সক্রেটিসগণঃ অন্ধ বিশ্বাসের আতংক

বাদল চৌধুরী

মহামান্য সক্রেটিস। বলা হয়ে থাকে দর্শন যোগের অধিনায়ক তিনি। নীতি শাস্ত্রের প্রবক্তা হিসাবেও স্বীকৃত। এই গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস জন্মগ্রহণ করেন খ্রীষ্টপূর্ব ৩৯৯ সালে। কোন কিছু লিখে না গেলেও তিনি দর্শন চর্চা করে গেছেন বক্তৃতার মাধ্যমে। মূলত তিনি তীক্ষ্ণ যুক্তি ও প্রশ্নবানের মাধ্যমে তুলে নিয়ে আসতেন দর্শনের বিভিন্ন দিক । তার দর্শনকে পরবর্তী প্রজন্মে তথা আজকের মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছেন তার সুযোগ্য শীষ্য দার্শনিক প্লোটো। সক্রেটিসের উপর তার লেখনির মধ্যে প্লেটোর সংলাপ অন্যতম। সক্রেটিস জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার উপর আলোচনা করে গেছেন বিস্তর। তিনি আর একটা কাজ করতেন, হাটে বাজারে, লোক সমাগমে বক্তৃতা করে বেড়াতেন। তার বক্তৃতার অন্যতম বিষয় সমাজে প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে এবং বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মুখোশ খুলে দিতেন প্রচন্ড যুক্তি ও ক্রস প্রশ্নের মাধ্যমে । তার এ ধরনের বক্তৃতায় তরুনেরা প্রচন্ডভাবে আকৃষ্ট হতে লাগল । ফলাফল চলে গেল তার বিপক্ষে। সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের শত্রুতে পরিনত হয়ে গেলেন। তার বিরুদ্ধে প্রধানতঃ দুইটি অভিযোগ আনিত হয়। (১) তিনি প্রজন্মের তরুন সম্প্রদায়কে পথভ্রষ্ট করছেন এবং (২) প্রচলিত দেবদেবতাদের অস্বীকার করছেন। অভিযোগ আদালত অবদি গড়ানোর ফলে বিচার কার্য শুরু হলো । বিচার সভার সদস্য ছিলেন ৫০১ জন। সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ডের পক্ষে তিরিশটি ভোট বেশি পড়ায় মৃত্যুর দন্ডাদেশ জারী করলেন আদালত । হেমলক বিষ পান করিয়ে সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড কার্যকরী করা হলো। আর সাথে সাথে এথেন্সবাসী দায়ী হয়ে গেলেন দার্শনীক সক্রেটিসকে হত্যার দায়ে। চিরতরে নষ্ট করে দেয়া হলো এমন একটি প্রতিভাকে, যিনি মানুষের মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসার দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন সেই ২৪০০ বছর আগে। মূলত তিনি সময়ের অনেক আগে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সর্বকালের ধর্মপ্রাণ নাগরিকদের জন্য পরিতাপের বিষয়, আজো সেই আত্মজিজ্ঞাসার দুয়ার রুদ্ধ হয়নি। বরং কালের বিবর্তনে আরো সহস্র উপায়ে তাদের সামনে হাজির হয়েছে। আজকে সব আস্তিক ধর্মবাদীদের যাবতীয় বিশ্বাস, কর্মকান্ড প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে প্রতিটি পদে পদে। একজন সক্রেটিসের মৃত্যুতে কি থেমে গেছে জ্ঞান পিপাসু মানুষের জিজ্ঞাসা? এই মহামানবের অপরাধ ছিল তিনি প্রচলিত ধর্মীয় মতবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পেরেছিলেন এবং তথাকথিত পন্ডিতদের মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন। তিনি তার এধরনের অবস্থানের পক্ষে পরকাল প্রসংগে যে যুক্তি দিয়েছেন তা হচ্ছে, “যা জানিনা তা জানি মনে করা বৈধ নয়। যা নিজে জানিনা, তা জানি মনে করার মতো নিন্দনীয় গোমরাহি আর কিছুই নাই।