বিশ্বের সর্বপ্রথম এবং এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক পার্ক হিসেবে আমেরিকার ইয়েলোষ্টোন ন্যাশনাল পার্ক সুপরিচিত। ২০০৬ সালের জুলাই মাসে এই ইয়েলোষ্টোন পার্কে ৪ দিনের ভ্রমনে গিয়েছিলাম। সে ভ্রমন ছিল পরিনত বয়সে আমার এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সেরা ভ্রমন। সেই মুগ্ধতার কোন তূলনা নেই, ৪ বছরেও তার রেশ তেমন কমেনি, বরং বেড়েছেই বলা যায়। আবার কবে যেতে পারব সে আশায় দিন গুনি। তাই মনে হল আপনাদেরও এর কিছুটা স্বাদ দেই। যারা এখনো সেখানে যাননি তারা হয়ত কিছুটা আবেশ পাবেন। যদিও দুধের স্বাদ ঘোলে কোনদিনই মেটে না বলাই বাহুল্য।

প্রায় সাড়ে তিন হাজার বর্গমাইল বিশিষ্ট ইয়েলোষ্টোন পার্কটি আমেরিকার মিডওয়েষ্টে ওয়াইওমিং, মন্টানা, ও আইডাহো এই তিনটি রাজ্যের মাঝে পড়েছে। বেশীরভাগ অংশই পড়েছে আমেরিকার সবচেয়ে জনবিরল ওয়াইওমিং রাজ্যে। যারা বিদেশের এ জাতীয় প্রাকৃতিক পার্ক সম্পর্কে জানেন না তারা হয়ত পার্কের আকার দেখে বুঝতে পারছেন না যে পার্ক কিভাবে এত বড় হয়। বিদেশে এ জাতীয় প্রাকৃতিক পার্কগু্লি কোন দেওয়াল বা সীমানা ঘেরা থাকে না। আদতে এগুলি রমনা পার্ক বা সোরওয়ার্দী উদ্যান বলতে আমাদের চোখে যা ভেসে ওঠে মোটেও তেমন কিছু নয়। এই প্রাকৃতিক পার্কগুলিকে পার্ক না বলে সংরক্ষিত এলাকা বললে বোঝা যায় ভাল। বন, পাহাড়, হ্রদ ওয়ালা কিছু বিস্তীর্ন এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষনা করে এ জাতীয় প্রাকৃতিক পার্ক বানানো হয়। এ জাতীয় পার্কের ভেতর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশে যথা সম্ভব কম আলোড়ন তুলে ভ্রমনকারিদের জন্য নগর জীবনের বেশীরভাগ সুবিধে যেমন হোটেল, রেস্তোরা, এসব গড়ে তোলা যেতে পারে। আবার কিছু কিছু পার্কে শুধুমাত্র বনের মাঝে ক্যাম্পিং এর ব্যাবস্থা থাকে। এ ধরনের ব্যাবস্থায় সাধারনত পানি ছাড়া আর তেমন কোন নাগরিক সুবিধে থাকে না; মোটামুটি আদম হাওয়ার জীবন। বস্তার মত স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে চেইন টেনে ঘুমাতে হবে, রাতের বেলায় হয়ত ভালুকে এসে তাবুর পাশে ঘুরে বেড়াবে। ভাল মুডে থাকলে হয়ত তাবুর ভেতরেও উকি দেবে।

