হাসানআল আব্দুল্লাহ
কবিতার উৎকৃষ্টতার জন্যে ছন্দ একমাত্র উপজিব্য না হলেও এটি যে প্রধানতম একটি দিক তা অস্বীকার করার উপায় নেই। শিল্প সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম, কবিতা, সৃষ্টির আদিযুগ থেকেই তাল লয় সুর ইত্যাদির সংমিশ্রণে ভাষার মালা হয়ে মানুষের মনে দোলা দিয়ে আসছে। অক্ষর ও শব্দের নানামুখি চালে এই মালা তৈরীর প্রক্রিয়া বা নিয়মই আদতে ছন্দ।
কালের বিবর্তনে, অতিক্রান্ত সময়ের সদ্ধিক্ষণে উৎকৃষ্ট কবিতা নির্মাণের জন্য বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে প্রায় সব ভাষার বিশিষ্ট কবিরা তৈরি করেছেন সুনির্দিষ্ট ও সুবিন্যস্ত নিয়ম। বাংলা কবিতাকেও অন্যান্য ভাষায় রচিত কবিতার মতো বাঁধা হয়েছে ছন্দের শৃঙ্খলে। আর এক পর্যায়ে ভেঙেও দেয়া হয়েছে সেই শৃঙ্খল, কিন্তু ভাঙার সেই প্রক্রিয়াও তৈরী করেছে নতুন ধ্বনি মাধুর্য।
ইট তৈরির কথা দিয়েই শুরু করা যাক। প্রথমেই প্রয়োজন উৎকৃষ্ট মাটির। মাটিকে আবর্জনা মুক্ত করে স্বচ্ছ পানি মিশিয়ে হাত দিয়ে বা মেশিনের সাহায্যে বারবার নেড়ে চেড়ে নরম করার প্রয়োজন পড়ে। তারপর এই মাটিকে ফর্মার মধ্যে ফেলা হয়। ফর্মায় মাটি ঠিক মতো পুরতে পারলেই মাটি আর মাটি থাকে না, ইটে পরিণত হয়। এখানেই শেষ নয়, এই নরম ইটকে শক্ত করার জন্য উচ্চ তাপে দগ্ধ করা হয়। লক্ষণীয় যে, নরম মাটিকে হাত দিয়ে পিটিয়ে বা মেশিনে নেড়ে চেড়েই ইটের রূপ দেয়া যায় না। দরকার একটি ফর্মা যা কিনা মাটিকে সুন্দর একটি ইটের আকার দিতে পারে।
কবিতার প্রসঙ্গেও একই রকম ভাবে বলা যায়, প্রথমেই প্রয়োজন সুন্দর একটা বিষয়। যদিও যে কোনো বিষয়েই উৎকৃষ্ট কবিতা তৈরীর প্রমাণ যথেষ্ট রয়েছে, তথাপি কবিতা লেখার শুরুর দিকে বা তরুণ কবিদের ক্ষেত্রে বিষয়ের গুরুত্ব অবহেলা করা যায় না। বিষয় স্পষ্ট হলে, তাকে ভাষায় রূপ দেয়ার জন্য দরকার শব্দ। বিষয় ও শব্দের একত্র মেলবন্ধনে গঠিত হয় কবিতার ভাব, যা ইট তৈরির পূর্বের ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করে। এখন প্রয়োজন ফর্মার। কবিতার ক্ষেত্রে এই ফর্মাই হলো ছন্দ। বিষয় এবং শব্দকে যদি নির্দিষ্ট ছন্দের মধ্যে গ্রন্থিত করা যায় তবে অন্তত দগ্ধ করার আগে কাঁচা ইটের মতো মোটামুটি একটা কবিতা দাঁড়িয়ে যায়। তারপর একে পরিপক্ক করার জন্য প্রয়োজন হয় উপমা, অনুপ্রাস, চিত্রকল্প ইত্যাদির। তাই, প্রথমে অন্তত সাধারণ ভাবে একটা কবিতা দাঁড় করার জন্য ছন্দের প্রয়োজনীয় দিকের প্রতি দৃষ্টি দেয়া যাক।
ছন্দের ভেতরে প্রবেশের আগে জানা দরকার শব্দের শরীর। আবার শব্দের শরীর সম্পর্কে জানতে হলে সর্বাগ্রে জানা দরকার স্বর বা ধ্বনি। স্বর জানার পর শব্দের শরীর অনেকাংশে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বাংলা স্বর বা ধ্বনিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
১. বদ্ধস্বর
২. মুক্তস্বর
বদ্ধস্বর:
যে সব ধ্বনি উচ্চারণের সময় জিভ মুখের প্রবহমান বাতাসকে আটকে দেয় তাদের বদ্ধস্বর বলা হয়। যেমন : কর, ধর, হায়, পাক, আঁক, ঝাঁক, থাক, দিন, বীন, হই, ইত্যাদি।
মুক্তস্বর:
যে সব ধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখের প্রবহমান বাতাস জিভের কোনো বাধা ছাড়াই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে তাদের মুক্তস্বর বলে। যেমন: হা, না, কা, চা, দি, দা, বা, বু ইত্যাদি।
এবার শব্দের শরীর প্রসঙ্গে আলোচনায় ঢোকার শুরুতেই বেছে নেয়া যাক “করলাম” শব্দটিকে। স্পষ্টত এটি দু’টি স্বর দিয়ে গঠিত। প্রথমটি ‘কর’ এবং দ্বিতীয়টি ‘লাম’। উপরে প্রদত্ত বদ্ধ এবং মুক্ত স্বরের সংজ্ঞানুসারে ‘কর’ এবং ‘লাম’ উভয়েই বদ্ধস্বর। তাহলে বলতে পারি “করলাম” শব্দটির শরীর দু’টি মাত্র বদ্ধস্বর দিয়ে গঠিত।
এবার “সঙ্গোপনে” শব্দটি গ্রহণ করা যায়। এ শব্দটি চারটি স্বর দিয়ে গঠিত সং, গো, প, এবং নে,। এটা স্পষ্ট, সং, বদ্ধস্বর এবং গো, প, ও নে এরা প্রত্যেকটিই মুক্তস্বর। অর্থাৎ সং উচ্চারণের সময় জিভ মুখের প্রবহমান বাতাসকে আটকে দেয় কিন্তু গো, প এবং নে উচ্চারণে জিভ সেটা করতে পারে না, ফলে মুখের ভেতরের বাতাস অনায়াসে বেরিয়ে আসে।
ছন্দের মূল আলোচনায় আসার আগে আরো একটি দিকে লক্ষ্য করা প্রয়োজন। তা হলো “মাত্রা”। স্বর জানার পর মাত্রা সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান অর্জন সহজতর হবে।
বাংলা কবিতার সব ছন্দেই একটি মুক্তস্বর, সে যে অবস্থানেই থাকুন না কেনো, একটি মাত্র মাত্রা বহন করে।
কিন্তু সমস্যা হলো বদ্ধস্বর নিয়ে। একটি বদ্ধ স্বর কখনো একটি আবার কখনো দু’টি মাত্রা বহন করে। অতএব পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনার মাধ্যমে বুঝে নেয়া দরকার বদ্ধস্বর কোন অবস্থায় একটি এবং কোন অবস্থায় দু’টি মাত্রা বহন করে। অবশ্য তার আগে জানা চাই ছন্দের প্রকার ভেদ।
বাংলা কবিতার ছন্দ প্রধানত তিন প্রকার।
১. স্বরবৃত্ত ছন্দ
২. মাত্রাবৃত্ত ছন্দ
৩. অক্ষরবৃত্ত ছন্দ
স্বরবৃত্ত ছন্দ:
স্বরবৃত্ত ছন্দে বদ্ধস্বর এক মাত্রা বহন করে। কোনো অবস্থাতেই এ ছন্দে বদ্ধস্বর দু’মাত্রা বহন করতে পারে না। তাছাড়া মুক্তস্বরের মাত্রা এক।
কবিতার পঙ্ক্তি দিয়ে বিবেচনা করা যাক।
১. মামার বাড়ি আর যাবো না আর খাবো না মামীর গাল,
কথায় কথায় পড়বে না আর আমার পিঠে অমন তাল।
এখানে প্রতি পঙ্ক্তিতে তিনটি করে পর্ব এবং একটি করে অতিপর্ব আছে। প্রত্যেক পর্বে সমান সংখ্যক মাত্রা আছে এবং লক্ষ্য করলে দেখা যাবে অতিপর্ব পর্ব থেকে কম সংখ্যক মাত্রা ধারণ করেছে। ছন্দ বিন্যাস করলে দেখা যায়,
মামার বাড়ি/ আর যাবো না/ আর খাবো না/ মামীর গাল,
কথায় কথায়/ পড়বে না আর/ আমার পিঠে/ অমন তাল।
স্বরের উপরে লম্বা দাগগুলো মাত্রা চিহ্ন নির্দেশক। মুক্ত স্বরের উপরে শুধু একটি দাগ দিলেও বদ্ধস্বর বোঝাতে চাঁদের মতো চক্র রেখা এঁকে তার উপরে মাত্রা চিহ্ন দেয়া হয়েছে। প্রতি লাইনে আড়াআড়ি দাগ কেটে পর্ব নির্দেশ করা হয়েছে।
পর্ব, অতিপর্ব ও উপপর্ব:
