আধুনিক পৃথিবীতে সর্বত্রই ধর্মের ছড়াছড়ি। এই ধর্মগুলোর মধ্যে যেমন রয়েছে বিপুল সাদৃশ্য, তেমনি বৈসাদৃশ্যও লক্ষণীয়। সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের ভিত্তিতে ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসের বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত ও সরল আলোচনায় আসা যাক।
ধর্মগুলোর মধ্যে একটি বড় সাদৃশ্য হল, সকল ধর্মই দাবি করে সে-ই সত্য ও সর্বোৎকৃষ্ট, এছাড়া অন্যান্য ধর্ম মিথ্যা ও নিকৃষ্ট। আবার ধর্মগুলো যেমন ঐ ধর্মের অনুসারিদের জন্য বরাদ্দ রেখেছে স্বর্গ, তেমনি অন্য ধর্মাবলম্বিদের জন্য নরক। কিন্তু ধর্মগুলোর ক্ষেত্রে কেউ কেউ বলে থাকেন -যত মত, তত পথ। যেখানে এক ধর্মের কাছে অন্য ধর্ম সম্পূর্ণ ভ্রান্ত সেখানে কথাটিতে স্ববিরোধিতা ছাড়া অন্য কিছুই প্রকাশ পায় না। কেননা সত্য এক ও অখণ্ড; একই সময় একই সাথে পরস্পর বিপরীত দুটি কথা সত্য হতে পারে না। তাই, সকল ধর্মই মানবতার কথা বলে -এরকম যারা বলেন তারা হয় মানবতা বোঝেন না, নয়ত ধর্ম বোঝেন না; একটি ভুল জীবনদর্শন মানুষকে শুধু প্রতারণাই দিতে পারে।
হিন্দুরা দাবি করেন তাদের ধর্ম চিরায়ত ধর্ম, সেই আদিমকাল থেকে তাদের ধর্ম চলে আসছে, তাই তাদের ধর্ম খাঁটি ও সর্বোত্তম, যদিও অন্য কোনো ধর্মাবলম্বির এই ধর্মে স্বাভাবিক প্রবেশাধিকার নেই । হিন্দু ধর্মে আছে, “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরাধর্ম ভয়াবহোঃ” -নিজের ধর্মে বিশ্বাসী থেকে মৃত্যুবরণ করলে পুরষ্কার প্রাপ্তি, ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করলে ভয়ঙ্কর শাস্তি। বিধর্মীর জন্য রয়েছে ‘রৌরব নরক’। অহিন্দু মাত্রই যবন, ম্লেচ্ছ ইত্যাদি।
ইহুদিরা প্রচণ্ড ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। তারা নিজেদের ঈশ্বরের একমাত্র মনোনীত জাতি বলে মনে কর -এ ধরনের বিশ্বাস নিঃসন্দেহে ভয়ঙ্কর। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে সকল মানুষ আদিপাপের বোঝা নিয়ে জন্মে; সকল মানুষই ইটারনেল ডেমনেসন বা অনন্তকাল নরকভোগের উপযুক্ত, শুধু খাঁটি খ্রিস্টানরা ব্যতীত। বৌদ্ধধর্মের মূল ধারাটি নিরীশ্বরবাদী হওয়ায় অনেকে একে ধর্ম মনে করেন না, তারা মনে করেন এটি একটি দর্শন।
এবার আসা যাক, ইসলাম প্রসঙ্গে। ইসলাম ধর্ম একবাক্যেই সব ধর্মকে নাকচ করে দেয়। কোরানে আছে, নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলাম (৩:১৯)। ইসলাম মতে, মুসলমানরা মৃত্যুর পরে (পাপ মোচনের পর) চিরদিনের জন্য বেহেশতে যাবে আর অবিশ্বাসীরা চিরদিনের জন্য দোজখে যাবে (২:৩৯)।
এবার, বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যদি মানুষের ধর্মবিশ্বাস প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করি তবে দেখতে পাই প্রায় সকল মানুষের ধর্মবিশ্বাস তার পিতা-মাতা বা পরিবারের উপর নির্ভর করে। একটি শিশু যে ধর্মাবলম্বী পরিবারে জন্মগ্রহণ করে সে সচরাচর সেই ধর্মেরই হয়ে থাকে, কেননা প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী পরিবার শিশু কিছুটা বড় হয়ে উঠতে না উঠতেই তাদের ধর্মে গভীরভাবে বিশ্বাসী করে তোলার জন্য তোড়জোড় শুরু করে। শিশুটিকে পরিবারের ধর্মের বিভিন্ন অলৌকিকতার কেচ্ছা, পৌরাণিক কাহিনী, স্বর্গ, নরক, মহাপুরুষের মহৎকীর্তি ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত করা হয়। অন্য ধর্ম সম্পর্কে একটা প্রচণ্ড ঘৃণাও এ বয়সে শিশুর মনে তৈরি করা হয়। শিশুদের মনে এগুলো স্থায়ীভাবে দাগ কাটে যার ফল হিসেবে সে কখনও স্বীয় পারিবারিক ধর্মের ঊর্ধ্বে কিছুই চিন্তা করতে পারে না। তাই সে সারা জীবন ধরে তার পরিবারের ধর্মেই থাকে, এমনকি তার ধর্মের এক শাখা পরিবর্তন করে অন্য শাখায়ও যায় না। এর অন্যথা খুবই বিরল। এছাড়া কোনো মানুষের জন্য ধর্ম ত্যাগ বা অন্য ধর্ম গ্রহণ অত্যন্ত জটিল ব্যাপার কেননা এতে পরিবার ও