বিশ্লেষণ

ইমরান মাহমুদ ডালিম

এক

জামার বোতাম লাগাতে লাগাতে মহিম আযনার দিকে তাকাল।আয়নাটা বহুদিনের পুরনো।জ়ায়গায় জায়গায় ধূলোর আস্তরণ পড়েছে।বেশ কিছুদিন এটি পরিষ্কার করা হয়নি।প্রতিদিন-ই আয়নাটা পরিষ্কার করার কথাটা ভাবে সে;প্রচন্ড ব্যস্ততায় দিন কাটছে আজকাল,কোন কিছুতেই আর আগের মত আগ্রহ পায় না,সময়ও হয়ে উঠে না।একটা পুরনো ন্যাকড়া এনে আয়নাটি পরিষ্কার করতে থাকে মহিম।চিটচিটে দাগ পড়েছে এখানে-ওখানে।সজোড়ে জায়গাগুলো ঘষতে থাকে সে।বেশ কিছুক্ষণ ঘষার পর বিরক্তিতে মনটা ভরে যায় তার। কেন,রেনু সারাটাদিন বাসায় কী করে!রেনুর কথা মনে হতেই বিরক্তিটা শতগুনে বেড়ে যায় তার।বিরক্তিভরা কন্ঠেই রেনুকে ডাক দেয় সে।রেনু যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল।ঠিক একই রকম বিরক্তিভরা কন্ঠে পাশের ঘর থেকে সে-ও উত্তর দেয়, কি ব্যাপার,তুমি এখনও অফিসে যাও নি!ডাকাডাকি করছ কেন?

কোন পাত্তা-ই দিল না!মহিম এর বিরক্তিটা হঠাৎ চরমে উঠে যায়।মাথার চারিপাশ যেন জ্বলতে থাকে তার।প্রায় দৌড়িয়ে ওপাশের ঘরে প্রবেশ করে সে।রেনু ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিল।মহিম প্রায় চেচিয়ে বলে উঠল, ওই মাগী ডাকলে আসিস না কেন?তরে কে ডাকলে তুই—
মহিম কথা শেষ করতে পারে না।রেনু তার কথার কোন গুরুত্ব দিচ্ছে না।চুপচাপ ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে।বিরক্তি নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে।

দুই

দুপুরে রেনুর ফোন আসে।রিসিভ করবে না ঠিক করেও ফোনটি রিসিভ করে মহিম।রেনু স্বাভাবিক,যেন কিছু হয় নি,শীতল কন্ঠে বলে,মহিম বাসায় আসার সময় কিছু তরকারী কিনে এনো।

মহিমের রাগটা আবার মাথচাড়া দিয়ে উঠে।কিন্তু রাগ কয়েক সেকেন্ডের বেশী স্থায়ী হয় না।সেই সাথে একটা ঝিম-ধরা ভাব আসে সারা শরীর জুড়ে।উত্তরে শুধু হুঁ হাঁ বলে সে। এবার রেনু যেন কী বলে,মহিম শুনতে পায় না।অন্যমনস্ক হয়ে ফোন লাইন কেটে দেয় সে।অথচ কী একটা চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খাছিল,লাইন কেটে দেয়ার পর,মনে পড়ে না তার।

পাশের ডেস্ক থেকে সাদাত উঠে আসে।দুপুরে খাওয়ার জন্য কেন্টিনে যাচ্ছে সে।সাদাতকে মহিম তেমন পছন্দ করে না।কেন করে না তার কোন সুনির্দিষ্ট কারণ নেই।তারপরও এই লোকের সাথেই মহিমের উঠা-বসা সবচেয়ে বেশী।সাদাত মহিমের কাঁধে চাপড় মেরে বলে, চলুন খেয়ে আসি।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মহিম উঠে দাড়াল।আর ঠিক তখন-ই শরীর টা কেমন করে উঠল তার।সামনের দিকটা হঠাৎ দুলে উঠল যেন।অন্ধকার হয়ে গেছে চারপাশ।একটা চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ উঠল যেন সবখানে।মেঝেতে পড়ে গেল সে।তার মনে হল বড় ধরণের একটা স্ট্রোক করতে যাচ্ছে সে।

