মৃত্যু মৃত্যু খেলা
ও একটি গল্প


একটা গল্প বলো তো। সুন্দর সাজানো গোছানো একটা গল্প, যে গল্প শুনে সকলে জীবনকে স্বীকার করবে অকপটে।
নাজমার এই আবেদনে অপারগতা প্রকাশ করে আসিফ।
‘‘না নাজমা, আমি পারবো না। যেখানে মানুষ মরছে অকাতরে, অকারণে ছুটছে সবাই, বৃষ্টির মত গলে পড়ছে সম্পর্ক, সেখানে আর যাই হোক সুন্দর কোন গল্প বলা যায় না।’’
নাজমা আসিফের কথার অনেকটাই বোঝে না তবুও ভালো লাগে আসিফকে। আসিফের চোখ দিয়ে সে দেখে নেয় তার অন্ধকার জগতের চারপাশ। নাজমা হুইল চেয়ারের চাকা কয়েক পা গড়িয়ে ছাদের কিনারে এসে থেমে যায়।
‘‘থামলে কেন? আরো কয়েক পাক খেলেই পারতে !’’
‘‘হু, সোজা নিচে, তারপর ধপাশ্!’’
‘‘তারপর মুক্তি! এই পাক খাওয়ার জীবন থেকে চিরন্তন মুক্তি।’’
আসিফের কথায় মুচকি হাসে নাজমা, এতেই গালে টোল পড়ে যায় খানিকটা।
‘‘হু, বলেছে তোমাকে? এইভাবে মুক্তি নেয়াকে বলা হয় আত্মহত্যা আর আত্মহত্যা যারা করে তাদের কথনোই মুক্তি মেলে না কারণ আত্মহত্যা হচ্ছে মহাপাপ!’’
‘‘মহাপাপ!’’ হো হো করে হেসে ওঠে আসিফ। যান্ত্রিক হাসি। এই হাসিতে কোন স্বাদ খুঁজে পায় না নাজমা। ‘‘নাজমা, এই পৃথিবীর বিভৎস রূপ তুমি দেখোনি, আমি দেখেছি – কত শত অন্যায় অবিচার ঘটে চলেছে এই পৃথিবীর বুকে। তোমার সৃষ্টিকর্তা বোধহয় তোমার মতই চারদেয়ালে বন্দি করে রেখেছে নিজেকে আর স্বপ্ন দেখছে : দলে পৃথিবীর সব জীব তাঁকে কুর্নিশ করছে, না খেতে পাওয়া শরীর, বিকৃত দেহ-সব গেছে তাঁকে সাধুবাদ জানাতে। দেখবে নাজমা, একদিন সত্য প্রকাশ পাবেই, কঠিন সে সত্য। আমার মত অনেকেই এখন সেই পথের সন্ধান করছে। ঐ পথ ধরে আবিষ্কার করা হবে সৃষ্টিকর্তার আসল রূপ, বন্ধ হবে এই মৃত্যু মৃত্যু খেলা।’’
‘‘আমি জানি, তুমি মৃত্যু দেখেছো খুব কাছে থেকে; আমি হয়ত দেখিনি তবে অনুভব করেছি – আমার অন্ধকার চোখ দিয়ে অন্ধকার মৃত্যুকে : চারিদিকে প্রচন্ড অন্ধকার, নিজের নিঃশ্বাসের শব্দে নিজেই আৎকে উঠি। শত হাতড়েও হাতে পাই না হুইল চেয়ারের ডানা। আসিফ! আসিফ!’’