সমাজের সাথে তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বেশিরভাগ সাধারণ মানুষই ধর্ম নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে বা বুঝতে অক্ষম। যারা স্বল্পশিক্ষিত বা নিরক্ষর (সমাজের বেশিরভাগ লোক) তাদের সে সুযোগই নেই। আমরা আজ থেকে দুয়েকশ’ বছর পূর্বের কথা চিন্তা করলে দেখি অতি অল্পকিছু মানুষ ছাড়া সকলেই নিরক্ষর এবং অতিমাত্রায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সুতরাং হাজার বছরের আগে যেসব ধর্ম প্রচারিত হয়েছে, আর যারা তা গ্রহণ করেছে, তারা কতটা সচেতনভাবে তা করেছে (যা বংশপরম্পরায় আজও সঞ্চারিত হচ্ছে) তা সত্যিই ভাবনার বিষয়। সভ্যতার ইতিহাসের মহাজ্ঞানী সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানীদের (ব্যতিক্রমী দুই একজন বাদে) কেউই যেখানে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে কথিত কোনো সত্য-ধর্ম গ্রহণ করেন নাই; সেখানে সাধারণ মানুষের, যাদের চিন্তার সীমা একেবারেই সীমাবদ্ধ তাদের ক্ষেত্রে এরকম আশা করা অবান্তর। অতি সামান্য কিছু মানুষ ছাড়া সকলেই যেখানে নিজ-নিজ ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ ও এর ভাষা সম্পর্কে খুব স্বল্প জ্ঞান রাখে সেখানে তাদের পক্ষে অন্য ধর্ম সম্পর্কে খুব একটা জানার বা চিন্তা করার প্রশ্নই উঠে না। এমতাবস্থায় দেখা যাচ্ছে একটি মুসলিম পরিবারের সন্তান মুসলিম হচ্ছে এবং তদ্রুপ অমুসলিম পরিবারের সন্তান অমুসলিম হচ্ছে। জন্মের আগে বা জন্ম নিয়ে কেউ কোনো পাপ করেনি। তবে কেন একজন মুসলমান শুধুমাত্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করার কারণে মুসলিম হওয়ায় মৃত্যুর পরে চিরকালের জন্য বেহেশতে যাবে আর একজন অমুসলিম শুধুমাত্র অমুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করার কারণে অমুসলিম হওয়ায় চিরদিনের জন্য দোজখে যাবে? জন্মই যেসব ক্ষেত্রে ধর্ম ঠিক করে দিচ্ছে সেখানে চিরকাল বেহেশত ও দোজখ ব্যাপারটি কি একটা অযৌক্তিক বিষয় নয়? প্রশ্নটি কিন্তু কিছুটা পরিবর্তন সাপেক্ষে সকল ধর্মের ব্যাপারেই প্রযোজ্য। আর, মানুষের ধর্মগ্রহণ প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করলেই আমরা অতি সহজে ধর্মগুলোর অসারতা প্রমাণ করতে পারি।
ধর্মগুলো বিশ্বাস নির্ভর। বিশ্বাস মানুষের একান্ত মনের ব্যাপার। কিন্তু ধর্মগুলো ‘বিশ্বাস’ মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। মুসলিম কেউ যদি ধর্ম ত্যাগ করে তবে তাকে মুরতাদ বলা হয় আর মুরতাদের শাস্তি শিরচ্ছেদ (শরিয়া আইন অনুযায়ী)। কোন অমুসলিম যদি মুসলিম হওয়ার পর তার আগের ধর্মে ফিরে যায় অথবা কোনো মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে কেউ বাল্যকালেই অমুসলিম হয় তবুও সে মুরতাদ এবং শাস্তির বিধান একই। সকল ধর্মই তাদের ধর্মত্যাগীদের বেলায় অত্যন্ত কঠোর। মানব ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই মানুষ কখনো অগ্নিকে আবার কখনো সূর্যকে এমনকি কখনো গাছকেও দেবতা বলে মনে করে। আর, এরকম হাস্যকর বিষয়ে বিশ্বাস ও তার আরাধনায় মানুষ তার জীবন উৎসর্গ করে দিতে পারে। মানুষের এই ‘বিশ্বাসটির’ জন্য ধর্ম তবে এত লালায়িত কেন? যে মানুষ ‘গরু’ পূজা করতে পারে সে স্রষ্টার পূজা করলে স্রষ্টার গৌরব কতটা বাড়বে তা ভেবে দেখার বিষয়।
বেশিরভাগ আধুনিক ধর্মই ঈশ্বরকেন্দ্রিক অর্থাৎ ঈশ্বরকে খুশি করা, তার আরাধনা করাই ধর্মের মূল লক্ষ্য। প্রতিটি ধর্মেই ঈশ্বরের ধারণা অত্যন্ত অদ্ভুত। ঈশ্বরের করুণা, দয়া, ক্ষমতা অসীম। কিন্তু অসীম দয়া, করুণা বা ক্ষমতা বলতে আসলে কী বুঝায়? আর দয়াময় ঈশ্বরের নির্দেশে যখন জলোচ্ছ্বাস বা সিডরের মত ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে, তখনো বলতে হবে ঈশ্বর করুণাময়, অসীম দয়ালু! ঈশ্বর স্তুতিপ্রিয়, তিনি নিজে নিজেই চমৎকার সব গুণবাচক নাম ধারণ করেন যা অনুসারিদের বাধ্যতামূলকভাবে জপ করতে হয়। তিনি রাগও করেন, কখনো কখনো এমন রাগ করেন যে, তার আরশ বা সিংহাসনও নাকি কেঁপে উঠে। কোনো কোনো ধর্মে ঈশ্বরকে বলা হয় নিরাকার। নিরাকার অথচ সচেতন সত্তা, তার ক্ষমতা ও অসীম, তা সত্ত্বেও তার বসার জন্য প্রয়োজন কুরসি বা চেয়ার বা আরশ বা রাজসিংহাসন, আবার তিনি সর্বব্যাপী -একেই বোধ হয় বলে, ‘বিল্ডিং এ কাসল ইন দা এয়ার’। যেহেতু নিরাকার কোনো সচেতন সত্তা আমাদের অভিজ্ঞতায় নেই এবং অসম্ভব; তাই নিরাকার ঈশ্বরের ধারণার কোনো দার্শনিক বৈধতা নেই।
