আজ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তি হল। আমার ভাল লাগছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। এ-ই হয়তো ভবিতব্য ছিল। এখানে না পড়লে আমার চারিদিকে এত সবুজ থাকত না। আমি আবিষ্কার করেছিলাম—এখানকার রোদ আসলে নিছক রোদ নয়—সবুজ রোদ্দুর। প্রাণদায়ী। আমাদের লিটিল ম্যাগাজিনের নাম রেখেছিলাম—সবুজ রোদ্দুর।

১৯৮৪ সালে ভর্তি হতে এসে আমি অপেক্ষামান তালিকায় থেকে ফিরে যাচ্ছিলাম। এ সময় খবর পেলাম কালচারাল কোটা নামে একটি সুযোগ আছে। কবি কাশেম রেজা আমাকে একটি ঠিকানা দিয়েছিলেন। আমি সেই মত দেখা করেছিলাম পশু চিকিৎসা অনুষদের এক শিক্ষকের সঙ্গে। তার চেয়ারের পাশে একটি মেয়ের ছোট একটি মূর্তি—এপ্রোন পরে আছে। তিনি খুবই ব্যস্ত । খামটা নিয়েই হেসে বিদায় দিলেন। বললেন, কাল সকালে তিনি খুলনায় চলে যাচ্ছেন। তার শ্বশুর অসুস্থ। সুতরাং আমার কালাচারাল কোটায় উপস্থিত থেকে লাভ নেই। ওটা বিশেষ বিশেষ দল ও রাজনীতির জন্য। ফিরে যাব বলে ব্রহ্মপুত্র নদীর পারে অনেক সময় বসেছিলাম।

রাতে হলে ফোন এল। সেই শিক্ষকের গলা। তিনি জানালেন, না, তিনি খুলনা যাচ্ছেন না। তাঁর স্ত্রী ছেলে মেয়েকে নিয়ে চলে গেছেন। তিনি যেতে পারেন না।কাশেম কাকা লিখেছেন। তার ছেলেটির জন্য অপেক্ষা করা দরকার।

আমি তো গান গাইতে পারি না। নাটক করতে পারি না। তাহলে? কবিতা লিখতে পারি। কালচারাল টেস্টে উপস্থিত পরীক্ষকগণ বললেন, কবিতা দিয়ে কী হবে? কবিতা খায় না পরে? এক শিক্ষকতো গজগজ করতে করতে বললেন, এইসব কবিরা হল মূর্তিমান ঝামেলা। পোলাপানদের মাথা নষ্ট করে দেবে। তিনি গান ভালবাসেন–মাঝে মাঝে নাচ। সোজা বলে দিলেন—যাও। নেকস্ট।

সেই শিক্ষক বসে ছিলেন চুপ করে। আমাকে চলে যেতে দেখে বললেন, ওকে, ওর যাওয়ার আগে ওর একটা কবিতা শুনতেতো আপত্তি নেই। বলতো ছেলে তোমার কবিতা।
আমি পড়ে শুনালাম—আমার সদ্য লেখা কবিতা :

নদী মরে গেলে সত্য হারিয়ে যায়
দুপাড়ের মানুষের বুক থেকে ঝরে পড়ে
বয়সের মতন এক একটা নিটোল স্বপ্ন
প্রতিটি গল্পের সাথে জেগে থাকে দীর্ঘশ্বাস
এরকম কথা আমাকে শুনিয়েছে একজন বুড়ো চাষি

আমি সেই থুত্থুরে বুড়ো চাষির বুকের ভিতরে
হাত দিয়ে দেখি-অনেক দূরের সবুজ ধান
পুড়তে পুড়তে হলুদ হয়ে যায়-

যে পরীক্ষকটি কবিতাকে ঝামেলা মনে করতেন, তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন—এ ছেলে আমার গ্রামের কথা লিখেছে। ওকে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে দরকার।