ইয়েলোষ্টোন পার্ক যে তিনটি রাজ্যে পড়ছে সেই তিনটি রাজ্যই বেশ জনবিরল। পার্কের একটি গেটের কাছাকাছি ওয়াইওমিং এর জ্যাকসন নামের একটি ছোট শহরে এয়ারপোর্ট থাকলেও বিমান ভাড়া বেশী পড়ে, কারন ছোট এয়ারপোর্ট বলে ফ্লাইট কম। তাই আমরা প্রথম কলোরাডোর ডেনভার শহরে নামি। এই ডেনভার শহরেই আমি আমেরিকায় প্রথম নামি, তাই আমার কাছে এর কদর একটু বেশী। তাছাড়াও সেখানে ছাত্র জীবনের এক ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল, সেও বহুদিন ধরে বলছিল যেতে। ডেনভার নিউইয়র্ক বা শিকাগোর মত মাল্টি মেগা সিটি না হলেও আকারে বেশ বড়, এবং পুরো শহরটাই পাহাড় এবং লেকের অপূর্ব বিন্যাসে ঘেরা। শুধু ডেনভার শহর আর এর আশে পাশের এলাকায়ই মনে হয় বেশ কদিন ঘোরা যায়। আমেরিকার মিড ওয়েষ্ট অঞ্চলটা বরাবরই আমার খুব প্রিয়। পূর্ব বা পশ্চীম উপকুলের জনারন্যের বাইরে এ অঞ্চলের প্রকৃতির অবারিত বিস্তার আমাকে সবসময়ই মুগ্ধ করে। লোকজনের মধ্যেও আন্তরিকতা অনেক বেশী মনে হয়। বন্ধুর উষ্ম আতিথিয়েতায় দুদিন ডেনভার এবং তার আশেপাশের নানান এলাকা দেখে অবশেষে গাড়ি ভাড়া নিয়ে রওনা দিলাম ইয়েলোষ্টোন পার্কের দিকে।

বলে রাখা ভাল যে ডেনভার শহর থেকে ইয়েলোষ্টন পার্ক প্রায় ৬০০ মাইলের কাছাকাছি। আমেরিকায় এই দুরত্ব এমন কিছু ব্যাপার না হলেও খুব কমও নয়। এই দীর্ঘ পথে বেছে নেবার আরেকটি কারন আমি আমেরিকায় যে শহরে প্রথম ছাত্রজীবন কাটাই সেই ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াইওমিং ও আমার প্রিয় ল্যারামী শহর এক নজর দেখা ও আমার স্ত্রীকে দেখানো। বিদেশে মনে হয় সবার মাঝেই এই বোধটা কম বেশী কাজ করে। নিজে প্রথম যে শহরে থাকে সেই শহরের প্রতি আলাদা মমত্বমোধ জন্মে। নইলে ২৬ হাজার লোকের একটা শহর ভাল লাগার তেমন কিছু নেই। আমার স্ত্রী আমার সেই অতি প্রিয় শহর যা তাকে দেখাতে এত লম্বা পথ ড্রাইভ করার সাহস করেছি দেখে চরমভাবে হতাশ, এবং আমার রুচি এবং লাইফ ষ্টাইল সম্পর্কে তার চিরন্তন চিন্তাধারার পূনরায় প্রকাশ ঘটালো যেগুলি যথেষ্ট আপত্তিকর ও ছাপার অযোগ্য। তাকে শহর দেখাই আর বলি এটা এই এটা সেই, সে আরো বিস্মিত হয়ে বলে এখানে কিভাবে এতদিন থাকলে? তবে ল্যারামি শহর থেকে আধা ঘন্টা দূরে ভিদাবু (আদিবাসী নাম) নামের একটা পাথুরে পাহাড়ের পার্ক দেখার পর সে কিছুটা খুশী হয়। এই পার্কের অনন্য বৈশিষ্ট্য হল এর পাহাড় বিশাল বিশাল বেশ কিছু পাথর খন্ডের উপর তৈরী। তাতে তেমন অবাক হবার কিছু নেই। তবে সেই দানবীয় খন্ডগুলি একটা আর একটার উপর যেভাবে হাজার হাজার বছর ধরে বসে আছে তাতে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। কোন কোন পাথর একটা আর একটার হয়ত মাত্র আধ হাত যায়গা জুড়ে মাত্র লেগে আছে, বাকি অংশ শূন্যের উপর। পাহাড়গুলির চূড়ায় তাকালেই মনে হয় এই বুঝি ওয়েষ্টার্ন ছবির মত এক এক করে রণসাজে সজ্জিত আদিবাসী ইন্ডিয়ান দেখা দেবে।

