ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন [০১] [০২] [০৩] [০৪] [০৫] [০৬] [০৭] [০৮] [০৯] [১০][১১][১২][১৩][১৪][১৫][১৬][১৭][১৮]

১৯
২৭ জুলাই ১৯৯৮ সোমবার
উইলির ফ্ল্যাট

মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অব আর্কিটেকচার, বিল্ডিং এণ্ড প্ল্যানিং বা সংক্ষেপে এবিপি’র বেশ নামডাক আছে। অস্ট্রেলিয়ার অনেক বড় বড় স্থাপনা গড়ে উঠেছে এ ফ্যাকাল্টি থেকে পাস করা স্থপতিদের হাতে কিংবা এর শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে। অথচ কেন জানি না- পুরো ইউনিভার্সিটির কয়েকশ’ বিল্ডিং এর মধ্যে হাতে গোনা যে ক’টা বিশ্রী বিল্ডিং আছে- আর্কিটেকচার বিল্ডিং-টাই হলো তাদের সেরা। আমার ধারণা অবশ্য ভুলও হতে পারে। তোমার মতে আমার সৌন্দর্যজ্ঞানতো ‘টেরিবল’। সে যাই হোক- এই বিল্ডিংটাকে এড়িয়ে চলার কোন উপায় নেই আমার। কারণ এর নিচের তলার একদিকে পোস্ট অফিস আর অন্যদিকে কমনওয়েলথ ব্যাংক। সকালে চিঠি পোস্ট করে ফেরার পথে ব্যাংকে ঢুকলাম।

সোমবারের সকাল। ব্যাংকে মোটামুটি ভীড়। পাঁচটা কাউন্টারেরই ব্যস্ততা। গত চৌদ্দ তারিখ একাউন্ট খোলার পর একটা কাগজে একাউন্ট নাম্বার লিখে দিয়েছিল। বলেছিল চারদিন পর এসে ব্যাংক-কার্ড নিয়ে যেতে। অথচ এলাম তেরো দিন পর। একাউন্ট নাম্বারটা দ্রুত টাইপ করলেন বুড়ো ভদ্রলোক- জুলিয়ান। মনিটরে চোখ রেখেই প্রশ্ন করলেন- “গট এন এড্রেস নাউ?”

বাংলাদেশের ঠিকানা দিয়েই একাউন্ট খুলেছিলাম। এখন বাসার ঠিকানা জানিয়ে দিলাম। জুলিয়ান একটা ড্রয়ার থেকে কয়েকটি খাম বের করে এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। ব্যাংকের চিঠি। বললেন, “কী-কার্ড আর পিন নাম্বার আছে আলাদা আলাদা খামে। পিন নাম্বার কাউকে বলো না”

স্কলারশিপের টাকা জমা হয়েছে কি না দেখা দরকার। জিজ্ঞেস করলাম। ব্যাংকিং সম্পর্কে আমি যে কিছুই জানি না তা বুঝতে জুলিয়ানের সময় লাগলো না একটুও। হাসিমুখে বললেন, “ইউ ক্যান চেক ইট ফ্রম এনি কমনওয়েল্‌থ এ-টি-এম। এ-টি-এম থেকে একাউন্ট ব্যালেন্স দেখে নিতে পারো, অথবা ফোন ব্যাংকিং। যে কোন ফোন থেকে ১৩২২২১ নম্বরে ফোন করে ফোন ব্যাংকিং করা যাবে”।

ব্যাপারটা সম্পূর্ণ নতুন আমার কাছে। জুলিয়ান বুঝতে পারলেন আমার অবস্থা। কাউন্টারের পাশে দেয়ালে লাগানো টেলিফোনটা দেখিয়ে বললেন, “ওটা থেকে ডায়াল করো ১৩২২২১ নম্বরে”।

মজা লাগলো যান্ত্রিক কন্ঠস্বর শুনে। যন্ত্রের নির্দেশ মত নম্বর টিপতে টিপতে ফোন ব্যাংকিং সেট হয়ে গেলো। এটার জন্যও একটা ছয় অংকের পিন নাম্বার সেট করতে হলো। একাউন্ট ব্যালেন্স জেনে খুশি হলাম। পাঁচ ডলার জমা দিয়ে একাউন্ট খুলেছিলাম- সেখানে এখন পাঁচশ’ ডলারেরও বেশি জমা হয়েছে। জুলিয়ানকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এলাম।

