আমার ভাই মুহাম্মদ এনামুল হক। মাঝারী গড়ন। স্বাস্থ্য ভাল। ইন্টারিমডিয়েট পাশ। তিনি জেলখানায় ছিলেন দীর্ঘদিন। অপরাধ জাসদ করতেন। আমাদের পরিবারের কেউ জাসদ করত না। সময় নেই। তবু বঙ্গবন্ধু কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে একটি প্যানেল হল। ওদের লোকজন কম। আমার দাদার নাম একদিন বড় করে লিখে দিল দেওয়ালে। অন্য রকম কাণ্ড।

এ সময় কজন সত্যিকারের পাগলের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল। ওরা দিনের বেলায় আমাকে চিনত না। সন্ধ্যে হলেই আমি তাদের রামের ভাই লক্ষ্মণ। পাগলে পাগলে পাগলতুতু ভাই। রোগা পটকা আর হতচ্ছাড়া ছেলের সঙ্গে কোন ভাল মানুষের পো বন্ধুত্ব করে? খেয়ে দেয়ে তাদের কাজ নেই!

সে সময় মানুষের কাছে চেয়ে-চিন্তে দশটি টাকা যোগাড় করা যেত। টাউন প্রেসে তখন নিয়মিত মাছি পড়ে। মালিক রোগা পটকা মানুষ। তিনি বসে বসে সত্য ধর্মের একটি কঠিন বই পড়েন। জগৎ সৃষ্টির কথা, মানুষ ও ঈশ্বর, আমরা কেন বেদনার্ত হই, মরনের পরে আমার স্থুল দেহ পরমাত্মায় মেলে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি খুব ধীরে ধীরে যত্ন নিয়ে কম্পোজ করেন। সকাল সাড়ে নটায় আর সোয়া চারটায় তার বড় মেয়েটি প্রেসের ভিতর দিয়ে যাওয়া আসা করত। পরণে স্কুল ড্রেস। আর কখনো দেখা যায় নি। শোনা যায় মেয়েটি গণিতে ভাল ছিল। ওর নাম ছিল শিখা। একদিন পোস্টারে দেখেছি। এই সময় থেকেই আমার মাথায় ‘প্রেস ও দর্শন তত্ত্বের অভেদানন্দ’ শিরোণামে একটি রচনা ঢুকে বসে আছে। সময় পেলে লিখব।

এই টাউন প্রেস থেকেই একটি দু’ভাজ কবিতাপত্র বের হত নিয়মিত। নাম—রূপোলী ফিতে। প্রীতি ও বন্ধুত্বের বিনিময়ে প্রকাশিত। পশ্চিমবঙ্গের অভিজিৎ ঘোষ আর নির্মল হালদার নামে দুজন কবি কবিতা পাঠাতেন। অভিজিৎ ঘোষের একটি বিখ্যাত ছিল—শুখা রুটি রোজগারে কাটে দিন মান। রুটি আমাদের খুব প্রিয় ছিল বলে মাঝে মাঝে গুড় দিয়ে খাওয়া হত। এই ইতিহাসখ্যাত রূপোলী ফিতের সম্পাদক–মুদিপুত্র অধমানন্দ, আর কবিপুত্র রেজা পল্টু। আকিকাঅনুসারে নাম রেজা সাইফুল ইসলাম পল্টু। স্কুলের নাম ছিল সহিদুল ইসলাম। এটা আমরা কেউ জানতাম না। সার্টিফিকেট জানত। তবে কবিতার নাম ছিল প্রতিক সাইফুল। আর্ট শিখেছিল ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে। ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিক সাইফুল প্রমোশন পেয়ে পূর্ণ সম্পাদক হিসাবে রূপোলী ফিতে বের করছে পরলোক স্ট্রিট থেকে। বেশ নাম ডাক আছে তার।

একদিন রূপোলী ফিতে হাতে একজন লোক আমাকে বটতলার শেকড়বাকড় থেকে খুঁজে বের করলেন। কবিতাপত্রটি দেখিয়ে বললেন, এগুলো কি?
–কবিতা।
–কবিতা কি জিনিস জানো?
–আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে।
–হা হা হা। সুনিল গাঙুলির নাম শুনেছ?
–ব্যাংক পাড়ার সুনিল উকিল?

