদ্রোহ করে নিলাম উচ্চতর গণিত। সে ছিল আমার এক অপরাধ! আমি কোন বিষয় পড়ব বা পড়ব না, সে স্বাধীনতাও আমার ছিল না। শেষটাই যখন নিলামই, তখন সাথে একটা শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছিল আমাকে, জীববিজ্ঞানকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে পড়তে হবে, ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল, প্রতিদিন অন্যকোন বিষয় পড়ি বা না পড়ি, জীববিজ্ঞান পড়তেই হবে! ভাবখানা এমন, রোজ জীববিজ্ঞান পড়লেই আমার চিকিৎসক হওয়া নিশ্চিত, আমি কি পড়তে চাই সেটা বিষয় না। করতাম বিতর্ক, বিচারকও একদিন ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিল, বিতার্কিক মেয়েকে বিয়ে দেয়া সমস্যা, পাত্রপক্ষ ভয় পাবে! সেদিন জেনেছিলাম, আমি বিতার্কিক হলেও মেয়ে বিতার্কিক। ভালো লাগেনি আমার। ভালো লাগেনি, সেকথা জানাবারও জায়গা ছিল না। এরপর করেছি আরেক যুদ্ধ, আমার জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার স্বপ্ন গুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, আমাকে ঢাকা বিশ্ব্যবিদ্যালয় বা অন্য কোথাও ভর্তি পরীক্ষা দেবার সুযোগ না দিয়ে। আমিও পরিবারের সবার ইচ্ছার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ভর্তি হলাম বুয়েটে, তাও আবার ১২০টা সহপাঠী নয়, ছেলের সাথে যন্ত্রকৌশলে! আমাকে ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রে ১০০টা ছেলের সাথে কাজ করতে হবে, এই ভয়ে বুক শুকিয়ে গিয়েছিলো অনেকেরই। আমি সে নিয়ে চিন্তিত ছিলাম না, চিন্তিত ছিলাম বরং ছেলে সহপাঠীদের নিয়ে, কারণ ওরা আসলে আমার স্বগোত্রের নয়, কোনদিন মানুষরূপে দেখার সুযোগ হয়নি তাদের, আপাদমস্তক ছেলেই থেকেছে! সুযোগটা আমিও নিয়েছি। সেশনালের বোর্ড ভাইভার দিন যখন ছেলেরা শেভ করে, চুল আঁচড়ে, সুন্দর শার্ট-প্যান্ট-জুতো পড়ে ক্লাসে আসতো, আমি ঘুরে ঘুরে ওদের দেখতাম, আর বলতাম, সাজগোজ করা ছেলে দেখি। বলেই সবকটা দাত দেখিয়ে দিতেম। সে জন্য খ্যাতিও ছিল আমার, ওরা ইচ্ছাকৃত ঠাট্টা করেই আমার ব্যাগ নিয়ে ঘাটাঘাটি করত, কেউ যখন বলত, “ঐ জানিস না, মেয়েদের ব্যাগ ধরতে হয় না”, তৈরী করা উত্তরটা দিতে সময় লাগতো না ছেলেবন্ধু গুলোর। “মেয়েদের ব্যাগ ধরতে হয় না, কিন্তু ওর ব্যাগ ধরা যায়!”

পহেলা ফাল্গুনে নিজে সেজেগুজে বাসন্তী রঙের শাড়ী না পরে, ছেলেগুলোকে গিয়ে বলতাম, পাখি দেখবা না? চল, পাখি দেখে আসি। হৈ হৈ করে উঠত সবকটা। বলত, তুমি পাখি দেখবা কেন? ওগুলো তো আমাদের ব্যাপার। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ক্যাম্পাসে হাঁটতে হাঁটতে ছেলেগুলোকে সুসজ্জিত পাখি আমি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েই ছাড়তাম। এগুলো যে আমার বাড়াবাড়ি ছিল, সে আমি জানি, সে আমি মানি। কিন্তু তবু এই বাড়াবাড়ি গুলো করতে আমি কখনও দ্বিধা করিনি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তো এরচেয়ে অনেক অনেক বেশী বাড়াবাড়ি সহ্য করেছে কোটি কোটি নারী জন্ম। সে হিশেবে এ যে নগন্য, কে না জানে? তবু কে মানে!