একেক ধর্মে পরলোকের ধারণা একেক রকম। ইসলামে রয়েছে শিঙ্গার ফুঁকে কিয়ামত হয়ে যাওয়া, সূর্য মাথার একহাত উপরে আসা, স্রষ্টার হাতে পাপ-পূণ্য পরিমাপের জন্য দাড়িপাল্লা নেয়া, পুলসিরাত ইত্যাদির ধারণা। অনেকে মনে করেন ‘শয়তানের’ ধারণার মত পুলসিরাতের ধারণাও ইসলাম জরথুস্ত্রবাদ থেকে পেয়েছে। স্বর্গ ও নরক নিয়ে একটু ভাবলেই আঁচ করা যায় যে, এর ধারণা ‘সময় ও স্থানীয়তার’ উপর নির্ভরশীল। প্রাচীন গ্রিকদের কাছে সাগরের বিশাল তীর দিয়ে প্রসারিত শ্যামল প্রান্তর খুবই আকর্ষণীয় ছিলো—বিশেষ করে যখন সূর্যের কিরণ তাতে বিচ্ছুরিত হত। তাই তাদের স্বর্গ অনন্ত বসন্তের হাওয়া বিরাজিত, কোমল ভাবে অনন্ত কিরণ ধারা প্রবাহিত মহা প্রান্তর। হিন্দুদের মাতৃভূমি নদীমাতৃক ফল-ফুলে শোভিত। তাই তাদের স্বর্গে রয়েছে অব্যাহত শান্তি, মন্দাকিনী কলনাদে প্রবাহিত, কুসুম ধারে ধারে প্রস্ফুটিত, অপ্সরা গীতি-কাকলি মুখরিত মঞ্জুরিবীথিকায় অপূর্ব নর্তনে ক্রীড়ারত। যিশুর সময় পৃথিবীতে ছিল রাজশক্তির প্রবল প্রভাব। তাই তার স্বর্গ একটি আর্দশ রাজ্য যেখানে ঈশ্বর জ্যোতির্ময় আসনে উপবিষ্ট আর দেবদূতেরা তার স্তুতিতে মুখর। স্বর্গে অমৃতের নদী প্রবাহিত ও তা অভেদ্য প্রাচীরে বেষ্টিত। দেড়হাজার বছর আগে আরবে ছিল ব্যাপক মদ্যপানের প্রচলন। গনগনে রৌদ্রের মধ্যে মরুভূমিতে সব সময় সুশীতল পানি ছিল অতি আকাঙ্ক্ষিত বস্তু। তাই ইসলামের স্বর্গে রয়েছে সুশীতল পানির নহর এবং পবিত্র মদ (শরাবান তাহুরা)। মরুভূমিতে জনজীবন প্রচণ্ড তাপমাত্রায় প্রায়ই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই ইসলামের নরকে রয়েছে অগ্নি, প্রচণ্ড উত্তাপ। স্বর্গ-নরক তথা পরকালে এমন কিছুই পাওয়া যাবে না, যা পৃথিবীতে বসে কল্পনা করা অসম্ভব।
প্রায় সকল ধর্মেই আমরা স্রষ্টার প্রেরিত পুরুষের সন্ধান পাই। তবে তাঁদের অনেকেই মিথ বা গুজবের সৃষ্টি, কেউ ভণ্ড আবার কেউ মানসিক রোগী। অনেকে আবার এমন তপস্যায় মেতে উঠেছিলেন যে মানসিক ভারসাম্য না হারানোটাই ছিল অস্বাভাবিক। অনুসারিরা কোনো কালেই তাঁদের সমালোচনা সহ্য করেনি। ফল হিসাবে ইতিহাসে কখনো তাদের দোষগুলো আসে না; বিশেষ করে যখন আবার কেউ বিজয়ী রাজা হয়ে যান। এছাড়া ধর্মপ্রচারকদের জীবন ইতিহাস তার অনুসারিরাই তৈরি করেন বলেই তারা ইতিহাসে মহানপুরুষে পরিণত হন। ধর্মবাদীরা তাদের ধর্মের মহাপুরুষদের জীবনকে ঘিরে একটা ইন্দ্রজাল তৈরিতে সদাব্যস্ত। একটা উদাহরণ দেয়া যাক :— হজরত মুহম্মদের জীবনীকারকগণ তাঁর নিষ্পাপতা প্রমাণ করার জন্য বলে থাকেন, -ফেরেশতারা কয়েকবার হজরতের ‘সিনা সাক’ বা বক্ষবিদারণ করে হৃৎপিণ্ডের জমা রক্ত যা ‘শয়তানি প্রণোদনার উৎস’, তা পবিত্র পানি দ্বারা ধোয়ে পরিষ্কার করেছিলেন। বলা বাহুল্য, ধারণাটি হাস্যকর। তখনকার ধারণা ছিল, মানুষের আত্মা বক্ষস্থলে বা হৃৎপিণ্ডে অবস্থান করে। আজ আমরা জানি, মানুষের সকল ধরনের চিন্তা বা অনুভূতির আশ্রয় মস্তিষ্ক। হৃৎপিণ্ড ধোয়ে পাপ-চিন্তা সরানো অসম্ভব, এর জন্য প্রয়োজন ‘ব্রেন সাক’! ইতিহাস বলছে ‘শয়তান ও ফেরেশতা’ তখনকার সেমেটিক বাজে চিন্তার ফসল। হজরতের জীবনযাত্রা প্রণালী মুসলমানদের কাছে অনুসরণীয়। কিন্তু শিশুবিবাহ, বহুবিবাহ, যুদ্ধে স্ত্রী সাথে নেয়া, পালক পুত্রের স্ত্রী বিয়ে করা, চুরি করার অপরাধে চোরের হাত কেটে ফেলা, ব্যাভিচারিকে প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করা -এগুলোর সমর্থনে কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
