উৎসর্গ: নৃপেন্দ্র সরকার

এই সিরিজটি কাল্পনিক সংখ্যাকে নিয়ে। সাধারণত $latex i$ প্রতীক দিয়ে এ সংখ্যাটিকে প্রকাশ করা হয়। তবে আসল উদ্দেশ্য কাল্পনিক সংখ্যার সাহায্যে গাণিতিক সাধারণীকরণের প্রক্রিয়া কিছুটা হলেও বোঝাবার চেষ্টা করা। লেখাটি সব ধরণের পাঠককে উদ্দেশ্য করে লেখা, কাজেই বুঝতে অসুবিধা হলে সেটা আমারই ব্যর্থতা, এবং সেটা ধরিয়ে দিলে যারপরনাই কৃতজ্ঞ থাকব। সিরিজে কয়টি পর্ব থাকবে তা এখনও নিশ্চিত নই, সম্ভবত ৪।

কাল্পনিক সংখ্যাকে বেছে নেবার আরেকটা কারণ আছে। কাল্পনিক সংখ্যার সংজ্ঞা হল $latex i = \sqrt{-1}$ বা অন্যভাবে বলতে গেলে $latex i^2 = i \times i = -1$। সংখ্যাটি একটু রহস্যময়। কোন সংখ্যাকে বর্গ করলে কিভাবে -১ পাওয়া সম্ভব, সাধারণ বুদ্ধিতে তার কূল পাওয়া যায়না। কারণ সাধারণ ভাবে আমরা জানি, একটি সংখ্যাকে বর্গ করলে একটি ধনাত্মক সংখ্যা পাওয়া যায়, মূল সংখ্যাটা নিজে ধনাত্মক-ঋণাত্মক যাই হোক না কেন। যেমন, $latex 2 \times 2 = 4$ আবার $latex -2 \times -2 = 4$। “কাল্পনিক” নামটাও এই রহস্যময়তার দিকে ইঙ্গিত দেয়। এর একটি কুফল হল, একসময় $latex i$ সহ $latex e, \pi$ এসব “রহস্যময়” সংখ্যা নানান ধরণের আধা-বৈজ্ঞানিক অপলাপে ব্যবহৃত হত, এমনকি ঈশ্বর প্রমাণের কাজেও! কাল্পনিক সংখ্যার রহস্য ব্যাখ্যা করাও তাই একটা উদ্দেশ্য।

এই পর্বে কাল্পনিক সংখ্যার কথা তেমন উল্লেখ করা হবে না। সাধারণ কিছু কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকব। গণিতের দুটি দিক নিয়ে প্রথমে কথা বলতে চাই। একটিকে আমরা বলব সামাজিক, অন্যটিকে অভ্যন্তরীন।

“সামাজিক” যখন বলছি, তখন সমাজ বলতে বোঝাচ্ছি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সমাজকে, গণিত যার সদস্য। গণিত বিষয়ক কিছু সামাজিক প্রশ্ন হতে পারে এরকম:

  • পরিসংখ্যানের ছাত্রদের কি ক্যালকুলাস শেখবার দরকার আছে?
  • বীজগাণিতিক জ্যামিতি কি পদার্থবিদদের কাজে আসে?
  • গণিত গবেষণার পেছনে সরকারি বাজেটের কি পরিমাণ ব্যয় করা উচিত?
  • সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর গতিপথ কি একটি উপবৃত্ত?

প্রশ্নগুলি পড়ে হয়ত বোঝা যাচ্ছে, এসব প্রশ্ন গণিতের উপযোগিতার প্রশ্ন, গণিত জ্ঞানের অন্য শাখাগুলিকে সাহায্য করার মাধ্যমে তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করছে কিনা সে বিষয়ক জিজ্ঞাসা। জ্ঞানের সব শাখাই পরস্পর সংলগ্ন, এবং দায়িত্ববান যেকোন বিদ্যার এই সামাজিক প্রশ্ন গুলোর সদুত্তর দিতে পারার কথা।

অনেক গাণিতিক ধারণার উৎপত্তি এই সামাজিক কারণের সাথে সংশ্লিষ্ট। প্রাচীন মিশরে জমি পরিমাপ থেকে জ্যামিতির গোড়াপত্তন হয়েছে, ক্যালকুলাসের বিকাশ ঘটেছে পদার্থবিদ্যার নানান সমস্যা মোকাবেলা করতে গিয়ে, সম্ভাবনা তত্বের ইতিহাসের সাথে জুয়াড়িদের হার-জিতের হিসেব বের করতে চাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। ইত্যাদি।

কিন্তু যেভাবেই হোক, একটি গাণিতিক ধারণা যখন পরিষ্কার হয়ে ওঠে, তখন সেটি গণিতের অভ্যন্তরীন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় — সে ধারণা সার্বভৌম, সামাজিক উপযোগিতার সাথে সম্পর্কশূন্য। জ্যামিতিক সত্য জ্যামিতির নিয়মের ফলাফল, তার জন্য আমিন ডেকে বারংবার জমি মাপামাপির প্রয়োজন নেই। একই ভাবে সম্ভাবনার গাণিতিক তত্ব বিংশ শতাব্দীতে গণিতের বিশুদ্ধ শাখায় পরিণত হয়েছে।

