স্বপ্নের জগতে ধর্মের শেকড়
উত্তর পুরুষ
মরুময় দেশগুলোতে প্রচণ্ড গরমের দাপটে মানুষ সামান্য পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়ে এটা যেমন সত্য তেমনি এই গরমের কারণে মানুষের মধ্যে কষ্টসহিষ্ণুতা গুণাবলীটিও বৃদ্ধি পায়। মধ্যপ্রাচ্য এলাকায় এই অগ্নিদহন আবহাওয়ার মধ্যে একটু খেজুরের রস, একটু আঙুরের রস, কিংবা শীতল পানীয় সেবন করার পর মানুষ নাক ডাকায়ে ঘুমায়। গরম-ক্লান্তির ঘুম এমন’ই গভীর যে, নাকে মুখে নানাবিধ মাছি বসে খেলা করলেও অধিকাংশ ঘুমকাতর মানুষ তা অনুভব করেনা। এই গভীর ঘুমের অবচেতনায় মানুষ যেসব এলোমেলো স্বপ্ন দেখতো, তা’নিয়ে তার জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। কেন দেখলো ? কি জন্য দেখলো ? এই স্বপ্নের মধ্যে কিসের ইঙ্গিত ? কিসের আলামত ? তাই নিয়ে ভাবতে ভাবতে সে তার নিজ মন থেকেই জন্ম দিত নানা গল্প। কারণ খেয়ে দেয়ে তার তো কোন রুটিন মাফিক কাজ নেই। আর কাজ থাকলেও নিজের কাজে এত তাড়না নেই। সুতরাং ঘুম থেকে উঠে সে দেখতে পেতো, পায়ের নিচে বালি আর উপরে অনন্ত আকাশ। মরুভূমির দেশ গাছপালা নেই, ঘাস নেই। নেই সবুজের সমারোহ, নেই পাখীর কলকাকলী কিংবা নদীর কলতান। সুতরাং গভীর স্বপ্নের আমেজ ও মোহ মনের মধ্যে আকুলি বিকুলি করতে থাকে। সেই প্রবাদ বাক্যের ‘ঢুল বাজাবার’ মতো। (যেমন আঞ্চলিক ভাষায় একটা প্রবাদ আছে “ঢুল রাখছে বেতাং বনে, ঘুরেফিরে উঠে মনে) অর্থাত স্বপ্নটা বার বার তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। স্বপ্নের এই মোহ কিংবা আমেজ দিবসের কোন সবুজ অরণ্যে (যেহেতু মরুভূমির দেশ) হারিয়ে যায়না, কিংবা মেঘমালার নানা বর্ণচ্ছটায় বিলীন হয়েও যায়না। সুতরাং স্বপ্নের ভাঙা-টুটা এলোমেলো বিচ্ছিন্ন ও খণ্ড কাহিনীকে অদৃশ্যের একটা আলামত হিসেবে খাড়া করে ওটাকে “আল্লাহর ইশারা” হিসেবে বিশ্বাস করা ছিল ‘ধমীর্য় দর্শনের মূল ভিত্তি’।
মধ্যপ্রাচ্যে তৎকালীন সমাজে, নানাবিধ গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব, আঞ্চলিক রাজ্য শাসনের কর্তৃত্ব, কিংবা মানসিক আনন্দের জন্য যত্রতত্র নারীভোগ, মদ্যপান, নাচ গান ইত্যাদি টিকিয়ে রাখার জন্য যত প্রকার অত্যাচার,কৌশল কিংবা কুপ্রথার প্রয়োজন পড়তো সব’ই তারা করতো নির্দ্বিধায়। এসব সামাজিক অবস্থাকে পরিবর্তন করে কি ভাবে শান্তি ও শৃঙ্খলা আনয়ন করা যায়, তা নিয়ে কিছু কিছু লোক মনে প্রাণে ভাবতো। কালক্রমে এরাই বিভিন্ন কওমের মধ্যে বিভিন্ন যুগে যুগে নিজেকে একজন নবী হিসেবে দাবী করার প্ল্যান প্রগাম শুরু করেন। কারণ উনারা বুঝতে পেরেছিলেন শুধু মুখের কথার কোন ভিত্তি নেই। সুতরাং নিজেকে সাজতে হবে আল্লাহর প্রতিনিধি। তাই