প্রত্যেক ধর্মের স্বতন্ত্র ধর্মশাস্ত্র রয়েছে; হিন্দুদের ‘বেদ’, ‘গীতা’, ‘উপনিষদ’, মুসলমানদের ‘কোরান’, খ্রিস্টানদের ‘বাইবেল’, ইহুদিদের ‘তৌরাত’, বৌদ্ধদের ‘ত্রিপিটক’, শিখদের ‘গ্রন্থসাহেব’। ধর্মশাস্ত্রগুলো যেহেতু অনেক পুরোনো তাই এগুলো আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শনের সাথে বিরোধপূর্ণ হতেই পারে। কিন্তু বর্তমানে এগুলোকে বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলার জন্য ধর্মবাদীরা গলদঘর্ম হয়ে পড়েছেন। তারা শাস্ত্রের কথাগুলোকে ইচ্ছেমত অপব্যাখ্যা করে, অর্থের পরিবর্তন করে বিজ্ঞানময় করে তুলতে চাচ্ছেন। কিছু কিছু ধর্মবিশ্বাসীরা ধর্মশাস্ত্রের হিজিবিজি কথার মধ্যে ‘গভীর তত্ত্বের’ খোঁজ পান। আবার কেউ কেউ দাবি করেন তাদের ধর্মগ্রন্থ সকল বিজ্ঞানের উৎস। কিন্তু কোনো কিছু আবিষ্কারের পরপরই তারা তা ধর্মশাস্ত্রে খোজাখুঁজি শুরু করেন এবং অল্পকাল পরে তা পেয়েও যান (!) এবং তারও কিছু পরে ধর্মশাস্ত্রের কিছু কথার ব্যাখ্যা এমনভাবে দেন যাতে মনে হয় এর আবিষ্কারক ঐ ধর্মশাস্ত্রটিই। কিন্তু আবিষ্কার হওয়ার আগে কেন ঐ বিষয়টি ঐ ধর্মশাস্ত্রে পাওয়া যায়নি? এ বিষয়ে ধর্মবাদীরা কেন জানি নিরুত্তর। এখনো বিজ্ঞানে সবকিছু আবিষ্কার হয়নি; তাই ধর্মবাদীরা যদি দয়াপরবশ শাস্ত্র ঘাঁটাঘঁটি করে অনাবিষ্কৃত বিষয়গুলো আগেই বের করে দেন, তাহলে তাদের দাবির সত্যতা নিয়ে অনেকেরই সংশয় কমে যাবে!
ধর্মগ্রন্থ পাঠের বা পাঠ শোনার সময় ধর্মাবলম্বিদের তথাকথিত অদ্ভুত ‘স্বর্গীয়’ অনুভূতি হতেই পারে, কেননা ঐ ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের প্রতি রয়েছে তাদের অগাধ বিশ্বাস, ভয় বা সম্ভ্রম -যা তাদের মস্তিষ্কের নিউরনগুলোকে বিশেষভাবে আলোড়িত করে; এটা অলৌকিক নয়, মানসিকবিভ্রম মাত্র। ধর্মগ্রন্থগুলোতে নিত্য নতুন অলৌকিকতা আবিষ্কারে ধর্মবাদীরা খুবই পারঙ্গম -যা অজ্ঞ ধর্মবিশ্বাসীদের জন্য প্রহেলিকা সৃষ্টি করে। কোনো কোনো ধর্মবাদী দাবি করেন – “তাদের শাস্ত্র অনুবাদ পড়ে বোঝা যাবে না”। প্রশ্ন হল, কেন? পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞান মানুষ বিনিময় করেছে, অর্জন করেছে অনুবাদের মাধ্যমে, কোথাও বিশেষ কোনো সমস্যা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। হ্যাঁ, অনুবাদের সময় দুয়েকটা শব্দের বা কথার একটু বিশদ ব্যাখ্যা প্রয়োজন হয়, যা তখন উল্লেখ করলেই হল। যে কোনো ধর্র্মবিশ্বাসীদের সিংহভাগই তাদের ধর্মগ্রন্থের মূল ভাষা জানেন না, অনুবাদের আশ্রয় নিতে হয়। মজার কথা হল, ধর্মবিশ্বাসীরা তাদের নিজ নিজ ভাষায় যতই ধর্মশাস্ত্র চর্চা (বুঝে অথবা না-বুঝে) করে থাকেন না কেন তাতে কো্নো সমস্যা হয় না, কিন্তু যখনই কেউ ধর্মশাস্ত্র নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেন বা সন্দেহ প্রকাশ করেন ঠিক তখনই ধর্মবাদীরা এ ‘ওজর’ তোলেন।
অনেকে আবার দাবি করেন তাদের ধর্মগ্রন্থ এমন শ্রেষ্ঠ—এর মতো কোনো গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব নয়। তাদের প্রতি প্রশ্ন -কোন দিক থেকে ধর্মগ্রন্থ শ্রেষ্ঠ আর কে সেটা নিরুপণ করবেন? কোনো গ্রন্থের বিষয়বস্তু ও সাহিত্যমান দ্বারাই এর মূল্যায়ন করা হয়। ধর্মগ্রন্থগুলোর সাহিত্যমানের সার্বিক মূল্যায়ন করলে তা আহামরি কিছু বলে মনে হয় না। বিষয়বস্তুর দিক থেকেও শাস্ত্রগুলো এতই দুর্বল যে, বলা যেতে পারে এঁদের চেয়ে জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থ যে কোনো ভাষায় অসংখ্য পাওয়া সম্ভব। এছাড়া ধর্মশাস্ত্রগুলোতে আদৌ কোনও জ্ঞান আছে কি না তাও প্রশ্ন সাপেক্ষ, কেননা যেকোনো জ্ঞানের স্বপক্ষে দলিল-প্রমাণ প্রয়োজন যা শাস্ত্রগুলো সরবরাহ করতে অক্ষম। তাই ধর্মগ্রন্থ থেকে মানুষ কখনো সঠিক দিক নির্দেশনা পেতে পারে না। এগুলো মানুষকে শুধু অজ্ঞ-আবেগপ্রবণ আর অসহিষ্ণু করে তোলতে পারে। মানুষের মুক্তির জন্য মানুষকেই বিধান তৈরি করতে হবে আর তা হতে হবে মানবীয় জ্ঞানের আলোকে, তথাকথিত কোনো ‘ঐশ্বরিক শাস্ত্রের’ ধুয়া তুলে নয়।