প্লাস্টিকের ছোট্ট একটা কার্ড- পেছনে ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ লাগানো। ফটোকপি কার্ডের সমান মাপের। ঝকঝকে নতুন কার্ডে সতেরো অংকের নাম্বারের নিচে আমার নাম খোদাই করা। দেখেই ভালো লেগে গেলো। নিজেকে কিছুটা হলেও গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে।

অটোম্যাটেড টেলার মেশিন বা এ-টি-এম ব্যবহার করলাম আজ প্রথম। এদেশে এগুলো হয়তো অনেক দিন ধরেই আছে, কিন্তু এই আটানব্বই সালেও বাংলাদেশে এ-টি-এম পৌঁছায়নি। এখানে যেমন যেখানে সেখানে এ-টি-এম, বাংলাদেশে কি তা সম্ভব হবে? মেশিন ভরা টাকা’র জন্য অস্ত্রধারী প্রহরীও লাগবে আমাদের। কোন রকমের ট্রেনিং ছাড়াই এ-টি-এম ব্যবহার করতে পেরে নিজেকে বেশ ‘ইস্‌মাট’ মনে হচ্ছে। (শব্দটির কথা মনে আছে?)

পঞ্চাশ ডলারের কিছু কড়কড়ে নোট পকেটে ভরে ডিপার্টমেন্টে ফেরার সময় মনটা খারাপ হয়ে গেল। শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে যতবারই স্কলারশিপের টাকা পেতাম- বন্ধুরা হৈ চৈ করে ধরে নিয়ে যেতো রেস্টুরেন্টে। সবাই তখন ‘রাজা’ হয়ে উঠতাম কিছু সময়ের জন্য। টাকার একটা অংশ উড়ে যেতো কয়েক ঘন্টার মধ্যেই। অথচ আজ! কেউই কাছে নেই যার সাথে ‘হৈ চৈ’ করা যায়। তাছাড়া আমাদের আনন্দ আর এদের আনন্দেও কত পার্থক্য। এখানে অনেকে একসাথে খেতে যায় বটে, কিন্তু কেউ কাউকে খাওয়ায় না।

অফিসের সামনে এসে একটু তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল কেনের সাথে। “মর্নিং প্রাডিব”
“মর্নিং কেন্‌”
“হ্যাড এ গুড উইকএন্ড?”
এ জাতীয় প্রশ্ন ভদ্রতার ব্র্যাকেটে বন্দী। সপ্তাহান্তে আমি কী করেছি তা আসলেই জানতে চাচ্ছেন ভাবার কোন কারণ নেই। তাই ‘ইয়েস’ বলার পরই প্রসঙ্গ পরিবর্তন।
“বাই দি ওয়ে, লেসের সাথে কি তোমার পরিচয় হয়েছে?”
“না”
“লেস- মানে লেস অ্যালেন। আমাদের গ্রুপেরই একজন। সে আবার পোস্টগ্রাজুয়েট রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর। ৬০২ নম্বর রুমে তার অফিস”
“আমি কি দেখা করবো তাঁর সাথে?”
“দেখো সে অফিসে আছে কি না। আরেকটা কথা, লেস ফোর্থ-ইয়ারের একটা কোর্স পড়াচ্ছে এ সেমিস্টারে। স্ক্যাটারিং থিওরির কোর্সটা তোমার কাজে আসবে। তুমি চাইলে তার লেকচারে যোগ দিতে পারো”

এ রকম কোন কোর্সের কথা আমিও ভাবছিলাম। কেন্‌ ঠিকই বুঝতে পেরেছেন আমার কী লাগবে। কেন্‌কে ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে গেলাম করিডোরের শেষ প্রান্তে। ৬০২ নম্বর রুমের দরজায় লেখাঃ এসোসিয়েট প্রফেসর লেস অ্যালেন। বন্ধ দরজায় মৃদু টোকা দিলাম। কোন সাড়াশব্দ নেই। তার মানে তিনি অফিসে নেই। ফিরে এলাম নিজের ডেস্কে।