কবিতার প্রতিটি লাইনে সমমাত্রার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশই হলো পর্ব। পঙ্ক্তি শেষের পর্বাংশকে অতিপর্ব বলা হয় যার মাত্রা সংখ্যা পর্বের মাত্রা সংখ্যা থেকে সর্বদাই কম। এ ধরনের পর্বাংশ লাইনের শুরুতে থাকলে আমরা তাকে উপপর্ব বলে চিহ্নিত করবো।
উপরে প্রদত্ত উদাহণের ছন্দ বিন্যাস লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, প্রতিটি পর্বের মাত্রা সংখ্যা চার, এবং অতিপর্বের মাত্রা সংখ্যা তিন। এই কাব্যাংশে কোনো উপপর্ব নেই।
যদি কবিতাটি সম্পূর্ণ করার প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে প্রতিটি বর্ধিত লাইনেও উপরের লাইনগুলির সমান সংখ্যক পর্ব একই মাত্রায় রাখতে হবে, এবং অতিপর্বেও উপরের লাইন অনুসারে তিন মাত্রা থাকবে। যেমন,
মামার বাড়ি আর যাবো না আর খাবো না মামীর গাল,
কথায় কথায় আমার পিঠে পড়বে না আর অমন তাল।
সকাল বেলা জেগে আমি তাই তো গেলাম মায়ের ঘর,
“ভায়ের বাড়ি যাওগে একা, আমার গায়ে ভীষণ জ্বর।”
তাহলে স্বরবৃত্ত ছন্দের এই কবিতাটির কাঠামো দাঁড়াবে:
৪ + ৪ + ৪ + ৩
২. যখন ওরা অপিশে যায় কিংবা চালায়
তুমুল দোকানদারি
তখন আমি ঢেউ সাজানো নদীর বুকে
দিব্যি জমাই পাড়ি।
(যখন ওরা/শামসুর রাহমান)
মাত্রা বিন্যাস:
যখন ওরা/ আপিশে যায়/ কিংবা চালায়/
তুমুল দোকান/ দারি
তখন আমি/ ঢেউ সাজানো/ নদীর বুকে/
দিব্যি জমাই/ পাড়ি।
কাঠামো:
৪ + ৪ + ৪
৪ + ২
এখানে চার মাত্রার চারটি পর্ব এবং দুই মাত্রার একটি অতিপর্ব দিয়ে পঙ্ক্তি গঠিত হয়েছে। সাথে সাথে লক্ষণীয় যে শামসুর রাহমান একটি পঙ্ক্তি ভেঙে দু’টি লাইন করেছেন। কিন্তু পর্ব সংখ্যা প্রতি দুই দুই লাইনে সমান রেখেছেন। ইচ্ছা করলে প্রথম উদাহরণের কবিতাটি একই ভাবে ভেঙে দেয়া যায়। যেমন,
মামার বাড়ি আর যাবো না
আর খাবো না মামীর গাল,
কথায় কথায় পড়বে না আর
আমার পিঠে অমন তাল।
এই নতুন আঙ্গিকে কবিতাটির কাঠামো দাঁড়াবে:
৪ + ৪ +
৪ + ৩
প্রতি দুই লাইনে পর্ব সংখ্যা সমান রাখা হয়েছে।
৩. মেঘনা নদীর শান্ত মেয়ে তিতাসে
মেঘের মতো পাল উড়িয়ে কী ভাসে!
(ভর দুপুরে/আল মাহমুদ)
মাত্রা বিন্যাস:
মেঘনা নদীর/ শান্ত মেয়ে/ তিতাসে
মেঘের মতো/ পাল উড়িয়ে/ কী ভাসে !
কবিতাটির কাঠামো:
৪ + ৪ + ৩
অর্থাৎ এই কবিতায় কবি প্রতি লাইনে চার মাত্রার দু’টি পর্ব এবং তিন মাত্রার একটি অতিপর্ব রেখেছেন।
উপরের উদাহরণগুলি থেকে দেখা যায় সব ক্ষেত্রেই প্রতিটি পর্বে চারমাত্রা এসেছে। তাহলে কি বলা যায়, স্বরবৃত্ত ছন্দে প্রতিটি পর্বে মাত্রা সংখ্যা চারে সীমাবদ্ধ থাকে? তাৎক্ষণিক উত্তর হ্যাঁ-সূচক।
তবে স্বরবৃত্ত ছন্দে কবিতার পর্বকে আরো এক প্রকার মাত্রার সমন্বয়ে গঠন করা যায়। সেটি হলো ‘সাত মাত্রার মন্দাক্রান্তা ছন্দ’ বা সংক্ষেপে মন্তাক্রান্তা ছন্দ। স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত উভয় ক্ষেত্রেই সংস্কৃত ধাচের এই বুনন সম্ভব। নাম থেকেই বোঝা যায় পর্বে মাত্রা সংখ্যা থাকবে সাতটি।
উদাহরণ:
৪. বাবুদের তাল পুকুরে
হাবুদের ডাল কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া
বলি থাম একটু দাঁড়া।
(লিচু চোর/ কাজী নজরুল ইসলাম)
এখানে প্রতিটি লাইন সাত মাত্রার একটি মাত্র পর্ব দিয়ে গঠিত। আবার অন্যভাবে বলা যায় যে, প্রথমে তিন এবং পরে চার মাত্রার দু’টি পর্ব দিয়ে লাইন গঠিত হয়েছে।
একই ছন্দে রচিত অন্য একটি কবিতার কথা বিবেচনা করা যায়,
৫. আগুনের পরশ মণি/ ছোঁয়াও পাণে,
এ জীবন পূণ্য করো/ দহন-দানে।
আমার এই দেহখানি/ তুলে ধরো,
তোমার ওই দেবালয়ের/ প্রদীপ করো
নিশিদিন আলোক-শিখা/ জ্বলুক গানে।
(পরশমণি/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
লক্ষণীয় প্রতিটি লাইনের প্রথমে সাত মাত্রার একটি পর্ব ও শেষে চার মাত্রার একটি অতিপর্ব এসেছে।
এই বুননে কবিতাটির কাঠামো দাঁড়ায় :
৭ + ৪
৭ + ৪
তবে কেউ হয়তো বলতে পারেন, রবীন্দ্রনাথ এই কবিতায় তিন মাত্রার উপপর্ব রেখে চার মাত্রার পর্ব গঠন করেছেন। সেক্ষেত্রে মাত্রা বিন্যাস হবে নিন্মরূপ:
আগুনের পরশ মণি/ ছোঁয়াও পাণে,/
এ জীবন পূণ্য করো/ দহন-দানে।/
আমার এই দেহখানি/ তুলে ধরো,/
তোমার ওই দেবালয়ের/ প্রদীপ করো/
নিশিদিন আলোক-শিখা/ জ্বলুক গানে।/
কাঠামো:
৩ + ৪ + ৪
৩ + ৪ +৪
লক্ষণীয়, যে ভাবেই পড়া হোক না কেনো, কবিতার চাল প্রথম পর্বকে সাত মাত্রায় টেনে নিয়ে যায়।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ:
মাত্রাবৃত্তের ক্রিয়া কলাপ অনেকটা স্বরবৃত্তের মতো হলেও এই ছন্দে বদ্ধস্বর দু’মাত্রা বহন করে। কোনো অবস্থাতেই বদ্ধস্বর একমাত্রা বহন করতে পারে না। কিন্তু স্বরবৃত্তের মতোই মুক্তস্বরের মাত্রা এক।
কবিতার পঙ্ক্তি দিয়ে বিবেচনা করা যায়।
১. মামার বাড়িতে/ যাবো না গো আমি/ খাবো না গো আর/ মামীর গাল,
কথায় কথায়/ পড়বে না আর/ পিঠের উপরে/ অমন তাল।
এখানে স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রথম উদাহরণটি একটু ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি লাইনে এবার ছয় মাত্রার তিনটি করে পর্ব এবং পাঁচ মাত্রার একটি করে অতিপর্ব এসেছে।
মাত্রা বিন্যাস:
মামার বাড়িতে/ যাবো না গো আমি/ খাবো না গো আর/ মামীর গাল,
কথায় কথায়/ পড়বে না আর/ পিঠের উপরে/ অমন তাল।
অতএব কবিতাটির কাঠামো দাঁড়ায় :
৬ + ৬ + ৬ + ৫
অতিপর্বের মাত্রা সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়, তবে কিছুতেই তা পর্বের মাত্রা সংখ্যার সমান হবে না। অতিপর্বের মাত্রা সংখ্যা যদি পর্বের মাত্রা সংখ্যার সমান হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে অতিপর্ব একটি পূর্ণ পর্বের রূপ নেবে। এখানে বলে রাখা ভালো, অতিপর্ব ছাড়াও শুধু পর্ব দিয়ে কবিতার কাঠামো তৈরি করা যায়। মাত্রা বিন্যাস সহ আরো কিছু কবিতার উদাহরণ:
ছয় মাত্রার পর্ব এবং চার মাত্রার অতিপর্ব:
২. কবি বন্ধুরা/ হতাশ হইয়া/ মোর লেখা পড়ে/ শ্বাস ফেলে
বলে কেজো ক্রমে/ হচ্ছে অকেজো/ পলি টিক্সের/ পাশ ঠেলে।
(আমার কৈফিয়ৎ/ কাজী নজরুল ইসলাম)
কবিতাটির কাঠামো:
৬ + ৬ + ৬ + ৪
ছয় মাত্রার পর্ব এবং তিন মাত্রার অতিপর্ব:
৩. সই পাতালো কি/ শরতে আজিকে/ স্নিগ্ধ আকাশ/ ধরণী ?
