‘স্বয়ং ঈশ্বরের কাছেও যে বিষয়টি বিব্রতকর, তা হল ‘ঈশ্বরবিশ্বাস’। মানুষ একদিকে যেমন বিশ্বাস করে ঈশ্বর কল্পনাতীত নির্দয় অনেক শাস্তির পরিকল্পনা করে রেখেছেন, তেমনি অপরদিকে মনে করে তিনি তাদেরকে শাস্তিস্বরূপ যে বিষয়টি অর্পণ করেছেন তা হল “জ্ঞান”। মানুষের ধারণামতে, তারা যদি ঈশ্বরের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ না হয়, তাঁর প্রতি সৎ না থাকে তবে এই “জ্ঞান” অবধারিতভাবে তাদেরকে নিরীশ্বরবাদী হতে বাধ্য করবে। এই বিষয়টি আমাকে এই উপসংহারে পৌঁছাতে প্রণোদিত করে যে, নাস্তিক এবং অজ্ঞেয়বাদীরাদেরকেই ঈশ্বর সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন। কারণ তাদের মধ্যে জ্ঞানস্পৃহা রয়েছে, এরাই সেই দল ব্যক্তি যারা ঈশ্বরকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে’।

-গ্যালেন স্ট্রাওসোন

প্রায়শই ধারণা করা হয়ে থাকে যে, ঈশ্বর এবং নৈতিকতার মাঝে একটি বিশেষ নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। বেশিরভাগ ধর্মবিশ্বাসী মানুষ এই মত পোষণ করেন যে নৈতিকতার সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত কোন বিষয়ে(পতিতাবৃত্তি, পর্ণোগ্রাফি, গর্ভপাত) নেয়া সিদ্ধান্ত যেন ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক না হয় কিংবা তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না হানে। নৈতিকতার সাথে ধর্ম কিংবা ঈশ্বরবিশ্বাস এর একটি নিবিড় সংযোগ রয়েছে-মূলত এই পূর্বানুমানই এরূপ ধারণার পেছনে দায়ী। হয়তো ধারণাটি এমন যে, একজন ঈশ্বরবিশ্বাসীর নৈতিক হবার সম্ভাবনা একজন ঈশ্বর-অবিশ্বাসীর তুলনায় বেশি, হয়তো ঈশ্বরবিশ্বাসী একজন ব্যক্তি বিশদভাবে নৈতিক জ্ঞানের অধিকারী, ঈশ্বরের সাথে যার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে।

নৈতিকতা এবং ঈশ্বরবিশ্বাসের পাশাপাশি চলা এবং নাস্তিকতা এবং অনৈতিকতার পাশাপাশি চলার ধারণাটির একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। আমরা এই গল্পটির সূচনা করতে পারি সপ্তদশ শতাব্দীতে লক এর একটি উদ্যোগের মধ্য দিয়ে। নিজের রচিত ‘নৈতিকতা সম্পর্কিত একটি চিঠি’ তে লক ধর্মীয় সহনশীলতা পালনের জন্য(খুবই সীমিত আকারের) সনির্বন্ধ একটি অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তার প্রদত্ত নির্ণায়কতার মানদণ্ডে যেসব ব্যক্তি এই সহনশীলতার সীমার বাইরে থাকবে তারা হল নাস্তিকরা, যাদের সম্পর্কে লক বলেছেনঃ

‘ঈশ্বরের অস্তিত্বকে যারা অস্বীকার করে, তাদেরকে কোন অবস্থাতেই সহ্য করা হবে না। প্রতিশ্রুতি, নির্ভরতা এবং আনুগত্যের মতো গুণগুলো মানব সমাজকে বেঁধে রেখেছে, যা একজন নাস্তিকের পক্ষে কখনো ধারণ করা সম্ভব হবে না। চিন্তার জগতেও কেউ ঈশ্বরকে ভুলে যায়, তাহলে সবকিছুই অর্থহীন হয়ে পড়ে’।

( লক ১৯৫৫:৫২)