ম্যান্ডি এখনো আসেনি। ইমাজিন হয়তো ক্লাসে গেছে। তার ডেস্কের পাশে দেয়ালে ঠেকানো একটা সাইকেল দেখা যাচ্ছে। ডেস্কের ওপর ময়লা ব্যাকপ্যাক। পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে ইমাজিন যথেষ্ঠ উদাসীন। পিটারও মনে হয় আসেননি আজ। হিগ্‌স কম্পিউটার খালি পড়ে আছে। গত কয়েকদিনের রপ্তকরা ইউনিক্স অপারেটিং অনুশীলন করা যাক।

ইন্টারনেটের সাথে প্রত্যক্ষ পরিচয় হয়েছে কিছুদিন হলো। বাংলাদেশে থাকতে আমার বন্ধু অঞ্জন আর টিটুর ‘ইন্টারন্যাশনাল কম্পিউটার সার্ভিস’-এ গিয়ে ই-মেইল করতে হয়েছিল কয়েকবার। তখন ইন্টারনেটের সাথে পরোক্ষ পরিচয় হয়েছিল। কিন্তু সে অভিজ্ঞতা তেমন কোন কাজে লাগলো না এখানে। স্টুডেন্ট ডায়েরিতে ইন্টারনেট ইউজার গাইড দেয়া আছে। ওটা কাজে লাগিয়ে নেটস্কেপ ব্যবহার করতে করতে মনে হলো অন্যরকম একটা নতুন জগতের দরজা খুলে গেছে আমার সামনে। গবেষণা শিক্ষার্থী হবার সুবাদে আন-লিমিটেড ইন্টারনেট। ঘরে বসেই সারা-দুনিয়া ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ এখন আঙুলের ডগায়। ওয়েব এড্রেস টাইপ করে এন্টার করলেই হলো।

ঘন্টা দেড়েক সময় যে কীভাবে চলে গেলো টেরও পেলাম না। অন্তর্জালের ঘোর কাটলো দরজা খোলার শব্দে। ম্যান্ডির প্রবেশ। দ্রুত এসে তার ডেস্কের ওপর ব্যাকপ্যাকটা ছুড়ে ফেলে আমার মাথাটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিলো। ম্যান্ডির যে একটু গায়ে-পড়া ভাব আছে তা এ ক’দিনে বুঝতে পেরেছি।

“হোয়াট ইউ ডুয়িং? সার্ফিং!”
‘সার্ফিং’ শব্দটা নতুন আমার কাছে। নতুন নতুন প্রযুক্তির সাথে যুক্ত হয়ে পুরনো শব্দের নতুন অর্থবোধক ব্যবহার শুরু হওয়াটা স্বাভাবিক। আমি কিছু বলার আগেই ম্যান্ডি ব্যস্ত হয়ে বললো, “উহ্‌ বারোটা বেজে গেছে। আমার হেয়ার-ড্রেসারের সাথে এপয়ন্টমেন্ট আছে। বাই বাই” ঝড়ো হাওয়ার মত চলে গেল ম্যান্ডি রুমের দরজা খোলা রেখেই। দরজা খোলা রেখে কাজ করে এখানে সবাই। কোন দরজাতেই পর্দা নেই। আমরা রক্ষণশীল দেশের মানুষ, আড়াল পছন্দ করি। উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেবো ভাবছি- এমন সময় লেসের প্রবেশ।

লাল চুল আর লাল দাড়ির এই ভদ্রলোকই যে প্রফেসর লেস অ্যালেন তা দেখামাত্রই বুঝতে পারলাম। একটু আগেই আমি আমাদের থিওরি কিউ গ্রুপের ওয়েবসাইটে গিয়ে কেনের পাশাপাশি লেসের বায়োডাটাও পড়েছি, ছবি দেখেছি। ওই ওয়েবসাইটে ইতোমধ্যেই আমার নাম ও রিসার্চ টপিক যুক্ত হয়েছে। অবশ্য ছবি এখনো দেয়া হয়নি।