বর্তমানের অবস্থা আরো করুণ, মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আমার বৃত্তান্ত পেশাগত কারণে কোথাও দেখাতে হলে, পুরুষশাষিত সমাজের ভুরু যে একটু কুঁচকে উঠে, চোখদুটো যে একটু বিস্ফোরিত হয়, আড়াল করবার অনেক চেষ্টা করলেও তা আড়ালে যায় না। যন্ত্রকৌশলীর পেশাকে পুরুষেরা তাদের একচেটিয়া সম্পত্তি বলেই মনে করে, সেখানে উৎকট আপদের মত এক মেয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করলে যে পুরুষের পেশা হিসাবে এর গুরুত্ব কমে যায়! দুটি পুরুষ যখন পেশাগত প্রতিদ্বন্দীতায় নামে, তখন তারা বিচার করে দক্ষতা আর মেধাগত উৎকর্ষ, কিন্তু যখনই একজন নারীর সাথে এই তুলনা করার ব্যাপারটা আসে, সেটা তাদের কাছে চরম অপমানজনক বলেই মনে হয়, তুলনাটা তখন কেবলই হয় পেশীশক্তিতে। কোনভাবে যদিবা মেয়েটিই উৎরে যায় এ বিচারে, তখন মেয়েটার চোখের আড়ালে বা প্রকাশ্যেই তার নারী জন্ম নিয়ে বিদ্রুপ করা হয়, যাতে মেয়েটা অনুভব করতে পারে, যোগ্য হওয়াটাও তার একটা অপরাধ! বাংলাদেশের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গগী বলে কথা। আমার বুয়েটে চান্স পাওয়া আর আমার কাকাতো ভাইয়ের না পাওয়াটাও যেমন ছিল আমার অপরাধ। আজো প্রতিদিন ভিন্ন বিষয়ে পড়েও আমাকে আমার পরিবার তুলনা করে চলে আমার কাকাতো ভাইয়ের সাথে। আমার পেশাগত জীবনের দূর্ঘটনায় তারা কষ্ট পায়না, বরং গোপনে একটা তৃপ্তির হাসি হাসে, হাসিটা প্রকাশ্যে আসতে আক্ষরিক অর্থেই দুদিনের বেশী সময় লাগেনি কখনও। কিন্তু কাকাত ভাইটির ক্ষেত্রে দূর্ঘটনার কারণ ব্যাখ্যার ঝুড়িটা এতোই বড় থাকে, আমার দম বন্ধ হয়ে আসে (বলাবাহুল্য, ব্যাখ্যা আমার চাওয়ার দরকার হয়নি কোনদিন, এভাবে ব্যাখ্যা করাটা তারা তাদের নৈতিক দ্বায়িত্ব এবং মানবতা বোধের প্রকাশ বলেই মনে করে তখন)। যেন আমার সব অপরাধ আর অযোগ্যতা লুকিয়ে আছে আমার XX ক্রোমজমে!

সে যাক, আমি নাহয় মানুষ হিশেবে পাইনি এখনও আমার সম্মান, পুরুষেরা নিজেরা মানুষ নয়, পুরুষ বলেই মানুষকে সম্মান দিতে শেখেনি আজো। কিন্তু আজ আর কিছুতেই মানতে পারিনে, মানুষ নয়, কেবল এবং কেবল মাত্র নারীই হতে হবে আমাকে। আমার কন্যা, জীবনসংগী, মা হতে আপত্তি নেই, কিন্তু তীব্র আপত্তি আছে কন্যাসন্তান, অর্ধাঙ্গিনী বা জননী হতে। সেই অর্থে, নারী হবার যোগ্যতা আসলে আমার নেই। সানন্দে শিরোধার্য করে নিয়েছি আমার এ অযোগ্যতাকে।

এতো কথা বলে ফেললাম, আমার স্বপ্নভূক মনের কথা বলতে গিয়ে, বলতে গিয়ে আমার ভালোবাসাভূক স্বত্তার কথা। আমি স্বপ্ন খাই, স্বপ্নে বাঁচি। আমি স্বপ্ন দেখি বিশাল লাইব্রেরীর, স্বপ্ন দেখি শিল্পী মনের গুনগুনানির জন্য দারুন একটা স্টুডিওর, স্বপ্ন দেখি একটা গবেষনাগারের, স্বপ্ন দেখি একদল সহযোদ্ধার যারা লড়ছে মানবতার জন্য, হাতে হাত ধরে, স্বপ্ন দেখি একটি দেশের লাল সবুজ পতাকা সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে পতপত করে জয়ের গৌরবে উড়ছে, বাংলাদেশী, শুনলেই শ্রদ্ধার চোখে তাকাচ্ছে সারাবিশ্ব! আমি স্বপ্ন দেখি, বিজ্ঞান গবেষক হবার। নারীত্বের সামাজিক সঙ্গা বা সুভাষিত মহিমায় এই স্বপ্নগুলোকে বন্দী করা যায় না। আর স্বপ্ন দেখি, আমারই মত আরেকটি স্বপ্নভূক মানুষ, ঘরে বাইরে সর্বত্র ধরে রেখেছে আমার হাতখানি, একসাথে হাঁটছি স্বপ্নের অলিতে গলিতে, স্বপ্নের পথে পথে। নারী না হয়ে মানুষ হতে চেয়েছি, তার মানে এই নয়, আমি একাই সর্বেসর্বা, আমার দরকার নেই আমার সংগীটিকে, সংগীকে কাছে পাবার বা চলার পথে সাথে পাবার আকাঙ্খাও আমি বিসর্জন দিয়েছি নারীত্বের তথাকথিত সঙ্গার সাথে! ভালোবাসার জিনটুকুতো আমার মধ্যেই আছে, ঘর বাঁধার সামাজিক অভ্যস্ততা কিংবা নিজের জিনগুলোকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেবার বাসনা আমার কোষে কোষে। এই স্বপ্ন দেখার প্রবণতা বা ভালোবাসা পাবার বাসনা জিনের মাঝে লেখা আছে, সে আমি জানি, কিন্তু স্বপ্ন এবং ভালোবাসা, এইগুলো দেহের কোনখানে, মনের কোন অজানা অধ্যায়ে লেখা আছে, কোথায় বসে বেঁচে থাকার জন্য শ্বাসের মত বা রক্তস্রোতের মত আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে, সে আমি জানিনা। আমি কেবল জানি, নারী নয়, মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকার দরকার আমার, চিন্তার স্বাধীনতা, কর্মের স্বাধীনতা, সৃষ্টির স্বাধীনতা, স্বপ্নের স্বাধীনতা এবং প্রানমেলে ভালোবাসার স্বাধীনতা চাই আমার। xx ক্রোমোজমের মানুষগুলোর এমন বাঁচার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে প্রতিদিন পুরুষেরা কত লক্ষ লক্ষ খুন করছে, তার হিসাব কে দেবে? তার বিচার চাইবো আমি কোন আদালতে? বাঁচার এই লড়াইটা নারী মুক্তির নয় কেবল, মানব মুক্তির! মানবতার মুক্তির!