প্রতিটি ধর্মের নিজ নিজ তীর্থস্থান রয়েছে। এসব স্থানে ভ্রমণে ধর্মবাদীরা নিজেদের পবিত্র করেন, পূণ্য অর্জন করেন। হিন্দুদের তীর্থক্ষেত্রগুলোর মধ্যে চন্দ্রনাথ, লাঙ্গলবন্দ, গয়া, কাশী, বৃন্দাবন, মথুরা, নবদ্বীপ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের রয়েছে জেরুজালেম যা মুসলমানদের কাছেও পবিত্র বটে। মুসলমানদের পবিত্র তীর্থস্থান মক্কা। প্রতিবছর লক্ষ-লক্ষ হাজি বিপুল অর্থ ব্যয় করে সেখানে যান। কাবাকে বলা হয় বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর আর হাজিরা আল্লাহর মেহমান বা অতিথি। কিন্তু প্রায়ই অসংখ্য হাজি তাবুতে অগ্নিকাণ্ডে বা পদপিষ্ট হয়ে মারা যান। এইতো কয়েক বছর আগে ৩৬০ জনের অধিক হাজি শয়তানকে প্রস্থর নিক্ষেপ করতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে মারা যান। অগ্নিদগ্ধ হয়ে বা পদপিষ্ট হয়ে মারা যাওয়া কেমন, তা একটু ভাবলেই অনুধাবন সম্ভব। আল্লাহর আতিথেয়তা সত্যিই চমৎকার! ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাক-ইসলামি যুগে কাবার ভেতর ৩৬০টি কিম্ভুতকিমাকার মূর্তি ছিল আর উৎসবের সময় তখনকার লোকেরা নাকি উলঙ্গ হয়ে এর চারদিকে ঘুরত! কিন্তু আজও হাজিরা হজে গিয়ে পরম পবিত্রজ্ঞানে কাবার চারদিকে ঘুরতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন!―কোনো সাদৃশ্য নজরে আসে কি? আরো একটি কথা―নামাজের সময় পশ্চিমদিকে (কাবারদিকে) মুখ করে নামাজ পড়তে হয়। কিন্তু পৃথিবী গোল, তাই কাবার বেশ দূরবর্তী এলাকা থেকে কাবার দিকে মুখ করে নামাজ পড়া এক কথায় অসম্ভব; গ্লোব মানচিত্র দেখলে সহজেই বুঝা যাবে। এটা অনেকের মাথাতেই আসে না!
ধর্মগুলো আরেকটি ব্যাপারে খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ আর তা হল, নারীদের তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা; এবং তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা। ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মমতে আদমের প্রয়োজনেই তাঁর এক বক্র হাড় থেকে ‘হাওয়া’ বা ‘ইভে’র উৎপত্তি। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ মনুসংহিতায় স্বয়ং মনু বলেছেন (৯:১৮): নাস্তি স্ত্রীণাং ক্রিয়া মন্ত্রৈরিতি ধর্মে ব্যবস্থিতিঃ। নিরিন্দ্রিয়া হ্যমন্ত্রাশ্চ স্ত্রিয়োহনৃতমিতি স্থিতিঃ॥ অর্থাৎ—মন্ত্র দ্বারা স্ত্রীলোকদের সংস্কার নেই, এরা ধর্মজ্ঞ নয়, মন্ত্রহীন এবং মিথ্যার ন্যায় (অশুভ)। ইসলাম ধর্মমতে, ‘‘পুরুষ নারীর রক্ষাকর্তা, কারণ আল্লাহ্ তাদের এককে অপরের ওপর বিশিষ্টতা দান করেছেন’’ (সুরা নিসা, ৪:৩৪), ‘‘তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র, অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা যেতে পার’’ (সুরা বাকারা, ২:২২৩)। বেহেশতেও নারীদের সম-অধিকার নেই। সেখানে পুরুষদের জন্য যে সত্তরজন হুরের ব্যবস্থা আছে অনুরূপ ব্যবস্থা নারীর জন্য অনুপস্থিত। বিবাহের ক্ষেত্রেও ধর্মগুলোর নীতি সম্পূর্ণই অমানবিক। ইসলাম মতে, ‘‘মুশরিক রমণী যে পর্যন্ত না বিশ্বাস করে তোমরা তাকে বিয়ে করো না। অবিশ্বাসী নারী তোমাদের চমৎকৃত করলেও নিশ্চয় ধর্মবিশ্বাসী ক্রীতদাসী তার চেয়ে ভালো’’ (সুরা বাকারা, ২:২২১)। অন্যান্য ধর্মগুলোতেও ভিন্ন ধর্মের কারো সাথে বিবাহ-বন্ধন গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া ধর্মগুলো পুরুষের বহুবিবাহকে অনুমোদন করেছে। এ ধরনের ব্যবস্থা একটি সভ্যসমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ।