আমার প্রিয় ল্যারামির কিছু পুরনো স্মৃতি চারনার পর দুপুর বেলা আবার রওনা হলাম। এবার আসল লক্ষ্য, ইয়েলোষ্টোন পার্ক, যেতে হবে উত্তর-পশ্চীমে। ল্যারামি থেকে ৩০ মাইল দূরে অবস্থিত স্নোয়ি রেঞ্জ নামের আরেকটা পার্কের ভেতর দিয়ে যাব, তাতে কিছুটা সময় বাড়বে। ল্যারামি থেকে স্নোয়ি রেঞ্জ যাবার হাইওয়ে ১৩০ পথটা আমেরিকার ন্যাশনাল সিনিক ওয়ে এর অন্তর্ভুক্ত। এই রাস্তার প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার লোভ সামলানো খুব কঠিন। পুরো পথটা ধীরে ধীরে পাহাড়ের উপর উঠতে থাকে, দুদিকে বিস্তীর্ন পান্ডব বিবর্জিত তৃণভূমি। পাহাড়ের চূড়ায় বারো মাসই বরফ থাকে। আশেপাশে তাকালে মনে হয় খালি চোখেই ৫০ মাইল দেখা যায়। মাঝে মাঝে হ্রদ এবং বনভূমি। সেই সৌন্দর্য বর্ননা করার মত উপযুক্ত ভাষা আমার নেই, বিভূতিভূষন হয়ত পারতেন। পাহাড়ের চূড়ায় সেন্টিনেল নামের ১০ বর্গমাইলের একটা ছোট শহর, যার জনসংখ্যা ১৯০। ১৯০ জনসংখ্যা শুনে অবাক হবেন না, পথে আরেকটি শহর ছিল যার জনসংখ্যা ৪। শহর বলতে দুয়েকটি বাড়ি, আর একটি গ্যাস ষ্টেশন; গ্যাস ষ্টেশনের মালিকই হলেন শহরের মহামান্য মেয়র বা নগর পিতা। ওয়াইমিং রাজ্যে ৫০/১০০ জনের শহর অনেক আছে। আমার ছাত্রাবস্থায় এসব ছোট শহরের ছেলেমেয়েদের অনেককেই ২৬ হাজার লোকের ল্যারামি শহরের “নাগরিক জীবনের বিড়ম্বনায়” বিরক্ত হতে দেখেছি। এত বড় শহর তাদের ভাল লাগে না। যদিও এ শহরে দরজা খোলা রেখেও রাতে ঘুমাতে পারেন, দিনে ক্লাসেও চলে যেতে পারেন, রাস্তায় হাটতে দেখলে গাড়ি দাঁড়িয়ে যাবে।

স্নোয়ি রেঞ্জ থেকে বের হয়ে ইয়েলোষ্টোন যাবার মূল পথ আই-৮০ তে উঠলাম। দ্রুত সবুজ গায়েব হয়ে যেতে শুরু করল, পথ হয়ে উঠতে লাগল কিছুটা বোরিং। শুধু মাঝে মাঝে হরিনের পাল আর অন্য কিছু বন্যপ্রানী ছাড়া তেমন কিছুই দেখার নেই। বেশ কয়েক পাল বুনো ঘোড়া দেখলাম। আমার স্ত্রীর ধারনা ছিল বুনো ঘোড়া মানেই দিবারাত্র অহঃনিশি দৌড়ের উপর থাকবে। দূঃখজনকভাবে কার্যত কোন ঘোড়ার পালকেই সেরকম ব্যাতিব্যাস্ত দেখা গেল না। সবকটা এক যায়গায় ঘাড় নীচু করে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে, দেখলে কেমন যেন বেকুব বেকুব লাগে, যদিও ঘোড়া খুবই বুদ্ধিমান প্রানী। এভাবে ক’ঘণ্টা একঘেয়ে পথ চলার পর রাত নামল।

