একজন নারীর জীবনে একই সময়ে একজন পুরুষ (পৌরাণিক চরিত্র দ্রৌপদীর মত দুয়েকজন ব্যতিক্রম বাদে) পৃথিবীর সব তথাকথিত সভ্য সমাজে সম্মানিত নারীর অবস্থান। এটি বিভিন্ন দেশের সামাজিক ইতিহাসে, পুরাণে, লোক উপখ্যানে বর্ণিত। আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে তো এটি আষ্ঠেপৃষ্ঠে লেগে আছে। গেঁথে আছে। তাহলে সভ্য সমাজে একজন পুরুষের জীবনে একই সময়ে একজন নারীর অস্তিত্ব প্রত্যাশা করা উচিত নয় কি?

বহুল আলোচিত এবং প্রায় সর্বজন সমর্থিত ধারণা, বিশ্বাস ও আকাঙ্ক্ষা মনোগ্যামী মানে একগামিতা শুধুই নারীদের বেলায় প্রযোজ্য। শুদ্ধ, বীর্যীয়, জেনেটিক ও রক্তীয় উত্তরাধিকার দেওয়ার জন্য নারীকে সতী সাবিত্রী থাকতে হবে, যদিও সে উত্তরাধিকার নারীটির ধারাবাহিকতা বহন করে না।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/রয়টার্স এর ১২ আগস্ট, ২০১০ এর খবরে প্রকাশ ইরানে ব্যাভিচার এবং স্বামী হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে পাথর ছুঁড়ে মৃত্যুদণ্ডের সম্মুখীন ৪৩ বছর বয়সী সাকিনা মোহাম্মদী আশতিয়ানি ।

আশতিয়ানির মামলাটি নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হৈচৈ হওয়ায় ইরানের কর্মকর্তারা পাথর ছুঁড়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর সাময়িকভাবে স্থগিত করে। তবে এখন তাকে ফাঁসি দেওয়া হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০০৬ সালের মে মাসে ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের এক অপরাধ আদালত দুই পুরুষের সাথে অবৈধ সম্পর্ক এবং স্বামী হত্যার দায়ে আশতিয়ানিকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং পাথর ছুঁড়ে তার মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়। এর আগে দুইজন পুরুষের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের কারণে দুই সন্তানের মা আশতিয়ানিকে ৯৯ টি দোররা মারা হয়।

টিভি সাক্ষাৎকারে স্বামীকে হত্যার ঘটনা বর্ণনায় আশতিয়ানি তার স্বামীর জ্ঞাতি ভাইয়ের কথা উল্লেখ করেন। আশতিয়ানি বলেন, সে তার স্বামীকে খুন করার কথা বললে তিনি প্রথমত একে কৌতুক মনে করেছিলেন। পরে তিনি বুঝতে পারেন সে ) জ্ঞাতি ভাই( পেশাদার খুনী । সে–ই বাড়িতে এসে তার স্বামীকে খুন করে বলে জানান আশতিয়ানি।

ওদিকে, ইরানের ইস্ট আজারবাইজান প্রদেশের বিচার বিভাগের প্রধান টেলিভিশন শো’তে বলেন, আশতিয়ানি তার স্বামীকে একটি অ্যানেশথেটিক ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর সে অচেতন হয়ে গেলে আসল খুনী তখন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস দিয়ে তাকে খুন করে।

আদালত এবং রাষ্ট্রও একজন নারীর বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডায় ব্যস্ত। দুই জন পুরুষের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের মত গৌণ বিষয়টির জন্য পাথর মেরে শাস্তি দেওয়া যৌক্তিক নয় বিধায় বর্হিবিশ্বকে ফাঁকি দিতে স্বামী হত্যার বিষয়টিকে যুক্ত করেছে বলে সন্দেহ পোষণ করা অন্যায় হবে না। ইরানের পুরুষটির কি হল? এ বিষয়ে খবরটি নিশ্চুপ। যদি একই সময়ে দুইজনের সাথে যৌন সম্পর্ক ব্যভিচার হয় তবে তা নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য হওয়া উচিত।

আমাদের মত অনেক দেশে পুরুষরা আইনের আশ্রয়ে, ধর্মীয় রীতিনীতির প্রশ্রয়ে বিয়ে নামক প্রহসন ঘটিয়ে অনায়াসে একাধিক নারীকে ভোগ করে। আইন ও ধর্ম পুরুষেকে অনেক যৌন স্বাধীনতা দিয়েছে। আর পুরুষদের এ যৌন স্বাধীনতা যে কোন কোন নারীর জন্য অপমানের ও যন্ত্রণার তা সমাজ ভেবে দেখে না।

