আধ্যাত্মিকতা ও মানব-মস্তিষ্ক

অনুবাদক: রাতুল পাল

মূল ইংরেজী রচনা: প্রফেসর অসীম দত্তরায়

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আলবার্ট আইনস্টাইন উভয়ই সংগীত ও প্রকৃতির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। বেশ কয়েকবার তাদের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়, এবং তারা আপেক্ষিকতা তত্ত্ব সহ আরও অনেক বিষয় নিয়ে নিজেদের ভিতর গভীর আলোচনা করেছিলেন। একবার তাদের আলোচনা মোড় নিয়েছিলো ‘সত্য’,‘সুন্দর’ এবং এ-বিষয় দু’টি মানবচেতনা নিরপেক্ষ কিনা সে-প্রশ্নের দিকে। ‘সত্য’ ও ‘সুন্দর’-কে রবীন্দ্রনাথ যখন মানব চেতনা নিরপেক্ষ হিসাবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন, আইনস্টাইনের পাল্টা প্রশ্ন ছিলো, “যদি মানুষ কখনো বিলুপ্ত হয়, তাহলে বেলভাদ্রের অ্যাপোলো কি আর সুন্দর রবে না?”। রবীন্দ্রনাথ উত্তর দিয়েছিলেন,‘না’। প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন আইনস্টাইন, “সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে আপনার ধারণা মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু সত্যের ক্ষেত্রে নয়”। আইনস্টাইনের যুক্তি ছিলো – বৈজ্ঞানিক সত্যকে বাস্তবতা-নিরপেক্ষ হিসাবে গ্রহণ করা উচিৎ। তখন রবীন্দ্রনাথ উত্তর দিলেন, “যদি এমন কোন সত্য থাকে, যার সাথে আমাদের চেতনার কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা যৌক্তিক সম্পর্ক নেই, তাহলে মানুষের কাছে সেই সত্যের কোন অস্তিত্ব থাকাই সম্ভব নয়”। ‘সত্য’ ও ‘সুন্দর’- এর উপর চেতনার ভূমিকা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের ধারণা পেতে তাঁর ‘আমি’ কবিতাটির অংশবিশেষ উল্লেখ করা যেতে পারে—

“ আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ ,

চুনি উঠল রাঙা হয়ে ।

আমি চোখ মেললুম আকাশে ,

জ্বলে উঠল আলো

পুবে পশ্চিমে ।

গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’,

সুন্দর হল সে ।

তুমি বলবে , এ যে তত্ত্বকথা ,

এ কবির বাণী নয় ।

আমি বলব , এ সত্য ,

তাই এ কাব্য ।

এ আমার অহংকার ,

অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে ।

মানুষের অহংকার – পটেই

বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প ।

তত্ত্বজ্ঞানী জপ করছেন নিশ্বাসে প্রশ্বাসে ,

না , না , না—

না – পান্না , না – চুনি , না – আলো , না – গোলাপ ,

না – আমি , না – তুমি ।

ও দিকে , অসীম যিনি তিনি স্বয়ং করেছেন সাধনা

মানুষের সীমানায় ,

তাকেই বলে ‘আমি’ । …”

আইনস্টাইন সম্ভবত কিছুটা বিজয়দৃপ্ত হয়ে বলেছিলেন, “তাহলে আমি আপনার চেয়ে বেশি ধার্মিক”।

 

 

উপরের আলোচনা থেকে মানব মনের সাথে সৌন্দর্য, সত্য ও আধ্যাত্মিকতা বা ধর্মের সম্পর্ক সম্বন্ধে সহজে ধারণা লাভ করা যায়।