প্রত্যেক ধর্ম অনেকগুলো শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত। হিন্দু ধর্মে আবার অনেক কাল আগে থেকেই বর্ণবাদ চলে আসছে। হিন্দু ধর্ম চারটি প্রধান বর্ণে বিভক্ত ছিল -ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের আবহমান কাল থেকেই নানারূপ নির্যাতন করে আসছে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। একমাত্র ব্রাহ্মণরা ব্যতীত অন্য কেউ ধর্মশাস্ত্র পাঠ করতে, এমনকি পাঠ শুনতেও পারত না। হিন্দুশাস্ত্রে মনু বলছেন (মনুসংহিতা, ৪:৮১), ‘‘যো হ্যস্য ধর্মমাচষ্টে যশ্চৈবাদিশতি ব্রতম্। সোহসংবৃতং নাম তমঃ সহ তেনৈব মজ্জতি॥’’ অর্থাৎ—যে ব্রাহ্মণ শূদ্রকে ধর্মোপদেশ প্রদান করবেন, তিনি সে শূদ্রের সহিত ‘অসংবৃত’ নামক নরকে নিমগ্ন হবেন। খ্রিস্টানদের প্রধান প্রধান শাখাগুলো হল, রোমান ক্যাথলিক, অর্থডক্স, প্রোটেস্টান্ট, অ্যাংলিকান। এদের এক শাখার প্রচণ্ড বিরোধ রয়েছে অন্য শাখার সাথে। মুসলমানরাও বেশ কিছু শাখায় বিভক্ত; যেমন: সুন্নি, শিয়া, আহলে হাদিস, কাদিয়ানি। এদের মধ্যে এতই বিরোধ রয়েছে যে, কোনো কোনো শাখা অন্য শাখাকে মুসলিমই মনে করে না। প্রধান শাখা সুন্নি আবার চারটি মজহাবে বিভক্ত, যাদের মধ্যে প্রচুর মতের অমিল রয়েছে। শিয়ারাও অনেক শাখায় বিভক্ত। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতিটি শাখাই মনে করে তারাই ঐ ধর্মের একমাত্র সঠিক অনুসারী!
পরিশেষে একটি কথা না বললেই নয় -আসুন আমাদের যারা ধর্মবিশ্বাসী তারা সবাই নিজ নিজ ধর্মসহ সকল ধর্ম সম্পর্কে গভীরভাবে জানার চেষ্টা করি এবং এ বিষয়ে মুক্তভাবে চিন্তা করে দেখি তা কতটা গ্রহণীয়। বর্তমান বিশ্ব যখন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও দর্শনে অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেছে সেখানে আমরা যদি কতগুলো অপবিশ্বাস নিয়ে বসে থাকি তবে তা আমাদের জন্য খুব একটা মঙ্গল বয়ে আনবে না। বদ্ধবিশ্বাস থেকে বেরিয়ে মুক্তচিন্তার দিকে আসা হল আমাদের যাবতীয় সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ। আমরা যদি অযৌক্তিক বিশ্বাসকে রেখে কোনো বিষয় চিন্তা করি তবে তা ঐ বিশ্বাস দ্বারাই পরিচালিত হবে, তাতে সমস্যা শুধু বাড়বেই। তাই আমাদেরকে প্রথমেই মুক্তচিন্তক হতে হবে, বুঝতে হবে যুক্তি। আসুন আমরা যুক্তির পথে, মুক্তচিন্তার পথে অগ্রসর হই, জীবনের সবক্ষেত্রে এর যথাযথ প্রয়োগ ঘটাই। এতেই আমাদের জীবন আনন্দময় ও সাফল্যমণ্ডিত হয়ে উঠবে।
( যুক্তি ম্যাগাজিন, সংখ্যা ২ এ প্রকাশিত)
বাপরে বাপ। সাংঘাতিক বিশ্লেষণ। (Y) । লেখাটা আগে কেন যে চোখে পড়েনি!! আমার মতে মুক্ত মনার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখা এটি ( এখনো পর্যন্ত যে কয়টা পড়েছি তাদের মধ্যে)।
সৈকত ভাই, লেখালেখি প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন, ব্যাপার কি? ধর্ম বিষয়ক এমন লেখাই তো মুক্ত মনার পাঠকরা আশা করে থাকেন!!
মুক্তমনায় ধর্ম বিষয়ক লেখাগুলো এখন আর পড়ি না। খুবই একঘেয়ে ও ক্লান্তিকর লাগে। কিন্তু এই লেখাটি বার বার পড়ছি। ছোট্ট লেখায় এতো চমৎকার বিশ্লেষণ– এ সংক্রান্ত লেখালেখিতে খুব কমই হয়েছে। লেখককে বিনম্র শ্রদ্ধা, অভিনন্দন।
লেখায় প্রয়োজনীয় তথ্যসূত্র/লিংক থাকলে আগ্রহীদের আরো জানার সুযোগ তৈরি হতো। চলুক। (Y)
*সংশোধন::
মুক্তমনায় ধর্ম বিষয়ক লেখাগুলো এখন আর পড়ি না= মুক্তমনায় ধর্ম বিষয়ক লেখাগুলো এখন আর [পারতঃ পক্ষে তেমন] পড়ি না।
এই লেখাটি পড়েও যদি কোন ধর্মআন্ধর চোখ না খোলে সেটা খুব ই মর্মান্তিক ব্যাপার। সৈকত চৌধুরী, hats off to you. 🙂
@লিলিয়া,
আপনাকে মুক্ত-মনায় স্বাগতম। :rose2:
আশা করি এখানে নিয়মিত আলোচনায় অংশ নিবেন।
‘আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপন’ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের একটি কবিতার দ্বিতীয় পংক্তি। শুরুটা ছিলো এরকম:
“ভগবান, ভগবান তুমি কি কেবল
আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপন?”