অষ্টাদশ শতাব্দীতে রুশো তার ‘এমিল’ বইটিতে একই চিন্তাধারার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেনঃ ‘যদি ঈশ্বরত্বের কোন অস্তিত্ব না থাকে, তাহলে দুষ্ট ব্যক্তিদের আচরণই যৌক্তিক এবং ভাল মানুষ নির্বোধ ব্যতিত অন্য কিছু নয়’(রুশো ১৯৯১:২৯২)। যদিও রুশো এখানে ‘যদি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, তথাপি এ সম্পর্কে তার মনে কোন সন্দেহ নেই। তার ধারণা এমন যে, যেহেতু ঈশ্বরের অস্তিত্ব রয়েছে, সুতরাং নৈতিকতা কোন বিভ্রম নয়।

একই চিন্তাধারার পুনরাবৃত্তি ঘটে উনবিংশ শতাব্দীতে ডস্তয়েভস্কির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে যেখানে তিনি বলেছেন,‘ঈশ্বরের মৃত্যু ঘটলে, সবকিছুই বৈধ হয়ে যাবে’। ডস্তয়েভস্কি নিজে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত ছিলেন যে,ঈশ্বর মৃত নন এবং সকল কাজই বৈধ নয়। কিন্তু তিনি পরিষ্কারভাবেই ধারণা পোষণ করতেন যে,ঈশ্বরের অস্তিত্বের উপরে নৈতিকতার মতো বিষয়টির অস্তিত্ব নির্ভর করে। ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকলে নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে তা যে কি পরিমাণে বিপর্যয়কর হতো, এ বিষয়টিকে তিনি তুলে ধরেছেন।

শুধুমাত্র ঈশ্বরবিশ্বাসীরাই যে ঈশ্বরের উপর নৈতিকতা নির্ভর করে বলে মনে করেন তা কিন্তু নয়। নাস্তিক সাত্রে তার ‘অস্তিত্ববাদ ও মানবতাবাদ’ বইটিতে বইটিতে এই বলে মত প্রকাশ করেছেন যেঃ

‘অস্তিত্ববাদীদের কাছে… ঈশ্বরের না থাকাটা চরম বিব্রতকর একটি বিষয়, যেহেতু একটি বোধগম্য স্বর্গলোকের মধ্যে মূল্য খুঁজে পাবার সকল সম্ভাবনা ঈশ্বরের সাথে সাথেই অর্থহীন হয়ে যায়। কোনো অবস্থায়ই আর “শুভ” এর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয় যেহেতু তা ভাবার জন্য কোনো অসীম ও নিখুঁত সচেতন সত্ত্বার অস্তিত্ব নেই। কোথাও একথাটি লেখা নেই যে, নৈতিকতার অস্তিত্ব রয়েছে, মানুষমাত্রই সৎ থাকতে হবে, কিংবা মিথ্যে বলা যাবেনা, যেহেতু আমরা এমন একটি ক্ষেত্রে অবস্থান করছি যেখানে মানবজাতি ব্যতীত আর কেউ নেই…ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকলে আদতেই সবকিছুই বৈধ হয়ে যাবে, এবং মানুষ সবসময় অনিশ্চয়তার দোলাচলে অবস্থান করে, যেহেতু সে নিজের ভিতরে কিংবা বাইরে নির্ভর করার মতো কোন কিছু খুঁজে পায়না’।

( সাত্রে ১৯৭০:৩৩-৪)

এই প্রবন্ধে আমরা নৈতিকতা এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বের মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে কিনা এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালাবো এবং আরও দেখব যে নৈতিক বিবেচনার দিক থেকে কোন যুক্তি ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা বাডিয়ে দেয় কিনা।