“হাই প্রাডিব। আই এম লেস”
দাঁড়িয়ে লেসের সাথে হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে খেয়াল করলাম তিনি খোসা-ছাড়ানো একটা বড় কলা ডান হাত থেকে বাম হাতে হস্তান্তরিত করে ডান হাতটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। মনে হলো ভদ্রলোক ঠিকমত কলা খেতে জানেন না। সম্পূর্ণ খোসা একেবারে ফেলে দিয়ে এভাবে কলা খেতে এর আগে শাহীন কলেজে দেখেছিলাম আমার একজন সহকর্মীকে। অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ায় কি সবাই এভাবেই কলা খায়? কলা অস্ট্রেলিয়ান ফল নয়। পাঞ্জাবী শিখরা এসে প্রথম কলার চাষ শুরু করে এখানে প্রায় দেড়শ’ বছর আগে। তবে কি শিখরাও এভাবে কলা খায়? জানি না তো।

লেস দক্ষিণ আফ্রিকার সাদা রঙের মানুষ। চোখদুটো স্বচ্ছ নীল। মুখে যদিও একটা হাসির রেখা লেগে আছে- আমার কেন যেন মনে হচ্ছে প্রয়োজনে ভীষণ হিংস্র হয়ে উঠতে পারেন এই লোক। এরকম মনে হওয়ার পেছনে একটাই মাত্র কারণ খুঁজে পেয়েছি তা হলো- ‘গান্ধী’ সিনেমায় দেখা দক্ষিণ আফ্রিকার যে পুলিশ অফিসার গান্ধীর হাতে লাঠির বাড়ি মেরেছিল সেই পুলিশ অফিসারের চেহারার সাথে লেসের চেহারার হুবহু মিল।

“সো প্রাডিব। আই হোপ ইউ সেটেল্ড ইন- আশা করি তুমি সব গুছিয়ে নিয়েছো”
“হ্যাঁ, একপ্রকার গুছিয়ে নিয়েছি”
“স্কলারশিপ চালু হয়েছে?”
“হ্যাঁ”
“ভেরি গুড। তাহলে এখানে একটা স্বাক্ষর করে দাও”

স্কুল অব গ্রাজুয়েট স্টাডিজের একটা ফর্ম। আমার রিসার্চ প্রজেক্ট আর সাথে আরো সব তথ্য। আশ্চর্য হয়ে গেলাম এই দেখে যে রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর নিজে এসেছেন শিক্ষার্থীর কাছে সাইন নেয়ার জন্য। মনে মনে বললাম, লেস স্যার, আপনি যদি আমাদের দেশের রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর হতেন, এই কাজটা হতো এভাবেঃ আপনি আপনার সহকারীকে বলতেন আমাদের খবর দেয়ার জন্য। আমরা সব কাজ ফেলে আপনার অফিসের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করতাম। আপনার সহকারী আমাদের বেশ কয়েকবার ধমক দিয়ে বলতেন- পরে আসবেন, স্যার এখন ব্যস্ত আছেন। আমরা আপনার সহকারীকে খুশি করে আপনার ব্যস্ততা কমানোর চেষ্টা করতাম। মাস্টার্সের গবেষণা প্রস্তাবের দরখাস্তে স্যারের সাইন নেয়ার জন্য স্যারের সহকারী আমাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা করে নিয়েছিলেন।

“কেন্‌ বলছিলো তুমি নাকি আমার স্ক্যাটারিং থিওরির লেকচারে যোগ দিতে চাও?”
“হ্যাঁ, যদি আপনি অনুমতি দেন”
“স্বচ্ছন্দে। সপ্তাহে তিনটা লেকচার। মঙ্গল, বৃহস্পতি আর শুক্রবার। সকাল দশটা থেকে বারোটা। গত সপ্তাহে তিনটা লেকচার হয়ে গেছে। কাল সকালে চার নম্বর লেকচার। ফিজিক্স পোডিয়ামের ১১ নম্বর লেকচার রুমে”
“থ্যাংক ইউ স্যার”
“কল মি লেস্‌। কোন সমস্যা হলে আমাকে জানাবে। আমাকে এখন লাঞ্চ করেই ছুটতে হবে একটা মিটিং-এ” বলে হাতে ধরা কলায় কামড় দিয়ে চিবুতে চিবুতে চলে গেলেন। তাহলে কাল থেকে ক্লাস শুরু হচ্ছে। এদেশের পাঠ-পদ্ধতি কেমন কাল কিছুটা বুঝতে পারবো।