রাতটা রক স্প্রীং নামের আরেকটি ছোট শহরের একটি মোটেলে কাটিয়ে দিয়ে সকাল বেলা আবার যাত্রা শুরু। এ শহরে রাতে খাবার জন্য একটা চীনে দোকানে ঢোকার পর একজন আমেরিকান আমাদের দিকে কিছুক্ষন কৌতূহলের চোখে তাকানোর পর এক পর্যায়ে ভদ্রভাবে অনুমতি নিয়ে আমাদের টেবিলে কিছুক্ষন বসলেন। যথারীতি আমেরিকান কায়দায় কিছু সৌজন্য মূলক কথাবার্তার পর তার আগ্রহের কারন ভেঙ্গে বললেন। আমাদের দেখে তার ধারনা হয়েছিল যে আমরা ভারতীয়। তার দাদী ছিলেন একজন পাঞ্জাবী ভারতীয় মহিলা। যদিও তিনি কখনো ভারত যানি, দাদীকেও কখনো দেখেননি, তবে ভারতীয় দেখলে আগ্রহ বোধ করেন। তিনি অবশ্য পাঞ্জাব উচ্চারন করতে পারেন না, বলেন পুঞ্জাব। ভদ্রলোক মার্কিন নৌবাহিনীতে বেশ কিছুদিন ছিলেন। আমাকেও, মনে হয় আমার লম্বা চওড়া দেহ দেখেই নৌবাহিনী বা সেনাবাহিনীতে ঢোকার সুপরামর্শ দিলেন। সেখানের চাকরির কি কি সুবিধা, রিটায়ার করলেও কত সুবিধে এসব বোঝালেন। আমিও বেশী ঝামেলা না করে একমত হলাম। এ কথা সেকথার পর তিনি তার টেবিলে চলে গেলেন। এখন তার নিয়মিত কিডনী ডায়ালাইসিস করতে হয়। যদিও খাবার সময় আড়চোখে তার প্লেট দেখে তেমন কোন আলামত চোখে পড়েনি। যে হারে তিনি চিংড়ী ভাজা সাঁটাচ্ছিলেন তাতে তার কোন গুরুতর রোগ আছে বিশ্বেস করা বেশ শক্ত।

ওয়াইওমিং অত্যন্ত জনবিরল আগেই বলেছি। রাজ্যে আধুনিক শিল্প কারখানা বলতে আক্ষরিক অর্থেই কিছু নেই। আমাদের ইউনিভার্সিটির ৭ তলা ছাত্রাবাস হল রাজ্যের সবচেয়ে উঁচূ বিল্ডিং। মাইলকে মাইল ধুধু আধা মরুময় তৃণভূমি, মাঝে মাঝে দুয়েকটা র‌্যাঞ্চ, সেখানে গরু, ছাগল, ঘোড়া পালন করা হয়। ছোট ছোট শহরগুলিতে ঢুকলে হঠাৎ মনে হয় ওয়াইল্ড ওয়েষ্টের যুগে চলে এসেছি। বাড়িঘর, দোকান পাট বেশীরভাগই পুরনো আমলের কাঠের লগ কেবিন ষ্টাইলের, পুরো পরিবেশের মাঝেই পুরনো দিনের প্রচ্ছন্ন ছাপ পাওয়া যায়। পুরনো দিনের ওয়েষ্টার্ন ছবিতে যেমন ব্যাট উইং ডোর ওয়ালা সেলুন, সেই ব্যাট উইং ওয়ালা দোকান পাটও আছে। লোকজনের বেশ ভূষাও অনেকটা তেমন; টাইট জীন্স, হাঁটু পর্যন্ত উঁচু বুট, মাথায় হ্যাট, ঘন ঝোলা দাঁড়ি গোফ। শুধু ঘোড়ার পিঠে না চড়ে চালাছে গাড়ি। স্থানীয় অধিবাসীরা তাদের ট্র্যাডিশন ও প্রকৃতি ধরে রাখার পক্ষে এখন পর্যন্ত খুবই কট্টর, তাই অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে তেমন জোর দেয় না। বড় কোম্পানীগুলি তাই এ রাজ্যে এখনো ঢুকতে পারেনি।

