গীতাদি নরসিংদীর মেয়ে। এই নরসিংদীর মানুষ অতীনবন্দ্যোপাধ্যায়। অতীনের নরসিংদীর পটভূমি নিয়ে লেখা নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে উপন্যাস। গীতাদি, আপনার জন্য তুলে দিলাম এখানে সেই উপন্যাসটির কথা।
30116_1396154715253_1573787229_30948631_593111_a
ঈশম তরমুজ ক্ষেতে টোঙ ঘরে শুয়ে থাকে। আর রাত জেগে জেগে পাহারা দেয়। ধনকর্তার ছেলে হয়েছে। এই খবর নিয়ে রওনা হয়েছে ধনকর্তার কাছে। বড়বৌ বারান্দায় ভাত বেড়ে দিয়েছে। তৃপ্তি সহকারে খেয়ে রওনা হয়েছে বিশ ক্রোশ পথে সন্ধ্যার অন্ধকারে। গোপাট থেকে আড়াআড়ি মাঠে নেমেছে ঈশম। আর খুঁজছে বড়কর্তাকে। বড়কর্তা কোন্ খেয়ালে থাকেন। মাঝে মাঝে বেরিয়ে যান। কোন এক পলিনকে খোঁজেন। আর নিজের মনে কথা বলেন। তার প্রকাশ হল– গাৎচোরেৎশালা। এই বড়কর্তাকে এলাকার হিন্দু মুসলমান সবাই সমীহ করেন। কেউ মনে করেন–তিনি ঐশীস্বভাবযুক্ত। তার জন্য সকলের মায়া রয়ে যায়।

শুরু হয়েছে ঈশমকে দিয়ে নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে উপন্যাসটি। তিনটি পর্ব। প্রতিটি পর্বে আবার অনেকগুলো খণ্ড। দ্বিতীয় পর্বের নাম–অলৌকিক জলযান, শেষ পর্ব–ঈশ্বরের বাগান।

অতীন লিখেছেন রাইনদি গ্রামের ঈশ্বরোপম মানুষের আর মানুষের মাঝে বেড়ে ওঠা গাছপালা, পশুপাখি আর প্রকৃতির কথা। এর মধ্যে দিয়ে মানুষ যে রূপের জগতে যেতে চায়–সে জগতের পরতে পরতে যে অরূপের আনন্দ, বেদনা আর অপার বিস্ময় খেলা করে তা গ্রন্থপাঠে অর্জিত হয়।
শুরু হয়েছিল সাতচল্লিশের দেশভাগের আগে। একটি খণ্ড শেষ হল সাতচল্লিশে–একটি অর্জুন গাছের বাকলের উৎকীর্ণ কষ্ট গাথা দিয়ে। সোনা তার পাগল জ্যাঠা মশাইকে খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ তারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অন্য সময় হলে–সবাই নানাভাবে জ্যাঠা মশাইকে খুঁজতে বের হত। বের হত কাকা শচীকর্তা, ঈশম, আবেদালী, জব্বর, সামু, জোটন, জালালী…ঝড়জলের মধ্যে দিয়ে এই নীলকণ্ঠ পাখিটিকে খুঁজতে বের হওয়া ছাড়া কারো অন্য কোন স্বভাব থাকে না– কারণ পাগলা বড়কর্তা তো কেবল কংগ্রেসের শচীকর্তার দাদা নন, তিনি মুসলিমলীগের সামুরও নিকটজন। তাকে খুঁজতে লড়কে লেঙে পাকিস্তান কিম্বা বন্দেমাতরম ফিকে হয়ে যায়। তিনি সকলের অন্বিষ্ট।

কিন্তু দেশভাগ এমন একটা সময়ে–যখন জ্যাঠা মশাইকে ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। তার জন্য অপেক্ষা করার উপায় নেই। সে স্বভাবটি তখন আর নেই। একমাত্র সোনা মহাবৃক্ষ অর্জুন গাছের বাকলে লিখে গেল,, “জ্যাঠা মশাই আমরা হিন্দুস্তানে চলিয়া গিয়াছি। ইতি-সোনা।” কোন মানুষকে বলে গেল না। মহাবৃক্ষটি অনন্ত মানুষের এই বেদনাটি নিয়ে বুড়ো হতে থাকল। কেউ না কেউ একদিন দেখে জেগে উঠবে। বুঝবে, এই বিভেদ আসলে অসভ্যতা। মানুষ মূলত মিলনে অভ্যস্ত।