তাঁরা সমাজের সকল প্রকার কল্যাণমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন এবং মানুষকে সৎপথে থাকার উপদেশ দিতে থাকেন। এভাবে কওমের মধ্যে নিজেদের পরিচিতি বাড়তে থাকে। নিজের নানাবিদ স্বপ্নের কথাগুলো আল্লাহর এক একটা ওহী বলে সমাজে প্রচার করতে থাকেন। কারণ তিনিরা বুঝেছিলেন ‘আল্লাহর কথা না বললে কেউ তাঁদেরকে বিশ্বাস করবেনা এবং মানবেনা’। এজন্য তাঁরা প্রচার চালাতে থাকেন যে, আল্লাহর সাথে তাঁর বা তাঁদের সম্পর্ক “প্রভূ ও গোলাম হিসেবে, না হয় কল্যাণকামী দোস্ত বা বন্ধু হিসেবে”। এবং তিনি’ই একমাত্র সাধক ব্যক্তি যে গোপনে, নিরবে, অন্ধকারে, স্বপ্নে , এই আল্লাহ বা মহাশক্তির সাথে যোগাযোগ রাখেন। তাঁরা আরও প্রচার করতে থাকেন যে, ঐসব শক্তির অর্থাৎ আল্লাহর সাধক কিংবা প্রতিনিধি হওয়ার যোগ্যতা ও সবার মধ্যে নেই। তা কেবল আল্লাহর একক ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল । তিনি যাকে পছন্দ করবেন, বা বাছাই করবেন তিনি হবেন যোগ্য প্রতিনিধি। তারপর ঐ প্রতিনিধি মানুষকে জীবনের সকল পথ ও পাপ পুণ্যের রাস্তা বাতলিয়ে দেবেন। এখন সমাজের মঙলার্থে প্রতিনিধিগণ জাগতিক রোগ, শোক, ক্ষুধা, অকালমৃত্যু, খরা, অতিবৃষ্টি, ঝড়, ভূমিকম্প, যুদ্ধ বিগ্রহ প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সম্বল করে মানুষের মগজে মুগর পেটা করতে থাকেন। আর তৈরি করেন এক একটা আইন। এখন পাপী তাপী দুষ্কর্মী সকলেই নবীদের জনপ্রিয়তা দেখে ঘাবড়াতে থাকে। আর দলে দলে ধর্মে যোগদান করে বলতে থাকে ” জীবনে অসংখ্য পাপ করেছি এখন তাহলে ‘পরিত্রাণের উপায় ? উপায় হিসেবে তখন আস্তে আস্তে শুরু হয় নবীগণের নিজের মনোদর্শনকে বাস্তবায়িত করার এক সবুজ নক্সা। মানুষের মনোজগতে মুকুটহীন এক সম্রাট হিসেবে চিরকাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক দুর্ভেদ্য বাসনা। এভাবে যুগ যুগ ধরে সাধারণ মানুষ, নবী নামক আল্লাহর প্রতিনিধিদের কথায় উঠছে বসছে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ধর্ম। তারপর শেকড়ের ভিতর শেকড় শাখার মধ্যে শাখা বিস্তার লাভ করে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ধর্ম ও ধর্মের বহুবিদ আচরণ।

যুগে যুগে ধর্মীয় সংস্কৃতি
উত্তর পুরুষ
ভারত উপমহাদেশের বঙ্গ ভূমিতে আগত ও অবস্থানরত পীর, ফকির, আউলিয়া দরবেশ ইত্যাদি উপাধিধারী ব্যক্তিবর্গের জীবন ছিল আধ্যাত্মিক ভিত্তিক। ধর্মের মশালে উনারা মানুষকে দিয়েছেন আলোর সন্ধান। যে আলোতে মানুষ শুধু পরকালের মুক্তি দেখেনি তৎসঙ্গে সে মুক্তি চেয়েছে বর্ণ-বৈষম্য তথা জাত প্রথা ও জাত বিদ্বেষের চরম অত্যাচার থেকে। যে অত্যাচার মানুষের জীবনে ঘটিয়েছে এক