অঁরি পোঁকারের Intuition and Logic in Mathematics থেকে অনুবাদ

ফরাসী গণিতবিদ পোঁকারে সবচেয়ে পরিচিত পোঁকারে অনুমানের জন্য, কিন্তু তিনি গণিতের বহু শাখায় গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। অনুদিত প্রবন্ধটি ১৯০৫ সালে লেখা বিজ্ঞানের মূল্য বইয়ের অন্তর্ভুক্ত। প্রবন্ধের ইংরেজী অনুবাদ, যেখান থেকে এই বাংলা অনুবাদ করা হচ্ছে, ইন্টারনেটে সহজলভ্য।

গণিতে অন্তর্জ্ঞান ও যুক্তিবিদ্যা

এই পর্যায়ে এসে দ্বিধা-দংশনে ভুগছি। একদম প্রথমে দু’রকম গাণিতিক মনের প্রভেদ নির্দেশ করেছিলাম — একদিকে যুক্তিবিদ-analyst এর দল, অন্যদিকে জ্যামিতিবিদ-অন্তর্জ্ঞানবাদীরা। পরে আবার অন্তর্জ্ঞানকে উদ্ভাবনের মূল হিসেবে চিহ্নিত করলাম। কিন্তু মুশকিল হল, যুক্তিবিদেরাও বহু উদ্ভাবনের জনক। যেসব মহান যুক্তিবিদের নাম এ লেখায় এসেছে তাঁরাই এ ব্যাপারে প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট।

এই আপাত-অসংগতির ব্যাখ্যা দরকার। বিশেষ থেকে সাধারণে উত্তরণ ছাড়া বিজ্ঞানের দিগন্ত প্রসারিত করা যায় না, এটা মাথায় রাখলে পরিষ্কার হয়ে পড়ে যে analyst রাও স্রেফ শুষ্ক যুক্তিবাদের ব্যবহারকারী নন, কারণ যুক্তিবাদ যায় সাধারণ থেকে বিশেষে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অর্জিত হয় সাধারণীকরণের মাধ্যমে, বিশেষায়িতকরণের মাধ্যমে নয়।

আমার “বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক প্রকল্প” বইয়ে গাণিতিক পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার অবকাশ আমার হয়েছিল, এবং আমি দেখিয়েছিলাম যে “গাণিতিক আরোহন” নামের এক সাধারণ পদ্ধতির সাহায্যে যুক্তি-নিশ্ছিদ্রতাকে বজায় রেখেই কিভাবে বিশেষ থেকে সাধারণের উত্তরণ সম্ভব। এই পদ্ধতি ব্যবহার করেই analyst রা বিজ্ঞানে অবদান রেখেছেন। তাঁদের কাজ অধ্যয়ন করলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই অ্যারিস্টোটল-বর্ণিত ও স্কলাসটিক-ব্যবহৃত ধ্রুপদী সিলোজিসম ছাড়াও এই “গাণিতিক আরোহন” এর বহুল ব্যবহার খুঁজে পাওয়া যায়।

এধারণা পোষণ করলেও ভুল হবে যে তাঁরা লক্ষ্যশূণ্য ভাবে শুধু ক্রমিক যুক্তির পথে ছুটে বেড়িয়েছেন। লক্ষ্য-মুখী একটা পথ বের করে সেদিকে এগোতে হয়েছে তাঁদের, এবং এ কাজে তাদের পথ-প্রদর্শকের দরকার হয়েছে। প্রথম পথপ্রদর্শক, তুলনা। উদাহরণস্বরূপ, ডমিনেন্ট ফাংশনের ব্যবহার analyst দের খুবই প্রিয় প্রমাণ-পদ্ধতি। আমরা জানি এই ধারণা বহু সমস্যার ক্ষেত্রে চমৎকার কাজে দিয়েছে। যে গণিতবিদ নতুন একটি সমস্যায় এটি কাজে লাগাবেন তাঁর কাজটি তাহলে কি? তাঁর যেটা প্রথমেই করতে হবে সেটা হল নতুন সমস্যার সাথে পুরোন একটা সমস্যার তুলনা করে মিল খুঁজে বের করা। পুরনো সমস্যাটি অবশ্য এমন হওয়া চাই যার সমাধান ডমিনেন্ট ফাংশনের সাহায্যে হয়েছিল। মিল বের করার পরে এই দুই সমস্যার বেমিলগুলোও তাঁর চিহ্নিত করতে হবে, তারপর এই সমাধান পদ্ধতির কি পরিবর্তন আনলে এই বেমিলগুলো সামলিয়ে পদ্ধতিটি এই নতুন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে সেটা তাঁর বের করতে হবে।

তবে প্রশ্ন ওঠে, মিল-বেমিল গুলো বোঝবার প্রক্রিয়াটি কি? যে উদাহরণ দিলাম আগে সেটার ক্ষেত্রে এ কাজটা একেবারেই সহজ, কিন্তু অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে মিলই হোক, আর বেমিলই হোক, তা খুব গভীরে প্রথিত, কিছু ক্ষেত্রে তা ধরবার জন্য অনন্য সাধারণ দৃষ্টির প্রয়োজন। যেসব analyst ধরতে চান এই গভীর সম্পর্কগুলিকে, অর্থাৎ — উদ্ভাবক হতে চান, তাঁদের ইন্দ্রিয় ও কল্পনাশক্তির সাহায্য ছাড়াই যুক্তিক্রমের মৌলিক একতার খোঁজ পেতে হবে। কবিত্ব করে বলতে গেলে, উপলব্ধি করতে পারতে হবে গাণিতিক সমস্যাটির আত্মাকে।