এমনি করে আসিফ নাজমার জগতে এই আসে এই যায়। নাজমা আসিফের চোখ দিয়ে প্রাচীরের ওপারের জগতকে দেখে নেয়। জেনে নেয়, বাইরের জগতের প্রাণীদের সম্পর্কে, যাদের নাজমার মতই দুটো হাত, দুটো পা, দুটো চোখ আছে। যারা আকাশের নীল নিয়ে কাড়াকাড়ি করে, সমুদ্রে এঁকে দেয় সীমানা, প্রতিনিয়ত ছুটতে থাকে অস্ত্র হাতে অস্ত্র কাড়তে। নাজমা পারে না ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে সভ্যতা গড়তে ফলে পার্থক্য থেকে যায়নাজমা বিশ্বাস ভাঙতে পারেনা বলেই স্বপ্ন গড়তে পারে। সাদা সাদা বরফের দেশের স্বপ্ন। হাতের উপর হাত হেঁটে যায় সেখানে। খুবই সহজ আর সরল সবকিছু। অন্যদিকে স্বপ্ন দেখতে না পেরে ডানা ঝাপটায় আসিফ। পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত চুষে বেড়ায় সে। নদীর তটে, বটের তলে বসে থাকে অকারণ। যুদ্ধময়দানের মত সেখানেও খাঁ খাঁ করে তার ভেতর। ফিরে আসে নাজমার কাছে, নাজমার হুইল চেয়ার স্পর্শ করে ছুঁতে চেষ্টা করে তার অনুভূতিকে।


‘‘দরজা খোলো-’’
‘‘বাইরের দিকে টান দাও-’’
‘‘খুলছে না তো-’’
‘‘তাহলে দেয়াল টপকে এসো-’’
‘‘চা খাবে-’’
‘‘না-’’
‘‘এত অস্থির হচ্ছ কেনো-’’
‘‘নাজমা, তুমি এ চারদেয়ালকে যত সহজে মেনে নিতে পারো আমি তত সহজে পারি না। প্রতিনিয়ত ধর্মের নামে ঘটে যাচ্ছে অসংখ্য অনিয়ম। সৃষ্টিকর্তার নাম দিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে বৈশম্য। একদিকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে র্যািপিং করা হচ্ছে নষ্ট সভ্যতাকে অন্যদিকে এক টুকরো রুটি নিয়ে কাড়াকাড়ি। একদিকে মধ্যরাতে মদ্য পান করে সাকসেসকে উপভোগ করছে মানবতারক্ষী কর্মীরা অন্যদিকে একমুঠো ভাতের জন্য ভালোবাসা বিক্রি করছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। আমি দেখেছি, শিশু আর বৃদ্ধদের মতন যুবকরাও কতটা অসহায়! না নাজমা না, এভাবে চলতে দেওয়া যায় না।’’
আসিফের সাথে পাল্লা দিয়ে বলতে পারে না নাজমানিজের উপর প্রচন্ড রাগ হয় তার।
‘‘কি করবো আমরা? সৃষ্টিকর্তাকে কাচকলা দেখিয়ে ঝাপ দেবো ছাদ থেকে?’’
‘‘তাহলে সবথেকে বেশি মজাটাই পাবেন সৃষ্টিকর্তা। বরং চলো মেরে ফেলি ওদেরকে যারা সৃষ্টিকর্তার দুয়ারে মাথা ঠুকে চলেছে প্রতিনিয়ত। ওরা মরলে সৃষ্টিকর্তার নাম ভাঙানো বন্ধ হবে। বন্ধ হবে নিগৃহিতদের নিগ্রহন।’’
নাজমা বোঝে না এসব মৃত্যু মৃত্যু খেলা। তার কল্পনার মানচিত্রে শুধুই বাঁচতে শেখা।
‘‘বিকল্প কোনো পথ কি খুঁজে পাওয়া যায় না আসিফ?’’
‘‘নাজমা, তুমি দেখোনি, আমি দেখেছি, চারিদিকে মৃত্যু আর মৃত্যু। বিভৎস, কুৎসিত মৃত্যুহাজারো রকমের মৃত্যু। মৃত্যুর মধ্য দিয়েই শেষ হবে এই মৃত্যু মৃত্যু খেলার, তুমি দেখে নিও।’’
‘‘কিন্তু আমার স্বপ্ন! আমার স্বপ্নেরও কি মৃত্যু হবে আসিফ? সাদা বরফের তৈরী মানুষ চারপাশে, জানতে চায় পথ ভুলে গেছি কি না। কোন অসহায় নেই, নেই কোন দরিদ্র। খুন, ধর্ষণ, মিটিং, মিছিল, ক্ষমতা এসব শব্দের কোন স্থান নেই ওদের অভিধানে। জানো, ওরা না আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসেওদেরও কি মৃত্যু চাও আসিফ? আসিফ! আসিফ!’’