ইয়েলোষ্টোন পার্কে ঢোকার মোট ৪টি গেট আছে। আমরা দক্ষিনের দিক থেকে ইয়েলোষ্টোনে যাই। পার্কের দক্ষিন গেট ঘেষে জ্যাকসন নামের একটি ছোট শহর আছে। অপূর্ব সুন্দর একটি ট্যূরিষ্ট শহর। এ শহরের এক প্রান্তে একটা বিশাল মাঠ আছে। এই মাঠে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে হরিনের দল এসে তাদের মাথার শিং ফেলে যায়। সে সময় পুরো মাঠময় শুধু হাজারে হাজারে শিং দেখা যায়, সে নাকি এক আজব দৃশ্য। শহরের ভেতর একটি গেট বানানো আছে হরিনদের ফেলে যাওয়া এসব শিং দিয়ে। আমেরিকার সব পার্কের প্রবেশ মুখেই একটি করে বিনে পয়সার নয়নাভিরাম ভিজিটর সেন্টার থাকে। এসব যায়গায় পার্ক সম্বন্ধীয় যাবতীয় তথ্যাবলী তথ্যাবলী চমতকারভাবে দেওয়া থাকে। জ্যাকসন শহরের এই সেন্টারটি আরো কয়েক কাঠি বাড়া। এখানে ইয়েলোষ্টোন পার্কের ইতিহাস, ভূপ্রকৃতি, আদিবাসীদের ঐতিহ্য, প্রায় সব প্রানীদের লাইভ সাইজের ষ্টাফিং কৃত্রিম জংগল সৃষ্টি করে রাখা আছে। এই সেন্টারটাই শুধু সারাদিন ঘোরা যায়।

আগেই বলেছি এসব পার্ক কোন দেওয়াল বা বেড়া ঘেরা নয়। তবে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে প্রবেশমূল্য নেওয়া হয়, তারজন্যই গেটের ব্যাবস্থা। আমাদের পার্কের ভেতরে থাকার রিজার্ভেশন ছিল, তাই প্রবেশমূল্য লাগল না। পার্কের ম্যাপ ধরিয়ে কিছু গতবাধা কথাবার্তা শুনিয়ে দিল। শুরু হল জংগলের ভেতর দিয়ে পথ চলা। তবে ভরা ট্যুরিষ্ট মওসুম হওয়ায় গাড়ির ভীড় যথেষ্ট। এর মাঝেই রাস্তায় বেধে গেল বিরাট জাম। কারন সামনে দূর্ঘটনা ঘটেছে। এই কারনে বেশ কিছুক্ষন দেরী হল। অবশেষে বিকেলের দিকে পৌছালাম আমাদের প্রথম রাত কাটাবার স্থান লেক ইয়েলোষ্টোন সাইটে।

ইয়েলোষ্টোন পার্কের ভেতর দর্শনার্থীদের সুবিধের জন্য ছোট ছোট ৪ টি কেন্দ্র তৈরী করা হয়েছে যেগুলিতে আধুনিক কায়দায় থাকা খাওয়া, বাজার, গাড়ির ওয়ার্কশপ সবই আছে। এ ছাড়াও পুরো পার্ক জুড়েই জংগলের ভেতর অসংখ্য ক্যাম্প সাইট আছে। পুরো পার্ক অনেক বড় হওয়াতে ভাল বুদ্ধি হল একাধিক যায়গায় রাত কাটানো। আমরা প্রথম দুরাত রাত কাটাই লেক ইয়েলষ্টোনের ধারের একটি কেবিনে। এই কেন্দ্রটিতে বেশ কয়েকটি কেবিন এবং ৩০০ রুমের অত্যাধুনিক একটি হোটেলও রয়েছে। পান্ডব বিবর্জিত ঘোর জংগলের মাঝে এই এলাহি কারবার দেখলে অবাকই হতে হয়। এই পুরো এলাকাটি লেক ইয়েলোষ্টোন নামের বিশাল এক নীল পানির হ্রদের পাড়ে, বহুদুরে অপর পাড় দেখা যায়, তাতে সুউচ্চ পর্বত শ্রেনী। লেকের ধারেই অদ্ভূত নির্জনতার মাঝে একটি চমতকার সন্ধ্যা কাটিয়ে দিলাম।