দুর্বিসহ নাভিঃশ্বাস। ধর্মের আলোকে এ অঞ্চলের মানুষেরা বুঝে নিল যে, পাপ থেকে নিজেকে আত্নরক্ষা করতে পারলেই জীবন স্বার্থক। তাই জীবনকে বিকশিত করার জ্ঞান তাঁরা শুধু ঐ ধর্মের মধ্যে দেখতে পেলেন। অন্যান্য জীবন চেতনার বহুমুখী বিকাশ তাঁদের চোখে কুয়াশার মত আড়াল হয়ে থাকলো। বিংশ শতাব্দির মধ্যভাগ অতিক্রম করে আমরা ঐ কুয়াশাজালের অস্তিত্বকে আর আগের মত অনুভব করিনা। ধমীর্য় পীর ফকিরেরা মানুষের চারিত্রিক মান উন্নয়নের জন্য অঢেল পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন কিংবা সমাজের বিরাট অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু করেননি। যার সুত্র ধরে ভবিষ্যৎ বংশধরগণ বীর-সাহসী কর্মঠ হিসেবে উন্নতি করতে পারে। তাঁরা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে আখড়া স্থাপন করেছেন। সেখানে বড় জোর মসজিদ তৈরী হয়েছে। ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ্ব যাকাত সম্বন্ধে শিক্ষা দিয়েছেন এবং প্রতি পদে পদে মানুষকে নানা প্রাকৃতিক ভয় দেখিয়ে কর্ম বিমুখ ও জীবন বিমুখ করেছেন। ভিন্ন ভিন্ন স্থানে তাঁরা বিয়ে-শাদী করেছেন। তারপর কারণে অকারণে নারীদেরকে কঠোর শৃঙ্খলের যাতাকলে মানসিক ভাবে করেছেন নিষ্পেষণ। বাচ্চাদের বেত্রাঘাত করে অপরিচিত আরবী ভাষা ও কয়েকটি সুরা মুখস্ত শিখিয়েছেন (যার অর্থ, ব্যাখ্যা ও বাস্তবতার সামঞ্জস্য সম্বন্ধে কোন বিজ্ঞান ভিত্তিক জ্ঞানদান করনে পারেননি।) আর ভক্তদের দেয়া ফল পানি ও রুটিতে পরনির্ভরশীল ভাবে উনারা দিন অতিবাহিত করেছেন। বিনিময়ে তাঁরা মানুষকে ঝাড়, ফুঁক, তাবিজ, জড়ি বা শিকড়, পানি পড়া, তাগা পড়া পথ্য দিয়েছেন। আমার স্পষ্টই মনে আছে কলেরা রোগের দৈত্যকে তাড়ানোর জন্য আমাকে যে আরবী দোয়া মুখস্ত শেখানো হয়েছিল তা ছিল এরকম: “ লিখামছাতুন উৎফি বিহা, হাররাল ওবাহিল ফাতিমা। আল-মস্তোফা ওয়াল মুরতাদা ওয়াবনাহুমা ওয়াল ফাতিমা ”। আমরা কেউই এর অর্থ জানতামনা। কিছু দিন পর এক ভিক্ষুকের মুখ থেকে যে বাংলা জিকির শুনলাম তাই শুনে শুনে মুখস্ত হয়েছিল, আর তা হলো এই:
“ আলী আলী জুলফিক্কা, ফাতিমার হাতে তীর,
যেই পন্থে আইছো ভলা (যম) সেই পন্থে দুর ”।
ইসলামী শিক্ষককে আমরা বলতাম “মিয়াছাব” কোন কোন অঞ্চলে বলা হয় “হুজুর”। সেই মিয়াছাব কোরানের ছুরাহ ফালাক ও ছুরাহ নাস পড়তে পড়তে তাগার মধ্যে ১১টি গিঁট দিলেন। আমি ও আমার বড় ভাই সেই গিঁট দেয়া তাবিজ পরেছিলাম কলেরার প্রকোপ দুর হওয়ার আগ পর্যন্ত। সেই তাগার গিঁটে কি ছুরাহ নাস ও ছুরাহ ফালাক আটকা পড়েছিল ? এই প্রশ্নটি আজো আমাকে ভাবায় । অতীতের বুজুর্গ নামের ব্যক্তিগণ জিকির ও দোয়া দুরুদের শেষে তারা কাঙ্গালী