হায়াত

বাড়ীতে মানুষের হাঁট বসেছে যেন তবুও লাশটিকে ধরে বিলাপ করার মত একটা মানুষও খুঁজে পাওয়া গেল না। মজিদ এ বাড়ির গৃহস্থালির কাজ-কর্ম দেখাশুনা করে, এখন সে কবর খোড়ায় ব্যস্ত। হাপেজ মিয়ার পারিবারিক গোরস্থানের এক কোনে করবটি খোঁড়া হচ্ছে। রাজা লাশটিকে চাটাই দিয়ে ঢেকে রেখে বাঁশ কাটার ব্যবস্থা করছে। রাজা এ বাড়ির গরুর রাখাল। মা বড় সাধ করে নাম রেখেছিল রাজা। কোন দেশে একবার এক ফকিরের ছেলে নাকি রাজা হয়েছিল। বলা তো যায় না ! তাই রাজার মা আগে ভাগেই ছেলের জন্য এই যুৎসই নামখানা রেখে দিয়েছিল। রাজা এখন মিয়া বাড়ির গরুর রাখাল। এ-বাড়ির রাখাল হওয়ার স্বপ্ন আশে পাশের দশ গ্রামের রাখালরা আয়েশ করে দেখে। রাজা এখন রাখাল সমাজের রাজায় বটে। ‘‘ঝামেলা জুটার আর জায়গা পালু না। হ্যালায় মজিদের পুলা, মরা ভেসে যাচ্ছিলু যাক, তুলে আনার দরকার কি আছিল! আজ এ-বাড়ির এত বড় একখান আনন্দে দিন আর হ্যলায় কুত্ থেকি একটা মরা কুড়ি আনছে।’’- রাজা আপন মনে বকে চলেছে।


মিয়া বাড়ির বড় ছেলে হায়াত মিয়া আজ বিশ বছর পর বিলেত থেকে বাড়ি ফিরছে। বাড়িতে তাই বিশাল আয়োজন-গত বছর সেজো ছেলের বিয়েতেও এত বড় আয়োজন হয়নি। হাফেজ মিয়ার সাত ছেলে এবং ছয় মেয়ে। স্ত্রী তিনটা, তিনটাই জীবিত। তবে স্ত্রীদের মধ্যে তথাকথিত সতীনের সম্পর্ক নেই। তারও অবশ্য কারণ আছে- এরা সবাই খুবই গরিব ঘরের মেয়ে, আয়েশ করে দু মুঠো ভাত খেতে পাচ্ছে এই এদের জন্য উপচে পড়া। আবার স্বামীকে নিয়ে টানাটানি করার মতন বয়স গত হয়েছে অনেক আগেই। হায়াত মিয়া মেঝ বৌয়ের ছেলে। বড় সন্তান অবশ্য বড় বৌয়ের কোলেই এসেছিল-সেটি ছিল কন্যা সন্তান। প্রথম ছেলে সন্তান পেটে ধরার দেমাগ মেঝ বৌয়ের ভেতরে অনেকদিন রয়ে গিয়েছিল। বাড়ির বড় সন্তান হায়াত মিয়াকে হাফেজ মিয়া বড় স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ পাঠায় ডাক্তারি পড়ার জন্য। সেই থেকে হাফেজ মিয়া গ্রামের কারো অসুস্থতার খবর পেলে আগ বাড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘‘ধৈর্য্য ধরো হে, আমার ছেলে দেশে ফিরলি তুমার এই ব্যরাম বাপ বাপ করি পালাবে।’’ কারো ইহত্যাগের খবর শুনলে বলেন, ‘‘আহা রে বেচারি ! আর কটা দিন জানটাকে ধরি রাখতি পারলু না;- আমার হায়াত আসলি আযরাইলের ক্ষেমতাই হতু না…!’’ ছেলে বিদেশ গেলে অসুস্থ মাকে গঞ্জের ডাক্তারের কাছে নেওয়া বন্ধ করে দিল হাফেজ মিয়া। হায়াতের দাদি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে সবাই যখন খুব পিড়াপিড়ি করল ডাক্তারের কাছে নেওয়ার জন্য, হাফেজ মিয়া বললেন, ‘‘গঞ্জের ডাক্তার কি জানে শুনি? ঢাকা থেকি দু’কলম বিদ্যে নিলিই ডাক্তার হওয়া যায়? ডাক্তার হওন কি এতই সস্থা!’’ বুড়ি মারা গেলেন বিলাপ বকতে বকতে, ‘‘আমার হায়াতকে খবর দে…! হায়াত! আমার হায়াত!’’

বছর যেতে না যেতেই ছেলের জন্য মেয়ে দেখা শুরু করলেন হাফেজ মিয়া। আশে পাশের দশ গাঁয়ের কোনো মেয়েকেই তার মনে ধরল না। যদি বা একটা একটু পছন্দ হয়-‘‘আমার ছেলে বিলেত ফেরত ডাক্তার! এ বাড়ির পরিবেশটা তার জন্যি একেবারেই যুৎসই হবি না।’’ ছেলে হায়াত মিয়া সাদা চামড়ার এক মেয়েকে বিয়ে করে বিদেশেই রয়ে গেল। হাফেজ মিয়া এই দুঃখে জনসম্মুখে আসাই প্রায় বন্ধ করে দিল। মেঝবৌর দেমাগি ভাব কোথায় যেন উবে গেল। আশেপাশের মানুষেরা টিটকিরি মেরে বিলেতি গাই বাড়ি আনার কথা বললে হাফেজ মিয়া চটে গিয়ে বলেন, ‘‘ওদের মরা মুখও আমি দেখতে চাই না’’। ছোট বৌ তার ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর বায়না ধরলে চটি হাতে তেড়ে আসেন হাফেজ মিয়া-‘‘শালী, ছেলে হারানোর আল্লাদ জুড়ছে ! আমার নাক কি এতই লম্বা ?’’