পরদিন শুরু হল আসল পার্ক সফর। ইয়েলোষ্টোন পার্ক আসলে এত বিশাল আর দেখার এত কিছু আছে (অবশ্যই ব্যাক্তিগত পছন্দ অপছনের ব্যাপার আছে) যে অনায়াসে আমরা ৪ মাস কাটিয়ে দিতে পারি। পার্ক ঘোরার পদ্ধুতি খুবই সহজ। গেট থেকেই পুরো পার্কের ম্যাপ দিয়ে দেয়। সেই ম্যাপ ভেতরেও বহু যায়গায় থাকে। ম্যাপের ভেতরেই অত্যন্ত সহজবোধ্য ভাবে দেখানো থাকে কোন কোন যায়গায় কি কি আছে, কিভাবে যেতে হয়। যেমন, পার্কে বনের ভেতর অসংখ্য পায়ে হাঁটার হাইকিং ট্রেইল আছে। ম্যাপে দেখানো থাকে সেসব ট্রেইলের অবস্থান এবং তার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য, গাড়ি পার্ক করার যায়গা, কোন যায়গায় রেষ্টুরেন্ট আছে এর সবকিছুই। কোন যায়গায় কি কি আকর্ষনীয় বিষয় আছে সব মার্ক করা থাকে। এখন আপনার কাজ কেবল আপনার পছন্দ অনুযায়ী যায়গা নির্বাচন করে সারাদিনের প্ল্যান ঠিক করে বেরিয়ে পড়া। ইয়েলোষ্টোনের বনভূমির গাছগুলি বেশীরভাগই শীত প্রধান দেশের কনিফার জাতীয় যা বারো মাসই সবুজ থাকে, সাথে আছে বিস্তীর্ন তৃনভূমি আর অসংখ্য ছোট বড় হ্রদ। বনের ভেতর প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবজন্তু পাখি দেখা প্রধান আকর্ষন, তবে এ ছাড়াও প্রকৃতি ও নির্জনতারও তূলনা মেলা ভার। আর আছে বেশ কিছু ইন্টারেষ্টিং জিওলোজিক্যাল ফিচার ও আকর্ষন যা পরে বলব।

ইয়েলোষ্টোন পার্কের অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে অবাধে বিচরন করা বন্যপ্রানী দর্শন হল একটি অন্যতম প্রধান আকর্ষন। হরিন ও বাইসনের পাল দেখা যায় অহরহ, কোন রকমের অপেক্ষা ছাড়াই। তবে ভালুক, নেকড়ে, বীভার, কয়োট এদের দেখাটা কিছুটা ভাগ্যের উপর নির্ভর করে। রাস্তার ধারের নির্দিষ্ট পার্কিং ছাড়া অন্য কোথাও হঠাত গাড়ির জটলা দেখলে বুঝে নিতে হবে যে দ্বিতীয় গ্রুপের কোন প্রানী দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় বাকিরাও দ্রুত গাড়ি কোনমতে রেখে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

আমরা সকালে রাস্তায় নামার মিনিট খানেকের মাঝেই একটা ঝোপের আড়ালে দেখি বিরাট এক বাইসন। তখনো জানি না যে এই বাইসনের পাল এখানে আমাদের দেশের কাকের মতই সহজলভ্য। তাই নগর জীবনে অভ্যস্ত আমি ক্যামেরা নিয়ে আধা উন্মাদের মত দৌড় দিলাম, পাছে এই অনন্য সুযোগ আবার না হাতছাড়া হয়ে যায়! আপনারা যারা সেবা প্রকাশনীর ওয়েষ্টার্নের ভক্ত বা আগে পড়তেন তারা হয়ত এই প্রানীর কথা অনেক পড়েছেন। বাইসন প্রানীটা হল অনেকটা আমাদের দেশের মহিষের মত, এরা আমেরিকান বাফেলো নামেও পরিচিত। আরেকটু বড় হবে মনে হয় সাইজে। প্রচন্ড শক্তিশালী, তবে খুবই নিরীহ। এককালে এরা সারা আমেরিকাময়ই গিজ গিজ করত। আজকের দিনে স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যায় কমে গেছে। তবে এখনো বহাল তবিয়তেই অনেক আছে।