‘‘জানো নাজমা আজ না…!’’
‘‘কি হল থামলে কেন? কোনো পরিবারের সকলকে খুন করা হয়েছে নিশ্চয়? নাকি তোমাদের মিছিলে বৃষ্টির মত গুলি বর্ষণ করা হয়েছে?
‘‘এ-গুলো তো দৈনিক কাগজগুলোর বিষয়। আজ সকালে এক ভ্যানে আমরা চারজন মেডিক্যালের দিকে যাচ্ছিলাম; ভ্যান চালাচ্ছিল বার কি চোদ্দ বছরের একটি ছেলেশুধুই হাড়গুলো টিকে আছে। তুমি কান পাতলেই শুনতে পেতে হাড়ের ঠক ঠক শব্দ। ভ্যানের গতি ত্রমশ কমে যেতে দেখে আমার পাশের ভদ্রলোকটি চেঁচিয়ে বললেন,
‘‘এই ব্যাটা চালা জলদি।’’
‘‘পারছি না স্যার!’’- সেকি করুন আবেদন।
‘‘তাহলে চালাস কেন?’’
‘‘জানি না! ওত রাগ হলে দিন না উপ্রে পাঠিয়ে। কত লোককে তো পাঠান। দিন না পাঠিয়ে। তাইলে মরেও বাঁচুম।’’
‘‘নাজমা, তুমি শোনোনি, আমি শুনেছিবাঁচার জন্য সেকি করুণ আকুতি। মরার মাঝে বাঁচা। একটা যুবক, জীবনের সে কিছুই দেখেনি, মরতে চাই কারণ সে বাঁচতে চায়!’’
আসিফ শক্ত করে ধরে নাজমার বাম হাতটা। নাজমা অনুভব করে আসিফ কাঁপছে, প্রচন্ড ভয়ে কাঁপছে আসিফ।
‘‘আসিফ, আমি তোমাকে বরফের দেশে নিয়ে যাবো, যাবে তুমি? প্রচন্ড ঠান্ডা, আমি প্রায়ই যাই।’’
‘‘আমি মৃত্যুর দেশে যেতে চাই, নিয়ে যাবে তুমি?’’
আসিফের কথায় অপারগতা স্বীকার করে নাজমা।
‘‘না আসিফ, আমি পারবো না। ইচ্ছে হলে তুমি একাই যাওসৃষ্টিকর্তা আমার মত করে গল্প শোনাবে তোমাকে, সাদা সাদা মানুষ…আরো কত কি!’’
হেসে ওঠে আসিফ, মটারের মত গোঁ গোঁ শব্দে। নাজমা কানে হাত চেপে ধরে।
‘‘যে সৃষ্টিকর্তা কোনো শিশুর মুখ দেখেননি, যে সৃষ্টিকর্তা কোনো মায়ের গর্ভ হতে জন্ম নেননি, পাখিদের ডাক শুনে যাঁর ঘুম ভাঙ্গে না, সে আসবে আমাকে গল্প শোনাতে! হাঃ! হাঃ! হাঃ!’’
‘‘মৃত্যুর পর সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই আসবেন, তিনি আমাদের সকলের কাছে আসবেন, তুমি দেখো।’’
‘‘হয়ত আসবেন কারণ তখন আর আমরা অসহায় থাকবো না, আর কোনো অভাব থাকবে না আমাদের। সৃষ্টিকর্তাও নিশ্চয় দারিদ্রকে ভয় পান? আমাদের যখন আর কোনো অনুভূতি থাকবে না তখন তিনি আসবেন গল্প শোনাতেঠান্ডা বরফের দেশের গল্প!’’
‘‘ওহ! বরফের দেশের গল্পটা না অসম্ভব সুন্দর! তোমাকে তো বলাই হল না সবটাশ্বেত ভাল্লুকের মত পোশাক সকলের; প্রচন্ড ঠান্ডা অথচ কি শান্তিটাই না পাচ্ছিলাম আমরা! তুমি যাওনি, আমি গিয়েছিলাম, সে এক অন্যরকম অনুভূতি। আসিফ! আসিফ!’’


