সঙ্গিনী

 

এই গল্পটা বন্যার জন্য। এর পিছনে দুটো কারণ আছে। একটা কারণ এখানে বলবো, আরেকটা বলবো না। গল্প শেষ হলে পাঠকেরা এমনিতেই বুঝতে পারবেন যে সেই অন্য কারণটা কী।

 

স্বল্প যে কয়েকজন মেয়ের মেধাকে আমি রীতিমত ঈর্ষা করি তাঁদের মধ্যে বন্যা অন্যতম। অসাধারণ লেখে বললেও কম বলা হয়। ও যে বিষয় নিয়ে লিখছে, সেই বিষয় নিয়েই বাংলায় এর আগে কেউ ঠিকমত লেখেই নি। বিবর্তন নিয়ে এই পরিশ্রমসাধ্য কাজের জন্য বন্যা একদিন যে বরণীয় হবে সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহই নেই। অবশ্য ওর বেশিরভাগ লেখাই আমি বুঝতে পারি না বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে। তারপরেও পড়ে যাই শুধুমাত্র ভাষার লালিত্য আর সহজবোধ্যতার কারণে। বুঝতে না পেরেও মাঝে মাঝে উল্টাপাল্টা মন্তব্য করি ওকে রাগানোর জন্য। আমার উল্টাপাল্টা মন্তব্য যে লক্ষ্যভেদ করে সেটা টের পাই ওর আউলাঝাউলা মার্কা উত্তর দেওয়া থেকেই।

 

 

আমার সাহিত্য প্রতিভার প্রতি আরো অনেকের মতই তার কোন উচ্চ ধারণা নেই। আমার কোন গল্পেই সে কোন মন্তব্য করে নি এখন পর্যন্ত। একারণে এটা তাকে উৎসর্গ করলাম। এইবার মন্তব্য না করে আর কোন উপায় থাকবে না তার।

 

তবে শুধু একা বন্যাকেই উৎসর্গ করছি না। অভিকেও যুক্ত করে দিলাম এর সাথে। এর পিছনেও দুইটা কারণ রয়েছে। প্রথমত, পারিবারিক ক্যাচাল লাগাতে চাই না আমি। এমনিতে কোন্দলবাজ লোক হিসাবে যথেষ্ট কুখ্যাতি এর মধ্যেই জুটিয়ে ফেলেছি। এই বোঝাকে আর বাড়াতে চাই না। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, অভি যাতে এটাকেও আমার তলানি ধরনের লেখা বলতে না পারে সেই রাস্তা বন্ধ করা।

 

আগের লেখাটা শুধু গীতাদিকে উৎসর্গ করেছিলাম। আমার উচিত ছিল গীতাদি এবং ইরতিশাদ ভাই দুজনকেই উৎসর্গ করা। তাহলে আর ইরতিশাদ ভাইয়ের কাছ থেকে ছাইপাশ লেখার তকমাটা আমার কপালে জুটতো না।

 

 

এখন থেকে বুদ্ধিমান হয়ে গিয়েছি। এর পর থেকে যত লেখা লিখবো তার সবগুলোই মুক্তমনার সব সদস্যদের উৎসর্গ করে দেবো। ফলে, কেউ আর আমার লেখার কোনো সমালোচনা করতে পারবে না।

 

ঝুঁকিটা মনে হয় একটু বেশিই নিয়ে ফেলেছি আমি। হঠাৎ করে মনে হলো আমার।

 

দলের লোকজনের কাছ থেকে বেশ কিছুটা দূরেই সরে এসেছি। চোখে পড়ছে না তাদের। কোলাহল শুনতে পাচ্ছি শুধু। আমাদের গোষ্ঠীর লোকজন যে এত হইহট্টগোল করতে পারে তা না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না। এরকম বিপদসঙ্কুল জীবন যাপন করেও যে এরকম হাসিখুশি থাকা যায় তার জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে তারা।

 

ভুল করে যে সবার কাছ থেকে দূরে সরে এসেছি তা কিন্তু নয়। ইচ্ছা করেই একটু দূরে দূরে থাকি আমি সবার কাছ থেকে। অবশ্য অন্যেরাও আমাকে দূরে রাখতে পারলেই খুশি হয়। আমার আলাদা ধরনের ভাবনা-চিন্তা সবার সাথে মেলে না। তাদের জন্য বড় ধরনের লজ্জা হয়ে জন্মেছি আমি।

