[ফরিদ আহমেদের “শিশু মন” গল্পটা আচমকা এই হযবরলটি লিখতে অনুপ্রাণিত করল। আমি honestly বলছি জীবনে গল্প-টল্প লিখার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। অকস্মাৎ একটা তাগিদ অনুভব করলাম। পড়ার মত কোন লেখা এটি নয়। মুক্তমনায় পাঠকের অভাব নেই। কেউ না কেউ পড়বে। পাঠক সংখ্যা দশ পর্য্যন্ত আমি একাই নিয়ে যেতে পারব।

লিখতে যেয়ে মাহফুজের কথাটা বেশী করে মনে পড়ছিল। লেখাটি তাই ওর জন্য থাকল। বাংলাদেশে বসে পড়বে। মাহফুজ আমার ১১ নম্বর পাঠক। তারপর আর কেউ না পড়লেও হবে

হেমেন এবং রানু দুটো ছদ্ম নাম]

নীচে মশারীর ভিতরে বসা ছবিটা আমার কাকাত মামার। পশ্চিম বংগের কুচবিহারে এখনও বেঁচে আছেন। দ্বিতীয় মামা কলকাতায়। তৃতীয় মামা কুচবিহার জেনারেল হাসপাতালের গাইনীর ডাক্তার ছিলেন। সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন। এখন শুধু তাঁকেই কল করি। ভাল একটি খবরের আশায়। – মামা এখনও মরেনি?
dsc00694

– নারে। আর সহ্য হয় না। দাদার পেনসনের টাকায় বাড়ী। বলতে গেলে এখনো পেনসনের টাকায় সংসার চলে। ছেলে দুটো বাসায় বসেই গিলে। ইদানীং বাপিটা তো প্রায়ই রাস্তায় পড়ে থাকে। ওর বৌটা মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেছে। ভালই করেছে।

২০০১ সালে গিয়ে মামার সাথে সারাদিন ছিলাম। তখনই একটা পা টেনে হাটতেন। আমেরিকাতে ফিরে আসার পরে টেলিফোনে বার কয়েক কথা হয়েছে। একদিন বললেন – তোর মামী তো নেই। ক্যান্সারে মারা গেছে। তারপর একদিন লক্ষ্য করলাম দুই পুত্র বধু সবসময় একই উত্তর দেয় – বাবা তো ঘুমুচ্ছেন। রহস্যটা বুঝলাম ২০০৮ সালে ডিসেম্বরে যেয়ে। দিনরাত, চব্বিশ ঘন্টা। মশারীর ভিতরে শুয়ে থাকেন। একজন নার্স জাতীয় কেউ গা মালিশ করে দিয়ে যায়। ঘর ভর্তি গন্ধ। নাক কামড়ে ধরে। বৌরা ঘরে ঢুকে না। টেলিফোনটা মামার হাতে পৌঁছে দেবে কে? এই জন্যই একই উত্তর – বাবা তো ঘুমুচ্ছেন।

আমি গন্ধ ঠেলে মশারির ভেতরে বসলাম। মামা তাকিয়েই বললেন – খুশী? দিদি কেমন আছেরে? তারপর অনেক কথা বলতে থাকলেন। একসময় বললেন – ছাগলের ব্যবসাই ভাল। খায় কম। আমরা এখন ছাগলের ব্যবসাই করি।

ছাগলের ব্যবসাই করি? বুঝলাম মাথাটাও গেছে। বললাম – মামা তুমি বসতে পার? উঠে বসলেন। হাটুর উপরে লুঙ্গি। পা দুটো চামড়া দিয়ে ঢাকা। ছেলে-বৌরা নূন্যতম খাবার খেতে দেয়। যত খাবার তত পায়খানা। নার্স চব্বিশ ঘন্টা থাকে না।

১৯৭১ সাল। আগষ্ট মাস। শিলিগুড়ি শহর থেকে ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে। আমি রিফিউজী হয়ে এই মামাটির বাসায় ছিলাম কিছুদিন। তখন তিনি চারু মজুমদারের নক্সালবাড়ী-খড়িবাড়ীর ব্লক সুপারভাইজার। মাস শেষে ৩২৭ টাকা বেতন। কচকচে এক টাকার নোট। স্ট্যাপল করা। যত্নে একটি কি দুটি খুলেন। খরচ করেন। বাকিটা জমান ভবিষ্যতের জন্য।