নীলিমা বহিয়া/ সওগাত নিয়া/ নমিছে মেঘের/ তরণী !
(রাখী বন্ধন/ কাজী নজরুল ইসলাম)
কাঠামো:
৬ + ৬ + ৬ + ৩
ছয় মাত্রার পর্ব এবং দুই মাত্রার অতিপর্ব:
৪ক. এ জগতে হায়/ সেই বেশি চায়/ আছে যার ভূরি/ ভূরি
রাজার হস্ত/ করে সমস্ত/ কাঙালের ধন/ চুরি।
(দুই বিঘে জমি/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
খ. দুর্গম গিরি/ কান্তার মরু/ দুস্তর পারো/ বার
লঙ্ঘিতে হবে/ রাত্রি নিশিতে/ যাত্রীরা হুশি/ য়ার।
(কাণ্ডারী হুশিয়ার/ কাজী নজরুল ইসলাম)
কাঠামো:
৬ + ৬ + ৬ + ২
পাঁচ মাত্রার পর্ব কিন্তু অতিপর্ব নেই:
৫. তোমারে পাছে/ সহজে বুঝি/ তাই কি এতো/ লীলার ছল/
বাহিরে যবে/ হাসির ছটা/ ভিতরে থাকে/ আখির জল।/
(ছল/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
কাঠামো:
৫ + ৫ + ৫ + ৫
পাঁচ মাত্রার পর্ব এবং দু’মাত্রার অতিপর্ব:
৬ক. এ-ভূজমাঝে/ হাজার রূপ/ বতি
আচম্বিতে/ প্রাসাদ হারা/ য়েছে;
অমরা হতে/ দেবীরা সুধা/ এনে,
গরল নিয়ে/ নরকে চলে/ গেছে।
(নিরুক্তি/ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত)
কাঠামো:
৫ + ৫ + ২
খ. হৃদয়ে তার/ অন্ধকার/ পৃথিবী নিঝ/ ঝুম
বিফল তার/ সকল বৈ/ভব
ভাঙে না তার/ বসন্তের/ অন্তহীন/ ঘুম
জাগে না কল রব/
কপালে যার/ আঁকেনি কেউ/ প্রেমের কুম/ কুম
ব্যর্থ তার/ সব।
(মধ্য ফাল্গুনে/নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)
কাঠামো:
৫ + ৫ + ৫ + ২
৫ + ৫ + ২
গ. তখনো ছিলো/ অন্ধকার/ তখনো ছিলো/ বেলা
হৃদয় পুরে/ জটিলতার/ চলিতেছিলো/ খেলা
ডুবিয়াছিলো/ নদীর ধার/ আকাশে আধো/ লীন
সুষমাময়ী/ চন্দ্রমার/ নয়ান ক্ষমা/ হীন
(হৃদয়পুর/শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
কাঠামো:
৫ + ৫ + ৫ + ২
আট মাত্রার পর্ব এবং ছয় মাত্রার অতিপর্ব:
৭. শেফালি কহিল আমি/ ঝরিলাম তারা !
তারা কহে আমারো তো/ হল কাজ সারা।
(এক পরিণাম/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
কাঠামো:
৮ + ৬
এখানে বলে রাখা ভালো এ কাঠামোর কবিতাকে আট-ছয় মাত্রার কবিতাও বলা যেতে পারে। চৌদ্দ মাত্রার সনেট সৃষ্টির কাজে এ ধরনের ছন্দ বিন্যাস বিশেষ ব্যবস্থায় কাজে লাগানো যায়। তাছাড়া অক্ষরবৃত্ত ছন্দে এর উপস্থিতি অনেক বেশি।
মাত্রাবৃত্তে সাত মাত্রার পর্বের ব্যবহার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অনেকটা স্বরবৃত্তের মতোই তবে মাত্রাবৃত্তে অতিপর্ব রাখাটা বেশ সহজতর। প্রথমে অতিপর্বহীন কয়েকটি কবিতার উদাহরণের দিকে তাকানো যাক।
সাত মাত্রার দুই পর্ব বিশিষ্ট কবিতা:
৮. তোমার মুখ আঁকা/ একটি দস্তায়/
লুটিয়ে দিতে পারি/ পিতার তরবারি/
বাগান জোত জমি/ সহজে সস্তায়/
তোমার মুখ আঁকা/ একটি দস্তায়;/
(শোণিতে সৌরভ/ আল মাহমুদ)
কাঠামো:
৭ + ৭
সাত মাত্রার তিন পর্ব বিশিষ্ট কবিতা:
৮. উগ্র ঢাল, তার/ তীক্ষè শরমুখ/ রঙিন, কোপনীয়/
রেখেছে সঞ্চিত/ যা-কিছু মায়াময়,/ মধুর, গোপনীয়
(সুন্দর জাহাজ/অনু: বুদ্ধদেব বসু)
কাঠামো:
৭ + ৭ + ৭
সাত মাত্রার চার পর্ব বিশিষ্ট কবিতা:
৯.