প্রকৃতপক্ষে ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা হলো মানুষের পাঁচটি প্রধান আচরণগত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভূক্ত, যা আধুনিক মানুষের বিকাশ লাভের সাথে গড়ে উঠেছে, এবং প্রত্যেকটি সংস্কৃতিতে এর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। অন্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল ভাষা, উন্নততর যন্ত্রসামগ্রী প্রস্তুতকরণ, সংগীত ও কলা। মানব প্রজাতিকে তার ঈশ্বরে বিশ্বাসের দরুণ homo religio বলে আখ্যায়িত করা হয়, যে বিশ্বাসকে সর্বজনীন বললে খুব বেশি ভুল বলা হবে না। ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা বা আচরণের অবশ্যই জীববিজ্ঞানভিত্তিক কারণ রয়েছে, যা বংশগতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে, ঠিক যেমন ভাবে প্রভাবিত হয় আমাদের বুদ্ধিমত্তা। মানুষ সর্বদাই একটা কিছুর সন্ধানে নিয়োজিত। কিন্তু কখনোই তার সন্ধান মেলে না। এই সন্ধান জীবিকার সন্ধান নয়, সম্পর্কের সন্ধান নয়, এমনকি অর্থেরও নয়। তাহলে কি? উত্তর হলো ঈশ্বর। মানুষ উপলব্ধি করছে, সে যাই করুক না কেনো, তাঁর উপস্থিতি ছাড়া সবকিছুই অপূর্ণ থেকে যায়। অনেকের কাছে ধর্ম ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ প্রকাশ, আবার অনেকে মনে করেন এই বিষয় দু’টি অবিচ্ছেদ্দ্যভাবে সম্পর্কযুক্ত নয়।

বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের একটি নতুন শাখায় ধর্ম ও মানব মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করছেন, যার নাম Neurotheologhy বা Neuropsychology of religion। এই গবেষকদের প্রধান উদ্দেশ্য ঈশ্বরের প্রকৃতি নির্ণয় নয়, বরং ধর্মীয় অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ। ধর্ম একটি আচরণগত ব্যাপার, যাকে অবশ্যই বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। ধারণা করা হয় যে মস্তিষ্কে neurochemical dopamine(DA)-এর বিবর্তনকেন্দ্রিক বৃদ্ধির সাথে ধর্মের বিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে। Brain imaging technology-এর উন্নতির জন্য গবেষণাকারীরা মস্তিষ্কের বিভিন্ন কার্যকলাপ স্নায়ুর সাথে কিভাবে সম্পর্কিত, সে সম্বন্ধে আরও বেশি করে জানতে পারছেন। ১৯৯৭ সালে বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট জায়গা চিহ্নিত করতে সমর্থ হন, যার সাথে মানুষের তীব্র আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার সম্পর্ক রয়েছে, ‘God Spot’ নামে যা গণমাধ্যমে পরিচিতি পায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন এই আবিষ্কার এটি প্রমাণ করে না যে, ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা শুধুই মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের ভিতর সীমাবদ্ধ; আবার এও প্রমাণ করে না যে, মস্তিষ্ক আধ্যাত্মিক অনুভূতি লাভের জন্য বিশেষ ভাবে প্রস্তুতকৃত। তবে এই আবিষ্কার স্নায়বিকবিজ্ঞানের জগতে একটি নতুন দিককে সাফল্যমন্ডিত করেছে, যা বিজ্ঞান ও ধর্মের পারস্পরিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সৃষ্টি করেছে নতুন ক্ষেত্র । এই গবেষণার আলোকে মস্তিষ্কের বিভিন্ন কার্যকলাপ বিশ্বজগতকে উপলব্ধি করতে কিভাবে সাহায্য করছে মানুষকে, তা আমাদের জানার প্রয়োজন রয়েছে। মানব-মস্তিষ্ক কি বংশগত ভাবেই জটিল ও বিশ্লেষণধর্মী চিন্তার জন্য গঠিত? মানুষের অভিজ্ঞতায় বিজ্ঞান ও বিশ্বাসের পারস্পরিক সম্বন্ধের কি অর্থ থাকতে পারে?