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ বড় বড় দেশের বড় বড় নেতাদের সাথে দেখা করে এসেছেন। মুক্তিকামী বাংলাদেশীদের সাহায্য আর সমর্থন দরকার। এডোয়ার্ড কেনেডী এসেছেন শরনার্থী শিবির পরিদর্শন করতে। শিলিগুড়ি থেকে একটি রাস্তা বাগডোগরা এয়ারপোর্টে গেছে। একটু আগেই এপথ দিয়ে গেলেন। নেমেও ছিলেন। নাদুস নুদুস মেয়ে দুটোর সাত বছরের ভাইকে কিছু একটা প্রশ্নও করেছেলেন। ভাইটি এসে তাই বলল আমাকে।

রাস্তার একপাশে নর্থ বেংগল ইউনিভার্সিটি। অন্য পাশে একটা অদ্ভূত বাড়ি। মাঝখানে বর্গাকার উঠান। চারপাশে দালান। এক এক রুমে একটি করে পরিবার। ঘেষা দুপাশে দুতলা। অপর দুপাশে একতলা। একটি একতলার খানিকটা সাড়ি করে রান্নার ব্যবস্থা। মামী নীচে এসে তারই একটাতে রান্না করে নিয়ে যান। একতলা দুটির কোণায় একটি বাঁধানো ইঁদারা। জলের একমাত্র ব্যবস্থা। একটি একতলার পেছনে কয়েকটি গন শৌচাগার। সকালে একটা বালতি ও বদনায় জল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কাজ শেষে বালতির জল দিয়ে ঝাপ্টা মারতে হয়। ফ্লাশিং।

দুতলায় চারটি ঘর। উত্তর-পুব কোনায় মামা। তারপরে তরুণবাবু – পশুহাসপাতালের ডাক্তার। তারপর ইন্দ্র মোহান্তি। শেষ মাথায় স্ত্রী এবং একবছরের ছেলে সহ থাকেন মহেশবাবু। রাতে মামার ঘর থেকে দার্জিলিংএর পাহাড় দেখি। ল্যামপোষ্টের বৈদ্যুতিক বাতি দেখে মনে হয় আকাশের তারাগুলো যেন মাটিতে মিশে গেছে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গাড়ী চলে। হেডলাইট গুলো উপরে উঠে, নীচে নামে। দক্ষিন দিকে দূরে একটি রেল লাইন। দিনের বেলা মালগাড়ীর ডাব্বা গুনি। ১০৫টা। ১১২টা।

মামার ঘরটির পুব পাশে প্রাইমারী স্কুলের মত লম্বা একতলা ঘর। ওপাশে দোকান। এপাশে পেছনে ঘরটির সাথে টিন ফিট করে কয়েকটা ঘর। মামার জানালা দিয়ে নীচে তাকালেই দেখা যায় একটি নেপালী পরিবার। দুইটি কিশোরী। দুধে-আলতা গায়ের রং। নাদুস-নুদুস চেহারা। একটা কাপড় বগলের নীচ দিয়ে সামনে লুঙ্গির মত গিট দিয়ে আটকানো। কখন হঠাৎ খুলে যায়। ভয় হয়। একটা মেয়ে রোজ মহেশবাবুকে এক লিটার করে দুধ দিয়ে যায়। ছেলেটি একাই খায়। বেজায় মোটা হয়েছে। বড় হয়ে জাপানী সুমু রেসলার হবে।
মামার নীচ তলায় থাকে এক নার্স। মামী রাতে পেছনে বারান্দায় খাবারের জিনিষ ধোয়। একটা চোঙ্গা দিয়ে জল নীচে পড়ে। ঝাপ্টা খেয়ে জল তার বারান্দায় উঠে আসে। ভাজখাই গলায় বলে উঠে – নরোত্তম বাবু, আপনি জল ফেলছেন, নাকি আপনার বাপি প্রস্রাব করছে। মামাও গলা উচিয়ে বলে – শুধু বাপি না। বড়টাও।