 

শুধু চিন্তাভাবনাতে যে আলাদা তা নয়, শারীরিকভাবে বিকৃত হয়েও জন্মেছি আমি। আমার কদাকার চেহারা দেখে আমার জন্মদাত্রী মাও পর্যন্ত চমকে উঠেছিল। আমাদের সভ্য সমাজে সন্তানকে মেরে ফেলা যায় না বলেই হয়তো বাঁচিয়ে রেখেছিল আমার মা। তা না হলে বোধহয় জন্মের পরেই মৃত্যু ভাগ্যে লেখা ছিল আমার। আমাকে নিয়ে বিব্রত জননী বিচ্ছিরি একটা নামও বরাদ্দ করেছিল আমার জন্য। কাউকে সেই নাম বলতে গেলেও লজ্জা লাগে আমার।

 

এই জঙ্গলে কোথা থেকে যে এসেছি আমরা তাও এক রহস্য। শ্বাপদসঙ্কুল এই বনভূমিতে চারপাশে মৃত্যুর ফাঁদ পাতা। সেকারণে আমাদের সকলকেই বেশিরভাগ সময়ে গাছের ডালেই বসে থাকতে হয়। অবতার সিনেমার নাভিদের মত গাছের ডালই আমাদের বসতবাটি হয়ে গিয়েছে। অবশ্য এ নিয়ে কারো কোনো ক্ষোভই দেখি না। বেশ ফূর্তিতেই আছে সবাই। খাদ্যের এতই প্রাচূর্য এখানে যে, বিপদ নিয়ে কেউ-ই মাথা ঘামায় না। আমি অবশ্য মাটিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। মাটি দিয়ে তৈরি বলেই হয়তো। ফলে, বিপদকে তোয়াক্কা করে বেশিরভাগ সময়ই মাটিতে কাটাই আমি।

 

পুরো গোত্রের মধ্যে সবুজই আমার একমাত্র বন্ধু। তার সাথেই যা টুকটাক আলাপ করা যায়। বাকিরা সবাই-ই আমাকে ঘেন্না করে। একদিন সবুজকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।

 

দোস্ত, এই যে ঘেরাটোপে ঘেরা আমাদের জীবন। এই জঙ্গলের বাইরে কী আছে কিছুইতো জানি না আমরা। এমনকি ওই যে, সূর্য, চন্দ্র, তারা ওগুলোর আড়ালেই বা কী আছে তাও জানি না আমরা। এগুলো নিয়ে আমাদের কি ভাবা উচিত না বল?

 

আমার কথা শুনে পেট চেপে ধরে খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠেছিল সবুজ। বলে, আরে বাহ! তুইতো দেখি একেবারে দার্শনিক হয়ে গেছিস। বড় হয়ে অভিজিৎ রায় হতে চাস নাকিরে ব্যাটা?

 

‘কোথা থেকে এলাম আমরা, মহাবিশ্বের অন্য কোনো স্থানে বুদ্ধিমান প্রাণী আছে কি না সেগুলোর খোঁজ নেওয়া কি আমাদের প্রয়োজন না? আমি যুক্তি দেখাই।

 

লুকিয়ে লুকিয়ে বন্যা আহমেদ, অভিজিত রায় আর ফরিদ আহমেদদের বইগুলো যে পড়ে ফেলেছি আমি সেটা আর বলি না সবুজকে। এমনিতেই আমাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে। আরো হাসির পাত্র হতে চাই না।

 

আরে ইয়ার, এই সব মুক্তমনা মার্কা ভাবনা-চিন্তা বাদ দে। এর চেয়ে আয়, খাই-দাই আর ফূর্তি করি। দুনিয়াতেতো আর ফুর্তির কমতি নাই।

 