ধর্মের উৎপত্তি উন্নততর অস্ত্রাদি ও শিল্পের সূচনার সাথে সাথে হয়েছে বলে ধারণা করা হয়, এবং এই পর্যায়টিকে মানুষের ক্রমবিবর্তনের ক্ষেত্রে ‘Big Bang’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকাশের দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিক মানুষের সময় (প্রায় ২০০০০০ বছর) ও ‘Big Bang’ পর্যায়ের মধ্যে (৪০০০০ – ৮০০০০ বছর) একটি বড় ব্যবধান রয়েছে, তাই ধরা হয় মস্তিষ্কের আকার ও গঠনের পাশাপাশি আরও কিছু বিষয় মানুষের সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে, এমন কি ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও। সাম্প্রতিক কালের একটি বিবর্তন তত্ত্ব দাবী করছে যে, dopaminergic brain system-এর বিকাশ বা বৃদ্ধি বুদ্ধিমত্তা অর্জনের পিছনে প্রধান চলৎশক্তি। এই বৃদ্ধি শুরু হয় শ্রেষ্ঠ স্তন্যপায়ীর বিবর্তনের সময়, যার ফলে সমগ্র মস্তিস্কে সমভাবে DA- এর বন্টন বৃদ্ধি পেতে থাকে, বিশেষ করে উপরের স্তরে।

বেশ অসঙ্গতিপূর্ণ শোনালেও এটি সত্য যে, মানুষ যেমন নিয়ন্ত্রক হতে চায়, তেমনি আবার বর্হিবিশ্বে এমন কিছুর সন্ধান করে, যার দ্বারা সে নিজেই হতে চায় নিয়ন্ত্রিত। বাহ্যজগৎ সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি মস্তিস্কে neurochemical গুলির সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে। তবে এখানে আরেকটি লক্ষণীয় দিক আছে। মস্তিষ্ক পরিবর্তনশীল এবং এর কার্যাদি বাহ্যপ্রকৃতির দ্বারা অনেকাংশে পরিবর্তিত হয়। একটি অনিশ্চিত পরিবেশে DA-এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে, যা আমাদেরকে ওই পরিস্থিতিতে সাড়া দিতে প্রস্তুত করে তোলে। DA-এর প্রভাবই কারাগারে বা যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষকে প্রবৃত্ত করে ঈশ্বর-চিন্তা করতে বা আধ্যাত্মিক হতে । আমাদের প্রচলিত ঈশ্বর-চিন্তা সৃষ্টি হয়েছে মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক যৌগের প্রতিক্রিয়ায় । তাই মানুষ কর্তৃক ধারণাকৃত ঈশ্বর খুবই সীমিত ও আপেক্ষিক, কেননা তা অনেকাংশে নির্ভর করছে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একজন ব্যক্তির মস্তিষ্কের ক্রিয়াশীলতার উপর। হয়তো জৈবিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার দ্বারা সৃষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত এই ঈশ্বরের ধারণার সাথে প্রকৃত সৃষ্টিকর্তার — যদি সত্যিই তাঁর অস্তিত্ব থেকে থাকে — কোনো সম্পর্কই নেই।

সাধারণ ভাবে যাকে ব্যক্তিগত ঘটনা বলে মনে হয়, গবেষণাকারীরা তাকে একটি বিশেষ সমাজের বিশেষ গঠনগত বৈশিষ্ট্য হিসাবে দেখেন। মানুষ প্রাথমিক ভাবে সামাজিক প্রাণী, যার মস্তিষ্কের উপর প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে সমাজের, এবং সে বিমূর্ত ধারণার চেয়ে