সৃষ্টিকর্তারূপে ঈশ্বরের ভূমিকা

অনেক লেখকই মনে করেন যে, ঈশ্বর যেহেতু আমাদের সৃষ্টি করেছেন, সুতরাং ঈশ্বরের প্রতি আমাদের কিছু বিশেষ দায়িত্ব পালন করা উচিত। জীবনকে আমাদের জন্য ঈশ্বরের সর্বোত্তম উপহার হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। জীবন যে একটি অসামান্য উপহার, এর প্রমাণ(দাবিকৃত) হিসেবে অগণিত মানুষকে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে যারা জন্ম নিতে পেরে খুশি এবং বেঁচে থাকার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতেও রাজি। ঈশ্বর শুধু আমাদেরকে জীবন নামক এই অসামান্য উপহারই প্রদান করেননি, উপরন্তু ঈশ্বরের সুনিপুণ নিয়ন্ত্রনের দ্ধারা সবকিছুর অস্তিত্ব বজায় থাকছে, যার দরুণ আমরা দিনের পর দিন বেঁচে থাকছি। এই ঐশ্বরিক শক্তি ব্যতীত আমরা সহ সমগ্র মহাবিশ্ব অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। তাই নূন্যতম পরিমাণে হলেও এই অসাধারণ উপহারের জন্য ঈশ্বরের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
এই ধরণের চিন্তাধারা ঈশ্বরবিশ্বাসীদের জন্য স্বাভাবিক হলেও তাতে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। প্রথমত, জীবনকে উপহার হিসেবে ধারণা করার ব্যাপারটি অসংলগ্ন। ধরা যাক, ‘ক’ নামক একজন ব্যক্তি ‘খ’ নামক অপর একজন ব্যক্তিকে একটি উপহার প্রদান করতে ইচ্ছুক। এক্ষেত্রে উভয়ের অস্তিত্ব থাকা বাঞ্চনীয়। উপহারটি যদি জীবন হয়ে থাকে তাহলে তা এক্ষেত্রে কাকে দান করা হল? যদি ইতোমধ্যে আমাদের অস্তিত্ব থেকে থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে আমাদের কাছে ইতোমধ্যে জীবন রয়েছে যা আমাদেরকে উপহার দেওয়ার কথা ছিল। যদি আমাদের অস্তিত্ব না থেকে থাকে তাহলে ঘোষিত উপহারটি গ্রহণ করার মতো কেউ নেই। উভয়দিক থেকেই বিবেচনা করলে, জীবন একটি উপহার হিসেবে ধারণা করার কোন অর্থ নেই।
উপস্থাপিত বিরুদ্ধ-যুক্তিটি আমাদেরকে ঈশ্বর সৃষ্টি করেননি,এমন দাবি করেনা। তবে তা দেখায় যে, আমাদের মনে জীবন নামক অসামান্য উপহারের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দায়িত্বের ধারণাটি, এই প্রসঙ্গে কোন অর্থ বহন করেনা। এর মানে এই নয় যে আমাদের ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কোন দায়িত্ব থাকতে পারে না, বরং অস্তিত্বদানের ব্যাপারটি যে কোন অবস্থাতেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সপক্ষে কোন যুক্তি হতে পারে না, তা দেখানোই এই যুক্তির মূল উদ্দেশ্য। ঈশ্বরের প্রতি যদি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয় তাহলে সেক্ষেত্রে আমাদের অস্তিত্বশীল হবার পর ঈশ্বর আমাদের অনেক হিতসাধন করেছেন বলে যে ধারণা করা হয়, একজন ঈশ্বরবিশ্বাসীর উচিত এই বিষয়টিকেই যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা।