আমি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম কবিতা লিখে। এটা হয়তো একটা রেকর্ড। আর যে শিক্ষক তাঁর শ্বশুরের অসুস্থতার খবর পেয়েও রওনা হওয়ার আগের মুহুর্তে থেকে গিয়েছিলেন, আমাকে কবিতা পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন—তিনি প্রফেসর আব্দুল কুদ্দছ মিঞা। তিনি সেদিন না থাকলে আমাকে হয়ত একটি ছোট মফস্বল শহরে রাস্তা পাশে ছালা বিছিয়ে আলুপটল বিক্রি করতে হত। তিনি আমার জীবন পাল্টে দিয়েছিলেন। আলু পটল বিক্রি করতে হয় নি। যারা আলু পটল ফলায় তাদেরকে পরামর্শ দিতে পেরেছি। আমার যা কিছু অর্জন—এই প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর আব্দুল কুদ্দুস মিঞার অবদান।

দীর্ঘ নটি বছর ময়মনসিংহ শহর থেকে দূরে একটি গ্রামের মধ্যে অবস্থিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছিলাম। শেষদিন পর্যন্ত আমাকে তাঁর সঙ্গ ছাড়া করেন নি। ছায়ার মত করে রেখেছেন। অথচ আমি কখনো গান করি নি। নাটক করি নি। মাঝে মাঝে দুএকটি পোস্টার লিখে দিয়েছি। দেওয়ালে দেওয়ালে টানিয়েছি। আর তাঁর নাটকের স্ক্রিন টেনেছি। এই টুকু।

সে সময় আমার মাথায় ভিতরে রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী ঘুরপাক খাচ্ছিল।ব্যাগের ভিতর থেকে রবি ঠাকুরের বইটি বের করি পড়ি ঘাসের উপর বসে। আর নন্দিনীর জন্য আকুল হয়ে উঠি। রঞ্জনের জন্য কান্না করি।

কুদ্দুস স্যার আমার বইটি নিলেন। তারপর তিনি মহড়া শুরু করলেন—রক্তকরবী নাটকের। ছাত্র/ ছাত্রদের ইন্টারভিউ নিয়ে নন্দনী, রাজা, বিশুসহ সব চরিত্র ঠিক করলেন। তার নিজের দল পিলসুজের একটি মেয়ে নন্দনী হতে না পেরে পিলসুজ ছেড়ে চলে গেল। উদীচির ঝুমা হল—নন্দিনী। নন্দিনীর জন্য ধানীরঙ শাড়ী কিনতে টাঙ্গাইলে যেতে হয়েছিল।

দীর্ঘ তিনমাস মহড়া শেষে অভিনীতি হল নাটকটি। আমরা কজন—নিপুন, প্রদীপদা, জামিল, ম হুদা নাইবচাচার সঙ্গে রক্তকরবীর সেট নির্মাণ করি। প্রদীপদা ফিস ফিস করে বলেন, রায় তোমার চরিত্র কোনটি?
–জানি না।
ভাই বললেন, রঞ্জন হৈবে।

শেষ দৃশ্যে রঞ্জন পড়ে আছে। নো ডায়লগ। নো একটিং। মরে পড়ে থাক। মৃত সৈনিক। শুনে নাইবচাচা হাসেন। আর খিচুড়ি খেতে দেন।
নাটকের দিন আবার সেই সিন টানার কাজ। শেষ দৃশ্যের আগে নাইব চাচা ডেকে নিয়ে গেলেন দর্শকের মাঝখানে। বললেন, দ্যাখো।

সিন উঠতেই দেখা গেল সিঁড়ির উপরে রঞ্জন পড়েআছে। এক মাথা চুল। গৌরকান্তি। মুখ স্বপ্নময়। পদতল পদ্মবর্ণ।গলায় রক্তকরবীর মালা।এই রঞ্জনকে একমাত্র স্বপ্নে দেখা সম্ভব। নন্দনী দৌড়ে এসে আছড়ে পড়ছে। আর্ত চিৎকার করে উঠছে—রঞ্জন…ন..ন। রাজা মাথা নিচু করে আছে। তার অহংকার চলে গেছে।
কে রঞ্জন?
তহসীন স্যার বলে উঠলেন, কে আবার—খোকন—পার্থ হেফাজ শেখ খোকন। তাঁর বোন ক্রিস্টি হেফাজ। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু গান করে।
আর নাইব চাচা হাসলেন। বললেন, দেখেছ—কুদ্দুছ জানে কী করে সুন্দরকে নির্মাণ করতে হয়।

সত্যিই তো, কুদ্দুছ স্যার ছাড়া সুন্দরকে এত সত্যি করে কি চিনতে পারতাম?