অন্ধ রেল গাড়ি/ বধির রেলগাড়ি/ অন্ধ রেল বেয়ে/ চলছে দ্রুত বেগে/
দু-চোখে মরা ঘুম/ আকাশে মরা মেঘ/ সঙ্গে মরা চাঁদ/ অন্ধ আছি জেগে/
অন্ধ বগিগুলো/ ক্লান্ত হয়ে গেছে/ এগিয়ে চলে তবু/ অন্ধ প্রতিযোগী/
চলছে ট্রাগ বেয়ে/ জানে না কোথা যাবে/ নষ্ট রেলগাড়ি/ অন্ধদূর বোগী।/
(অন্ধ রেলগাড়ি / হুমায়ুন আজাদ)
কাঠামো:
৭ + ৭ + ৭ + ৭
সাত মাত্রার মাত্রাবৃত্তে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার অতিপর্ব ব্যবহারের নমুনা:
১০. ফসল অন্যের,/ তোমার শুধু
অন্য কোনো দূর/ অরণ্যের
পন্থহীনতায়/ স্বপ্নে কেঁপে ওঠা/
কোন অসম্ভব/ আকাক্সক্ষায়।
(অসম্ভবের গান/বুদ্ধদেব বসু)
কাঠামো:
৭ + ৫
৭ + ৫
৭ + ৭
৭ + ৬
এই চার লাইনে অতিপর্বে কোথাও পাঁচ কোথাও ছয় মাত্রা রাখা হয়েছে। কিন্তু তৃতীয় লাইনে কোনো অতিপর্ব নেই। ফলে, তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন মিলে একটি পঙ্ক্তি তৈরী করেছে।
১১. নিমেষে ভুলি সাধ/ অতল মোহে।
মোহিনী ও-মুখের/ মিথ্যা বুলি
সত্য সার ভাবি,/ এবং আমি
ধারি না ধার কোনো/ মহোদয়ের।
(কবর খোড়ার গান/শামসুর রাহমান)
কাঠামো:
৭ + ৫
৭ + ৫
এই কবিতায় পাঁচ মাত্রার অতিপর্ব রাখা হয়েছে।
১২. যেখানে লেজবস/ প্রণয় ঝর্ণায়/ উলঙ্গ
শান্ত বয়ে যায়/ গভীর শেষমেশ/ সমুদ্রে
ভাসিয়ে প্রান্তর/ যায় সে আঁকাবাঁকা/ খলখল
ঝঞ্ঝা গোপনীয়,/ দেবতা ভূমিতলে/ অসংখ্য
যেখানে লেজবস/ প্রণয় ঝর্ণায়/ উলঙ্গ।
(লেসবস/অনু: হাসানআল আব্দুল্লাহ)
কাঠামো:
৭ + ৭ + ৪
৭ + ৭ + ৪
বোদলেয়ার রচিত এই কবিতাটি অনুবাদে অতিপর্বে চার মাত্রা রাখা হয়েছে। দু’টি করে পর্ব দিয়ে কবিতার লাইন গঠিত।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ:
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে বদ্ধস্বর কখনো একমাত্রা এবং কখনো দুই মাত্রা বহন করে। অর্থাৎ পর্বে মাত্রা গণনা রীতি কোথাও স্বরবৃত্তের আবার কোথাও মাত্রাবৃত্তের মতন। বদ্ধস্বর যদি শব্দের প্রথম বা মাঝে থাকে তবে তা এক মাত্রা কিন্তু শব্দের শেষে অবস্থান করলে দুই মাত্রা বহন করে। উদাহরণ স্বরূপ “সূর্যশোক” শব্দটি বিবেচনা করা যেতে পারে।
স্বর বিন্যাসে শব্দটি নতুন করে লিখে আমরা পাই:
সূর + য + শোক
প্রথম এবং শেষেরটি বদ্ধস্বর, কিন্তু মাঝেরটি মুক্তস্বর। “সূর” বদ্ধস্বরটি শব্দের প্রথমে থাকায় এর মাত্রা সংখ্যা এক। অন্যদিকে “শোক” বদ্ধস্বরটি শব্দের শেষে থাকায় এর মাত্রা সংখ্যা দুই। আর মুক্ত স্বর “য”-এর মাত্রা সংখ্যা সর্বদাই এক। অতএব অক্ষরবৃত্তের এই নিয়মে “সূর্যশোক” এর মাত্রা সংখ্যা চার।
মাত্রা বিন্যাস:
সূর্যশোক
সূর + য + শোক
= ১ + ১ + ২
= ৪
মাত্রা বিন্যাস সহ অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত কয়েকটি কবিতা।
পর্বে আট মাত্রা এবং অতিপর্বে ছয়মাত্রা আছে এমন একটি কবিতা:
১. হাজার বছর ধরে/ আমি পথ হাঁটিতেছি/ পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে/ নিশীথের অন্ধকারে/ মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি ;/ বিম্বিসার অশোকের/ ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি;/ আরো দূর অন্ধকারে/ বিদর্ভ নগরে;
(বনলতা সেন/ জীবনানন্দ দাশ)
কাঠামো:
৮ + ৮ + ৬
এখানে “সংহল” “সমুদ্র” “অন্ধকার” এবং “বিম্বিসার” শব্দ চারটি লক্ষ্য করা যায়। প্রথম শব্দ দু’টি তিনটি করে এবং শেষের শব্দ দু’টি চারটি করে মাত্রা বহন করছে।
এদের স্বর ও মাত্রা বিন্যাস নিম্নরূপ:
সিংহল
সিং + হল
= ১ + ২
= ৩
সমুদ্র
স + মুদ + রো
= ১ + ১ + ২
= ৩
অন্ধকার
অন্ + ধো + কার
= ১ + ১ + ২
= ৪
বিম্বিসার
বিম + বি + সার
= ১ + ১ + ২
= ৪
দেখা যাচ্ছে, শব্দের প্রথমে এবং মাঝে অবস্থিত বদ্ধস্বরগুলি এক মাত্রা কিন্তু শেষে অবস্থিত বদ্ধস্বরগুলি দু’মাত্রা বহন করছে।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে মাত্রা গণনার এই রীতি কবি ইচ্ছা করলে বদলে দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে সব বদ্ধস্বরকে দিতে হবে দু’মাত্রা বহন করার ক্ষমতা। তবে, সতর্ক থাকা প্রয়োজন, যাতে পুরো কবিতায় একই নিয়ম প্রতিফলিত হয়। এক কবিতায় দু’রকম নিয়ম অনুসরণ করলে একদিকে পাঠক যেমন বিভ্রান্ত হবেন, অন্যদিকে কবিরও ছন্দে অদক্ষ হাতের প্রমাণ থেকে যাবে।
সকল বদ্ধস্বরকে দু’মাত্রা বহন করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এমন একটি কবিতা:
২. বহুদিন থেকে আমি/ লিখছি কবিতা
বহুদিন থেকে আমি/ লিখিনা কবিতা
(বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা/ সৈয়দ শামসুল হক)
কাঠামো:
৮ + ৬
এখানে “লিখছি” শব্দটির “লিখ” বদ্ধস্বরটি শব্দের প্রথমে বসেও দুই মাত্রা বহন করছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রম। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে, এটা কবির ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।
শব্দের প্রথম ও মাঝের বদ্ধস্বরকে একমাত্রা দেয়া হয়েছে এমন আরো দু’টি কবিতা:
৩. …রহে বলী; রাজদণ্ড/ যত খণ্ড হয়
তত তার দুর্বলতা,/ তত তার ক্ষয়।
একা সকলের উর্ধ্বে/ মস্তক আপন
যদি না রাখিতে রাজা,/ যদি বহুজন…
(গন্ধারীর আবেদন/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
কাঠামো:
৮+৬
৪. হে দারিদ্র্য তুমি মোরে/ করেছ মহান
তুমি মোরে দানিয়েছ/ খ্রীস্টের সম্মান।
কণ্টক-মুকুট শোভ!/ ─দিয়াছ, তাপস
অসঙ্কোচ প্রকাশের/ দুরন্ত সাহস:
(দারিদ্র / কাজী নজরুল ইসলাম)
কাঠামো:
৮ + ৬
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এ দু’টি কবিতাই চোদ্দ মাত্রার সনেট নির্মাণের কাজে অবদান রাখতে পারে। সনেট অধ্যায়ে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।