আমাকে এড়াতে চায় সবুজ। তার চোখ পড়ে রয়েছে বীথির দিকে। একটু দূরেই কোমর বাঁকা করে বিপদজনক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে বীথি। উদ্ভিন্নযৌবনা তরুণী। ঠোঁটের কোণায় হাসি। চোখে সুস্পষ্ট আমন্ত্রণের দৃষ্টি। সেই আমন্ত্রণকে উপেক্ষা করার শক্তি সবুজের নেই। আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বীথির দিকে ছুটে যায় সবুজ। সবুজকে দৌড়ে তার দিকে আসতে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠে বীথি। তারপর সেও উল্টোদিকে ঘুরে ছুট লাগায়। সবুজ আর বীথির এই রঙ-তামাশা দেখে হতাশায় মাথা নাড়ি আমি। শাখামৃগই হয়ে থাকবে এগুলো চিরদিন, মানুষ আর হতে পারবে না কোনোদিনও।

 

আমাদের গোত্রের মেয়েগুলো সবই এরকম। নির্লজ্জ, বেহায়া, ছেনাল ধরনের। ছেলে দেখলেই ছোঁক ছোঁক করে উঠে একেকটা। কী কারণে যেন আমাকেও ওদের বেশ পছন্দ। আমার সমতল ললাট, খাঁড়া নাক, ঋজু শরীর, এবং বৃদ্ধাঙ্গুলির বিকৃতিও তাদেরকে দূরে সরাতে পারে নি। বরং প্রবল আকর্ষণই বোধ করে এরা তাতে। সুমী, নীতা, পারুদের মত দুর্দান্ত সুন্দরীগুলো সহ গোত্রের প্রায় অর্ধেক যুবতী মেয়েই এর মধ্যে সরাসরি প্রেম নিবেদন করে ফেলেছে আমাকে। সবগুলোকেই প্রত্যাখান করেছি আমি। মেয়েদের এরকম নির্লজ্জভাব, বেহায়া স্বভাব আর ছেনালপনা একদমই পছন্দ না আমার। তাছাড়া কেন যেন ওদের প্রতি কোন আকর্ষণই বোধ করি না আমি। হয়তো সবার থেকে আলাদা হবার কারণেই এই সমস্যা হয়েছে আমার। আমার প্রত্যাখানে রুষ্ট হয়ে দুই একজনতো আমার পুরুষত্ব নিয়েই সন্দেহ পোষণ করেছে। হাবলু বলে ডাকে আমাকে তারা। আমাকে দেখলেই মেয়েগুলো এ ওকে ঠেলা দেয়, আর হাসিতে গড়িয়ে পড়ে। শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, ‘ওটাতো মরদ না, হিজড়া।’ কী করে ওদের বোঝাই যে, এ নিয়ে আমার কোনো সমস্যাই নেই। গোপনে গোপনে গুপ্তবাবুর সব বই-ই পড়ে ফেলেছি আমি।

 

হঠাৎ করেই সামনের ঝোপটা একটু নড়ে উঠে। ভয়ের হিমস্রোত বয়ে যায় আমার সারা শরীরে। মাটি থেকে বড়সড় এক টুকরো পাথর তুলে নেই হাতে। প্রস্তুত। বুড়ো আঙুলের বিকৃতির কারণে এই জিনিষটা বেশ সহজেই করতে পারি আমি। আমার গোত্রের আর কারোরই এরকম নমনীয় বুড়ো আঙুল নেই।

 

ঝোপের ভিতরের আলোড়্ন আরো বেড়ে গিয়েছে। কিছু একটা বেরিয়ে আসছে ঝোপ থেকে সশব্দে। আমি পাথর ধরা ডান হাতটাকে একটু পিছনে নিয়ে তৈরি হয়ে যাই ছুঁড়ে মারার জন্য।

 

আমাকে অবাক করে দিয়ে ঝোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা মেয়ে। পাথর হাতে আমাকে রণমূর্তিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠে সে। মেয়েটাকে দেখেই হাত নামিয়ে নেই আমি। পাথরটাকে ফেলে দিই মাটিতে। ভয়ে তখনও কাঁপছে মেয়েটা। অনেকটা আমার মতই দেখতে। সমতল কপাল, উন্নত নাসিকা, ঋজু শরীর। তবে বুকটা বেশ উঁচু মেয়েটার। ঠিক আমাদের গোত্রের মেয়েদের মতন নয়।

 

সম্মোহিতের মত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকি আমি। বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক ধরনের অনুভূতি টের পাই। একেই কি বলে প্রেম? কে জানে? সুমী, নীতা, পারুরা হাজার চেষ্টা করেও যে অনুভূতি আমার মধ্যে জন্ম দিতে পারে নি। মাত্র এক লহমার দেখাতেই এই মেয়েটা সেই অনুভূতি জন্ম দিয়ে ফেলেছে আমার বুকের মধ্যে।

