tigar

‘মাঘের শীতে বাঘে কাঁপে’, ‘বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়’, ‘জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ’, ‘টাকায় বাঘের দুধ মেলে’ — প্রাচীণ এ সব প্রবাদ-প্রবচন মনে করিয়ে দেয়, বহু বছর ধরে এদেশে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে মানুষ টিকে আছে। তবে টিকে থাকার এই লড়াইয়ে বাঘ হারতে বসায় এখন তাদের অস্তিত্বই চরম সংকটে।

কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে মেছো বাঘ, ছোট আকৃতির বাঘ বলে পরিচিত বাঘডাশার অস্তিত্ব ছিল। খোদ চট্টগ্রাম শহরের একটি জায়গার নাম ‘টাইগার পাস’। ওই এলাকাটি বাঘ চলাচলের জন্য চিহ্নিত ছিল বলে ব্রিটিশ আমলে এমন নামকরণ করা হয়। চট্টগ্রাম শহরেই আরেকটি জায়গার নাম ‘বাঘ ঘোনা’। এক সময় সেখানের ঘন বনে প্রচুর বাঘের অস্তিত্ব ছিল বলেই এমন নাম হয়েছে স্থানটির। কিন্তু এখন সুন্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের অন্যত্র বাঘের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।

সত্যিকার অর্থে বাঘ এখন সারা বিশ্বেই অতি বিপন্ন প্রাণীগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশ্বে বাঘের সংখ্যা এখন মাত্র তিন হাজার ২০০টি। এরমধ্যে ভারতে সবচেয়ে বেশী বাঘ (প্রায় দেড় হাজার) রয়েছে। একক বন হিসেবে সবচেয়ে বেশী বাঘ রয়েছে সুন্দরবনে (প্রায় সাড়ে ৪০০টি)। ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনে বাঘের ঘনত্বও সবচেয়ে বেশী। হিমালয় অঞ্চলে রয়েছে দুর্লভ শ্বেতচিতা।

২০০৪ সালে সুন্দরবনে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, বাংলাদেশ ও ভারতের বিশেষজ্ঞরা যৌথভাবে জরিপ চালিয়ে ৪৪০টি রয়েল বেঙ্গলের সংখ্যা নির্ধারণ করেন। এরপরে আর কোনো বাঘ-শুমারী হয়নি। তবে বাংলাদেশের বাঘ বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে বাঘ বনাম মানুষ সংঘাত। পরিবেশ বিপর্যয়, খাদ্য সংকট, পানির লবনাক্ততা বৃদ্ধি ইত্যাদিই এর কারণ। খাদ্যের সন্ধানে মাঝে মধ্যেই বাঘ এসে হানা দিচ্ছে লোকালয়ে কোনো কৃষকের গোয়ালে। মারা পড়ছে নির্বিচারে।

আবার পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সুন্দরবনের নদী ও খালে-বিলের পানির লবনাক্ততা আগের চেয়ে বেড়েছে। বাঘ বিশেষজ্ঞ খসরু চৌধুরি গবেষণা করে দেখেছেন, এই পানি পান করার ফলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের পাকস্থলিতে ক্ষত সৃষ্টি হয়। এতে অসুস্থ্য বাঘের মেজাজ খিটিমিটি হয়ে পড়ে। মানুষ দেখলেই তারা হামলে পড়ে। আবার বনের ঘনত্ব হ্রাস পাওয়ায় বনে মানুষের আনাগোনা এখন আগের চেয়ে সহজেই বাঘের নজরে পড়ছে। এতে মানুষ সম্পর্কে বাঘের ভীতি কমছে।

এ দেশের বন বিভাগের পর্যালোচনা অনুযায়ী, প্রতি বছর ২৫ থেকে ৪০ জন মানুষ বাঘের আক্রমনে মারা যাচ্ছে। অন্যদিকে লোকালয়ে এসে গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা পড়ছে দু থেকে তিনটি বাঘ। আইলার মহাবিপর্যয়ে মানুষের পাশাপাশি ব্যপক ক্ষতি হয় সুন্দরবনে। সে সময় নদীর পানিতে মরে ভেসে ওঠে কয়েকটি বাঘ।