তিন

জ্ঞান ফিরলে নিজেকে একটা হাসপাতালের ফ্লোরে আবিষ্কার করে মহিম।লম্বা একটা করিডোরের একপাশে আরো অনেকের সাথে শুয়ে আছে সে।প্রায় সবাই চেঁচাচ্ছে।সাদা এপ্রোন পড়া কিছু লোক খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে ছুটাছুটি করছে।মহিম প্রথমে বুঝতে পারে না তার কী হয়েছে।তারপর কারো কারো কথা শুনতে পায় সে।শহরে একটা মারাত্মক ভূমিকম্প হয়েছে।ক্যাজুয়ালিটি হয়েছে অগনিত।হাসপাতালের অনেকখানি ধ্বসে পড়েছে।হঠাৎ পায়ের দিকটা থেকে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করে সে।

চার

চোখ মেলতেই কতগুলো পরিচিত মুখকে দেখতে পায় সে।মা-কে দেখতে পায়।মা রোগা হয়ে গেছে অনেক।কিন্তু মাকে এত অসুস্থ লাগছে কেন!অনেক বেশী পাংশু লাগছে তার মুখখানা।মহিমের মনে হয় সে বেঁচে নেই মনে করে মা হয়ত প্রচন্ড কান্নাকাটি করেছে।বাবাকে দেখতে পায় না মহিম।পায়ের দিকটা থেকে চিনচিনে ব্যথা উঠছে।রেণু পাশে দাঁড়িয়ে ছিল,যেন অসাড়,চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে।মহিমের হঠাৎ আশ্চর্‍য বোধ হয়।রেণুও কী তার জন্য কান্নাকাটি করেছে!কেন করেছে?রেণু কী তাকে ভালবাসে?কিন্তু রেণু তো তাকে বলেছে ওগুলো বাংলা সিনেমার ন্যাকামো।বাস্তব জীবন বড়ই কঠিন।মহিমের মেজাজটা যেন আবারো বিগড়ে উঠে।রেণু বাস্তবতার কী বুঝে!সে কী কামাই করে?সে কী সংসার চালায়?সে বাস্তবতার কী বুঝে।সে সিদ্ধান্ত নেয় রেণুকে এই কথাগুলো তার বলা দরকার।পরক্ষণেই তার মনে হয় এই পরিস্থতিতে কথাগুলো বলা ঠিক হবে না।তার মনে হয় সে কোন এক ট্রাজেডির নায়ক।এবং বেশ জোড়ের সাথেই তার কন্ঠস্বর আশপাশ জুড়ে ধ্বনিত হয়।মহিম বলে,মা বাবা মারা গেছে কখন?

প্রায় সাথে সাথে সে একটি কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়।মহিমের মনে হয় তার মা এত উচ্চৈস্বরে কখনো কাঁদে নি।তার মায়ের কান্না ছিল নিঃশব্দের মত, যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসা কোন এক জ়াহাজের সাইরেন,অস্পষ্ট।এই রকম একটি কান্নার স্বর মহিম এবার শুনতে পায়। সে পাশ ফিরে দেখে রেনু কাঁদছে।মহিম কান্নার এই বৈসাদৃশ্য দেখে আশ্চর্‍য বোধ করে।সে মারা গেলে রেনু কী তার মায়ের মত উচ্চৈঃস্বরে কাঁদত?

বাবার কথা মনে পড়ে মহিমের।কিন্তু কোন দুঃখ বোধ হয় না বলে সে আশ্চর্‍য হয়। তার মা এবার রেণুকে কী একটা ঈঙ্গিত করে বেরিয়ে যায়।রেনু চোখ মুছে।তারপর বাসার কাজের মেয়েটির নাম উল্লেখ করে।রেনু জানায় কাজের মেয়েটিকে তার বাবা বিয়ে করেছে।ভূমিকম্পের সমান ভূমিকম্পে তাদের সংসার উলট-পালট হয়ে গেছে।মহিমের হঠাৎ হাসি পায়।সে আস্তে করে রেনুকে বলে,তাতে তোর কী হয়েছে মাগী?

রেনু এবার চমকিত হয়ে মহিমের দিকে তাকায়।মহিমের কপাল কুঁচকে আছে।চোখ দুটো বন্ধ।মহিমের কথা বুঝে উঠতে পারে না সে।মনে মনে প্রচন্ড বিশ্লেষণ চলতে থাকে তার।