প্রবাদ আছে— নারীরা স্বামীকে যমকে দিতে চায় কিন্তু সতীনকে নয়। অর্থাৎ সতীনের সাথে ঘর করার চেয়ে বৈধব্য বরণ করা কম কষ্টকর। এ নিয়ে অনেকে বলতে পারেন নারীদের ছোট মন বলেই স্বামী ভাগাভাগির চেয়ে তার মৃত্যু কামনা করে। আসলে প্রবাদটি নারীর মনোকষ্টের গভীরতা ও ব্যাপকতা বুঝাতেই ব্যবহৃত হয়। উল্লেখিত হয়। তাছাড়া, কিন্তু সামাজিক অবস্থানের কারণে প্রথমা স্ত্রী স্বামীর প্রতি তার দাবি টিকিয়ে রাখতে পারে না। নিজে জ্বলে অথচ জ্বালাতে পারে না। এ অক্ষমতা থেকে বেছে নেয় আত্মহত্যার মত পলায়ন মনোবৃত্তিকে, প্রথমা স্ত্রী সতীনের ঘর না করে সন্তানসহ নিজেই যমের দেশে চলে যায়। নিজের প্রিয়তম সন্তানদের নিরুপায় ভবিষ্যত জীবন কল্পনা করে তাদেরকে নিজের সহযাত্রী করে নেয়।
অথচ কবি হেলাল হাফিজের অচল প্রেমের পদ্য-০৭ এর মতই —

‘আমাকে উস্টা মেরে দিব্যি যাচ্ছো চলে,
দেখি দেখি
বাঁ পায়ের চারু নখে চোট লাগেনি তো,
ইস! করছো কি? বসো না লক্ষ্মীটি,
ক্ষমা রুমালে মুছে সজীব ক্ষতেই
এন্টিসেপ্টিক দুটো চুমু দিয়ে দেই।‘

নারীকে এ রকম ভূমিকায়ই দেখতে চায় পরিবার, সমাজ, এমনকি রাষ্ট্রও?
যেখানে পুরুষ তার স্ত্রীর ন্যুনতম স্খলনও মেনে নেয় না সেখানে আমাদের দেশের বহু নারী চার সতীনের ঘর করছে। যে দুয়েকজন তা মেনে নিতে পারে না তারাই পত্রিকার পাতার খবর হয়।

গত ১২ জুন, ২০১০ তারিখে প্রায় সব গণ মাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যে ১০ জুন রাতে রাজধানীর কদমতলী থানার জুরাইনে ফারজানা কবির রীতা (৩৭) নাম্মী এক নারী তার দুই শিশুসন্তান পাবন বিন রাশেদ (১৩) ও রাইশা রাশমীন পায়েল (১০) সহ অতিরিক্ত ঘুমের বড়ি সেবন করে একসঙ্গে আত্মহত্যা করেছে।
৬ আগষ্ট ২০১০ তারিখে প্রায় সব গণ মাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়ছে যে গত ৫ আগষ্ট ২০১০, তারিখে আরেক গৃহবধূ বিলাসী আক্তার
(২৭) তার ছেলে রায়হান (৩) ও মেয়ে রজনীকে (৮) সহ গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা ।

গণ মাধ্যমে আলোড়িত না হলেও এমন ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে এবং প্রকাশিত হচ্ছে। নিশ্চয়ই কিছু অপ্রকাশিতও থাকে। আলোড়িত দুইটি কাহিনীর ঘটনা একই। ঘটনার দুইজন নারীর স্বামীই দ্বিতীয় বিয়ে করেছে এবং প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের অবহেলা করে, তাদের উপর অবিচার করে, অত্যাচার করে। পরিণামে স্ত্রী হিসেবে অনন্যোপায় হয়ে সন্তানসহ আত্মহত্যা।

