বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম তথ্য অনুযায়ী ‘চট্টগ্রাম নগরীর বন্দর থানার গোসাইলডাঙ্গা এলাকায় ১১ সেপ্টেম্বর,১০ শনিবার রাতে শ্রী শ্রী শ্মশান কালীবাড়ি মন্দিরে ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, মন্দির সংলগ্ন মুসলমান পাড়ার মো. মাসুদের নেতৃত্বে ৫/৬ জন তরুণ মন্দিরের লোহার গেট ও কাঠের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে শিবলিঙ্গ, ঘট, নারায়ণ মূর্তি ও আসবাবপত্র ভাংচুর করে। রাত পৌনে ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে বলে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী জানায়’।

অনেকদিন পর বাংলাদেশে এমন সাম্পদায়িক একটি ঘটনা ঘটল। কাকতালীয়ভাবে ঘটলেও এক ঐতিহাসিক তারিখেই ঘটল। আসলে কাকতালীয় কি?

উল্লেখ্য যে, ঘটনার রাত ৯/১১। বিশ্বব্যপী ঐতিহাসিক তারিখ। উপরন্তু, আমরা সবাই জানি যে ‘ডোভ ওয়ার্ল্ড আউটরিচ সেন্টার’ নামক ছোট্ট এক গির্জার যাজক টেরি জোনস ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ারে আল কায়েদার সন্ত্রাসী হামলার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক কোরান পোড়ানো দিবস’ হিসেবে পালন করার ঘোষণা দেন। এদিন কোরানের ২০০ টি কপি পোড়ানোর পরিকল্পনা করেন জোনস। কিন্তু বিশ্বব্যাপী নিন্দা-সমালোচনার মুখে তিনি আপাতত এ পরিকল্পনা বাতিল করলেন।

অনেকে ঘরের বাইরে কারও সাথে ঝগড়া করে না পারলে নিজেদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে ঘরে এসে নিরীহ স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের মারধোর করেন। মা বাবার মার খেয়ে ছেলেমেয়েদের উপর ঝাল ঝাড়েন। এটা কি এরই বহিঃপ্রকাশ?

আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৪ হল জাতীয় স্মৃতিনিদর্শন প্রভৃতি ।
ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে—-
‘’বিশেষ শৈল্পিক কিংবা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বা তাৎপর্যমন্ডিত স্মৃতিনিদর্শন। বস্তু বা স্থানসমূহকে বিকৃতি, বিনাশ ও অপসারণ হইতে রক্ষা করিবার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’’
প্রথমত, প্রশ্ন হল লোহার গেট ও কাঠের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে শিবলিঙ্গ, ঘট, নারায়ণ মূর্তিসহ শ্রী শ্রী শ্মশান কালীবাড়ি মন্দিরটি ’বিশেষ শৈল্পিক কিংবা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বা তাৎপর্যমন্ডিত স্মৃতিনিদর্শন’ কি না। যদি হয় তবে তা ধ্বংসে জন্য মাসুদ এন্ড গং এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ আনা উচিত।
দ্বিতীয়ত, অনুচ্ছেদ ৪১ হল ধর্মীয় স্বাধীনতা।
আর ৪১ এর ১ এতে বলা হয়েছে আইন, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে –
(খ) ‘’প্রত্যেক ধর্মীয় সম্পদায় ও উপ- সম্পদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে।’’
কাজেই এখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে নিঃসন্দেহে।
এ প্রসঙ্গেও মাসুদ এন্ড গং এর বিরুদ্ধে সংবিধান লংঘনের অভিযোগ আনা যায়।

এ অঘটনে দুটি আশার খবর পাওয়া যায়। একটি হল, দুর্ঘটনার পর এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার লোক তাৎক্ষণিকভাবে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করে। আশার খবর এজন্য যে ইতোপূর্বে এমন অঘটনের পর দেখা যেত হিন্দু সম্প্রদায় নিজেদের গুটিয়ে রাখত। প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের সাহস খুবই কম দেখাত।
আরেকটি আশার খবর হল, ঘটনার পরপরই বন্দর থানার ওসি রেজাউল করিম ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ঘটনাস্থলে যান এবং ওসি রেজাউল করিম বলেন, এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যা ২০০১ এক সালে দেখা যায়নি।

তবে এ ঘটনার প্রভাব কিন্তু সুদূর প্রসারী। ঐ মন্দিরের আশেপাশে হিন্দু ধর্মালম্বীদের মধ্যে দেশ ত্যাগের প্রবণতা দেখা দেবে। বাংলাদেশের অন্য এলাকার হিন্দুরা যারা খবরটি পড়বে তারা নতুন করে আতংকিত হবে ও দেশ ত্যাগের পরিকল্পনা চলবে। এ আতংক ভূমিকম্পের চেয়ে কম নয়। আগেও হয়ত ছিল। তবে এ ঘটনাও এতে ইন্ধন যোগাবে। সেই কবি জসীমউদ্দীনের সময় থেকেই হিন্দুদের দেশ ত্যাগ নীরবে অব্যাহত রয়েছে। কবি লিখেছিলেন —
গীতারা কোথায় গেলো,
আহা সেই পুতুলের মতো রাঙা টুকটুকে মেয়ে।
দেখলে তাহারে মায়া মমতার ধারা বয়ে যায়
সারা বুকখানি ছেয়ে,
———————-
ওদের গ্রামের চারিদিক বেড়ি ঘিরেছে দস্যুদল,
ঘরে ঘরে তারা আগুন জ্বালায়ে ফুকারে অগ্নিকল।

——————————-
আহারে আমার ছোট গীতামণি,
তোর তরে আজ কেঁদে ফিরি সবখানে,
মোর ক্রদন নিঠুর দেশের সীমানা পেরিয়ে
পারিবে কি যেতে কোন দরদীয় কানে।
মন্দির ভাঙ্গা, হিন্দুমেয়েকে ধর্ষণ করা, জমি দখল এমন ঘটনায় দেশ ত্যাগকে আরও উসকে দেয় মাত্র।