‘‘নাজমা নাজমা-’’
‘‘খোলা আছে। চলে এসো।’’ খুব কষ্ট করে ভেতরে আসে আসিফ।
‘‘না নাজমা, ওরা আর আমাকে বাঁচতে দিল না। তবে…!’’
‘‘কি বলছো আসিফ? কি হয়েছে তোমার?’’ আসিফের রক্তাক্ত বুকে হাত রাখে নাজমা।
‘‘তবে মুক্তির পথের সন্ধান আমি পেয়ে গেছি। সব মিথ্যা এতদিন যা গভীর সত্য বলে জেনেছি। আমি চললাম, শূণ্যে : মুক্তির পথে।’’ নাজমা হুইল চেয়ারের হাতলটি শক্ত করে ধরে।
‘‘কিন্তু আমার গল্পের যে এখনো অনেকটা বাকী…! বরফের দেশে হাঁটছি আমরা। কারো পায়ে স্কেটিং নেই অথচ আমরা হাঁটছি ঝড়ের গতিতে। কেউ কেউ মেঘ ছুঁয়ে আসছে একেক লাফে, বিশ্বাস করো আসিফ। আসিফ! আসিফ! আসিফ!’’

[ লেখকের নোট : প্রতিটা মানুষের ভিতরে নাজমা ও আসিফরূপী দুটো বিপরীতমূখী সত্তা সহবাস করে। একটা সত্তা (নাজমা) মমতাময়ী ও স্বপ্নমূখী। বাস্তব জগতের সবকিছু থেকে অনেকদূরে বাস করতে চায়। অন্য সত্তা (আসিফ) নিজের অস্তিত্ব নিয়ে ভাবতে থাকে। স্রষ্ঠার উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্নতোলে। যেকোনো অন্যায় অবিচার দেখলে প্রতিবাদ করতে চায়। এই দুটো সত্তার conflict আমাদের ভেতরে সর্বদা চলতে থাকে। দ্বৈতসত্তার উপস্থিতির কারণে মানুষ চিন্তা-ভাবনা করতে পারে এবং একাকীত্ব উপভোগ্য হয়ে ওঠে। এ জন্য, একটু লক্ষ্য করলেই, প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রে, মনের স্ববিরোধিতার বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়।

আরো একটি বিষয় লক্ষ্যনীয়, প্রতিটা মানুষের ভেতরে উভয় সেক্সের (নারী ও পুরুষ) উপস্থিতি ঘটে। পুরুষেরা নারীর এবং নারীরা পুরুষের উপস্থিতি টের পায় আপন সত্তার ভেতরেই এবং এই উপস্থিতি একধরণের sexual pleasure প্রদান করে বৈকি। এবং এই উপস্থিতির কারণেই আমরা পরস্পরকে আরো পরিস্কারভাবে জানতে ও বুঝতে পারি। এ বিষয়টি কিছুটা উঠে এসেছে ইয়ুং এর দর্শনের মধ্য দিয়ে ।

জীবনের কোন একটা সময়ে এবং কোন না কোন ঘটনার কারণে মানুষের একটা সত্তা ঘুমিয়ে পড়ে। যদি নাজমারূপী সত্তাটা ঘুমিয়ে পড়ে তবে এই ক্ষেত্রে মানুষ নিষ্ঠুর ও এ্যরোগেন্ট হয়ে ওঠে; আর যদি আসিফরূপী সত্তা ঘুমিয়ে পড়ে তবে মানুষ স্বাভাবিকের থেকে বেশি আবেগী ও ভিতু হয়ে ওঠে। এ দুটোই চিকিৎসা যোগ্য অসুখ। ]

রচনাকাল : মার্চ, ২০০৪

Asim Duttaroy
If there is any behavior that has been universally exhibited (such as spirituality or feeling of God) among every human culture, that behavior must represent an inherent characteristic of our species, a genetically inherited instinct. The h…uman concept of God seems a biological processed phenomenon that depends on certain chemicals in brains, therefore the humanly felt or understood God is highly limited and variable identity as it expression depends on particular person’s brain activity at that time. This biological processed God probably has nothing to with the real creator if there is any. The spiritual consciousness probably evolved in us in response to the emergence of self-conscious awareness which brought with it, as an unfortunate side-effect, an awareness of our own deaths. As a result of this new type of consciousness, the human animal would have to live in a state of constant mortal peril and dread unless some adaptation could help relieve us of this awarenesses’ painful effects.