কেন স্বামীর অত্যাচারে জর্জরিত মা সন্তান সহ আত্মহত্যা করে? নিজে মরে গেলে তার অনুপস্থিতিতে তার সন্তানদের অসহায় জীবনের কথা চিন্তা করে একজন ছেলেমেয়েসহ ঘুমের বড়ি খেয়েছে আর অন্যজন ছেলেমেয়েসহ শরীরে কেরোসিন ঢেলে পুড়েছে। পোড়া মা বিলাসী তার জবানবন্দিতে বলেছেই যে তার অনুপস্থিতিতে তার সন্তানদের দুঃখময় জীবন কল্পনা করেই সে এ ধরনের ক্রিয়াকলাপ করেছে।
দুজন নারীই আত্মহত্যা করলেও তারা ছেলেমেয়ে হত্যাকারী। কোনমতে তারা বেঁচে গেলে তাদের বিরুদ্ধে হত্যাকারীর অভিযোগ আনা হতো। যেমন ঘটেছে লতিফার ক্ষেত্রে। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার গাজীরচর ইউনিয়নের খন্দকারকান্দি গ্রামে ১৭জুলাই ২০১০ রাজমিস্ত্রি আওয়াল মিয়ার স্ত্রী লতিফা স্বামীর সাথে ঝগড়ার জের ধরে দুই মেয়ে মহিমা (৫) ও মোহনা (২) কে নিজের শাড়ির সাথে বেঁধে পুকুরে ঝাঁপ দেয়। ঘটনা ক্রমে তিনজনকেই উদ্ধার করে বাজিতপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে শিশুদেরকে মৃত ঘোষণা করে ও লতিফা বেঁচে যায়। সে এখন সন্তান হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে জেলহাজতে।
প্রথমত রীতা ও বিলাসী নাম্মী নারীদ্বয় কেন ছেলেমেয়েসহ আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন। কারণ দুজনেরই স্বামীই আইন না মেনে প্রথমা স্ত্রীর অনুমতি বিহীন বিয়ে করেছে। এতে তারা আইনের আশ্রয় নিলে তাদের স্বামীর জেল জরিমানা হতে পারত; তবে দ্বিতীয় বিয়েটি বাতিল হতো না। আর স্বাভাবিকভাবেই জেল জরিমানা হলে প্রথমা স্ত্রীর কারণে জেলখাটা স্বামী আর এ স্ত্রী নিয়ে ঘর করত না।
নিজেরা তাই অপমানিত তো বটেই, মৌলিক চাহিদা মেটানোর মত সংস্থানও তাদের নেই। গৃহবধূদ্বয়কে স্বামীর দয়ায়ই চলতে হতো। তাই আত্মহননের পথ বেছে নেয়। অপমান, অসহায়ত্ব, অবিচার, অত্যাচার ( শারিরীক মানসিক উভয়ই) তাদেরকে জীবন থেকে দূরে নিয়ে যায়। বাস্তবে দেখে সে ছাড়া তার সন্তানদের আর কেউ কোথাও নেই।
স্বামী ও বড়ছেলে রেখে মা মারা গেলে প্রবাদই আছে—-
‘মা মরলে বাপ তালৈ
ভাই হয় বনের বাবুই।’
সেখানে বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে আলাদা থাকা বাবা তো তালৈ এর চেয়েও পর। পুরুষ বাঘ নিজের সন্তানদের খেয়ে ফেলে। সুস্থ সবল প্রথমা স্ত্রী ও সন্তান রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করা বাবা তো বাঘের চেয়েও পৈশাচিক। এমতাবস্থায় তাদের অবস্থানে থেকে সন্তানসহ মরণকেই শ্রেয় মনে করা অবাস্তব নয়।
পরিবার ও সমাজ নারীদের অসহায় করে গড়ে তুলে বলেই দুর্বল চিত্তের নারীরা স্বামীর অপরাধের প্রতিরোধ তো দূরে থাক প্রতিবাদও না করে নিজেই দুটো অপরাধ করে বসে। প্রথমত সন্তানদের হত্যা। দ্বিতীয়ত আত্মহত্যা। ধর্ম নির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় বেড়ে উঠা সব ধর্মেই আত্মহত্যা মহাপাপ জেনেও দুই গৃহবধূ এ পথকেই বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে।

এ থেকে মুক্তির পথ খোঁজার দায়িত্ব পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের।

নারীদের শৈশব থেকেই পুতুল খেলা দিয়ে তাকে মা বানানোর প্রক্রিয়া শুরু। মায়ের কোল সন্তানের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ। কাজেই এ সামাজিকীকরণের ফলে, সাথে যুক্ত স্বামীর সন্তানদের প্রতি অবহেলা, মায়ের মন নিজের অনুপস্থিতিতে সন্তানের অসহায়ত্ব চিন্তা করেই এমন সহমরণের ঘটনা। একজন শিশুর দায়িত্ব শুধু মা বাবাকে নয়,পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে, সমাজকে, সর্বোপরি রাষ্ট্রকে গ্রহণ করার আইনগত বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে ও নৈতিক ধারণা প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন। তাহলে রীতা ও বিলাসী নিজেরা আত্মহত্যায় প্ররোচিত হলেও সন্তানসহ হবে না। আর রীতা বিলাসীদের আত্মহত্যা বন্ধের জন্য দাবী করচি বহু বিবাহ আইনকে আরও কঠোর করা ও তা প্রয়োগের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া।
আর! আর ? আর রীতা বিলাসীদের গড়ে তুলতে হবে সম্পূর্ণ একজন মানুষ হিসেবে যাতে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েকে সামাজিক, আর্থিক ও মানসিকভাবে শক্ত মন নিয়ে মোকাবেলা করতে পারে। সর্বোপরি যাতে নারী হিসেবে নির্যাতনের শিকার হতে না হয় এবং হলেও নিজেই প্রতিরোধ করতে পারে।