এবার অন্য একটি কবিতা:
৫. ক্রূর ঝড় থেমে গেছে,/ এখন আকাশ বড়ো নীল/
গাছের সবুজ পাতা/ কেঁপে কেঁপে অত্যন্ত সুষম/
বিন্যাসে আবার স্থির/
(বাজপাখি / শামসুর রাহমান)
এই কবিতাটির প্রতিটি লাইনের প্রথম পর্ব আট মাত্রা এবং দ্বিতীয় পর্ব দশ মাত্রা বহন করছে। যদি পর্বের আলোচনার আলোকে এটা বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে বলা যায় শেষের দশ মাত্রার পর্বটি অতিপর্ব। কিন্তু তা কি করে হয়? অতিপর্বের মাত্রা তো পর্বের মাত্রা সংখ্যা থেকে কম হওয়ার কথা। তবে কি এক্ষেত্রে মন্তব্য করা যাবে যে কবিতাটি লেখা হয়েছে ৮+৮+২ কাঠামোতে অর্থাৎ আট মাত্রার দু’টি পর্ব এবং দুই মাত্রার অতিপর্ব রেখে। কিন্তু তাও ঠিক নয়। কারণ, প্রথম লাইনের “নীল” শব্দটি দুইমাত্রা বহন করায় এটাকে দুই মাত্রার অতিপর্ব ধরলেও ধরা যায়। কিন্তু সমস্যা হয় দ্বিতীয় লাইনের “সুষম” শব্দটিকে নিয়ে। দুই মাত্রার অতিপর্ব বের করতে হলে “সুষম” থেকে “সু” স্বরটিকে পূর্বের পর্বের সঙ্গে যুক্ত করতে হয়, এবং “ষম” কে অতিপর্ব ধরতে হয়। অর্থাৎ তিন অক্ষরের এই শব্দটিকে ভেঙে দিয়ে কবিতার পর্ব বিন্যাস করতে হয়। এক্ষেত্রে যা যুক্তিপূর্ণ নয়। তাই এই কবিতাটিকে “আট-দশ” মাত্রার বা “আট-দশ” চালের কবিতা বলা প্রয়োজন, যা অক্ষরবৃত্তে কবিতা লেখার অন্য একটি নিয়ম হিসেবে বেশ কয়েক যুগ ধরে বাংলা কবিতায় প্রচলিত এবং এটাই হচ্ছে আঠারো মাত্রার সনেট গঠনের নির্ভরযোগ্য কাঠামো।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আলোচনায় অগ্রসর হলে মনে হতে পারে যে এর অঙ্গন অনেক প্রশস্ত এবং কিছুটা খোলামেলা।
আসলেই তাই। বাংলা কবিতার ত্রিশের দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবিরা অক্ষরবৃত্তের উপর প্রচুর কাজ করেছেন এবং একে একটা মুক্ত রূপ দিয়েছেন; যা অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মাত্রা গণনার নিয়মকে ঠিক রেখে পর্বে মাত্রা বাড়িয়ে কমিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পর্ব ভেঙেচুরে ছন্দকে শাসন করে সজোরে আছাড় মেরে কবিতাকে সোজা করে দাঁড় করা হয়েছে। উঁকি দিয়েছে অক্ষরবৃত্তের নতুন ধারা। অক্ষরবৃত্তের এই নতুন রূপকে অনেকে “মুক্ত ছন্দ” বলেন। কিন্তু আমরা একে “নঞ ছন্দ” বলবো। নাই অর্থে নঞ। অর্থাৎ সাধারণ ভাবে দেখলে কবিতায় ছন্দ নেই, কিন্তু বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করলে ছন্দের দৃঢ় বন্ধন দৃষ্টিগোচর হয়। নঞ ছন্দের উদাহরণ লক্ষ্য করা যাক:
১. আকাশ জানে না,/
প্রকাশ রাস্তায় একী/ কুড়ানো স্বাক্ষর,/
নক্ষত্র সমাজ খোঁজে/ শেষ পরিচয়/
ওরা পরস্পর/
নূতন বিরহে পায়/ অভিন্ন বিচ্ছেদে দীপ্তিময়/
উদ্ভাসিত দূরে দূরে/ অনন্ত বাসর।/
(যুগ্মদূর/ অমিয় চক্রবর্তী)
কাঠামো:
৬
৮ + ৬
৮ + ৬
৬
৮ + ১০
৮ + ৬
২. সজীব সকালে চোখ মেলি,/ প্রতিদিনের পৃথিবী/
আমাকে জানায় অভি/ বাদন। টাটকা রোদ
পাখিদের উড়াউড়ি,/ গাছের পাতার দুলুনি,/ বেলফুলের গন্ধ/
ডেকে আনে আমার বালকবেলাকে/
(একটি দুপুরের উপকথা / শামসুর রাহমান)
কাঠামো:
১০ + ৮
৮ + ৮
৮ + ৮ + ৮
১৪
৩. যখন তাদের দেখি/ হঠাৎ আগুন লাগে/ চাষীদের মেয়েদের/
বিব্রত আঁচলে;/ সমস্ত শহর জুড়ে/ শুরু হয় খুন, লুঠ,/ সম্মিলিত অবাধ ধর্ষণ,
ভেঙে পড়ে শিল্পকলা,/ গদ্যপদ্য;/ দাউদাউ পোড়ে/ পৃষ্ঠা সমস্ত গ্রন্থের;
ডাল থেকে/ গোঙিয়ে লুটিয়ে পড়ে/ ডানা ভাঙা নিঃসঙ্গ দোয়েল
আর্তনাদ করে বাঁশি/ যখন ওঠেন মঞ্চে/ রাজনীতিবিদগণ।
(রাজনীতিবিদগণ/ হুমায়ুন আজাদ)
কাঠামো:
৮ + ৮ + ৮
৬ + ৮ + ৮ + ১০
১০ + ৪ + ৬ + ৮
৪ + ৮ + ১০
৮ + ৮ + ৮
এইসব উদাহরণ থেকে এটা স্পষ্ট যে পর্বে মাত্রা সংখ্যা অসমান; কিন্তু জোড় মাত্রার পর্ব গঠিত হয়েছে।
মুক্ত বা নঞ ছন্দে কবিতা লেখার সহজ উপায়
এখন প্রশ্ন হলো মুক্ত বা নঞ ছন্দে কবিতা লেখার নিয়ম কি? এ ছন্দে লেখা কবিতাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে যা ধরা পড়বে তা হলো:
১. অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মাত্রা গণনার নিয়ম ঠিক থাকবে।
২. প্রতিটি পর্বে জোড়সংখ্যক মাত্রা থাকতে হবে।
৩. পর্বে মাত্রা সংখ্যা দুই থেকে শুরু করে চার, ছয়, আট, দশ যে কোনো সংখ্যক রাখা যেতে পারে।
মুক্ত বা নঞ ছন্দে কবিতা লেখার সময় যদি একটা বিশেষ নীতি মেনে চলা হয় তবে উপরের তিনটি শর্তই একসঙ্গে পূরণ করা সম্ভব। নীতিটি হলো:
জোড়ে জোড়, বিজোড়ে বিজোড়।
তার মানে জোড় মাত্রার শব্দের পাশাপাশি জোড় মাত্রার শব্দ এবং বিজোড় মাত্রার শব্দের পাশাপাশি বিজোড় মাত্রার শব্দ বসানো। এরপর ইচ্ছা মতো লাইন তৈরি করা হলেও ছন্দের কোনো বিচ্চুতি ঘটে না।
——————————————————–
কবিতার ছন্দ, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৭ ।। দ্বিতীয় সংস্করণ: মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিতব্য, ফেব্রুয়ারী, ২০১১।। এই অধ্যায়টি ‘মুক্তমনা’র বন্ধুদের জন্যে তুলে দিলাম। স্বরের উপর দাগ দেওয়ার কথা বলা আছে কিন্তু কম্পিউটারে তা সম্ভব হলো না। তারপরেও আমার মনে হয় মাত্রা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়।
যাওয়া, খাওয়া, রাস্তায়, আস্তায়।, অর্থাৎ য় শব্দের শেষে থাকেলে এই শব্দগুলোর অক্ষর বিন্যাস একটু বুঝিয়ে বললে উপকৃত হতাম।
একটা প্রশ্ন হলো অক্ষরবৃত্ত ছন্দে “যাওয়া” কয় মাত্রা হবে? যদি “যাও+ য়া “ হয় তাহলে দুইটাই মুক্তাক্ষর হিসাবে দুই মাত্রা হয়। আবার শব্দের শেষে য় থাকার কারণে বদ্ধাক্ষর হয়। তখন তিন মাত্রা হয়। ব্যাখ্যা করলে উপকৃত হব।
অনেক সুন্দর লিখা। তবে আমার ছোট্ট একটা প্রশ্ন আছে। বদ্যাক্ষর এর মাত্রা বিভিন্ন ছন্দে বিভিন্ন রকম। কবিতার লাইন পড়ে এটা কীভাবে বোঝা সম্ভব?