গোষ্ঠীগত ভাবনা ও আলোচনার দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। আধ্যাত্মিকতার সাথে মানুষের চিরকালীন আকাঙ্খার একটি সম্পর্ক রয়েছে। দুঃখের কারণ, পরম প্রাপ্তি, কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ ইত্যাদি বিষয়গুলি এর সাথে জড়িত। সমাজ শুধু ধার্মিকের ধারণাই তৈরি করে না, নির্ধারণ করে তার অভিব্যক্তিকেও। যেমন নেটিভ্ আমেরিকানসহ অন্যান্য কিছু প্রজাতির মানুষ, যারা প্রকৃতির সাথে আধুনিক আমেরিকানদের তুলনায় অধিক নিবিড় ভাবে সম্পৃক্ত, প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানকে দেবতা হিসাবে উপাসনা করে থাকে, যেমন – বজ্রের দেবতা, চন্দ্রের দেবতা, শস্যক্ষেতের দেবতা ইত্যাদি। নেটিভ্ আমিরিকানদের মতো প্রাচীন ধর্মগুলিতে দেব-দেবীর পূজা করা হতো। আমেরিকায় এই ধরণের ধর্মীয় আচার এখন প্রায় লোপ পেয়েছে।

বিবর্তনের সাথে যেমন DA বৃদ্ধি পেয়েছে, neurotransmitter system-এর আর কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়নি, বা কমে গেছে, যেমন – glutamate, acetylcholine(Ach)। DA-এর প্রাথমিক বৃদ্ধির সাথে মানুষের তাপসহিষ্ণু হবার সম্বন্ধ রয়েছে, আর শেষ পর্যায়ের বৃদ্ধির সাথে সম্পর্ক রয়েছে মানুষের বিমূর্ত চেতনার ক্ষমতা, সংগীত ও শিল্পকলায় সৃষ্টিশীলতা ও আধ্যাত্মিক আচরণের। বিমূর্ত ও আধ্যাত্মিক চেতনা উভয়ই গড়ে উঠছে মূলত অদৃশ্য কাল ও স্থানের উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে, এবং এই দু’টি বিষয়ই মস্তিষ্কের উপরিভাগের সাথে সম্পর্কযুক্ত। DA-এর পরবর্তী পর্যায়ের বিকাশের সাথে schizophrenia-এর মতো মানসিক বিকারের যোগাযোগ সুস্পষ্ট, কারণ এই পর্যায়ে DA অধিক ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। আবার ধারণা করা হয় যে, schizophrenia-এর পিছেন যে কারণ কাজ করে, বুদ্ধিমত্তা ও আধ্যাত্মিক অনুভূতির পিছনেও কাজ করে সেই একই কারণ। বিস্ময়কর শোনালেও এটি সত্য যে, বুদ্ধিমত্তা ও বিকারগ্রস্থতা অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত, কারণ দেখা যায় যে schizophrenia আক্রান্তদের বুদ্ধিমত্তার স্তর কমে যায়। তবে কিছু schizophrenia আক্রান্ত মানুষের বিকার-পূর্ববর্তী বুদ্ধিমত্তা আকস্মিকভাবে বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে। DA-এর হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে যে লক্ষণগুলি দেখা যায়, মেধাবী ও বিকারগ্রস্থ উভয়ই তার ভিতর কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এছাড়া অতিশয় মেধাবীদের schizophrenia আক্রান্ত পরিবারেও অনেক ক্ষেত্রে জন্মগ্রহণ করতে দেখা যায় । আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক আচার ও বৈজ্ঞানিক চেতনা, যাদেরকে স্বাভাবিক ভাবে দুই ভিন্ন মেরুর বিষয় বলে মনে হয়, উন্মেষিত হয়েছিল সম্ভবত একই সাথে। এই দু’টি বিষয়ই মূলত নির্ভর করে বিমূর্ত ধারণার উপর। ক্রোল ও শিহানের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জানা গেছে যে, ৭০% schizophrenia আক্রান্ত রোগীর আধ্যাত্মিক কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। এছাড়া দেখা যায় নারীদের তুলনায় পুরুষদের schizophrenia দ্বারা আক্রান্ত হবার পরিমাণ বা আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা লাভের পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। পুরুষের ক্ষেত্রে DA-এর অধিক ক্রিয়াশীলতা হয়তো এর কারণ।