—- মরনের পরে কি হয় তা আমি জানিনা । তাই কখনো দাবীও করিনা যে, আমি জানি । সুতরাং যে সব জিনিস আমি জানিনা সে সব জিনিসকে আমি ভয়ও পাবনা।” সাথে সাথে আমাদের মধ্যে আরো সহস্র প্রশ্নের উদয় হয়ে যায়। ব্যাখ্যাতীত সেই ঈশ্বর, অজ্ঞাত পরকাল, অজ্ঞাত সেই দোযখের ভয় আমাদের এই অন্ধ সমাজটাকে পুরোপুরি কাবু করে ফেলেছে । সক্রেটিস এই অজ্ঞাত পরিনতির ভয়ে কুকড়ে যাওয়া সমাজটাকে নাড়া দেয়ার চেষ্টা করিছেলেন। অন্তত একবারের জন্য জ্ঞানের চক্ষূ মেলে দেখার জন্য, অন্তত একবার যুক্তির ছাঁচে জালাই করে আশে পাশের জগৎটাকে ব্যাখ্যা করার জন্য। তিনি যতটুকু ব্যর্থ হয়েছিলেন, ততটুকু সফলও হয়েছিলেন বটে। কেননা আজকের মৌলবাদীদের নানান মাথা ব্যথা। অন্তত তাদের (ঈশ্বরের লোকদের) অবস্থানটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা গেছে।

“এইসব দেখি কানার হাট বাজার”। একটি বাংলা বাউল গানের প্রথম লাইন। (গীতিকারের উদ্দেশ্য এখানে মূখ্য বিষয় নয়) । শব্দগত দিক থেকে এই লাইনটি তেমন কিছু না। কিন্তু মর্মার্থও কম নয় । ধর্মান্ধরা তাদের কানা চোখ দিয়ে তাদের প্রয়োজনের বাইরে আর কিছুই দেখেন না। তারা বউকে প্রহারের মধ্যে অনৈতিকতার কিছুই দেখেননা। জিহাদ (ধর্মযুদ্ধ) করে জনপদ রঞ্জিত করার মধ্যে কোন অপরাধ দেখেননা, সতীদাহ প্রথার মত জগন্য রীতির মধ্যে তারা পূণ্যত্ব দেখেন, বিচারের নামে মানুষের দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্নতার মধ্যে তারা কোন অমানবিকতা খুঁজে পান না । গলা পর্যন্ত মাটিতে পুতে পাথর নিক্ষেপ করে মানুষ হত্যার মধ্যে তারা দেখেনা কোন নির্মমতা। ৬বছরের বালিকাকে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করার মাঝে তারা কোন বর্বরতা দেখতে পান না। নিজের পালক (ধর্মপুত্র) পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করার মধ্যে তারা কোন অসভ্যতা খুঁজে পান না। তাদের বিবেক চক্ষু কি অন্ধ নয়? এরা কি জ্ঞান পাপী নয়? কার স্বার্থে এরা কানা হয়ে আছে? আর এই কানাদের সংখ্যাই বা কত? হাট-বাজার-মাজার থেকে শরু করে রাজার প্রাসাদ, রান্ন ঘর থেকে শুরু করে বাসর ঘর, দুষ্ট জ্ঞান থেকে শুরু করে অপবিজ্ঞান সব খানে এই কানাদের দুর্দান্ত প্রতাপ, প্রভাব। সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজনীতি, ফ্যামিলি টিচিং, সংস্কৃতি, দেশাত্ববোধ সবখানে এই কানাদের অবাধ বিচরণ। সবখানে তাদের এতই প্রভাব যে কোন স্বাধীন মত প্রকাশ করলেই তার উপর নেমে আসে জগন্য থাবা। প্রায় ২৪০০ বছর আগে এই কানাদের কানা বলেছিলেন বলে সক্রেটিসকে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে তাকে হত্যা করা হলো। ওখানেই থেমে থাকেনি তারা, ৪১৫ সালে নির্মমভাবে শরীরের অংগ প্রত্যংগকে টুকরো টুকরো করে হত্যা করা হলো বিজ্ঞ দার্শনিক হাইপেশিয়াকে। ১৬০০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞানী ব্রুনোকে বাইবেলের বিরুদ্ধে কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদের সমর্থন করার অপরাধে উলঙ্গ করে খুঁটির সাথে বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো। হুমায়ুন আজাদকে চাপাতির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করা হয় প্রথার বিরুদ্ধে লেখনির জন্য। তাসলিমা নাছরিনকে মাতৃভূমি থেকে নির্বাসিত হতে হয় স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অপরাধের জন্য । হায়রে, এই অন্ধ সমাজ। তারা এইসব অপকর্মের জন্য অনুসূচনা তো দূরের কথা, মিষ্টি মূখ করে উল্লাস করেও বহাল তবিয়তে আছে। অনুমান করা যায় ওদের শিকড় কত গভীরে?