লেখাটা দারুন লেগেছে। ধন্যবাদ লেখককে।
আসসালামু আলাইকুম, সুপ্রিয় কবি, মূলত আমি ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়া লেখা করা একজন ছাত্র। আমি সময় কাটাতে এই লেখা লেখি টা বেছে নিয়েছি, কারণ প্রবাসের একাকিত্ব জিবনে এই পথ ছাড়া আর কিছু পায় নি। আমি মূলত মাত্রা সম্পর্কে জানতে এমন কিছু খুঁজ করছিলাম কিন্তু আপনার লেখাটা পড়ে আরো অনেক বেশি কিছু শিক্ষা নিতে পারলাম। তবে পড়া লেখা কম হওয়ায় সব কিছু ঠিকঠাক ভাবে এখনো মাথায় নিতে পারিনি। তবে ইনশাআল্লাহ চেষ্টা করবো আপনার উপদেশ গুলো সম্পূর্ণ পরিষ্কার ভাবে কন্ট্রোল করতে মাথায়। অসংখ্য শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আপনাকে আমাদের মত অশিক্ষিত কিছু মানুষ আপনার লেখাটা পড়ে অনেক কিছু শিখতে পারবে।
বাংলা গানের কবিতায় সাধারণত কী ধরণের ছন্দের ব্যবহার হয়ে থাকে? গীতিকবিতা বা গানের কি বিশেষ কোন ভাষাশৈলী আছে? গানের ভাষার ব্যবচ্ছেদে কী কী মৌলিক অনুষঙ্গ পাওয়া যায়? গানের ভাষাগত শরীর নিয়ে একগাদা প্রশ্ন উঁকি মারলে কোন ভালো বই/জার্নাল/ প্রবন্ধ/ ম্যাগাজিন কিছুর দিকে কি আমাকে নির্দেশ করবেন? আর হ্যাঁ, জনাব হাসান আব্দুল্লাহ, আপনার এই লেখাটিকে একটি মৌলিক লেখা হিসেবে ছাত্রদের পড়তে নির্দেশ করেছি। এটি সংখিপ্ত শরীরে পূর্ণাঙ্গ সুখপাঠ্য একটি প্রবন্ধ। অশেষ কৃতজ্ঞতা।
অনেক উপকারী বিষয় গুলি
লেখাটি পড়ে অনেক উপকৃত হলাম। কিন্তু আমি সনেটের অন্তমিলের ক্ষেত্রে কখখক কখখক কগ কগ এই ব্যপারে ঠিক বুঝতে পারছি না। এখানে কখ গ ঘ ঙ চ ছ এই সিরিয়াল গুলো কোন হিসেবে বসে ? দয়াকরে জানালে চির কৃতজ্ঞ থাকব।
“একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।”
ছন্দ নির্ণয় করবো কি করে??
আমি অনেক অনেক তৃপ্ত হলাম। খুব সাবলীল প্রকাশ ভঙ্গি। শিখলাম অনেক কিছু যা সম্পূর্ণ অজানা ছিলো, তাও অনেক সহজ ভাবে। আমার একটা প্রশ্ন আছে…..কবিতা কি এবং কেন?
“হেন দূর্বল আমি,তব কাছে
তথাপি জানিতে চাই মনে যাহা আছে”_—
মনে হয় আপনাকে স্যার বলাটাই উত্তম হবে।
স্যার,আমার ছোট্ট কালের শখ আমি লেখক হব।অনেক কবিতা লিখেছি। হয়তো বা এই কবিতা গুলোর শিল্পমূল্য নেই।তবু আমার সাধনা পূরণ করার প্রত্যাশায় আপনাকে অনুরোধ করি,
আমার লিখা গুলো কিভাবে প্রকাশ করব??
একটু নির্দেশনা দিলে আমার মন বাসনা পূরণ হয়।।।স্যার জানান প্লিজ।
–আপানার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী।
মন্তব্য…ধন্যবাদ
মন্তব্য… আপনাকে ভাইয়া বলব নাকি স্যার বলব বুঝতে পারছি না।তবে স্যার বলাই শ্রেয় মনে করছি।।প্রথমেই বলে নেই ,আমি একজন বাংলার ছাত্র।বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার স্যার যেভাবে ‘ছন্দ’ পড়িয়েছেন আপনিও ঠিক সেভাবেই এখানে বুঝিয়েছেন।।ক্লাসে পড়ার পর আপনার লেখা পড়ে আমার ছন্দ সম্পর্কে ধারনা আরও পরিষ্কার হয়ে গেল।।আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না।দীর্ঘজীবি হোন।
একটা প্রশ্ন ছিল উত্তর দিলে উপকৃত হবো
প্রশ্ন: অক্রবৃত্তে বদ্ধস্বরগুলো শব্দের প্রথম, মধ্যে থাকলে ১ মাত্রা আর শেষে থাকলে ২ মাত্রা গুনতে হবে… তবে কথ্য ক্রিয়াপদে যেমন: করলে, বললে, ধরতে, লিখবে ইত্যাদিতে কত মাত্রা গুনবো?
প্রশ্ন: কোন নাম শব্দের শরুতে বদ্ধস্বর থাকলে তা কি ১ মাত্রা হবে?
যেমন আয়না= আয়+না=২ মাত্রা নাকি তিন মাত্রা।
অক্ষরবৃত্তের ক্ষেত্রে শব্দের শুরু ও মাঝের বদ্ধস্বরগুলো একমাত্র পায়। শব্দ শেষের বদ্ধস্বর পায় দুই মাত্রা। তবে সবগুলো বদ্ধস্বরকে দুইমাত্রা দেবার ক্ষমতা কবির আছে। তিনি যদি চান ‘আয়না’কে দুই (প্রথম নিয়ম অনুসারে) আবার তিনও (দ্বিতীয় নিয়মে) দিতে পারেন। আপনি যদি আমার ‘স্বতন্ত্র সনেট’ পড়েন, তাহলে দেখবেন আমি অন্যরকম একটি নিয়ম তৈরি করেছি।
“শব্দের প্রথম ও মাঝের বদ্ধস্বর, যারা যুক্তবর্ণ দিয়ে গঠিত নয়, শব্দ শেষের বদ্ধস্বরের মতো তাদেরও দুই মাত্রা বহন করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যেমন, ‘আসমান’ শব্দের ‘আস’ বদ্ধস্বরটি ‘মান’-এর মতোই দুই মাত্রা পায়। কিন্তু ‘ক্লান্ত’ শব্দের ‘ক্লান’ বদ্ধস্বরটি পায় একমাত্রা। এই নিয়মে সনেট রচিত হওয়ায় পঙক্তিতে আঠারো মাত্রার পাশাপাশি আঠারোটি বর্ণও সংযোজিত হয়েছে।” [সূত্র: স্বতন্ত্র সনেট, তৃতীয় সংস্করণ, ধ্রুবপদ, ঢাকা, ২০১৪]
নিয়ম জানলে ভাঙতেও বাধা নেই। কিন্তু একটি কবিতার বিভিন্ন পঙক্তিতে বিভিন্ন নিয়ম অনুসরণ না করে একটি নিয়মই মেনে চলা উচিৎ।
‘নাম’ শব্দ বলে বাংলা ছন্দে আলাদা কোনো নিয়ম ব্যবহৃত হয় না। সব শব্দের ক্ষেত্রেই একই নিয়ম।
সাইয়েদ জামিলের কবিতায় ইতরপনা শব্দ এবং তার মতিচুরের আলুর পুরষ্কার নিয়ে ফেসবুকে অনেক পোস্ট আসছে। তেমন একটি পোস্টে একজনের মন্তব্য-
এই প্রশ্নটার উত্তর চাইছি জনাব হাসানআল আব্দুল্লাহ আপনার কাছ থেকে।
(যদিও আমার ধারণা, গ্রামার ও বিধিনিষেধ মেনেই কবিতা রচনা করতে হয়)
ছড়া পড়তে এসে পেয়ে গেলাম ছন্দের উপর আপনার লেখা প্রবন্ধগুলি। প্রথম থেকে পড়া শুরু করেছি। আজ এই প্রবন্ধটির স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দ দুটি পড়লাম। অক্ষরবৃত্ত আগামীকাল পড়ব।
শিক্ষনীয় বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনামূলক লেখাগুলি পড়ে শিখতে পারবো, এজন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
অনেক ভাল লেখা, কবিতা বিষয়ে অনেক কিছু শেখার আছে সেটা সবাই জানতেও পারবে এই লেখাটা পরে !