মানে, ফারুক সাহেবের মতো ভক্তপ্রাণ যদি অবিশ্বাসের দিকে কখনো ধাবিত হয়ে সংশয়াকুল হয়ে আর্তনাদ করেন (সম্ভাবনা হয়তো আছে!!! ঈশ্বরের লীলা কে বুঝিতে পারে), তখন তাঁর মুখে এই ভাষা শোনা গেলেও যেতে পারে।
@রাব্বানী,
বিশ্বাসীদের মতে , “উপরওয়ালার ইচ্ছায় কি না হয় !” আর আমার মত অবিশ্বাসীদের মতে, উপরওয়ালা তো জন্ম থেকেই ফেরারী , তার ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কি বা আসে যায় !
@ সৈকত ভাই,
‘আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপন’ আপনার এই লেখাটি মোট তিনবার পড়েছি। প্রথমবার মুক্তমনাতেই, দ্বিতীয় বার যুক্তি ম্যাগাজিন পাবার পর। আর এইবার পড়ে তিনবার হলো। বলতে দ্বিধা নেই যে, প্রথমবার নাম দেখে আমার একটু সন্দেহ হয়েছিল। কারণ এই নামে ড. হুমায়ুন আজাদের একটি প্রবন্ধ রয়েছে ‘আমার অবিশ্বাস’ গ্রন্থে। শিরোনামটি যে সত্যি সত্যিই তার কাছ থেকে ধার করা এতে কোন সন্দেহ নেই। এবং আপনার এই চমৎকার লেখাটি প্রমাণ করে যে আপনি হুমায়ুন আজাদ দ্বারা মুগ্ধ এবং প্রভাবিত। আমরা প্রত্যেকেই যদি এমনিভাবে ধর্মের বিশ্লেষণটা করতে পারতাম তাহলে কত মঙ্গলই না হতো?
নতুন করে পোষ্ট দিয়ে বিষয়বস্তু স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। কিছু কিছু লেখা পুরোনো হয় না। পুরোনোটাই যেন আবার নতুন হয়ে দেখা দেয়। আপনার এই লেখাটিও আমার নিকট তদ্রুপ।
আচ্ছা, যদি কোন শিশু অন্য কোন ধর্মের মা-বাবার ঘরে জন্ম গ্রহনকালে মারা যায়, তাহলে ও কি সে by definition নরকে যাবে?
আবার ধরেন, শিশু অন্য ধর্মে জন্মগ্রহন করল এবং সে জন্মগত ভাবেই মানসিকভাবে অসুস্থ (mentally retarded) যার ফলে সে জানলই না ধর্ম কি। সেও কি নরকে যাবে?
আর সূর্য্য মাথার এক হাত উপরে আসলে হিমালয়ে ধাক্কা খাবেনা, অভিকর্ষ বলের আকর্ষনে তো পৃথিবী সূর্য্যের কেন্দ্রে ঢুকে যাওয়ার কথা। আবার বলেন না যে অভিকর্ষ বল থাকবে না।
জানা কেউ উত্তর দিলে খুশি হব। ধন্যবাদ।
@রাব্বানী, অনেক আলেম-উলামারা বলে থাকেন শুনেছি, কোরানের একটি অগ্রন্থিত আয়াতে নাকি বলা আছে যে- হাশরের সময় চারজন শক্তিশালী ফেরেস্তা পৃথিবীর চার প্রান্ত টেনে ধরে পৃথিবীকে প্রলম্বিত করবে, যাতে সকল মানুষ ও জ্বিনের সেখানে স্থান হয়। ঐ চার ফেরেস্তা হবে এতোই শক্তিশালী যে পিরিয়ডিক ইন্টারভালে আল্লার তাদেরকে রিমাইন্ডার দিতে হবে এই বলে, “এই দুষ্ট ফেরেস্তার দল এতো জোড়ে টান দেয়না, ছিড়ে যাবে। ছিড়ে গেলে জ্বিন ইনসান সব নীচে পড়ে যাবে। আর আমার হাশরের আসরটা হবে মাটি।” এটুকু বোঝার মতো জ্ঞান আপনার আশা করি রয়েছে যে, এতোটা শক্তিশালী ফেরেস্তা যখন কিনা ধরে আছে, তখন সূর্যের অভিকর্ষের টানে পৃথিবীর অন্য কোথাও যাওয়ার উপায় নেই কোন। মহাবিজ্ঞানগ্রন্থ কোরানকে আপনার বাকাস্বরে প্রশ্ন করার ধরণটা পছন্দ হলো না।
লেখাটা দারুন লাগল।
তবে প্রবন্ধের শিরোনামটা জটিল। কেমন যেন খটমট। আরও একটু সহজ সরল করলে তা পাবলিকের দৃষ্টি বেশী কাড়ে বলে মনে হয় আর তা মানুষ বেশী পড়বে বলেও মনে হয়। যাহোক এটা আমার ব্যক্তিগত মত।
অল্প কথায় আসলেই চমতকার বিশ্লেষন।
যত মত তত পথ- এ জাতীয় কথাবার্তা আমার কাছেও অতি নাটুকে বা অতি উদারতা দেখানো মনে হয়। ব্যাবহারিক অর্থে এসব কথার কোন দাম নেই।
মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে যে সব ধর্মের শান্তিপূর্ন সহাবস্থান কি আদৌ সম্ভব?