ধরা যাক, ঈশ্বরবিশ্বাসীগণ স্বীকার করে নিলেন যে অস্তিত্ব প্রদানের জন্য কৃতজ্ঞতা বোধের বিষয়টিতে অসংলগ্নতা রয়েছে। এর পরিবর্তে তারা প্রতিটি মুহূর্ত, দিনের পর দিন কিংবা বছরের পর বছর ধরে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখায় ঈশ্বরের যে ভূমিকা রয়েছে,এই বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আনলেন। ব্যাপারটিকে যদি আমরা বদান্যতা হিসেবে ধরে নিই, তাহলে নিশ্চিতভাবেই কৃতজ্ঞতা বোধের সুযোগ রয়েছে, এবং নৈতিকভাবে হয়তো এই বোধের প্রয়োজনও রয়েছে।
কিন্তু আবারও এই ধরণের চিন্তাধারা খুবই দূর্বল বলে প্রতীয়মান হয়। যদিও বেশিরভাগ মানুষের বেঁচে থাকার প্রবল আশা প্রমাণ করে যে, তারা বিশ্বাস করে মরে যাবার চেয়ে বেঁচে থাকা অনেক শ্রেয়তর, তবে এক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা বোধ সঠিক অনুভূতি কিনা সে বিষয়ে আমরা প্রশ্ন তুলতেই পারি। অনেকের জীবনই দুঃখ কষ্টে পরিপূর্ণ, যেখানে ঈশ্বর ইচ্ছে করলেই জীবনের এই ক্ষতিকর দিকগুলো প্রতিরোধ করতে পারতেন। এই পরিস্থিতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করাকেই সঠিক অনুভূতির প্রকাশ বলে প্রতীয়মান হয়। যদি ঈশ্বর মূল্যবান কোন কিছু দান করেও থাকেন, তাহলে তার পক্ষে আরও অনেক গুণ বেশি মূল্যবান কোন কিছু দেওয়া সম্ভব ছিল। তাই এক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা বোধ সঠিক অনুভূতি কিনা তা পরিষ্কার হলনা।
উপকৃত ব্যক্তির কৃতজ্ঞতা বোধের যথার্থতা শুধুমাত্র উপকৃত হবার প্রক্রিয়ার উপরই নির্ভর করেনা, একই সাথে উপকারী ব্যক্তি এক্ষেত্রে যে পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করেছেন তার উপরও নির্ভর করে। সুতরাং, এক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি যিনি আমাদের হিতসাধনে কোন ত্যাগ স্বীকার করেননি, বরংচ যিনি একইভাবে কোন ত্যাগ স্বীকার না করে আরও অনেক বেশি উপকার করতে পারতেন তার প্রতি আমাদের কতটুকু কৃতজ্ঞতাবোধ থাকা উচিত এ বিষয়টি ধোঁয়াশার মধ্যেই থেকে গেল। এই যৌক্তিক চিন্তাটি যে শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী(যেমন-অন্ধ) হয়ে জন্ম নেওয়া একজন ব্যক্তির মনে আসতে পারে তা কিন্তু নয়, একইসাথে দুঃখভারাক্রান্ত জীবনের অধিকারী যে কারোরই একই অনুভূতি হতে পারে।
তারপরও আমরা ধরে নিলাম যে, ঈশ্বর আমাদের জন্য অনেক হিতকর কাজ করেছেন এবং কৃতজ্ঞতা একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া যা নৈতিকতার সাথে সংগতিপূর্ণ। এর ফলে যা প্রতীয়মান হয় তা হল, আমাদের নৈতিক দায়িত্বগুলোর কিছু অংশ ঈশ্বরের অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অস্তিত্বহীন কারো প্রতি আপনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দায়িত্ব থাকতে পারেনা। কিন্তু এই বক্তব্যটি নৈতিকতা যে ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে তা প্রমাণ করতে অসমর্থ । প্রথমত, ‘যদি ঈশ্বর আমাদের হিতসাধন করে থাকেন, তবে তাঁর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দায়িত্ব রয়েছে’, বক্তব্যটি কোন অবস্থাতেই ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে কোন যুক্তি হতে পারেনা। ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মূল দাবিটি ঈশ্বরের অস্তিত্ব রয়েছে বলে পূর্বানুমান করে বসে আছে, কিন্তু তা এমন কোন যুক্তি দেখাতে পারছে না যার ফলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব রয়েছে বলে আমাদের মনে ধারণার জন্ম দেয়। দ্বিতীয়ত, ঈশ্বরের প্রতি দায়িত্ব পালনের ফলে তার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় এবং কোন ধরণের নৈতিকতা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করে- এ দুটি বক্তব্যও ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে কোন যুক্তি প্রদানে অসমর্থ।
একজন ঈশ্বরবিশ্বাসী সর্বসাকুল্যে যে দাবিটি করেছেন তা হল, ‘আপনি যদি কারো দ্বারা উপকৃত হোন তাহলে কৃতজ্ঞতাবোধ, নৈতিকতার সাথে সংগতিপূর্ণ একটি প্রতিক্রিয়া’। তিনি এমন কোন যুক্তি দেখাতে পারেননি যা প্রমাণ করে নৈতিকতা ঈশ্বর থেকে আগত কিংবা ঈশ্বর যদি ভিন্ন ইচ্ছা পোষণ করতেন তাহলে হিতসাধনের বিপরীতে বিদ্বেষ প্রকাশ কিংবা ভাবলেশহীনতা নৈতিকতার সাথে সংগতিপূর্ণ প্রতিক্রিয়া হিসেবে পরিগণিত হত। অন্যভাবে বলা যায়, বিষয়টি এমন একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয় যেখানে নৈতিক গুণগুলোর ঈশ্বর ব্যতিরেকে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান রয়েছে, হয়ত ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকলেও তারা অস্তিত্বশীল থাকতে পারে এবং ঈশ্বরকে না জানা গেলেও তাদেরকে জানা যেতে পারে।

আমাদের নৈতিক গুণগুলো কি ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত?