ভোজের প্রচলন ও শিখিয়েছেন। আর তাদের মৃত্যুর পর তাদের কবরে চাদোয়া টাঙ্গানো ও মোমবাতি জ্বালানোর মত অর্থহীন প্রচলনের মনোভাব ভক্তদের মনে সঞ্চার করে গেছেন। আজো মোকামে, মাজারে, কত ধরনের গুপ্ত ও প্রকাশ্য (বেহেদাতি) অপকর্ম হচ্ছে তা সকলেই দেখতে পাচ্ছি। ঐ সমস্ত ছিল সে যুগের সামাজিক কার্য্যাবলীর প্রধান অঙ্গ। এসব নিয়ে কেউ তখন খুব একটা প্রশ্ন তুলতো না।
ব্রিটিশরা যখন পাক ভারতের রাজদণ্ড কেড়ে নিল। তখন মুসলমানরা এ পরাজয়কে মেনে নিতে পারেনি। কারণ তাঁরা সরাসরি শাসক থেকে শাসিত (প্রজা) হিসেবে পরিণত হয়। এটা তাঁদের জন্য ছিল একটি জাতীয় অপমান। অপরদিকে হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্ভীদের এরকম জাতীয়ভাবে অপদস্থ হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। কারণ তারা পূর্বেও ছিল শাসিত আর বৃটিশ আসার পরও ছিল একই ভাবে শাসিত। তাদের বেলায় পার্থক্য হলো শুধু শাসক গোষ্ঠীর পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের বাস্তবতাকে মুসলমান জাতিরা জ্ঞানগর্ভ চিন্তায় বুঝে নিতে পারেননি। তাই ব্রিটিশকে অবলম্ভন করে নিজেদের সম্মানী অস্তিত্বকে যতটুকু সম্ভব অন্যান্য জাতির চেয়ে অগ্রসর করে রাখার কৌশলটিও তাঁরা হারালেন। শেষ অবধি যা হবার তা হলো। তাঁদের রক্ষণশীলতার কারণে ও দূরদর্শিতার অভাবে নিজের ঘরে নিজেরা হলেন পরাধীন। ব্রিটিশরা তাঁদের ধর্ম ও কৃষ্টি ডুবিয়ে দেবে ঐ ভয়ে তাঁরা লজ্জ্বাবতী লতার মতো চুপসে গেলেন। কিছুটা আন্দোলন ও করেছিলেন। আর তাঁদের স্বদেশী আরেক গোষ্ঠী বাঙালি ভাইয়েরা ব্রিটিশদের কাছে ঘেসে তাদের ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, আইন ইত্যাদি আগ্রহের সাথে গ্রহণ করে নিলো। পড়াশুনায় মন দিলো। যার ফলশ্রুতিতে আজকেও এই দেশের এক কোণে বসে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার যেদিকে তাকাই দেখতে পাই পাঠশালা, হাইস্কুল, কলেজ, লাইব্রেরী, দাতব্য চিকিৎসালয়, পোষ্টাপিস, ক্লাব, মঞ্চ, থিয়েটার, বাজার ইত্যাদি ধনী সুশিক্ষিত হিন্দু বাঙ্গালী, হিন্দু জমিদারদে অবদান। তুলনামুলক ভাবে সেখানে মুসলমানদের কোন অবদান নেই বললেই চলে। আজকে বাংলাদেশে ব্রিটিশ নেই, ব্রিটিশের শাসনও নেই, পাকিস্তানি ও নেই, হিন্দু এবং অন্যান্য উপজাতি যারা আছে তাদের সংখ্যা ও তুলনামূলক ভাবে নগণ্য । তাহলে মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশের অবস্থা আজ এত চরমে কেন ? এত চোর-চামার আর সন্ত্রাসীতে দেশটা ভর্তি কেন ? বাংলাদেশ ইসলামী রাষ্ট্র হয়ে গেলেই যে সব মুসলমান ফেরেশতা হয়ে যাবেন। সমাজ বদলে যাবে, অভ্যাস ও চরিত্র ঠিক হয়ে যাবে এর কোন গ্যারান্টি আছে ?