ডিপার্টমেন্টাল একাউন্টে দিঠুনের কোন ই-মেইল না পেয়ে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছি। সে এবার এস-এস-সি পরীক্ষা দিয়েছে। আজ তার রেজাল্ট বেরোনোর কথা ছিল। মনে হয় পিছিয়ে গেছে। গতকাল দিদিভাইর সাথে তাকেও ইমেইল করেছিলাম। টিটু ইমেইলে জানিয়েছে সে আমার ইমেইল প্রিন্ট করে দিদির বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। এখানে আসার সময় অঞ্জন আর টিটুকে বলে রেখেছিলাম আমি যদি ই-মেইল করি তা যেন প্রিন্ট করে দিদির বাসায় পাঠিয়ে দেয়। অথবা ফোন করে জানালে বাসা থেকে কেউ এসে নিয়ে যাবে। সামান্য প্রিন্টিং খরচের বিনিময়ে তারা যে আমার এতবড় উপকার করছে- কীভাবে তাদের ধন্যবাদ দেবো জানি না।

সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে সেফওয়েতে গেলাম। এখানে জিনিস-পত্রের দাম মনে হচ্ছে প্রতিদিনই উঠানামা করে। আলুর দাম দেখে একটু অবাক লাগলো। কিছু আলু একেবারে পরিষ্কার করে ধোয়া ধবধবে সাদা। দাম এক ডলার নব্বই সেন্ট মানে সাতান্ন টাকা কেজি। তার পাশেই রাখা আছে অপরিষ্কার আলু- চামড়ায় যাদের মাটি লেগে আছে এখনো- দাম মাত্র পঞ্চাশ সেন্ট অর্থাৎ পনেরো টাকা কেজি। হয়তো একই মাঠের আলু- শুধুমাত্র পরিচ্ছন্নতার কারণে দামের এত পার্থক্য। বুঝতে পারছি এদেশে শ্রমমূল্য অনেক ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্যের চেয়েও বেশি।

রান্না করেছি ডিম আলু আর মিষ্টিকুমড়া। রান্নাঘর থেকে বেরোবার সময় ডেভিডকে দেখেছি একটু করে। মনে হলো আমাকে দেখেই দ্রুত চলে গেলো নিজের রুমে। আমার বিশ ডলার ফেরৎ দেয়ার কথা কি ভুলে গেল সে?

খাওয়া শেষ করে লিখতে বসেছিলাম। বাইরে ডেভিড, জোয়ানা আর ফিলের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সিরিয়াস কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মাঝে মাঝে বেশ জোরে শোনা যাচ্ছে ‘ফা.. ইউ’। পিতা-পুত্রের মাঝে এরকম কুৎসিত বাক্যবিনিময় আমাদের দেশের বস্তিতেও শোনা যায়। কি আশ্চর্য মানুষের শরীর-ভাবনা। কত সুন্দর সুন্দর বিশেষণ আমরা আবিষ্কার করেছি শরীরের বর্ণনা দেয়ার জন্য, আবার সবচেয়ে কুৎসিত কথাগুলোও তৈরি হয়েছে এই শরীরকে ঘিরেই।

২৮ জুলাই ১৯৯৮ মঙ্গলবার
উইলির ফ্ল্যাট

কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। অপমান লাগছে খুব। মুখের উপর সহজ সত্যি কথা কেউ বললে তা হজম করতে এত কষ্ট কেন লাগে বলতে পারো? আসলে অপ্রিয় সত্য কথা বলা যত সহজ সহ্য করা তত সহজ নয়। যাক একটা শিক্ষা হলো – সোজাসাপ্টা কথা বলার পাশাপাশি সোজাসাপ্টা কথা সহ্য করার অনুশীলনও করতে হবে। ব্যাপারটা ঘটেছে ফিলের সাথে। তেমন মারাত্মক কিছু নয়- তবুও কেন যে এত খারাপ লাগছে।