নৈতিকতা সম্পর্কে একটি প্রচলিত ধারণা হল যে, এটি ঈশ্বরের আদেশের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে। এই তত্ত্বমতে, মানুষ হত্যা করা কিংবা কারো সাথে প্রতারণা করার মতো কাজগুলো খারাপ যেহেতু ঈশ্বর এগুলোকে খারাপ কাজ হিসেবেই অভিহিত করেছেন। বক্তব্যটিকে আপাতদৃষ্টিতে সোজাসাপ্টা মনে হলেও এর ফলে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বক্তব্য উপস্থাপিত হয়।

১। ঈশ্বরপ্রদত্ত বিধানসমূহ আমাদেরকে ভাল ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য শেখায়।

২। ঈশ্বর কিছু কাজকে বৈধ এবং কিছু কাজকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন(ঈশ্বর যদি ভিন্ন ইচ্ছা পোষণ করতেন তাহলে তিনি ভিন্ন যেকোন কাজকে বৈধতা দিতে পারতেন কিংবা অবৈধ ঘোষণা করতে পারতেন)।

প্রথম বক্তব্যটি থেকে শুরু করা যাক। বক্তব্যটিকে বিশ্লেষণ করলে মর্মার্থ যা দাঁড়ায় তা হল, সীমাবদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী মানুষ এ মহাবিশ্বে নিয়ত চলমান ঘটনাবলী কিংবা বস্তুজগত সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান আহরণে অনেক ক্ষেত্রেই অপারগ। ঠিক একইভাবে, নৈতিকতা সম্পর্কিত যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণেও মানুষ অনেক ক্ষেত্রে ভুল করে বসে। তাই এক্ষেত্রে অসীম জ্ঞানের অধিকারী ঈশ্বরের প্রণীত বিধানসমূহ অনুসরণ করাই যুক্তিযুক্ত। সুতরাং, ধর্মগ্রন্থে প্রণীত ঐশ্বরিক বিধানসমূহ অনুসরণ ব্যতীত নৈতিকতা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়।

কিন্তু এই বক্তব্যের ফলে কোন অবস্থাতেই প্রমাণিত হয় না যে, নৈতিকতা ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট। বরংচ, তা ভিন্ন একটি ব্যাখ্যা প্রদান করে। আপনাকে যদি কোন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হয়, তাহলে সে বিষয় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান আহরণের জন্য নূন্যতম যে যোগ্যতা প্রয়োজন, তা আপনার মাঝে থাকতে হবে। এটি জ্ঞান আহরণের অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এ মহাবিশ্বের বাইরে কি রয়েছে, বা আদৌ কোন কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে কিনা তা এই মূহুর্তে মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়, যেহেতু তা মানুষের পরীক্ষণ ক্ষমতার বাইরে। এর ফলে প্রতীয়মান হয় যে, কোন বস্তু কিংবা বিষয়াদি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে একে পরীক্ষণ করা ব্যতীত অন্য কোন উপায় নেই। এক্ষেত্রে পরীক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট বস্তু বা বিষয়ের স্বকীয় অস্তিত্ব থাকা জরুরী। যেকোন বিষয়াদি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান আহরিত হয়েছে কিনা, তা বুঝতে হলে অর্জিত জ্ঞানকে আবার যাচাইকরণের প্রয়োজন রয়েছে। কাল্পনিক বস্তু সম্পর্কিত ধারণাকে কোন অবস্থাতেই জ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। যেহেতু তা ব্যক্তিমনের কল্পনার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে, সুতরাং তার অস্তিত্বও ব্যক্তিনির্ভর। ফলে, একে স্বতন্ত্রভাবে যাচাইকরণের কোন সুযোগ থাকে না। আপনি যদি কোন বস্তু অস্তিত্বশীল রয়েছে বলে দাবি করেন, তাহলে আপনাকে আপনার দাবির সপক্ষে বস্তুটির অস্তিত্বের বাস্তবিক প্রমাণ হাজির করতে হবে, যেন অন্যরা তা যাচাইকরণের সুযোগ পায়। এক্ষেত্রে বস্তুটির অস্তিত্ব আপনার চিন্তাধারা বা বিশ্বাসের উপর কেবলমাত্র নির্ভরশীল হলে চলবে না, এর স্বকীয় অস্তিত্ব থাকতে হবে। ফলে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে কেবলমাত্র ব্যক্তিগত চিন্তাধারা বা বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল হয়ে কোন বস্তু অস্তিত্বশীল থাকতে পারেনা এবং সংশ্লিষ্ট বস্তু সম্পর্কিত ধারণাকেও জ্ঞানের শাখা হিসেবে বিবেচনা করা যাবেনা। সুতরাং প্রথম ব্যাখ্যামতে, ঈশ্বর তখনই নৈতিক জ্ঞানের অধিকারী হতে পারবেন যখন নৈতিক গুণগুলোর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকবে। অপরদিকে যেহেতু নৈতিকতার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে, ফলে যেকোন নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ঈশ্বরের মুখাপেক্ষী হবার প্রয়োজন নেই। নৈতিকতার সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত বিষয়াবলী বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, ঈশ্বরের অস্তিত্ব যদি নাও থাকে তারপরও সমাজে কোন ধরণের নির্যাতনকে অনৈতিক হিসেবে গণ্য করা হবে এবং দয়ালু মনোভাবকে গ্রহনযোগ্য আচরণ হিসেবে গ্রহণ করা হবে।

দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, নৈতিকতা স্বকীয়ভাবে অস্তিত্বশীল নয়। বরংচ ঈশ্বর তাঁর ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে এদেরকে সৃষ্টি করেছেন। কোন কাজটি আমাদের করা উচিত কিংবা কোন কাজটি বর্জন করা উচিত তা ঈশ্বরই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ঈশ্বর কোন একটি কাজ পূর্ববর্তী কোন ঘটনার দরুণ ভাল কিংবা খারাপ হয়েছে তা বলেন না, বরং সেই কাজটিকে সৃষ্টির সময়েই ভাল কিংবা খারাপ হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এটি অনেকটা সংসদীয় আইনের মতো যেখানে পূর্ববর্তী কারণ ব্যাখ্যা না করেই বিভিন্ন কাজসমূহকে বৈধতা দেয়া হয় কিংবা অবৈধ ঘোষণা করা হয়। সুতরাং, অকাট্যভাবে সঠিকতা কিংবা ভুলের কারণ ব্যাখ্যা করার পরিবর্তে ঈশ্বরের বিধান অনুসারেই নির্ধারিত হবে একটি কাজ সঠিক নাকি ভুল।

কিন্তু আমরা যখনই এই ব্যাখ্যার দরুণ সৃষ্ট ফলাফলসমূহ অনুসন্ধান করতে যাই, তখনই কিছু জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়।