আজ এই একবিংশ শতাব্দির দোর গোড়ায় দাড়িয়ে আমরা কঠোর কণ্ঠে বলতে পারি কি অপরাধ হত যদি আমাদের শিশুরা নিজ মাতৃ-ভাষায়, ছালাম, নামাজ শিক্ষা, কোরান পাঠ, দোয়া দুরুদ, বিবাহ অনুষ্ঠান, মৃতের দাফন ইত্যাদি শেখানো হত ? আল্লাহ যে আমাদের ভাষা বুঝবেন না এমনতো কথা নয়। কিন্তু বাধ সাধেন আমাদের মুসলমানরা, বিশেষ করে আলেম উলামাগণ, উনাদের যুক্তিতে আরবী ভাষায় প্রার্থণা ছাড়া আর কোন গতি নেই। ওখানে প্রতিটি অক্ষরে দশটি নেকী এই বিশ্বাসের নেশা উনাদের মাথায়। কিন্তু কোরানের কোথাও এমন কিছু লিখা নেই। (নিশ্চয়ই তৈরি করা হাদীসে আছে) কিন্তু আমাদের মাতৃভাষা কি অক্ষরবিহীন ? যদি তা হয় তাহলে কোরানে তো স্পষ্টই আছে “আল্লাহ হিসেব গ্রহণে অত্যন্ত তৎপর”। আল্লাহ মানুষের অন্তর ও ঈমান দেখেন, আমাদের মাতৃভাষার প্রার্থণা যে অনুবাদ হয়ে আল্লাহর দরবারে পৌছাবেনা এমন কথা কেউ চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারবে না। হয়তো ফেরেশতাদের উপর অনুবাদের জন্য সামান্য কাজের চাপ বাড়বে। তওবা ! তওবা ! আল্লাহ যে সবজান্তা সুতরাং অনুবাদের তো প্রশ্নই উঠে না। যাক, কথা এখানেই শেষ নয়, উলামাগণ আরও যুক্তি দেখান “কোরআনের এক একটি শব্দের অর্থ ও গুরুত্ব এত গভীর ও এত অসীম যে, সে গুলোর অনেক প্রতিশব্দ অন্য ভাষায় পাওয়া যায় না। কথাটি আংশিক সত্য হলেও প্রশ্ন আসে আরবী ঐ সমস্ত শব্দের অর্থ ও গুরুত্ব যে এত গভীর ও ব্যাপক তা বাঙালি ভাষা-ভাষীরা বুঝলেন কি ভাবে ? বুঝতে হলে নিশ্চয়ই ভাষার মাধ্যমে তা বুঝতে হবে। আর সে ভাষাটা যদি বাংলাই হয় তাহলে এখানে তর্ক বির্তকের তো প্রশ্নই উঠেনা। দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ একজন নবীর কাছে কোরআন পাঠিয়েছেন, নিশ্চয়ই তা না বুঝার জন্য পাঠাননি। তদুপরি সে যুগের অধিকাংশ মানুষও ছিল নিরক্ষর। নিরক্ষর মানুষদের জন্য কঠিন ভাষায় আল্লাহ কোরআন উপহার দেবেন, তা মন বলেনা। এতে আল্লাহর জ্ঞান-বুদ্ধির কমতি কিংবা ত্রুটি ধরা পড়বে।
এমতাবস্থায় কোরআন কাপড়ের বস্তনীতে বন্দী হয়ে চুমু খাবার জন্য পৃথিবীতে আসেনি। সারা পৃথিবীর ভাষাকে মানুষ আজ অনুবাদ করে প্রয়োজনীয় সমস্যার সমাধান করে যাচ্ছে। কিছুই আটকেনি। আটকে শুধু আমাদের স্যালাত বা প্রার্থণা। এভাবেই আমাদের ধর্মীয় রক্ষক গোষ্ঠীরা ধর্মকে দুবোর্ধ্য ও কঠিন করে রেখেছেন। অতিমাত্রায় সংবেদনশীলতা দিয়ে ধর্মকে রুদ্ধ কারাঘরে নিক্ষেপ করে রেখেছেন। মাতৃ ভাষায় প্রার্থণা করলে এর অর্থ ও গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। আল্লাহকে ডাকতে গিয়ে ঠিক ঠিক ডাকছি, না ভুল করছি, শ্রদ্ধা, ভক্তি ও বিনয় প্রকাশ পাচ্ছে কিনা সবটি পরিষ্কার হয়। নামাজ বা স্যালাতের