বিকেলে আলী সাহেব ফোন করেছিলেন অফিসে। জিজ্ঞেস করলেন আমি বিট্টুর সাথে কথা বলেছি কিনা। বিট্টুর সাথে এরমধ্যে কোন কথা হয়নি আমার। তাকে ফোন করেছিলাম কিন্তু পাইনি।
“কাল রাতে তুমি বাসায় ছিলে না?”
“ছিলাম তো”
“তবে ফিল যে বললো তুমি নেই! বিট্টু তোমাকে অনেকদিন বাসায় ফোন করেছে। তুমি কোন ম্যাসেজ পাওনি?”
“না, ফিল তো আমাকে কিছু বলেন নি”
“কালকে আমিও ফোন করেছি। ফিলকে বললাম তোমাকে ডেকে দিতে। সে বললো তুমি বাসায় নেই”
“আমি তো কাল সন্ধ্যা থেকে বাসায়। ফিল তো আমাকে কিছু বলেনি”
“বুঝতে পারছি। তুমি বিট্টুকে ফোন করো। সে তোমার জন্য কী একটা কাজ জোগাড় করেছে”।

ফিলের ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। তিনি কেন আমাকে ডেকে দিলেন না? বিট্টু এতদিন ফোন করেছে, একটা বারও তো ফিল আমাকে কিছু বলেন নি। হঠাৎ মনে পড়লো সেফওয়েতে যে চাকরির দরখাস্ত জমা দিয়ে এসেছিলাম সেখানেও ফিলের নম্বর দিয়েছিলাম। খোঁজ নেয়া দরকার।

সেফওয়েতে গিয়ে স্টোর ম্যানেজারের সাথে কথা বললাম। তিনি ফাইল খুলে বললেন, “তোমাকে তো ডেকেছিলাম ইন্টারভিউর জন্য। তুমি তো আসো নি, কোন খবরও দাওনি”
“আপনারা কি ফোন করেছিলেন?”
“হ্যাঁ, তাই তো করি। তোমার দেয়া নম্বরেই তো ফোন করেছিলাম। গতকাল আসতে বলেছিলাম। আমি খুব দুঃখিত, আমরা তো লোক নিয়ে ফেলেছি যতজন দরকার। তুমি চাইলে তোমার দরখাস্ত আবার বিবেচনার জন্য রেখে দিতে পারি”

কোন রকমে ধন্যবাদ দিয়ে বাসায় ফেরার পথে রাগে মাথায় রক্ত উঠে গেল। ফিল কেন এরকম করবে? আমার টেলিফোন এসেছে আমাকে বলবে না? কিন্তু ফিলের ওপর রাগ করে আমি যে কত অনধিকারচর্চা করেছি তা বুঝতে পেরেছি ফিলের সাথে কয়েকটা বাক্য বিনিময়ের পরেই।

রেগে গেলে কথাবার্তা ঠিকমত গুছিয়ে বলতে পারি না আমি। যুক্তিবোধগুলোও কেমন যেন ভোঁতা হয়ে যায়। বাসায় ঢুকেই সরাসরি চলে গেলাম লাউঞ্জরুমে। ফিল মদের পাত্র হাতে টিভির সামনে বসে আছেন। তাঁর সঙ্গিনী এখনো আসেন নি।
“হাই ফিল”
“প্রাডিব। হাউ আর ইউ মাইট?”
“গুড। আপনার সাথে কি একটু কথা বলতে পারি?”
“অবশ্যই। কী ব্যাপার?”
“আমার কি কোন ফোন এসেছিল?”
“তোমার ফোন? তোমার ফোন এখানে আসবে কেন?”
“আপনার নম্বরটা আমি দিয়েছিলাম কাজের জন্য। ওখান থেকে ফোন করে আমাকে ডেকেছিল ইন্টারভিউর জন্য। আপনি আমাকে জানাননি”
“তাতে কী হয়েছে?”
“ফোনটা জরুরি ছিল”
“হু কেয়ার্‌স?”
“আই কেয়ার। আমাকে জব ইন্টারভিউর জন্য ডেকেছিল। কিন্তু আপনি আমাকে জানান নি”
“থামো থামো। এই ফোনটা তোমার না আমার?”
“আপনার”
“আমার নম্বর অন্যকে দেবার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে?”
“জ্বি না”
“এই টেলিফোনের জন্য তুমি আমাকে কোন পয়সা দাও?”
“না”
“তোমাকে ঘরভাড়া দেবার সময় কি আমি বলেছিলাম যে তুমি টেলিফোন ব্যবহার করতে পারবে?”
“ব্যবহার যে করতে পারবো না তাও তো বলেন নি”
“এখন তো বললাম”