মডেল স্কুলের শিক্ষক ছিলেন সুনিলকুমার দাশ। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। পরে ন্যাপ। ছাত্রদের নিয়ে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী করার অপরাধে মডেল স্কুল থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে কেস টেস হয়। অভিমান করে তিনি আর অন্য কোনো স্কুলের মাস্টারী নেন নি। কেসে পড়ে নিজেই হয়ে গেলেন বিশিষ্ট উকিল। পাদ্মপুকুর পাড়ে তাদের বাসা। সামনে ছোট মাঠ। কয়েকটি আমগাছ। এ গাছগুলিতে কোনদিন বোল আসে নি। পাতাগুলো সুস্নিগ্ধ। এর পাশে একটি সরু রাস্তা। ওপারে টিনের ঘর। সামনে লাগানো সাদা রঙ দিয়ে লেখা একটি সাইনবোর্ড—সুনিল কুমার দাশ, বি.এ। এ্যাডভোকেট। এইখান থেকে নাপিত পাড়া শুরু। তিনি নাপিত, শুদ্র, কায়স্ত, ব্রাহ্মণ ও মুসলমান লোকজনেরও উকিল। এই সুনিল উকিলকে নিয়ে একটি কবিতা প্রচারিত ছিল। তার দুলাইন নিম্নরূপ–

সুনিল বাবুর কুড়ে ঘর।
ভাইঙা চুইরা নৌকা ভর।।

কিন্তু সুনিল বাবু নিজে কবিতা লেখেন এরকম জনশ্রুতি ছিল না। লোকটি শোনালেন। তেত্রিশ বছর কাটল—কেউ কথা রাখে নি। এবং তার পর ছেলেবেলার এক বোষ্টমীর উল্লেখ আছে। আছে বোষ্টমী আগমনীর গানের কথা। মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড়।

লোকটির নাম মুহাম্মদ এনামুল হক। ডাক নাম মেহেদী। এটা ২০ বছর পরে আবিষ্কৃত হবে । তার বয়স ছিল উনত্রিশ। তেত্রিশ বছর কাটল কবিতাটির আধখানা তিনি মুখস্ত বলেছিলেন। বাকীটুকু শোনার জন্য পিছনে পিছনে ছুটতে হল। শহর থেকে মাইল চারেক দূরে। মধুমতির পাড়ে—ফকিরকান্দি গ্রাম। গ্রামটির গাছে গাছে পাখি ডাকে। হাওয়া শিরশির করে বয়। আকাশ মাঝে মাঝে নিচু হয়ে আসে। বলে, অবনী বাড়ি আছ? মধুমতি নদীটি তখনো বাড়িতেই ছিল। কিছুটা পাগল প্রায়। বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। এর পাশে একটি রাস্তা এক বেঁকে সোজা চলে গেছে শিখাদের চুলের ফিতার মত। এই রাস্তায় শব্দ করে টেম্পু চলে। মৎসবাজার টু হরিদাশপুর।

ফকিরকান্দি গ্রামে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হল। তিনি গাছপালার মধ্যে ঢুকে গেলেন। আর কোনো লোকজন এলো না। শুধু মাটি ফুঁড়ে একজন ফকির এসে বললেন, বাবা, আখের নষ্ট করছ কেন?
–আখের গুড়?
–না বাবা, আখেরাত। কপাল। অদেরেষ্ট। কপাল নষ্ট করলি আর কি থাকে রে, বাবা!

কিছুক্ষণ পরে একটি বই হাতে মুহাম্মদ এনামুল হক ফিরে এলেন। আর ফকির লোকটি হাওয়া। সুনিল গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা। পদ্মপুকুরের সুনিল উকিল নয়। তিনি বইটির পাতা থেকে কবিতাটির বাকীটুকু পড়ে শোনালেন—আমাদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে লাঠি লজেন্স চুষেছে লস্কর বাড়ির ছেলেরা। সুবর্ণ কঙ্কন পরা ফর্শা রমণীরা কত রকম আমোদের হেসেছে। তার দিকে কেউ ফিরেও তাকায় নি। এ কবিতা শুনে মনে হল—সোনার চুড়ি পরা ফর্শা মেয়েরা ভাল নয়। বেশ নিষ্ঠুর। কখনো সুযোগ পেলে বকে দিতে হবে।

সে সময় মেয়েরা ফর্শা কি অফর্শা—এরকম বিচারআচার বোধটি হয় নি। শুধু পোস্টার পড়লে বোঝা যেত—কারো কারো ফর্শা হওয়া খুব ভাল কাজ। আর কালিবাড়ি গেলে কাল ভাল লাগে। কাল মানে সময়। টাইম। কালে খায় আমাদের কাল।

তবে কবিতাটি থেকে বোঝা গেল, পৃথিবীতে মেয়েদের দুটি শ্রেণী আছে। এক শ্রেণী হাতে সোনার চুড়ি পরে। অন্য শ্রেণী পরে না। তাদের হাতে হারিকেন আর মাঝে মাঝে কাঁচের চুড়ি। এজন্য তাদের চলতে হয় ভয়ে ভয়ে। এই সোনার চুড়ি আর কাঁচের চুড়ি নিয়ে কিছু ঝামেলা আছে। একে বলা হয় শ্রেণী দ্বন্দ্ব।
–এর জন্য কি দরকার?
–শ্রেণী সংগ্রাম।
–তারপর?
–বিপ্লব।
–বিপ্লব দিয়ে কি হবে?
— সমাজতন্ত্র হবে। তবে যে সে সমাজতন্ত্র নয়—বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। বলেছেন সিরাজুল আলম খান। সবার দাদা ভাই। ওনার তুল্য আর বিপ্লবী নাই এ ভবে। লম্বা ফিনফিনে চুল। আর দাড়ি। চক্ষু টানাটানা।