সাত সকালে সপ্তাহে বার কয়েক মহেশবাবুকে দেখা যাবে কূয়োতলায়। স্ত্রীর শাড়ি থেকে ব্রা পর্য্যন্ত সাবান লাগানো। তারপর বালতিতে জল দিয়ে খোছানো। মামা তখনই বলবেন – তরুণবাবু নীচে তাকিয়ে দেখুন। মহেশবাবু। তরুণবাবু বলবেন – একটাই বালতি। নষ্ট করে দিলেন। আজ স্নান ছাড়াই অফিসে যেতে হবে।

বাপি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। বড় বেশী ট্যাকনা। ইউনিভার্সিটির সবাই যেন চিনে ওকে। – বাপী কেমন আছ? বাপী বলবে – ভাল। তোমাদের খবর কী কাকু। দেখিনা অনেকদিন।

রাস্তা পাড় হয়ে যেতে হয়। দ্রুত গাড়ী চলে। মিলিটারী ট্রাক। বাপি আমাকে হাত ধরে ওপারে নিয়ে যায়, এপারে নিয়ে আসে। সাবধানে। বলল – জান, খুশীদা! মিলিটারীরা বাবাকে খুব ভয় পায়। বললাম – কেন?
– একবার বাবা ঐ দোকান থেকে সিগারেট কিনছিল। একটা মিলিটারী ট্রাক থামিয়ে মাকে টানল। বাবা দেখেই দৌড়ে এল। আর বাবাকে দেখেই ট্রাকটি চলে গেল।
– তা ঠিক। যে রকম হাতীর মত দেহ তোর বাবার।
– বাবার কি হাতীর মর শুড় আছে? তোমার পেট খারাপ, না মাথা খারাপ?

বাপি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান ধরে
আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা
আর কতকাল আমি রব দিশাসারা (দিশাহারা)
রব দিশাসারা

রানূ এবং বন্দনা ইউনিভার্সিটির ছাত্রাবাসে থাকে। মাঝে মাঝেই মামার বাসায় বেড়াতে আসে। বন্দনা সরাসরি মোহান্তিবাবুর ওখানে চলে যায়। বাপি বলে – খুশীদা তুমি জান? মোহান্তী কাকুটা ভাল না। বন্দনা পিসিকে শুড়শুড়ি দেয়। পিসির ভাল লাগে না। তাও দেয়। পিসিটা বোকা। ওখানেই যাবে।

রানূ বলে – আমার জামাইবাবু, হেমেন্দ্র চক্রবর্তী। ফেব্রুয়ারী মাসে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বেড়াতে এসে আটকা পড়ে গেছে। আপনার কথা চিঠিতে লিখেছি। দেশের খবর নিতে আপনার সাথে দেখা করতে আসবে।

জামাইবাবু আমার পূর্ব পরিচিত। আসলেন। কিন্তু দেশের কথা কিছুই জানতে চাইলেন না। বিকেলেই রানুর সাথে দেখা করতে নিয়ে গেলেন। একটা মনিপুরী ছাত্রী সংবাদ নিয়ে ভিতরে গেল। শোনা গেল আর একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করছে – কার রে?

রানূ এল। প্রায় ঘন্টা খানেক কী গল্প করলেন কিছুই বুঝলাম না। ফেরার পথে জামাইবাবু বললেন – নৃপেন, শুনেছ? একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করল – কার রে? মেয়েগুলো ভারী দুষ্ট।

মামা-মামী একটা চৌকিতে শোন। আমাদের জন্য নীচে একটা পাটি পেতে বিছানা। তিনি কয়েক দিন থাকবেন। দীর্ঘদিন স্ত্রী ছাড়া আটকা পড়ে আছেন। পরদিন আমাকে নিয়ে শিলিগুড়ি শহরে গেলেন। কয়েকটি ছোট হোটেলে গেলেন। থাকার ভাড়া সংক্রান্ত তথ্যাদি জানলেন। বাসায় ফিরে এলাম। জামাইবাবু শৌচাগারে গেলেন। মামা জেনে গেলেন ফেরার পথে দুজনের ভাড়া পঁচিশ নয়া আমিই দিয়েছি। তাঁর রাগ দেখে কে। – তোর কিছুই হবে না। ও তোকে নিয়ে গেল। আর তুই পঁচিশ নয়া খরচ করে ফেললি?