লেখাটা এই ব্লগে http://onukabbo.net/ শেয়ার করে বাংলায় প্রথম পূর্নাঙ্গ কবিতা ব্লগকে সমৃদ্ধ করতে এগিয়ে আসুন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
পুরনো ডায়েরীটা হারিয়ে সবকিছুই হারিয়ে ফেলেছিলাম।
আপনার এই লিখাটা আমাকে আবার উৎসাহ যোগাবে।
ধন্যবাদ আবারো।
:yes:
@ হাসানআল আব্দুল্লাহ, অনেক কিছু শিখলাম আপনার লেখাটা পড়ে, ধন্যবাদ আপনাকে।
যারা কবিতার চর্চার করছেন, তাদের জন্য লেখাটা খুবই উপকারী; এতে কোনোই সন্দেহ নেই।
আমার মনে পড়ছে, আপনি এক সময় ছন্দ বিষয়ক লেখা মুক্তমনায় দিতে চেয়েছিলেন। আপনি আপনার কথা রেখেছেন। আপনি সত্যিই কথা রাখনেওয়ালা এক সুন্দর মনের কবি।
মুক্তমনার চারজন কবি যথা: আফরোজা আলম, লাইজু মান নাহার, সাইফুল ইসলাম আর মোজাফফর হোসেন। আপনি বাদ, কারণ আপনি হচ্ছেন গুরু। গুরুর কাছ থেকে এমন লেখা পেয়ে আনন্দে নেচে ওঠার কথা। আমি যদি কবিতা চর্চা করতাম, তাহলে ঠিকই নেচে উঠতাম।
কয়েকদিন আগে আরজ আলী মাতুব্বরের কয়েকটি কবিতা পড়লাম। প্রতিটি লাইনের আদ্যাক্ষর দিয়ে মানুষের নাম হয়ে যায়। পড়তে বড় ভালো লাগে। এধরনের কবিতাকে কি অক্ষরবৃত্ত?
আপনার এই ছন্দের উপর লেখা পড়ে কবি হওয়ার বাসনা জেগেছে মনে। হাসান ভাই, কবিতা লিখতে পারবো তো?
আমার একটা প্রশ্ন জাগে মনে; যারা স্বভাব কবি, তাদের কি এমন ছন্দ- মাত্রা সম্পর্কিত ব্যাকরণ জানার প্রয়োজন পড়ে কি-না?
@মাহফুজ,
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। বিনয়ের সাথে আপনার ‘গুরু’ শব্দটিকে প্রত্যাখ্যান করছি। কালই ই-চিঠিতে একজনকে লিখেছিলাম, “এটা আমাদের সামাজিক অভ্যাস।” আমিও কবি, কবিতা নিয়ে চিন্তা করি। মনের ভাষাকে শব্দবন্ধের বিভিন্ন খেলায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি। এই যে ‘খেলা’ শব্দটি ব্যবহার করলাম। সম্ভবত এটাই ছন্দ। এবং কিছু অলঙ্কারও এর সাথে জড়িত। যেমন, আপনি লাইনের আদ্যাক্ষরে কারো নাম হয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। এটাও একটা খেলা বই অন্য কিছু নয়। তবে এটা ছন্দের নয়, অলঙ্কারের খেলা। ইংরেজীতে একে বলে অ্যাক্রস্টিক(Acrostic)। স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত যেকোনো ছন্দে এমন কবিতা লেখা যেতে পারে। খুব সত্য যে, মার্কিন দেশে এই ধরনের কবিতা লেখানো হয় তৃতীয় থেকে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রদের দিয়ে। উদাহরণ,
Edgar Allan Poe
Eerie stories and poems
Decorate our imagination. Both
Good and evil
Are challanged along with
Reality.
Also,
Love and insanity
Lurk through the pages and
Anthologies. You will
Never know what is to happen next.
Problems of murder and mystery,
Oddities and wonderment are
Expressed with such peculiarity only he could acheive.
– – – – – Christina M.
কবিতা লিখতে পারবেন কিনা সে প্রশ্নের উত্তরে এটুকু বলবো যে, লেখা শুরু করার প্রাথমিক ধাপগুলো এই প্রবন্ধে আছে। এটাকে আয়ত্ত করে যদি কাজে হাত দেন তবে অবশ্যই কিছু না কিছু একটা দাঁড়াবে। তবে ভালো কবিতা লেখার জন্যে তো নিয়মিত সাধনার দরকার। পর্যাপ্ত পরিমানে পড়াশুনা করা দরকার। সাধনা করলে ভালো লিখতে না-পারার তো কোনো কারণ দেখি না।…স্বভাব কবির প্রশ্নে বলবো, এখন আর ওদের যুগ নেই। একটু কঠিন শোনালেও কথাটা সত্য যে জানা এবং সেখান থেকে কিছু একটা তৈরী করার যুগ এটি। এই জায়গাটিতে বিজ্ঞান বা টেকনোলজির সাথে কবিতার একটি চমৎকার মিল পাই। এই সুযোগে আপনাকে একটি গল্প বলি। আমি গণিতের ছাত্র। এক সময় আমার প্রফেসর, প্রফেসর জ্যাম্বয়েস, জানতে পারলেন যে আমি কবিতা লিখি। এই শিক্ষককে ছাত্ররা যারপরনাই এই মার্কিন দেশেও প্রচণ্ড ভয় করতো। মূলত ফেল করার ভয়। আমি কিন্তু তাঁকে খুব পছন্দ করতাম; এবং তাঁর চার চারটি ক্লাস নিয়েছিলাম। একদিন অনেকের মতো তিনিও জানতে চাইলেন, “গণিত পড়ো আর কবিতা লেখো এটা কিভাবে সম্ভব।” আমি বললাম, “কেনো আমি তো কোনো পার্থক্য দেখি না; বরং যথেষ্ট মিল পাই।” ধরা পড়ে গেলাম। তাঁকে তখন মিলটি বোঝাবার কাজ করতে হলো। তিনি বুঝলেন, এবং মন্তব্য করলেন, “তোমার মতো পাগল আমি দ্বিতীয়টি দেখি নাই।”
এখানেই শেষ নয়। আমার ব্যাচেলর ডিগ্রী শেষ হলে প্রফেসরকে অনুরোধ করলাম একটি রিকমান্ডেশন দিতে আমি যাতে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে পারি। (বলে রাখা ভালো যে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাচেলর করার পর এমএ না করে সরাসরি পিএইচডি কোর্চে ভর্তি হওয়া যায়)। প্রফেসর এবার তাঁর গুটি চাললেন, বললেন, “হ্যাঁ আমি সেটা করবো তুমি যদি আমাকে লিখিত দিতে পারো যে আগামী পাঁচ বছর কবিতা লিখবে না।” না, আমার পিএইচডি করা হয়নি। কারণ, কবিতাকে আমি ছাড়তে পারিনি। পরে অবশ্য এমএ করে নিয়েছি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে কবিতাকে না ছেড়ে ভালোই করেছি। অন্তত প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাগজে কলমে ঠোকাঠুকি করতে পারছি। এ-ও তো এক প্রকার শান্তি। আপনার জন্যে যদি এই শান্তি প্রযোজ্য হয়, কবিতার জগতে আপনাকেও স্বগত জানাই।
@হাসানআল আব্দুল্লাহ,
আপনার লেখা আর মন্তব্য পড়ে আমি অনুপ্রাণিত। আমারও যাত্রা শুরু হলো আপনার দলে। ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ -এর মত শুরু করলাম।
গণিতের ছাত্র,
জানলাম এই মাত্র।
হলেন একজন কবি,
চোখে ভাসে তার ছবি।
লম্বা লম্বা চুল,
নহে এ নজরুল।
নাম তার হাসান,
সবাই করে সম্মান।
বিসমিল্লাহ বলে শুরু,
আজ থেকে উনিই আমার গুরু।
ধন্যবাদ আমার মন্তব্যের প্রত্যুত্তর দেবার জন্য।
যখন আবৃত্তি করতাম, তখন ছন্দ পড়ে করিনি। কিন্তু একটা সময় মনে হয়েছে, কোনকিছু করলে শিখে পড়েই করা ভালো। কন্ঠশীলনে ক্লাস করতেও শুরু করেছিলাম এজন্য। অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় আর সেযাত্রায় পথ চলা হয়নি। স্কুল কলেজের আবৃত্তিগুলো হত কেবলই আবেগ আর কানের সাধনায় কন্ঠস্বরের উত্থান পতনে। অন্ধের মত সেই পথচলা অপূর্ণ হলেও একদম খারাপ লাগেনি আমার।