DA আমাদের দূরবর্তী স্থান ও কাল (space & time) সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করে। দূরবর্তী স্থান মানে শুধুমাত্র বর্হিবিশ্বের স্থান নয়, সুদূরের অদৃশ্যমান স্থানও; দূরবর্তী কাল মানে শুধুমাত্র রৈখিক সময়ই নয়, নিরন্তন-শাশ্বত কালও, এমনকি মৃত্যুর পরবর্তী সময়ও এর অন্তর্ভূক্ত। ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা কিছু বিশ্বাস, অভিজ্ঞতা ও আচারের সমষ্টি। অতিপ্রাকৃতিক কিছু ব্যাপার এর সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত। সৃষ্টিতত্ত্ব ও মহাজাগতিক বিষয় সম্বন্ধে মানুষের ধারণা, যা আধ্যাত্মিকতার একটি গুরত্বপূর্ণ অংশ, DA-এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। এটি শুধু বিষয়গুলি সম্বন্ধে চিন্তা করতেই প্ররোচিত করে না, তাকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণও করে। বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনার ভিতর সংযোগ খোঁজার প্রবৃত্তি, ও তাকে নিয়ন্ত্রণের পিছনেও রয়েছে এর প্রভাব। এছাড়াও একটি বিশেষ উদ্দেশ্যকেন্দ্রিক আচরণ, কোনো ফলাফল সম্বন্ধে আগাম ধারণা প্রদান, ভবিষ্যতবাণী করা ইত্যাদিও নিয়ন্ত্রন করে DA। মানুষ সব ঘটনার নিয়ন্ত্রক হতে চায়। সব নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমরা আসলে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই আমাদের উদ্বেগের মাত্রাকে। পরকালে বিশ্বাস মূলত dopamine-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি প্রবণতার ফল, যা মৃত্যুর পরও আমাদের নিয়ন্ত্রক হবার আকাঙ্খার বহিঃপ্রকাশমাত্র।

স্বপ্নকে আধ্যাত্মিকতার অংশ হিসাবে বহুকাল ধরে বিবেচনা করা হয়, এবং এর দ্বারা অতিপ্রাকৃতিক বার্তা গৃহীত হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। Old Testament- এ স্বপ্ন অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উপস্থাপিত হয়েছে, যার অন্যতম সাক্ষ্য বহন করে Genesis-এ

জোসেফের স্বপ্ন। এমনকি অতীতে জাপানী মন্দিরগুলি স্বপ্ন দেখার অনুকূল জায়গা হিসাবে ব্যবহৃত হতো। তাছাড়া প্রাচীন ধর্মগুলিতে বিশ্বাস করা হতো স্বপ্নের সময় আত্মা উন্নীত হয় তুরীয় অবস্থায় । Epilepsy ও paranoid schizophrenia-এর সময় যে hallucinations হয়, তা থেকে উদ্ভূত কিছু অভিজ্ঞতাই বিশ্বের বেশ কিছু প্রধান ধর্ম সৃষ্টির কারণ বলে ভাবা হয়। মনস্তত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত কিছু উপাদানের কারণে সৃষ্ট hallucination-এর সাথে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সংযোগ আছে, বিশেষ করে নেটিভ্ আমেরিকানদের ক্ষেত্রে। দৃষ্টিভ্রম সৃষ্টিকারী মাদকদ্রব্য বিভিন্ন রহস্যজনক অভিজ্ঞতালাভে প্রবৃত্ত করে গ্রহণকারীকে। শরীর ত্যাগের(out-of-body) অভিজ্ঞতাও এক ধরণের hallucination, যার উপলব্ধি ঘটে থাকে সাধারণত মৃত্যুপূর্ববর্তী সময়ে। এই বিষয়টিও ধর্মীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে ।