গাড়ি আবার রাস্তায় তুলতেই বিরল বাইসন দর্শনের অপার আনন্দ নিমেষেই উবে গিয়ে বুক শুকিয়ে গেল। কারন এবার দেখি পুরো এক পাল বাইসন রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি পানে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তাদের চেহারা সূরত দেখে মোটেও বন্ধুসূলভ মনে তো হয়ই না, উল্টাটাই মনে হয়। আগে যেটাকে দেখেছিলাম সে এই পালেরই অন্তর্ভুক্ত। তাকেও দেখি জাবর কাটতে কাটতে গদাই লষ্করি চালে ঢাল বেয়ে নেমে আসছে। আমার মাথায় তখন হিসেব খেলা করছে ভাড়ার গাড়ি ভাংচুর হলে কি গতি হবে। গাড়ির ভেতর আমাদের কি হবে সেই চিন্তা কেন যেন আসেনি। ধরেই নিয়েছি যে এই পাল নিশ্চিত গাড়িতে চড়াও হবে। গাড়ি বাঁয়ে ঘুরিয়ে পাল এড়ানোর চেষ্টা করলাম। তাতে ফল হল যে বাইসনেররা ভয় পেয়ে রাস্তা ছেড়ে বনের মাঝে ঢুকে গেল। সাধারন নিয়ম আসলে বন্যপ্রানী রাস্তায় দেখলে গাড়ি থামিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করা। বন্যপ্রানীর সাথে বাড়ি লেগে প্রতি বছরই অনেক দূর্ঘটনা ঘটে থাকে।

নদীর ধার ধরে ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছি আর প্রকৃতির শোভা উপভোগ করছি। এই ইয়েলোষ্টোন নদী আমাদের পদ্মা মেঘনার তূলনায় নস্যি হলেও যথেষ্ট চওড়া, দক্ষিন দিকে লেক ইয়েলোষ্টনে পড়েছে। দুধারেই ঘন বন। চলতে চলতেই দেখি রাস্তার এক পাশে বড় ধরনের জটলা। নদী এখানে রাস্তা থেকে অনেকটাই নীচে, ঘন ঝোপের জন্য পুরো দেখা যায় না। বুঝলাম যে নদীতে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি গাড়ি রাস্তার ধারে থামিয়ে দুজনে দৌড় দিলাম। ঘটনাস্থলে পৌছে দেখলাম অভাবনীয় দৃশ্য। নদীর প্রায় মাঝ বরাবর একটি হরিনের মৃতদেহ। দেখেই বোঝা যায় বেশ কদিনের পুরনো। সেটা লক্ষ্য করে একটি ভালুক নদীর মাঝ বরাবর ধীরে ধীরে হেটে এগুচ্ছে। তারা হাঁটার ভংগীতে বেশ বৈচিত্র আছে। সাধারনত চার পায়েই হাঁটে, তবে মাঝে মাঝে দুপায়ে দাঁড়িয়ে আশে পাশে তাকিয়ে দেখে। আশে পাশের বিশেষজ্ঞদের কথায় বুঝলাম যে এটা সাধারন কালো ভালুক নয়, গ্রিজলী ভালুক।

নদীর অপর পাড়ে বনের ভেতর আরেকটি কয়োটকেও দেখা যাচ্ছে অসীম ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে। এদের বলা যায় চান্স মোহাম্মদ। এরা নেকড়ে জাতীয় প্রানী হলেও আকারে অনেক ছোট, কিছুটা শেয়াল এবং আমাদের দেশীয় কুকুরের মাঝামাঝি। এরা তালে থাকে ভালুক বা নেকড়ে যখন শিকার ধরে খায় তার ছিটে ফোটা বা উচ্ছিষ্ট কপালে জোটে কিনা এই অপেক্ষায়। তবে বাগে পেলে এরাও হরিন শাবক বা ছোট প্রানীর উপর হামলা করে ভক্ষন করে। দর্শকরা পার্কের নিয়ম নীতি মেনে প্রায় সবাই নীরব ছিলেন। তারপরেও ক্যামেরার সামান্য শব্দ হচ্ছিল। তাই মনে হয় ভালুক বাবাজীর জন্য যথেষ্ট। উনি তাতে যথেষ্ট বিরক্তি বোধ করলেন, এমনকি লোভনীয় কদিনের পঁচা হরিনের মাংসের মায়া ত্যাগ করে ধীরে ধীরে গদাই লষ্করি চালে বনের ভেতর ঢুকে গেলেন।