ইতোমধ্যে বিশ বছর গত হয়েছে;-এ বাড়িতে কয়েকপাল সন্তান জন্ম নিয়েছে : কেউ বা হাফেজ মিয়ার বৌদের পেটে, কেউ বা ছেলের বৌদের পেটে, কেউ বা মেয়েদের পেটে। এরা সবাই বাড়ির মুরুবিবদের কাছ থেকে হায়াত মিয়ার গল্পই শুনে এসেছে এতদিন। হায়াত মিয়া এদের কারো ভাই, কারো মামা, কারো বা চাচা। তাই তার আগমনি বার্তায় এদের কারোরি আনন্দের কমনি নেই।

দীর্ঘ বিশ বছর পর বাড়ি ফিরছে হায়াত মিয়া। হাফেজ মিয়ার সেই রাগ গত হয়েছে কবে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাফেজ মিয়া বলতে থাকে, ‘‘ছোট বৌ, জন্যি ডিমের হালুয়া তৈয়ার করতি ভুলু না যেনে। আর সাদিক, খোঁজ নে ওরা হায়াতকে আনতি রওনা হলু কি না। মা আছিয়া, ঘর দুয়ার গোছ-গাছ করি রাখ। কেউ একজন মজিদরে বল, লাশটা মাটি দি পুকুরের সবথেকি মোটা মাছটা ধরতি।’’


কবর খোঁড়া শেষ। লাশটা চাটায়ের তলে পড়েই আছে। মজিদ মসজিদের ইমামের কাছে গিয়েছিল জানাজার জন্য। ইমাম বলেছিলেন, ‘‘বেওয়ারিশ লাশ, হিন্দু না মুসলিম কে জানে! আমি তার জানাজায় যেতি পারব না।’’ মজিদ বলেছিল, ‘‘হুজুর লাশের আবার হিন্দু আর মসুলমান কি? আর তাছাড়া হেই মসুলমান, আমি কাপড় উঠাইয়ে দেখছিলাম একবার।’’ হুজুর ক্ষেপে গিয়ে বলেছিল, জানাজার মানে বুঝিস?-আল্লার কাছে মূর্দার সাক্ষি দেওয়া। যার কিছুই আমি জানি না, তার সাক্ষি দেব কেমনে?’’ ‘‘ওই পাড়ার মমিন সম্পর্কে তো জানতেন, সে পাকা চোর আছিল, বৌ না পিটালি ভাত হজম হতু না। হের জানাজা তো ঠিকই পড়ালেন?’’ মজিদের এই কথায় হুজুর তেলে বেগুনে তেতে ওঠে,- ‘‘যতবড় মুখ নয় ততবড় কথা! মিয়া বাড়ির চাকর না হলি থাবড়ায়ে তোর দাঁত আমি খুলি দিতাম।’’

উপায়ান্তর না দেখে মজিদ আর রাজা লাশ কবরের কাছে নেয়ার ব্যবস্থা করল। আম্বিয়াও হাত লাগাল। আম্বিয়া এ বাড়ির অনেক পুরানো কাজের মানুষ। লাশটি অনেকক্ষণ পানিতে থাকাতে ফুলে ফেঁপে একাকার অবস্থা। মুখমন্ডলের মাংস মাছে খাবলে খুবলে বিশ্রি অবস্থা করে দিয়েছে-চেনবার কোনো জো নেই।

‘‘আহা রে ! মানুষটা বড় সাহেবের লাহান লম্বা চওড়া, কার বাড়ির ছেলে কে জানে? হের মা বাপ নিশ্চয় হের জন্যি অপেক্ষা করছি।’’ আম্বিয়ার কথা শুনে মজিদ তেড়ে ওঠে-‘‘ওতো কতা না বুলি শক্ত করি ধরো, বড় সাহেব চলি আসলি আর কারো রক্ষ্যি থাকবি না।’’ লাশটিকে টেনে হিঁচড়ে কবরে নামাই ওরা। তারপর ফটাফট মাটি চাপা দেয়।

বাড়িতে হৈ রৈ বাড়তেই থাকে। দেখে বোঝবার উপায় নেই, এ-বাড়ির গোরস্থানে এইমাত্র একটা লাশ দাফন করা হল। যারা গঞ্জে গিয়েছিল হায়াত মিয়াকে আনতে, সন্ধ্যা হয়ে এলো তাদের কোনো খোঁজ নেই। একজনকে বলতে শোনা গেল, ‘‘গেল রাতে নাকি লঞ্চডুবি হয়ছে, তাই বোধহয় বড়সাহেবের আসতে এতো দেরি হচ্ছে।’’