আর একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে তথাকথিত প্রগতিশীল লেখকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। প্রগতির কথা লিখতে লিখতে একেবারে ক্লান্ত, শ্রান্ত। তারপরও লিখে যাচ্ছেন অবিরত। যে ধর্মগুলো (ধর্মীয় সংস্কার) দ্বারা প্রগতির চাকাকে উল্টো দিকে ঘুরানো হচ্ছে সেই ধর্মীয় রেওয়াজ এবং রীতি কিংবা পবিত্র গ্রন্থগুলোর উপর কোন সুনির্দিষ্ট এবং বস্তুনিষ্ট আলোচনা তারা করেন না। আর একধরনের তথাকথিত প্রগতিশীল সংবাদপত্রের সম্পাদককে আমরা টুপি মাথায় মসজিদে তওবা করতে দেখি। অপরাধ, পত্রিকার ফান ম্যাগাজিনে মুহাম্মদ নাম নিয়ে ব্যাঙ্গ করে কার্টুন ছাপা হয়েছে। সম্পাদক সাহেব তওবা করে কলেমা পড়ে নবরুপে ঈমান আনয়ন করে ছাচ্চা মুসলমান হলেন। অথচ দেখুন এদের উপর নির্ভর করছে প্রগতি, সেকুলারিজম, মানবতা, নৈতিকতার মত মানুষের মনস্তাত্বিক অবকাঠামোগত উপাদানগুলোর ব্যাখ্যা কি রকম হবে। অন্তত আমাদের দেশে তারাই মুখপাত্র। তারাই এখন দাবী করতে পারে সর্বাদিক প্রচারিত দৈনিক। এই দেশে তাদের গ্রহণযোগ্যতা এত বেশি। এক কানা (ছদ্মবেশী কানা) আর কানারে জ্ঞানের আলো দেখাচ্ছে। এসব কানারাই আমাদের সমাজের জাতির বিবেকের দায়িত্ব পালন করছে। কোথায় নেই এরা? মানুষের যে জায়গায় সর্বপ্রথম সংস্কারের প্রয়োজন সে জায়গাটি হচ্ছে, ব্যক্তির বিবেক। আর সেই বিবেকটাই দখল করে আছে ওই জ্ঞান পাপীর দল। ব্যক্তির বিবেকের চার পাশে এমন প্রতিরক্ষার দেয়াল স্থাপন করা হয়েছে যে, সেখানে মানবিক নৈতিকতা, ইহজাগতিকতা, বিজ্ঞান মনস্কতা প্রভৃতির অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ। যখনি কোন সক্রেটিস বা হুমায়ুন আজাদেরা গোমরাহির উপর/অন্ধবিশ্বাসের উপর তাদের স্বাধীন মত প্রকাশ করেন তখন চারপোশে রে রে—- রবে পৃথিবী প্রকম্পিত হয়। এমনকি এধরনের স্বাধীন মতামতকে রাষ্ট্র কর্তৃক নিষিদ্ধ করা হয় কোন প্রকার বাচ-বিচার ব্যতিরেকে। আর অন্য দিকে রাষ্ট্রিয় পৃষ্টপোষকতায় এবং সরকারী অর্থায়নে প্রকাশিত হয় অহরহ পুস্তকাদি যা অন্ধবিশ্বাস এবং ধর্মানুভূতির উপর রচিত অপজ্ঞান। রাষ্ট্রিয় এবং সামাজিকভাবে জ্ঞান পাপীরা যে সুবিধা পেয়ে আসছে সেই আবহমান কাল থেকে তার ফলশ্রুতিতে আমাদের এই অন্ধ সমাজ। স্বাভাবিকভাবেই তার ব্যক্তির বিবেকের চারপাশে দেয়াল তৈরী করতে অতিরিক্ত সুবিধার মধ্যে রয়েছে। অপর দিকে নানান প্রতিবন্ধকতা, রাষ্ট্রিয় নিষেদাজ্ঞা, মানুষের অজ্ঞতা, শিক্ষার প্রতিকুল পরিবেশ প্রভৃতি বাঁধা অপসারণ করে মুষ্টিমেয় কয়েকজন স্বাধীনচেতা ব্যক্তির দ্বারা এত বিস্তর পরিসরে ছড়িয়ে যাওয়া জ্ঞানকে পরিশুদ্ধ করা মোটেও সহজ নয়। ডিগ্রীধারী শতশত তথাকথিত প্রগতিশীল চিন্তাবিদ দ্বারা সমাজের জীর্ণ বিবেকগুলোকে আরে জীর্ণ করা সম্ভব। কিন্তু তাদের দ্বারা পরিত্রান সম্ভব নয়। অথচ স্বশিক্ষিত একজন আরজ আলী মাতুববর এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজটাকে, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসকে উপযুক্ত আঘাত করতে সক্ষম হয়েছেন। মানুষের চেতনাকে যাবতীয় অন্ধত্ব থেকে মুক্ত করতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্ব কম তা হয়ত বলা যাবেনা। পাঠ্য পুস্তক থেকে শুরু করে শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি ছাত্রদের মধ্যে যেমন প্রভাব ফেলে তেমনি জনপ্রিয় লেখকদের লেখাও প্রভাব পড়ে প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মানসিকতার উপর। বুদ্ধির মুক্তির জন্য এই দুইটি মাধ্যমের ভূমিকা আজ অপরিহার্য বলে মনে হচ্ছে।