মত্যুপূবর্বর্তী অভিজ্ঞতা বিভিন্ন সংস্কৃতিতে প্রায় একই রকম প্রভাব রাখে, তাই একে বিশ্বজনীন বললে ভুল হবে না। মত্যুপূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার মধ্যে রয়েছে “ভিন্ন জগতে” স্থানান্তর, অতিপ্রাকৃতিক সত্ত্বার সম্মূখীন হওয়া, নিজের দেহকে বাইরে থেকে দেখা(autoscopy) ইত্যাদি। এই অভিজ্ঞতাগুলিকে সাধারণভাবে আধ্যাত্মিক ব্যাপার হিসাবে পরিগণিত করা হয়। হ্রাসকৃত অক্সিজেন ও প্রচন্ড পীড়ন থেতে উদ্ভূত পরিস্থির সাথে মানুষের মানিয়ে নেবার প্রবণতা এই অভিজ্ঞতার অন্যতম কারণ হতে পারে। বৃদ্ধিপ্রাপ্ত DA সঞ্চারণ Hypoxia (অক্সিজেন ঘাটতি)-এর অন্যতম কারণ, এবং Hypoxia-কে schizophrenia-এর অন্যতম পূর্বলক্ষণ হিসাবে দেখা হয়। এছাড়া যে সব মাদকদ্রব্য রহস্যজনক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে, তার সাথে DA-এর ক্রিয়াশীলতার সম্বন্ধ রয়েছে।

কিন্তু সব কিছুর পরও বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যেটি অস্পষ্ট থেকে গেছে, এবং হয়তো থেকে যাবে চিরকাল, তা হল — আধ্যাত্মিক রূপান্তর কি শুধুই DA বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া, যা মানুষকে প্ররোচিত করে উচ্চতর কোনো শক্তির বিশ্বাসে? নাকি DA-এর বৃদ্ধি মস্তিষ্কে সৃষ্টি করে এমন কোনো পরিবেশ, যা চিরবিরাজমান সেই উচ্চতর সত্ত্বার উপলব্ধির জন্য একান্ত অনুকূল? সৃষ্টিকর্তার কি সত্যিই কোনো ভূমিকা আছে? নাকি ভূমিকা DA-এর? নাকি কোনটিরই নয়? বিজ্ঞানীরা প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন এই উত্তর সন্ধানের। কিন্তু বিজ্ঞানীরা যতই সফল হোক, অধ্যাত্মবাদীরা তার ব্যাখ্যা দেবেন। বিষয়টিকে ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা বা মনস্ত্বাত্বিক ঘটনা যাই বলা হোক না কেনো, মানবিক চেতনার গঠনে এর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা থাকুক বা নাই থাকুক, মানুষের মস্তিষ্ক-সৃষ্ট ঈশ্বর বা আধ্যাত্মিকতা বিলীন হবে না, যদি না মানুষের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা লুপ্ত না হয়। ভাবনা-ভালোবাসা-সুখ-দুঃখ-আশা-আকাঙ্খার মতো আধ্যাত্মিকতা একটি মস্তিস্কপ্রসূত মানবিক অনুভূতি, যা আমাদের চিরকালের সঙ্গী, এবং এর সাথে প্রকৃত সৃষ্টিকর্তার হয়তো কোনো সম্বন্ধ নেই। প্রচলিত ধর্মগুলি গড়ে উঠেছে প্রাচীন মানুষের অর্জিত জ্ঞান-অভিজ্ঞতা ও তাদের মস্তিষ্কের DA ও অন্যান্য যৌগের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে। মানুষের বৃহত্তর উন্নতির জন্য ধর্মকে যথেষ্ট প্রমানসহ বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করা যেতে পারে, কিন্তু কখনোই অশ্লীল আক্রমণ নয়। আধ্যাত্মিকতা বা ঈশ্বর-ভাবনায় মস্তিষ্কের স্নায়ু ক্রিয়া বর্তমান সময়ে আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে, কিন্তু একটি মস্তিষ্কপ্রসূত বিষয় হিসাবে এটি ভাষা-দৃষ্টিগত উপলব্ধি-সংগীত-গণিত ইত্যাদির সাথে কিভাবে সম্পর্কযুক্ত, সে সম্বন্ধে এখনো যথেষ্ট গবেষণা হয়নি।

(“শাশ্বতিকী” তে প্রকাশিত)