 

কোমল গলায় বলি, ভয় নেই, মারবো না তোমাকে আমি।

 

আমার কোমল গলা শুনে কাঁপুনি কিছুটা বন্ধ হয় মেয়েটার। তার বদলে একরাশ লজ্জা এসে গ্রাস করে তাকে। গাল দুটো পাকা চেরির মত লাল হয়ে উঠেছে। একটানে পাশের গাছ থেকে বড়বড় দুটো গোলপাতা ছিড়ে নেয় সে। একটা দিয়ে উন্নত বুক ঢাকে, আর অন্যটা দিয়ে উরুসন্ধিকে আড়াল করে সে। এরকম অদ্ভুত কাজ আমাদের গোত্রের কোন মেয়েকে কখনো করতে দেখি নি আমি। আমিও বোকার মত মেয়েটাকে অনুসরণ করি। একটা পাতা ছিড়ে নিয়ে নিজের পুরুষত্বকে ঢাকি।

 

সলজ্জভঙ্গিতে নীচের ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। আড়চোখে দেখছে আমাকে।

 

মেয়েটাকে নিজের পরিচয় দেওয়াটা প্রয়োজনবোধ করি আমি। বুকে তর্জনী ঠেকিয়ে মোলায়েম কণ্ঠে বলি, আমি আদম।’

 

এই প্রথম নিজের বিদঘুটে নামটা বলতে বিন্দুমাত্র সংকোচ হয় না আমার।

 

‘তোমার নাম কী?’ জিজ্ঞেস করি আমি।

 

হাওয়া। রিনরিন কণ্ঠে উত্তর দেয় মেয়েটা।

 

মেয়েটার নাম কানে যেতেই প্রবল আলোড়ন টের পাই শরীরের কোষে কোষে। লক্ষ লক্ষ বছর ঘুমিয়ে থাকা হার না মানা জিনগুলো ঘুম থেকে জেগে উঠে বিপুল বিক্রমে আমার ভিতরে। রক্তনদীর প্রবল ঢেউয়ে তথ্যের বিপুল প্রবাহ পৌঁছে যায় মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে। কোটি কোটি বছর আগে শোনা ঈশ্বরের বাণী ধ্বণিত-প্রতিধ্বণিত হতে থাকে আমার মাথার ভিতরে। গুরুগম্ভীর স্বরে তিনি বলছেন, আদম, এই যে তোমার শস্যক্ষেত্র। চাষবাস করো মনের সুখে। ছড়িয়ে দাও তোমার জিনগুলোকে চারিদিকে। ধাবিত হও অমরত্বের দিকে।

 

হাসিমুখে আমি তাকাই হাওয়ার দিকে। এইতো আমার হাজার বছর ধরে হারিয়ে যাওয়া সঙ্গিনী। যে বুড়ো আঙুলকে বিকৃত ভেবে সবসময় লুকিয়ে রাখতাম আমি, সেটা বের করে দেখাই হাওয়াকে। ডান হাতটাকে এগিয়ে দেই ও দিকে। হাওয়াও বুকের উপরের পাতাটাকে থুতনি দিয়ে আটকে তার বাঁ হাতটাকে মেলে দেয় আমার দিকে। ওর হাতের বুড়ো আঙুলটা অবিকল আমার মতন। আমার মতই বিকৃত বুড়ো আঙুল নিয়ে জন্মেছে সেও।

 

গভীর ভালবাসায় হাওয়ার হাত ধরি আমি। গাঢ় স্বরে বলি, এসো প্রিয়ে, ফুলে-ফলে ভরে ফেলি এই বসুন্ধরাকে আমরা। আমাদের জিনকে ছড়িয়ে দেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

 

আমার হাতের ভিতরে কেঁপে কেঁপে উঠে হাওয়ার ঘামে ভেজা পিচ্ছিল হাত। কিছু বলে না সে। আরক্ত মুখটাকে নীচু করে আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করে। ঠোঁটের কোণায় লেপ্টে আছে সলজ্জ হাসি।

 

ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে থাকে সে।