নির্বিকার ভাবে মদের পাত্রে চুমুক দিচ্ছে ফিল। আর কথা বাড়ানোর মানে হয় না। রুমে চলে এলাম। রাগে অপমানে অস্থিরতায় কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। গাল বাড়িয়ে চড়টা নিজে নিজেই খেয়ে এসেছি, যন্ত্রণা তো লাগবেই। কষ্টের ভাগ দেয়ার জন্য তোমাকে লিখতে বসেছিলাম। লিখতে লিখতেই রাগটা কমে গিয়ে যুক্তিবোধ ফিরে এসেছে।

“অচেনা অন্ধকার পথে চলার সময় নিজেকে যথাসম্ভব নমনীয় করে ফেলবি। তখন শক্ত কিছুতে ধাক্কা লাগলেও ব্যথা কম পাবি” আমার ক্লাস-ফোর পাস বাবার দার্শনিক কথাবার্তা। খুব মনে পড়ছে কথাগুলো, সাথে মানুষটাকেও। এখানকার কিছুই চিনি না, পায়ের তলায় মাটির নাগাল পাইনি এখনো। রাগ করার কোন যোগ্যতাই নেই আমার। ফিল তো ঠিক কথাই বলেছেন। কী দায় পড়েছে তাঁর যে আমার প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেবেন?

থাক এসব কথা। আজ লেস অ্যালেনের ক্লাস করলাম। ফোর্থ ইয়ার বা অনার্স ইয়ারের সাত জন শিক্ষার্থী স্ক্যাটারিং থিওরির কোর্সটা নিয়েছে। আমি সহ আটজন হলাম। আমাদের অনার্স সিস্টেমের সাথে এদের সিস্টেমের পার্থক্য অনেক। আমাদের মত ফার্স্ট ইয়ার থেকেই এরা অনার্স শুরু করে না। তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স শেষ করার পর শতকরা আশিভাগ নম্বর পেলে অনার্স করার সুযোগ পাওয়া যায়। এবছর ফিজিক্সে উনিশ জন অনার্স করছে। উনিশ জনের মধ্যে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে মাত্র সাতজন- পাঁচজন ছেলে আর দু’জন মেয়ে। পরিচয় হলো সবার সাথে। ম্যাট আর ফিওনা যেভাবে আঁঠার মত লেগে আছে একে অপরের সাথে- বোঝাই যাচ্ছে নতুন জুটি।

আমি যে তিনটা ক্লাস মিস করেছি সেগুলোর লেকচারনোট দিয়ে দিলেন লেস। কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির জটিল ব্যাপারগুলো যেভাবে বোঝালেন তাতে মনে হলো কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কিছু কিছু অংশ বুঝতে পারছি। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বুঝলেও আবার বিপদ আছে। রিচার্ড ফাইনম্যান বলেছেন “ইফ ইউ থিংক ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড কোয়ান্টাম মেকানিক্স, ইউ ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড কোয়ান্টাম মেকানিক্স”- তুমি যদি মনে করো যে তুমি কোয়ান্টাম মেকানিক্স বোঝ, তুমি আসলে কোয়ান্টাম মেকানিক্স বোঝ না। তাই ঠিক বুঝতে পারছি না বুঝতে পারছি কি না।

আমাদের অনার্স আর মাস্টার্সে কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়াতেন প্রামাণিক স্যার। স্যারকে কষ্ট করে সবগুলো সমীকরণ ব্ল্যাকবোর্ডে লিখতে হতো। পুরো সময়টাই চলে যেতো সমীকরণের পর সমীকরণ লিখতে। আর আমরাও বোর্ড থেকে খাতায় তুলতাম প্রায় কিছু না বুঝেই। পরীক্ষার সময় ঝাড়া মুখস্থ। এখানে মুখস্থ করার ঝামেলা নেই। কারণ এই কোর্সে নাকি ওপেন বুক এক্সামিনেশান। বই খাতা নোট দেখে দেখে পরীক্ষার খাতায় লেখা। এ রকম পরীক্ষার কথা আগে কখনো শুনিনি। কোর্স শেষ হলেই বোঝা যাবে কেমন পরীক্ষা হয়।

আজ রাখছি এখানে। ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে না আর। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে- টাপুর টুপুর বৃষ্টি। যাই একটু ভিজে আসি।

ক্রমশ________