প্রথম দিনের পর থেকে জামাইবাবু একাই ছাত্রাবাসে যাতায়াত করেন। চার পাঁচ দিন হয়ে গেছে। জামাইবাবু আছেন। একদিন দুপুরে খেয়ে আমরা দুজন গাটা এলিয়ে দিতে যাচ্ছি। মামা-মামী সেই মূহুর্তে রান্না ঘরে। বাপিও ছিল। সে সিড়ি বেয়ে দৌড়ে উঠে এল। ঘরে ঢুকেই বলল
– কাকু, তুমি আমাদের বাসা থেকে যাচ্ছ কবে?

জামাইবাবু হতভম্ব। আমি হতভম্ব। কারও মুখে কথা নেই। বাপি আবার বলল – এই যে তুমি এসেছ। আর যাচ্ছ না। থাকছ। ভাত খাচ্ছ। আমাদের খরচ হচ্ছে না? আমাদের তো মাস চলবে না।

জামাইবাবু লুংগি ছেড়ে প্যান্ট পড়লেন। ব্যাগটা গুছায়ে বাইরে দাঁড়ালেন। মামা এলে বললেন – দাদা। অনেক দিন থাকলাম। যাচ্ছি। মামা সন্দেহ করলেন। কিছু বলতে পারলেন না। জামাইবাবু চলে গেলেন। খানিক পরে মামা বললেন – খুশী। বাপি কি হেমেনকে কিছু বলেছে? আমি সব বললাম। মামা আমার উপর ক্ষেপে গেলেন – তুই আগে কেন বলিস নি। আমি এখন কী করি? একথা নীলাম্বরের কানে গেলে ও কী করবে তুই জানিস? তুই যা রানুর ওখানে। ওখানেই গেছে। নিয়ে আয়।

বাপি পা দুটো ভাঁজ করে ফ্লোরে বসে আছে। বাবার রক্তচোখ দেখে কাঁপছে। আমার দিকে তাকাল। রাস্তা পার করার জন্য আমার সাথে আসার সাহস করল না। চুপ করে বসে রইল। আমি ছুটলাম। রাস্তা পার হয়েই দেখলাম ওরা আসছে। রানুর ব্যাগে দু-তিন রাত থাকার মত কাপড়-চোপড় হবে হয়তো। বললাম মামা যেতে বলেছেন। রাজী হলেন না।
– এখন তো জলপাইগুড়ি যাওয়ার মত কোন ট্রেন বা বাস কোনটাই নেই। যাবেন কোথায়?

জামাইবাবু কোন উত্তর দিলেন না। মনে পড়ল সেদিন তিনি হোটেলের রেট জেনে নিচ্ছিলেন।

বাসায় ফিরে দেখলাম মামা গুম হয়ে বসে আছেন। বাপি নীচে শুয়ে। মামী কপালে মলম লাগেচ্ছেন। কপালে আড়াআড়ি ভাবে কেটে গেছে। চুটটা বেশ জুড়েই লেগেছে।

পরদিন বাপি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। দুপুর বেলা কেউ নেই। বললাম – মামা তোকে মারল কেনরে?
– কাকুকে যে যেতে বললাম, তাই।
– কেন বললি?
– মা-বাবাই তো বলতে চাইছিল। বাবা বলল মাকে বলতে। মা বলল – আমি পারব না। তুমি বল। কেউ বলতে রাজী হল না। তাই আমি বললাম।

আমি বললাম – বাপি, আমিও তোদের এখানে থাকি। ভাত খাই। তোদের খরচ হয়। তাই না? বল। হয় না?

বাপি বলল – বলব না।
– বল না, শুনি।
– না, বাবা মারবে।

টেক্সাস, ১৫ আগষ্ট ২০১০।