বাঘ–মানুষ সংঘাত কমাতে বন বিভাগ শিগরিই সাতক্ষীরার শ্যমনগরে নিতে যাচ্ছে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় বাঘ সর্ম্পকে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হবে। লোকালয়ে বাঘ এলে সেগুলোকে মেরে না ফেলে কিভাবে আবার বন্যপ্রাণীটিকে বনের প্রাকৃতিক পরিবেশে ফিরিয়ে দেওয়া যায়, এ বিষয়ে স্থানীয়দের দেওয়া হবে বিশেষ প্রশিক্ষণ। পরীক্ষায় সাফল্য পাওয়া গেলে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে বাঘ উপদ্রুত অন্যান্য অঞ্চলেও।

চোরা শিকারিদের কাছে বাঘের চামড়া, দাঁত, নখ, হাড় ও চর্বি লোভনীয় বস্তু। ভারত–বাংলাদেশ–মায়ানমার অঞ্চলে রয়েছে চোরা বাঘ শিকারিদের বিশাল নেটওয়ার্ক।

এই বৈরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় অতিবিপন্ন রয়েল বেঙ্গল টাইগার রক্ষায় বাংলাদেশ–ভারত মতৈক্যে পৌঁছেছে। দুদেশের সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গলের বিচরণ অবাধ করতে শিগগিরই স্বাক্ষরিত হতে হচ্ছে যৌথ প্রটোকল। এরই মধ্যে দুদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বন বিভাগ এই প্রটোকল স্বাক্ষরের বিষয়টি চূড়ান্ত করেছে। প্রটোকল স্বাক্ষর হলে বাঘ রক্ষায় দুদেশের অভিজ্ঞতার বিনিময়ের পাশাপাশি বাঘ শুমারী তথা বাঘ সংরক্ষণ অনেক সহজ হবে।

বন সংরক্ষক (বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি) ড. তপন কুমার জানিয়েছেন, গত জানুয়ারিতে থাইল্যাণ্ডে বাঘ সংরক্ষণ বিষয়ক মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনের ঘোষণায় বাঘের অস্তিত্ব আছে এমন ১৩টি দেশ একমত পোষণ করেছে। এর মধ্যে ২০২২ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুন, বাঘের আবাসস্থল হিসেবে চিহ্নিত বন সংরক্ষণ, দুদেশের সীমান্ত সংলগ্ন বনে বাঘের বিচরণ অবাধ করতে ট্রান্সবাউন্ডারি ইস্যুতে যৌথ প্রটোকল স্বাক্ষর, আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্যে বাঘ শিকার ও চোরাচালান বন্ধ– ইত্যাদি অন্যতম। ওই সম্মেলনের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ও ভারত সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গলের চলাচল অবাধ করতে শিগগিরই ট্রান্সবাউন্ডারি ইস্যুতে যৌথ প্রটোকল স্বাক্ষর করবে।

তার ভাষ্যমতে, বাঘ রক্ষায় ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদপেক্ষ নিয়েছে। এরমধ্যে বাঘ সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, সুন্দরবনের গ্রামগুলোতে বাঘ বিষয়ক সতর্কমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে বিশেষ টিম গঠন, বাঘ ও হরিণ শিকার বন্ধে আইনগত শাস্তি বৃদ্ধির উদ্যোগ, বাঘের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণ প্রদান, চেতনা নাশক অষুধ প্রয়োগ করে লোকালয়ে চলে আসা বাঘকে আবার বনে ছেড়ে দেওয়া– ইত্যাদি অন্যতম।

বন সংরক্ষক আরো জানান, অন্যদিকে ১৯ কোটি পাঁচ লাখ, ছয় কোটি ৫৬ লাখ এবং নয় কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সুন্দরবনের ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন ও পুনর্বাসন খাতে তিনটি পৃথক প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলছে। একটি প্রকল্প এ বছর এবং বাকী দুটি প্রকল্প আগামী দুবছরের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে। এছাড়া গত ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবসে এদেশের বন বিভাগ ‘বিপন্ন বাঘ বাঁচান, সুন্দরবন রক্ষা করুন’ শ্লোগানে দিবসটি একই সঙ্গে ঢাকা, খুলনা ও সাতক্ষীরায় পালন করেছে।

ছবি: অন্তর্জাল