এখন ছন্দের অভাবটা বেশ বোধ করি। মাঝে মাঝে সাহস করে টুকটাক কবিতা লেখার অপপ্রয়াস চালালে, কেন যেন মনে হয়, সবটুকু অনুভূতি দিয়েও একটা অপূর্ণতা ঠিকই রয়ে গেল, সে ছন্দ! এইসব অপূর্ণতার বেড়াজালে, মন হারিয়ে গেছে কেবলই কবিতার বক্তব্যে, ছন্দকে ফাঁকি দিয়ে। এই ফাঁকটা পূরণের খুব ইচ্ছা আমার… কেমন যেনো কন্ঠে সুর না লাগার মত ব্যাপার হয়ে গেছে।
অনেক ধন্যবাদ, এই লেখাটির জন্য। :rose2:
আপনার প্রবন্ধটা আমাকে ছন্দ বুঝতে অনেক সাহায্য করবে। ধন্যবাদ। :yes:
লেখাটি পড়ে অনেককিছু শিখলাম। ধন্যবাদ হাসানআল আব্দুল্লাহ ভাইকে…
@মোজাফফর হোসেন,
ধন্যবাদ মোজাফফর। আসলে ছন্দ অনেকটা গণিতের হিসাবের মতো। অন্যদিকে কানকে সতর্ক রাখলেই ছন্দ পতন ধরা যায়। লেখাটি তোমার উপকারে এসেছে জেনে খুশী হলাম।
সাইফুল ইসলাম ও আফরোজা আলমকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আশা করি লেখাটি বেশী গাণিতিক হয়ে যায়নি। অনেক দিন আগে অঙ্গিকার করেছিলাম যে
‘মুক্তমনা’য় এ ধরনের একটি লেখা দেবো। কাজটি করতে পেরে এক প্রকার ভালোই লাগছে।
@হাসানআল আব্দুল্লাহ,
আপনি বিদেশের সাহিত্য বিশেষতঃ কবিতা’র যে খবরটা জানালেন ভালোলাগলো জেনে। আমি শখে লিখি তবু প্রায়শঃ শুনতে হয়”কবিদের ভাত নেই” জানি কথাটা নির্মম সত্য।কিন্তু ,
সত্যরে বাসিয়াছি ভালো
সে কখনও করেনা বঞ্চনা
@হাসানআল আব্দুল্লাহ,
পুরানো পড়াকে ঝালাই করার সুযোগ পেলাম।এজন্য ধন্যবাদ।
অনুরোধ রইল কবিতায় চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক নিয়ে আরেকটি লেখার জন্য।
@গীতা দাস,
দেখি “উপমা অনুপ্রাস চিত্রকল্প” নামে ওই বইয়ে লেখা প্রবন্ধটি দেওয়া যায় কি না। আপনাকে ধন্যবাদ।
কবি ভাইয়া, আপনার লেখাটি কবিতা লেখার জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। এইজন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। কিন্তুঘ বর্তমানে অনেকে মিল বা অমিলে কিছু লিখে কবি নামে বাহবা নিচ্ছে। কেউ বা বই প্রকাশ করছে, কেউ বা ফেসবুকে পোস্ট করছে, যাতে কবিতার কোন বৈশিষ্ট্য নাই। এক কথায় লেখাগুলো কবিতার মধ্যেই পড়েনা। এরা বাংলা কবিতার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ছে। এদের থেকে কবিতার জগতকে কিভাবে রক্ষা করা যায়, তা বলবেন। তানাহলে কবিতার জন্য কোনো নতুন ডিজিটাল বৈশিষ্ট্য চালু করা যায় কিনা তা ভেবে দেখবেন।
@ : হাসানআল আব্দুল্লাহ
১. স্বরবৃত্ত ছন্দ
২. মাত্রাবৃত্ত ছন্দ
৩. অক্ষরবৃত্ত ছন্দ
ছন্দের উপরে লেখা পড়ে অভিভুত হলাম। অনেক ধন্যবাদ। 🙂
হাসান
কেমন আছেন? অনেকদিন ধরে একটা একটা প্রশ্ন করতে চাই, আপনি তো অনেক আন্তর্জাতিক কবির সাথে কাজ করেন আপনিই হয়তো আমাকে এর উত্তর দিতে পারবেন। আচ্ছা, আমাদের দেশের লেখালিখি, ব্লগ, পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন খুললেই কবিতার ছড়াছড়ি দেখা যায়। এখানে তো কোন মিডিয়া, বইএর দোকান বা পত্রপত্রিকায় সেভাবে কবিতা দেখি না। পৃথিবীর সব দেশের মানুষই কি আমাদের মত এত কবিতা লেখে? নাকি এ বিষয়ে আমার জ্ঞান সীমিত দেখে আমি ঠিকমত দেখতে পাচ্ছি না? অনেক দিন ধরেই কাউকে জিজ্ঞেস করবো ভাবছি, কিন্তু ঝাড়ি খাওয়ার ভয়ে প্রশ্নটা করিনি। ভাবলাম আপনাকেই করি, আপনি হয়তো আমার অজ্ঞানতাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে উত্তরটা দিবেন 😕 .
@বন্যা আহমেদ,
একজন বিজ্ঞানি উদ্বিগ্ন কবিতা নিয়ে। অন্ততঃ আপনার প্রশ্নে যা বুঝতে পারছি ভালো কবিতা না হওয়া নিয়ে আপনার এই উদ্বেগ কবিদেরকে আশার আলো দেখাবে। তবে কেউ কেউ তো ‘আলো হাতে চলিয়াছে’, চলিতেছে।
আমারও একসময় মনে হতো কবিতা নিয়ে বুঝি আমাদের দেশেই অমন বাড়াবাড়ি। কিন্তু মার্কিন কবিতার সাথে, বা বলা যায় কবিদের সাথে, যখন যোগাযোগ শুরু হলো, অবাক হয়ে দেখলাম, একি এরা তো আমাদের থেকে কয়েকশ’ গুণ বেশী বাড়ছে! শুনে মন খারাপ করবেন না যে, এই নিউইয়র্ক শহরে (পাঁচ বোরে) প্রতিদিন প্রায় পাঁচশ’ কবিতার আসার বসে। আর কতো যে ম্যাগাজিন! সোহো’তে একটা মাগাজিনের দোকান আছে, ওখানে গেলে যে কারো পিলে চমকে যাবার কথা, হাজার হাজার কবিতা-জার্নাল! তবে সুখের কথা হলো যে হাজার হাজার অন্যান্য বিষয়ের জার্নালও দেখা যায়। আর আমাদের তো শুধু ঢাকা মুখি। এদের পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্যের প্রায় সবগুলো বড়ো শহর কেন্দ্রীক এই উন্মাদনা। তবে, ব্যতিক্রম হলো, বাংলাদেশে দৈনিকের সাময়িকীতে কবিতা ছাপা হয়। এটা এখানে হয় না। আমাদের তরুণ কবিরা অধিকাংশই তরুণ, কিন্তু এখানকার তরুণ কবিরা অধিকাংশই রিটায়ার্ড।
সুযোগ হলে একবার নিউজার্সির ‘ডজ পোয়ের্টি উৎসব’এ আসুন। তিন দিন ধরে দশ-পনের হাজার মানুষের ঢল নামে ওখানে। এমন উৎসব বড়ো বড়ো শহরকে ঘিরে যথেষ্ট আছে। লন্ডন ও প্যারিসের অবস্থাও প্রায় একই রকম। …তবে ভালো কবিতার অভাব সবখানে। ভালো কবি প্রতিদিন আসে না, একজন বড়ু চণ্ডীদাসের পর আরেক চণ্ডীদাসকে পেতে দুশ’ বছর অপেক্ষা করতে হয়। আর সেখান থেকে মধুসুদন দত্তর দূরত্বও প্রায় দেড়শ’ বছরের। ইংরেজীতেও প্রায় একই রকম দেখা যায়, একজন চসারের পরে একজন শেক্সপীয়র আসতে প্রায় পোনে দুশ’ বছর লাগে। তবে স্বীকার করতেই হবে, রোমান্টিক ও আধুনিক কালে (উভয় ভাষায়) আমরা অল্প সময়ে অনেকগুলো বড়ো কবি পেয়ে গেছি। হয়তো কবিতায় উন্মাদনা আসার এটাও একটি প্রধান কারণ। …এই উত্তরটা লেখার সময় কৌতূহল বসত গুগলে ‘আমেরিকান পোয়েট্রি’ লিখে সার্চ করে এক কোটি নয় লক্ষ এন্ট্রি পেলাম। অবস্থাটা বুঝুন! আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপনের জন্যে।
কোন কথা নাই, না পড়েই আগে ধন্যবাদ দিয়ে নেই। পড়ে আবার মন্তব্য করব। হাসান ভাই অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ এই লেখাটার জন্য।