পরে প্রায় মসজিদেই বাংলা মোনাজাত হয়, তার সঙ্গে আরবী মিশ্রন হয়, তখন তো কোন বাধা পড়েনা। আসলে এই মোনাজাতের মধ্যে দিয়ে হুজুররা বাঙালি মানুষের ধর্মের প্রতি অনুরাগ ও আকর্ষণকে বাড়িয়ে তুলার উদ্দেশ্যে তাই করেন। হুজুরের এহেন বিনয় ও কাকুতি মিনতি তার নরম দিলের পরিচয় মিলে। মনে মনে আশ্বাস এবং বিশ্বাস জন্মে এহেন মোনাজাত নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য না হয়ে উপায় নেই।
মাতৃভাষায় কিভাবে উপাসনা করা সম্ভব ? এ নিয়ে হয়তো অনেকের মাথা ব্যাথা। কোরআন, হাদিছে বড় বড় টাইটেল নিয়েও যারা এ সূত্র জানেন না। তাঁরা আমাদেরকে তা খোলাখুলি বলুন, পরবর্তীতে এর যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দেয়া যাবে। আজকের যুগে সমাজে শান্তি ও উন্নতি আনতে প্রয়োজন আধুনিক শিক্ষা আর নিজ মাতৃভাষায় ধর্মচর্চা করা। “ইসলাম শব্দের হুবহু অর্থ হল “শান্তি”। কিন্তু এই শান্তি এসেছে অনেক রক্তপাতের শেষে। তাও জেনেছি নিজ ভাষায় ইতিহাস লিখা হয়েছিল বলে। শান্তি আর উন্নতি এক জিনিষ নয়। জীবনে শান্তি পেতে হলে চাই উন্নতি। শুধু ধর্মচর্চায় উন্নতি আসে না। উন্নতির জন্য প্রয়োজন, শিক্ষা, গবেষণা, উৎপাদন, বিজ্ঞান চর্চা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আইন ও কর্তব্যের চর্চা বা অনুশীলন।
আধুনিক শিক্ষা বলতে উলঙ্গপনা, আবাধ স্বাধীনতা, বিলাসিতা ইত্যাদি যারা বুঝেন আমি তাঁদের সঙ্গে কখনও একমত নই। আধুনিক শিক্ষা বলতে আমি বুঝতে চাই উৎপাদনমুখী শিক্ষা, স্বনির্ভরশীলতার শিক্ষা, ভদ্রতা ও শালীনতার শিক্ষা। যুগ উপযোগী আইনের প্রতিষ্ঠায় নারী জাতির মানবিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করা। ধর্মীয় পুস্তক থেকে জানতে পারি আল্লাহ পাক মুসলমানদের শুধু ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ্জ যাকাতের কথা বলে থেমে থাকেননি। জীবনের প্রতি দিকেই দিক নির্দেশনা দিয়ে নিজের বিবেক বুদ্ধিকে ঠিকমত কাজে লাগাবার নির্দেশ দিয়েছেন। সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজের নিষেধ সম্পর্কে আমরা সকলেই জানি। প্রতিটি সমাজ, প্রতিটি রাষ্ট্রই এই উপদেশবাণীকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু মানুষ আজকাল একথা ভুলে গিয়ে এমন দুনিয়ামুখী হয়েছে যে, তাদের মনের উপর শাসন করার মত কোন যাদুমন্ত্র আমাদের হাতে নেই। এর পরও কোরআনে আছে “ যারা অবিশ্বাস করেছে তুমি তাদের সর্তক করবা না কর তাদের পক্ষে উভয়ই সমান; তারা বিশ্বাস করবে না। আলস্নাহ তাদের হৃদয় ও কান, মোহর করে দিয়েছেন, তাদের চোখের উপর রয়েছে আভরন ” “ছুরা বাকারাহ” আয়াত বা বাক্য নং ৬ ও ৭। এরপর ছূরা নং- ৪২ (শুরা) আয়াত বা বাক্য নং- ৪৪ এ আছে ” আল্লাহ কাউকে পথ ভ্রষ্ট করলে তার জন্য তিনি ব্যতীত কোন অভিবাবক নেই” এছাড়া ও কোরআনের বহু জায়গায় লিখা আছে অর্থাৎ আল্লাহ বলছেন মানুষ জাতিকে “আমি যাকে সৎপথ দেখাই না সে কিছুতেই সৎপথ প্রাপ্ত হয় না”। অনুরূপ একটি আয়াত হচ্ছে ছুরা ইব্রাহিম এর ৪ নং আয়াত।