ভালুক আর সব হিংস্র বন্যপ্রানীর মতই মানব সংসর্গ একেবারেই পছন্দ করে না। এদের ঘ্রান শক্তি অকল্পনীয়। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় দেখা গেছে যে পুলিশের বিশেষ ট্রেনিং পাওয়া গন্ধ শোকার কুকুর থেকে ভালুকের ঘ্রানশক্তি ২৫ গুন পর্যন্ত বেশী হতে পারে। মানুষ এড়িয়ে চললেও প্রতি বছরই পার্কে দু একটি দূর্ঘটনা ঘটে যায়। নির্জন ট্রেইলে ভালুকের সাথে অপ্রত্যাশিত মোলাকাতে প্রানহানীর ঘটনাও মাঝে মাঝে ঘটে। পার্কে এ ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতামূলক বেশ কিছু নির্দেশনা আছে। যেসব অঞ্চল ভালুকের বিশেষ প্রিয় সেসব যায়গার ট্রেইলে হাইক করার সময় অনবরত কথা বলা বা কিছুর আওয়াজ করা সাধারন নিয়ম। ভালুক শব্দে বিরক্ত হয়ে দূরে চলে যায়। আমরা বনের মাঝে বেশ কিছু ট্রেইলে হাঁটার সময় গাছের গুড়িতে ভালুকের থাবার তাজা আঁচড়ের দাগ দেখেছি। পার্কের সাধারন নিয়ম কানুনের মাঝে ভালুক আক্রমন করলে কি করতে হয় তার নিয়মও জানানো হয়। নিয়ম অনেকটা সেই ছেলেবেলায় শোনা “ভল্লুক তোমার কানে কানে কি বলিল” গল্পের মত। নিজেকে বলের মত বানিয়ে মরার ভান ধরে মটকা মেরে পড়ে থাকা আর কি। ভালুক দর্শনের সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য অবশ্য এ যাত্রা পার্কে আর হয়নি।

এবার জীব জানোয়ারের জগত থেকে একটু প্রকৃতির দিকে নজর ফেরাই। পার্কের বৈচিত্রময় প্রকৃতি হতে পারে যেকোন প্রকৃতি প্রেমিকের বহুদিন উপভোগ করার মত খোরাক। হীরক রাজার ষ্টাইলেই বলতে হয় সাপ ব্যাং শকুনের ঠ্যাং কি নাই সেখানে? অবারিত সবুজ তৃণভূমি, ছোট বড় লেক, বিস্তীর্ন বনাঞ্চল, সুউচ্চ পর্বতমালা, বেশ কটি নয়নাভিরাম জলপ্রপাত, প্রকৃতির বিস্ময় বেশ কিছু বিরল জিওলজিক্যাল বৈশিষ্ট্য…সব লিখতে গেলে আক্ষরিক অর্থেই মহাভারত রচনা করতে হবে। ভালুক দর্শনের পর দুপুরের লাঞ্চের পর রওনা দিলাম গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন অফ ইয়েলোষ্টোন দেখতে। এটা এরিজোনার বিশ্বখ্যাত গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মত অতটা গভীর না হলেও আমেজটা পাওয়া যায়। দিগন্ত বিস্তৃত দুই উঁচু লালচে পাথুরে পাহাড়ের মাঝে গভীর খাদ, বহু নীচে রুপালী ফিতের মত বয়ে চলা খরস্রোতা নদী। খাদের সর্বোচ্চ গভীরতা ১২০০ ফুট, কিছু কিছু যায়গায় ৪০০০ ফুট চওড়া। গাড়ি পার্ক করার যায়গা থেকে পাহাড়ের কিনারা ঘেষে কিছুটা গেলে দর্শকদের জন্য ভিউ পয়েন্ট আছে যেখান থেকে এর বিস্তৃতি সময় নিয়ে উপভোগ করা যায়। এখান থেকেই দেখা যায় আপার ফলস এবং লোয়ার ফলস নামের দুই জলপ্রপাত। পাহাড়ি চিকন আঁকা বাঁকা পথ ধরে জলপ্রপাতের একেবারে কাছেও চলে যাওয়া যায়। সেও এক দারুন অভিজ্ঞতা।

[প্রথম পর্ব সমাপ্ত]

পার্কের অফিশিয়াল ওয়েব সাইট