এই প্রেক্ষিতে এখন একটি মন্তব্য করব।

একটি গাণিতিক ধারণা “কি” এই প্রশ্ন অবান্তর। একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, গাণিতিক ধারণাটি “কি করে”।

কাল্পনিক সংখ্যার ব্যাপারটাই ধরুন। এই সংখ্যার সংজ্ঞায় বিভ্রান্ত হয়ে মানুষ যখন প্রশ্ন করে “কাল্পনিক সংখ্যাটা ভাই আসলে কি? এটা কিভাবে সম্ভব?” এই প্রশ্নটা কোন বৈধ গাণিতিক প্রশ্নই নয়। এই প্রশ্নের মধ্যে আসলে লুকিয়ে আছে সামাজিক প্রশ্নটি — কাল্পনিক সংখ্যা দিয়ে আমরা কি করব, অথবা আমাদের সাধারণ জ্ঞানের সাথে কেন এটা ঠিক মিলছে না এসব ব্যাপার। এই প্রশ্নটা গুরুত্বহীন তা নয়। কিন্তু জগাখিচুড়ি করার মানে হয় না। সামাজিক প্রশ্নটার জবাব দেয়ার চেষ্টা করব পরে, কিন্তু আমাদের প্রথম উদ্দেশ্য হবে স্রেফ গাণিতিক ভাবে কাল্পনিক সংখ্যাকে বোঝবার চেষ্টা করা। এটার জন্য এটা জানাই যথেষ্ট যে অর্থাৎ একটি গাণিতিক পরিস্থিতিতে কাল্পনিক সংখ্যা কি করে, অর্থাৎ অন্য সব সংখ্যা এবং গাণিতিক প্রক্রিয়ার সাথে তার মিথস্ক্রিয়া কিভাবে ঘটে। তবে এটি সরাসরি না করে আমরা গাণিতিক সাধারণীকরণের একটু ঘোরালো পথটি বেছে নেব।

সাধারণীকরণ
বিশেষ থেকে সাধারণে উত্তরণ — সাধারণীকরণ।

:cigarette: :cigarette:
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কোন গ্রামে এসে উপস্থিত হল একটি বুনো মেয়ে — উরুসন্ধি ও বুকে মানকচু পাতা জড়ানো, গলা রিনরিনে। যে লিচু-তলায় সে আশ্রয় নিয়েছে, তার নিচে ৫ গরু চরতে আসে প্রতিদিন — ৩টি সাদা, ২টি লাল। মেয়েটি এর আগে সাপ ছাড়া কোন প্রাণী দেখেনি, তাই প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে এদের দিকে সে তাকিয়ে থাকে। প্রথম-প্রথম গরু গুলিকে আলাদা-আলাদা ভাবে পর্যবেক্ষণ করত, কিন্তু ইদানিং কিছু লিচু খাওয়ার পরে তার মধ্যে অন্য একটা ভাবের উদয় হয়। অনেক দেখে শুনে সে একটি সাধারণ সংজ্ঞা ভেবে বের করল:

যারা নড়ে, তারা “নাড়ু”।

অর্থাৎ ৫টি গরুকে সে একটি সাধারণ কাঠামোর মধ্যে নিয়ে এল। লক্ষ্য করুন, শুধুই নড়ে, আর কোন বৈশিষ্ট নেই — এরকম কিছু নেই। গরুগুলির নড়াচড়া করা ছাড়াও অন্যান্য নানান বৈশিষ্ট রয়েছে, কেউ লাল, কেউ সাদা, কারো শিং আছে, কেউ দুধ দেয়। অর্থাৎ “নাড়ু”-র সংজ্ঞা দিতে গিয়ে মেয়েটির গরুগুলির কিছু বৈশিষ্ট্যকে উপেক্ষা করে শুধু একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের উপর জোর দিতে হয়েছে। এটাই সাধারণীকরণ, বা বিমূর্তায়ন।

আরো লক্ষ্য করুন, এটাই একমাত্র সাধারণীকরণ নয় যেটা মেয়েটির মাথায় আসতে পারত। আরেকটি হতে পারে এরকম:

যাদের গায়ের রং লাল, তারা “লালা”।

এই “লালা” সংজ্ঞার মধ্যে ২টি গরু এবং সাড়ে তিন হাজার লিচু পড়ে। এখন, আমরা সবাই হয়ত বলব যে “লালা” সংজ্ঞাটা খুবই বাজে একটা সংজ্ঞা, “নাড়ু” তার চেয়ে অনেক ভাল। কিন্তু সেটা উপযোগিতার প্রসঙ্গ, বিশুদ্ধ সাধারণীকরণের উদাহরণ হিসেবে দুটো একই রকম। সাধারণীকরণের যে বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করলাম, পরে তাদের গাণিতিক রূপ আমরা দেখব।

চলবে…

দ্রঃ কাল্পনিক সংখ্যা নিয়ে এই চমৎকার লেখাটির খোঁজ পেয়েছি, আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন। এর সাথে আমি পরে যা লিখব তার মিল আছে, বেমিলও আছে।