প্রথমত, যদি ‘ভাল’ এবং ‘মন্দ’ ঈশ্বর কর্তৃক নির্ধারিত হয়ে থাকে, তবে ঈশ্বরকে ভাল হিসেবে চিহ্নিত খুবই দুর্বল একটি যুক্তিতে পরিণত হবে। এটা অনেকটা হিটলার ফুয়েরার হিসেবে যেসব কাজ করেছেন, তার ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট আইন অনুসারে সেসব কাজকে বৈধতা প্রদান করার মতই। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, ঈশ্বর যদি আগামীকাল সকালে ঘোষণা করেন যে, হত্যা করা সঠিক কাজ এবং আমরা কোনভাবে জানতে পারি যে তিনি এমন ঘোষণা দিয়েছেন তাহলে আমাদের মনে এমন ধারণা জন্মাবে না যে হত্যা করাটা সঠিক কাজ। বরংচ আমরা বলব, ‘ঈশ্বরও শেষ পর্যন্ত খারাপ হয়ে গেলেন, কী লজ্জাজনক ব্যাপার’! যেহেতু গতকালের মতো আজও হত্যা করাটা একটি খারাপ কাজ হিসেবে বিবেচিত। এই বিরুদ্ধমতকে কি এই বলে ভ্রান্ত দাবি করা যেতে পারে যে, ‘ঈশ্বর এ ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বলে চিন্তা করাটা হাস্যকর। ঈশ্বর কোন অবস্থাতেই হত্যাকে সঠিক বলে ঘোষণা করতে পারেন না’। কিন্তু এ দাবিটিকেও গ্রহণযোগ্য হিসেবে মেনে নেওয়া কঠিন। ঈশ্বর কেন এ ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন না? যদি বলা হয়, ঈশ্বর সংজ্ঞাগত কারণেই নৈতিক এবং কোন ধরণের মন্দ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন না তবে দেখা যাচ্ছে আমরা আবার আগের কথায় ফিরে যাচ্ছি, যেহেতু এই বক্তব্যটির ফলে প্রতীয়মান হয় যে, হত্যা করা সার্বজনীনভাবে মন্দ কাজ হিসেবে বিবেচিত। এটি ঈশ্বরের আজ্ঞাধীনে মন্দ কাজ হিসেবে নির্ধারিত হয়নি এবং ঈশ্বরের মতো একজন নৈতিকভাবে পরিশুদ্ধ ব্যক্তির পক্ষে এমন কাজ করা সম্ভব নয়। ঈশ্বরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পূর্বে হত্যা করাকে যদি নিরপেক্ষভাবে নৈতিক হিসেবে আমরা ধরে নেই, তবে ঈশ্বরের পক্ষে কেন হত্যাকে বৈধ হিসেবে ঘোষণা করা সম্ভব হবে না? একই সাথে ঈশ্বরের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সীমাবদ্ধতা ঈশ্বরের আরেকটি সংজ্ঞাবাচক বৈশিষ্ট্য ‘সর্বশক্তিমান’ এর সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।

দ্বিতীয়ত, এই ব্যাখ্যার ফলে ঈশ্বরকে নৈতিকভাবে পরিশুদ্ধ হিসেবে মেনে নেওয়াটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। প্রচলিত ধারণামতে, নৈতিক পরিশুদ্ধতা একটি বাস্তব গুণ এবং এই গুণের অধিকারী ব্যক্তিমাত্রই প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার। কিন্তু নৈতিকতা যদি ঈশ্বরের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয় তাহলে বলতে হয় ঈশ্বরের নৈতিক পরিশুদ্ধতার পরিমাণ নির্ভর করে ‘ঈশ্বর নিজে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন কিনা’ তার উপর । ‘ঈশ্বর যেন সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন’-এরূপ প্রার্থনা করা থেকে হয়ত আমরা নিজেদেরকে বঞ্চিত করেছি।

তৃতীয়ত, নৈতিকতার স্বকীয় অস্তিত্ব স্বীকারকারী একজন ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়তো দাবি করতে পারেন যে, ঈশ্বর একই সাথে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন এবং নৈতিকতা সংক্রান্ত বিধানগুলো অর্পণ করেছেন। কিন্তু তার মানে কি এই যে, শুধুমাত্র নৈতিক বিধানগুলো বদলে দিয়ে ঈশ্বর একই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতে পারতেন? এমনটা যদি হয় তাহলে, মহাবিশ্বে ঘটিত অনৈতিক কাজগুলো প্রতিরোধে এই নবসৃষ্ট নৈতিক বিধানগুলো কোন ভূমিকা রাখতে পারত না। এক্ষেত্রে স্বকীয় কোন নৈতিকতার অস্তিত্ব থাকতো না এবং ঈশ্বর কর্তৃক স্বেচ্ছাচারী নৈতিক বিধান অর্পণের সাথে এই নবসৃষ্ট বিধানগুলোর কি পার্থক্য থাকতো? বরংচ, নৈতিক বিধানগুলো যদি এই মহাবিশ্বে ঘটমান অনৈতিক ঘটনাবলীর প্রতিরোধেই তৈরি হয়ে থাকে, তবে নৈতিক বিধানের উৎস অনুসন্ধানের জন্য ‘ঈশ্বর’ নামক অনুকল্পের কোন প্রয়োজন আমাদের নেই।

রেফারেন্সঃ
১। Atheism Explained From Folly to Philosophy : DAVID RAMSAY STEELE
২। ATHEISM: The Case Against God : George H. Smith
৩। THE NON-EXISTENCE OF GOD : Nicholas Everitt
৪। THE TWILIGHT OF ATHEISM : Alister McGrath
৫। The Atheist’s Bible : conceived and edited by Joan konner