এগুলো খুব কঠিন বিষয়। কিন্তু সুনিল গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলি সহজ। নীল পদ্মর কথা আছে। বরুণা নামে কোন একটি স্বাস্থ্যবতী মেয়ের কথা আছে। একটি খ্যাপা গরুর কথাও আছে। বইটি কখনো হাতে পাই না। তিনি হাত ছাড়া করেন না। কখনো হাতে, কখনো ব্যাগে, কখনো বগলে রাখেন। হেঁটে হেঁটে চলে যান ছোট শহরের এ গলি থেকে ও গলিতে। তখন কলাপাতা নড়ে চড়ে—আমপাতা ঝরে পড়ে। আর কোন কোন দরোজায় টুক টুক করেন। যারা খুলে দেন তাদের তিনি পড়ে শোনান তেত্রিশ বছর কাটল কবিতাটি। শুরুটা একটু কঠিন কঠিন স্বরে। শেষ দিকে ধরা গলায়। শ্লেষ্মা জড়িয়ে আসে। আর আমাদের মাথা কখনো ছাদ, কখনো টিনের চাল ফুড়ে আকাশ স্পর্শ করে। টের পাই রোদ ঘুরে যায় দূরে দুরে। বেদনাহত। সন্ধ্যে হয়। তিনি ফিরে যান ফকিরকান্দি। আমি খাটরায়। উদয়ন পাড়ায়। পুরনো বটতলায়।

এইভাবে তিনি আমার ভাই হয়ে যান। তাকে বলি, এনামুলদা। জড়ুয়া কি ভাই। দুপুরে এক সঙ্গে ভাত খাই। পাঁচ ফোঁড়ন দিয়ে মা পাতে ঢেলে দেন গরম গরম মুসুরীর ডাল। খেয়ে দেয়ে দুভাই কবিতা পড়ি। ভাবি, লস্করবাড়িতে একদিন ঢোকা যাবে। এনামুলদা ফর্শা রমণীদের কবিতা শোনাবেন। আমি শুধু বকে দেব। তার জন্য আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষা করা মন্দ নয়। এনামুলদা এটা খুব ভাল করে জানেন। দীর্ঘকাল জেলখানায় থেকে এইসব গুঢ় কথা জেনেছেন তিনি। আমাদের ছোট শহরে তার মত করে আর কে জানবে?

ঠিক এইখানে এসে হেসে ফেলেন আমার জড়ুয়া ভাই মুহাম্মদ এনামুল হক। খিন্ন-কিষ্ট হাসি। মাঝে শুনতে পেয়েছিলেন—জাসদের দাদাভাই নেই—মাঝে মাঝে কি এক থিসিস লিখতে মার্কিন দেশে তাকে যেতে হয়। আর হাওয়া খেতে হয়। ধানমণ্ডির লেকের হাওয়া তার জন্য স্বাস্থ্যকর। মাথার চুল সাদা। ফিনফিনে দাড়ি হাওয়ায় ওড়ে। দাদাভাইয়ের কথা আর কিছু শোনেন না। মনে রাখেন বিপ্লবের আসতে একটু দেরী হবে। বিপ্লব ক্লান্ত হয়ে সামান্য ঘুমিয়ে নিচ্ছে। গরমের দিন বলে তাঁর এসি ছাড়া চলে না। তবু বিপ্লব তুমি এসো। অনেকগুলো তেত্রিশ বছর কাটল। তোমারক কিন্তু কথা রাখতে হবে সত্যি সত্যি। এনামুলদার কাছে কোন ধানাই পানাই নট। নাহলে এতগুলো বছর হাঁটছেন কেন পথে পথে একা একা?

এনামুলদার গোলগাল মুখটি। শুকিয়ে আসছে। শীত আসার আগে এরকম শুকনো ভাব জাগতে পারে। হাতে এখনো সুনিলের শ্রেষ্ঠ কবিতা। আস্তে ধীরে হেঁটে হেঁটে—আমাদের ছোট মফস্বল শহর থেকে—মৎসবাজার পেরিয়ে—বেদগ্রামের স্লুইজ গেট ছাড়িয়ে—কুয়াডাঙার তেল পাম্পটি পাশ কাটিয়ে তাকে ফিরতে হয় ফকিরকান্দি গ্রামে। এই গ্রামে রাত্রির অন্ধকার আকাশের জ্যোৎস্নার সঙ্গে একটু নত হয়ে মেশে। মাঝে মাঝে শোনা যায়–জ্যোৎস্না নামের একটি মেয়ে কি রমণী কি রূপকথা পথ দেখিয়ে চলে কোন এক মানুষকে।

তেত্রিশ বছর কাটল।
তাদের কথা কেউ রাখে না।