এরমিত সাহেব কক্ষোনো ছবির ভাষায় কথা বলতেননা, কিন্তু তাঁর সাথে কথা বললে অচিরেই বোঝা যেত, বিমূর্ত গাণিতিক ধারণাগুলি তাঁর কাছে রীতিমত জীবন্ত। তাঁদেরকে তিনি দেখতে পেতেন না জ্যামিতিবিদদের মত, কিন্তু এই বোধ তাঁর ছিল যে এই ধারণাগুলি বিচ্ছিন্ন জগাখিচুড়ি নয়, অন্তর্গত ঐক্যের ভিত্তিতে গঠিত।

আপত্তি উঠতে পারে, ওটাও সেক্ষেত্রে একপ্রকারের অন্তর্জ্ঞান। তাহলে কি আমরা বলব যে শুরুতে যে পার্থক্যের কথা বলেছিলাম সেটা শুধুই বাহ্যিক, সব গণিতবিদই (অন্তত যাঁরা উদ্ভাবক) অন্তর্জ্ঞানবাদী, শেষ বিচারে?

না, ওই পার্থক্য একেবারে মিথ্যে নয়। আগেই বলেছি, অন্তর্জ্ঞান বহুরকমের হয়। বিশুদ্ধ সংখ্যার অন্তর্জ্ঞান, যে অন্তর্জ্ঞান গাণিতিক আরোহন পদ্ধতির উৎস, আর ইন্দ্রিয়জ অন্তর্জ্ঞান, যেখানে কল্পনাশক্তিরই রাজত্ব, এদুটোর মধ্যে যে বিরাট পার্থক্য, সেটিও আমি দেখিয়েছি।

এই পার্থক্য কি অলঙ্ঘনীয় সমুদ্র, নাকি মরীচিকা মাত্র? এমন কি হতে পারে যে বিশুদ্ধ অন্তর্জ্ঞানও এক পর্যায়ে ইন্দ্রিয়-নির্ভর? এই প্রশ্ন মনস্তত্ব ও অধিবিদ্যার অন্তর্গত, কাজেই এখানে এ প্রশ্নটা পরিহার করা হবে। কিন্তু প্রশ্নটা যে বেশ জটিল এটাই যথেষ্ট এ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য যে দু ধরনের অন্তর্জ্ঞানের পার্থক্য মৌলিক, তাদের লক্ষ্য এক নয়, মানব-মনের এক এলাকায় জন্ম নয় তাদের। দুই ভিন্ন, পরস্পর-অজানা জগতের ওপর যেন অবিরত আলো ফেলে চলে তারা।

বিশুদ্ধ সংখ্যা, বিশুদ্ধ যুক্তির অন্তর্জ্ঞানের আলোয় পথ চলেন যাঁদেরকে আমরা analyst বলেছি তাঁরা। এই আলোয় তাঁরা উদ্ভাবন করেন, শুধু প্রমাণ নয়। এরই সাহায্যে তাঁরা দেখতে পান যুক্তিক্রমের সার্বিক পরিকল্পনা, চিত্রকল্পের সাহায্য ছাড়াই। প্রায়শ-ভ্রান্ত কল্পনাশক্তির সাহায্য যেহেতু তাঁরা নেন না, কাজেই তাঁদের পথ চলা আত্ম-প্রতারণার সম্ভাবনামুক্ত। এই ক্ষমতা যাদের আছে, তাঁদের সম্মান না করে উপায় নেই। কিন্তু এঁরা বিরল, বড়ই বিরল।

তাই উদ্ভাবক অবশ্যই থাকবেন analyst দের মধ্যে, কিন্তু সংখ্যায় থাকবেন কম। আমাদের বেশিরভাগের পক্ষে বিশুদ্ধ অন্তর্জ্ঞানের সাহায্যে বহুদূর দেখবার চেষ্টা মাথা ঘোরার ব্যবস্থা ছাড়া কিছু করতে পারবেনা। আরেকটু শক্ত একটা লাঠির প্রয়োজন হবে আমাদের। এবং এই লাঠি যে অধিকাংশ গণিতবিদের ক্ষেত্রেই চিত্রকল্পের অন্তর্জ্ঞান, উল্লিখিত ব্যতিক্রম গুলো সত্বেও একথা সত্যি।

এই সব চিন্তা-ভাবনার প্রেক্ষিতে আরেকটা প্রশ্ন উঠে আসে যেটা নিয়ে আমি বেশি সময় ব্যয় করতে পারিনি, সমাধান তো দূরের কথা। প্রশ্নটা এরকম: গণিতবিদদের মধ্যে তৃতীয় আরেকটি শ্রেণীবিভাগের স্থান কি আছে, যার উদ্দেশ্য হবে analyst দের দুভাগে ভাগ করা, একভাগে বিশুদ্ধ অন্তর্জ্ঞানবাদীরা, আরেক দলে বিশুদ্ধ যুক্তিবাদীরা?

শার্লস এরমিত
এরমিত সাহেব, যাঁর কথা কয়েকবারই উল্লেখ করেছি, কোনমতেই জ্যামিতিবিদদের মধ্যে পড়েন না, কিন্তু আবার বিশুদ্ধ যুক্তিবাদীও ঠিক নন। স্রেফ অবরোহী পদ্ধতিগুলি, অর্থাৎ যেগুলি সাধারণ থেকে বিশেষে যায়, স্পষ্টতই তাঁর না-পছন্দ ছিল।

সমাপ্ত।