অতীন লিখছেন, সোনা দেখল এক সকালে কিছু মানুষজন এসে ঘরগুলির ওপর উঠে টিনের স্ক্র খুলে নিচ্ছে। আর টিনগুলো রাখছে আলাদা করে। ওর বাবার মনে হচ্ছে জ্যাঠা মশাই তার মত পাল্টাবে। কিন্তু সব যখন খোলা হচ্ছে–তখন সোনা একা হয়ে যাচ্ছে। তখন অর্জুন গাছটা তাকে বার বার হাত ছানি দিচ্ছে। ঘর ভাঙা হচ্ছে বলেই গরীব মানুষজন ভীড় করে আসছে। টুকটাক জিনিসপত্র কুড়িয়ে নিচ্ছে। কিন্তু ঈশম আবার সেসব ফিরিয়ে আনছে।
সোনাদের নৌকা যখন চলতে শুরু করেছে,, ঈশম তার প্রাপ্য পেয়েও নৌকার সাথে সাথে হাটতে শুরু করেছে। ভূপেন্দ্রনাথ তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। ঈশম হাত তুলে যেন বলল, সময় হলেই ফিরে যাবে। ভূপেন্দ্রনাথ বুঝলেন, ঈশম যতক্ষণ পারে ততক্ষণ ওদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটবে। এবং ঠিক দামোদরদির মাঠ পার হলে সে আর এগুতে পারবে না। সামনে বড় বাওড় পড়বে। সে জল ভেঙে ওপারে যেতে পারবে না। ওকে থেকে ফিরে যেতেই হবে।

কিন্তু ঈশম জানে সেই বিন্দু বিন্দু নৌকা থেকে এখনও কেউ একজন দেখছে। যতক্ষণ দেখা যায় দেখছে। সেতো লিখে গেছে তার প্রাণের হাহাকার অর্জুন গাছের কাণ্ডে। যেন আবার তাদের ডাক দিলে ফিরে আসবে। নীলকণ্ঠ পাখির মত এইসব মানুষের কথা অতীন লিখেছেন। নির্মোহভাবে। প্রবলভাবে। আমাদের সর্বতোভাবে ঝাঁকি দেওয়ার জন্য। আমাদের বোধকে উস্কে দেওয়ার জন্য।
নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজের মধ্যে এই ঈশমই প্রকৃত মানবের প্রকৃতি। এই প্রকৃতির মহৎ পাঠটি আমাদের মত করে আর কেউ কি লিখেছেন? লিখবেন?

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
করুণা প্রকাশনী। কলকাতা-৯
প্রথম প্রকাশ : এপ্রিল ১৯৭১
নবম অখণ্ড সংস্করণ : অক্টোবর ২০০৮
উৎসর্গ : ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং আমার মাকে’

কয়েকটি মন্তব্য :
পুতুলনাচের ইতিকথার পর এতটা অভিভূত হইনি।–অশোক মিত্র।
অতীনের এই রচনা এযাৎকালের নজিরের বাইরে। ভাবতে গর্ব অনুভব করছি যে, আমার সমকালে এক তাজা তেজস্বী খাঁটি লেখকের আবির্ভাব ঘটেছে। আজ তিনি নিঃসঙ্গ যাত্রী। কিন্তু বিশ্বাস করি, একদা আমাদের বংশধরগণ তাঁর নিঃসঙ্গ যন্ত্রণা অনুভব করে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে তিরস্কার বর্ষণ করবে। ‘পথের পাঁচালীর’ পর এই হচ্ছে দ্বিতীয় উপন্যাস যা বাংলা সাহিত্যের মূল সুরকে অনুসরণ করেছে।–সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ।
‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ এই সময়ের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।–শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়।