এতে বুঝা যাচ্ছে যাদের হৃদয় বক্র, মনের উপর সীলমোহর, তাদেরকে শত চেষ্টা করলেও আমরা কামিয়াবি হব না। বেহেশত দোজখ ওরাও বুঝে। কাজেই তারা বুঝেও যদি দোজখে বা নরকে যেতে চায় তাহলে আমাদের এত মাথা ব্যথা কেন ? উপরের কোরআনিক বাক্য থেকে স্পষ্টই বুঝা যাচ্চে যে, আল্লাহর ইচ্ছে ছাড়া আমাদের কোন শক্তি নেই বরং এর চেয়ে ধর্মীয় নীতিগুলো যদি আমরা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে কায়েম করতে পারি ও বাচ্চাদের সেই পরিবেশে গড়ে তুলতে পারি তাহলে বোধ হয় আমরা বেশী সফল কাম হব। আজকাল সারা মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও অন্যান্য মুসলিম অধিকাংশ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মুসলমান জাতির বদ চরিত্রের হিসেব আমরা সকলেই জানি এবং শুনি। ইদানিং তেলে গ্যাসে ফুলা দেশ গুলোয় চাকুরীতে অবস্থানরত সকল বাঙালি ভাইয়েরা মুসলমানদের অভ্যাস ও আচরণ সম্বন্ধে যে হিসেব নিকেশ জানতে পেরেছেন, তাতে মুসলমানী বা ইসলামী রাষ্ট্র বানানোর চেয়ে নিজে উত্তম মুসলমান হওয়াই সব সমস্যার সমাধান মনে করেন। মধ্য প্রাচ্যের মুসলমানেরা হঠাৎ করে বড় লোক হওয়াতে দেখা গেল কম জলের মাছ গভীর জলে পড়লে যেমন টাপুর টুপুর ও তিড়িং বিড়িং লাফাতে থাকে, তাদের অবস্থাও ঠিক তাই। তারা অন্যান্য মানুষ জাতিকে অতি হেয় চোখে দেখে। ইউরোপ, আমেরিকান ও জাপানী ব্যতীত সকল জাতি আজ তাদের কাছে “মিসকীন”। আর বিয়ে এবং রক্ষিতা রাখার নামে চলছে অবাধ যৌনতা। গাড়ী বাড়ী অর্থ বিলাসিতা আতর সুগন্ধি ইত্যাদির পেছনে সীমাহীন অর্থ খোয়ানোর প্রতিযোগিতা দেখলে মানুষের বুক কাঁপে। কোরআনের ছুরা ‘ওয়াকিয়াহ তে যা বলা হয়েছিল’, আজ আমরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তার বাস্তবতা দেখতে পাচ্ছি। মৃত্যুর পরে আর এসব দেখার প্রয়োজন হবেনা। আজ দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে কোথায় গেল বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের ঐক্য ভুমিকা ? কোথায় গেল ইসলামের খেদমত, হেফাজত ও সেবা দায়িত্ব কিংবা সাম্যের গান ? যে দেশে ইসলামের শিকড় সেই দেশে সীমাহীন অপচয়, বিলাসিতা, গুপ্ত যৌনচর্চা আর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর দাসত্ব করা ছাড়া কি আছে ওখানে ? আজকে কি মুসলমানদের উচিত নয় সৌদি আরবকে বয়কট করা ? এমনকি তাদের দেশে হজ্জ্ব পালনে যাওয়ার ইচ্ছেটা ও ত্যাগ করা ? যদি অতীত যুগের কথাই বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাই সে যুগে বিজ্ঞান ছিল না, প্রযুক্তি ছিল না, কর্ম ব্যস্ততা ছিলনা। বিলাসিতার পরিবেশ ও প্রতিযোগিতা ছিল না। মানুষ তাই ঘুরে ফিরে আল্লাহকে খুঁজতে চেষ্টা করেছে। তাদের ক্রিয়াকলাপ দুনিয়া ভিত্তিকের চেয়ে আখের ভিত্তিক হিসেবেই প্রাধান্য পেয়েছিল। তাঁরা ছিল অল্পে তুষ্ট, অভাব ছিল নৈমিত্তিক। তাই তাঁরা আল্লাহর নামে জপ জিকির দ্বারা, সংযম দ্বারা হৃদয়ের ক্লেশ যাতনাকে মহৌষধ হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন। এতে তাঁরা কৃতকার্যও হয়েছেন অনেক। বিশ্বাস তাদেরকে মুক্তি দিয়েছে বহুদিকে। জীবনটাকে তাঁরা এক প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশের ভিতর চালাতে সচেষ্ট হয়েছেন। ক্ষুধাকে, তৃষ্ণাকে, নারীর মানসিক যাতনাকে তাঁরা আমল দেয়নি। কিন্তু এযুগে এসব চারিত্রিক গুণান্বিতার অবলুপ্তি ঘটেছে। সমস্ত পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার ভারসাম্য রক্ষায় দুদোল্যমান।
এ যুগে বিজ্ঞানের প্রভুত উন্নতি সাধিত হলেও এখানে মানুষের জীবন সব সময় ব্যস্ততায় তটস্থ। যুদ্ধ, ফসাদ, হিংসা, শোষণ, অপকৌশল, পরিবেশ দুষণ, আর মানসিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উৎপীড়ন দ্বারা পৃথিবীকে এক কণ্টকময় জ্বরাজ্বীর্ণ ভূমিতে পরিণত করেছে। এটাও চরম সত্য যে; যেহারে পৃথিবীতে মানুষ বাড়ছে সেহারে তার অর্থনৈতিক সমাধান হচ্ছে না। আর এ সমাধান হচ্ছে না বলেই মানুষ অবিরত বিকল্প পথ খুঁজছে। ধর্মনীতির উপরেও আরও কিছু চাইছে। বিকল্প পথ খুঁজতে গিয়ে আমরা বহুমত ও বহু পথের গোলক ধাঁধায় পড়েছি। বর্তমান বিশ্বে পুঁজিবাদ ঠিকে আছে অস্ত্রে, বহুবলে, ব্যবসায় আর সুদের ভিত্তিতে। আর এগুলোকে ধুলিসাৎ করে ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে চাই খাঁটি খোদার গজব। এ গজবতো মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় চিরকাল এক জাতির হাতে শক্তি ও নেতৃত্ব থাকে না। মানুষের মন ও জলবায়ু পরিবর্তন হয়। সম্পদ আবিস্কৃত হয়। হয়তো তারই ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতির আশা বিভিন্ন সময়ে সফল হয়। কাজেই যুগ-উপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদেরকে এমন ভাবে চলতে হবে, যাতে মানুষের কল্যাণ বিরোধী কার্যকলাপ গুলো ধীর ও মন্থর গতিতে উপড়ে ফেলা যায়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : প্রবন্ধটি আমি লিখেছিলাম বিশ্বের অনেক বাস্তব জ্ঞানে দুর্বল থাকার সময় এবং বিজ্ঞানের চমকপ্রদ অনেক তথ্যাদি জানার বহু আগে