খুব ছোট উদাহরন দেই। আমাদের দেশে যে কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার বিপক্ষে জেল জরিমানার বিধান আছে। বাংলাদেশে কোরবানী ঈদের সময় গনহারে হিন্দুদের পরম পবিত্র গো-মাতা জবাই করা হয়। এতে কি হিন্দুদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে না? হিন্দু সমাজের কেউ কি এ ব্যাপারে মামলা করেছেন? আবার, ভারতের বেশীরভাগ যায়গায় গরু জবাই নিষিদ্ধ। সেখানকার মুসলমানদের কি তাতে ধর্মানুভুতিতে আঘাত করা হচ্ছে না?
মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশে অন্য কোন ধর্মের প্রকাশ্য চর্চা প্রচারনা নিষিদ্ধ। শুনতে বেশ কর্কষ লাগে। যদিও মূল ইসলামী চেতনা মানলে তো তাদের কোন দোষ দেওয়া যায় না। ইসলাম বাদের অন্য সব ধর্ম আল্লাহ বাতিল ঘোষনা করলে সেই বাতিলদের কোন আক্কেলে আবার ধর্মকর্ম করার সুযোগ দেওয়া হবে?
আসলে, যতই সময় যাচ্ছে, মানুষকে ধর্মের মূল দর্শনের সাথেও আপোষ করতে হচ্ছে। এভাবেই কেবল সহাবস্থান সম্ভব। যারা এই আপোষ মেনে নিতে পারবে না তারাই গোলযোগ পাকাচ্ছে।
@আদিল মাহমুদ,
দারূণ মন্তব্য। আমাকে ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দিলেন। আমার এক হিন্দু বন্ধু এক কোরবানির ঈদে এই বিষয়ে আমার কাছে জানতে চেয়েছিলো। সে বলেছিলো-‘ আমরা সন্ধ্যেবেলা পূঁজো করলে, মন্দিরের ঢাকের শব্দে তোমাদের খারাপ লাগে; আর তোমরা আমাদের ‘ভগবান’কে এভাবে মেরে ফেলছ, আমাদের কি খারাপ লাগেনা বুঝি?” আমি ক্লিন বোল্ড!
@নিটোল,
বোল্ড না হয়ে উপায় নেই।
আসলে যত মত তত পথ বা সব ধর্মের সহাবস্থান একত্রে সম্ভব এসব কথা অতি সরলীকরন, শাক দিয়ে মাছ ঢাকার সামিল।
ধর্ম মেনে সব ধর্ম একত্রে বসবাদ করতে গেলে পদে পদে গোলযোগ বাধবে। কারো না কারো ধর্মানুভূতিতে কোন না কোনভাবে আঘাত লাগবেই।
সমাধান সহজ, যা মোটামুটি সব সমাজেই চলে আসছে; সংখ্যালঘুদের ছাড় দিতে হয়।
@আদিল মাহমুদ,
ধর্মগুলোর শান্তিপুর্ণ সহাবস্থানের জন্য “যত মত তত পথ” জাতীয় সুবোধ বালকসুলভ কথার কোন দরকার নেই। দরকার একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আর তার সাথে একটা গণতান্ত্রিক সামাজিক সংস্কৃতির। এটা পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে বহু আগেই হয়েছে। সেজন্যই আমেরিকাতে কু ক্লাক্স ক্লান, কম্যুনিষ্ট পার্টি আর নাতসি পার্টির মত চরমপন্থী দলগুলো একই ঘাটে বিনা সংঘর্ষে নির্ঝন্ঝাটে পানি খাচ্ছে। আর ধর্মগুলোত সেই তুলনায় নস্যি। আমেরিকার ভিতরে কোন উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় সংঘর্ষ গত দুশ বছরে হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তবে গত পন্চাশ বছরে যে হয়নি সে সন্মন্ধে আমি নিশ্চিত।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হলে তখন আঘাত দেওয়ার প্রবনতা এবং আঘাতের পরিমান দুটোই কমে আসবে। আর কেউ আঘাত দিলেও সেটা নিয়ে স্পর্সকাতরতা কমে আসবে। এগুলো ঘটবে সমাজের বিভিন্ন গুষ্ঠিগুলোর রাজনৈতিক স্বার্থে, তাদের মধ্যে উদারতা বেড়ে যাওয়ার কারনে নয়।
আমাদের দেশে যারা নিজেদেরকে প্রগতিবাদি মনে করেন তাদের উচিত একটা গণতান্ত্রিক সামাজিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য কাজ করা।
@মোঃ হারুন উজ জামান,
আপনার কথা ঠিক। প্রকৃত গনতান্ত্রিক পরিবেশে সেটা সম্ভব। তবে তার চাইতেও অনেক বড় কথা হল ধর্ম ও রাষ্ট্র যন্ত্র ও রাজনীতিকে পৃথক অতি অবশ্যই করতে হবে। সেটা করা না গেলে শুধু গনতন্ত্র দিয়ে তেমন কিছু হবে না, হলেও তার রেট হবে খুব কম। ভারতের মত দেশ সেক্যুলার তকমা গায়ে লাগিয়েও বিশাল সুবিধে করতে পেরেছে তা নয়। ইরান সৌদী আরব এসব দেশে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলেই সব ধর্মের লোকে সমান অধিকার পাবে? মনে তো হয় না।
সেটাই বা কিভাবে করা যায়? করা যায় তখনই যদি মানুষের মনে এ বোধ আসে যে প্রতি পদের দিক নির্দেশনার জন্য কোন ধর্মের দ্বারস্থ হতে হবে। যে সমস্যা আমাদের সহ অন্যান্য মুসলমান দেশগুলিতে আছে। আপনি যদি এই মৌলিক বিশ্বাস পোষন করেন যে আপনার ধর্মগ্রন্থ অনুসরন ব্যাতীত জীবন অর্থহীন তবে অবশ্যই চাইবেন যে সেই ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী যেন দেশ চলে সেটা নিশ্চিত করতে। খুবই স্বাভাবিক। ধরেন আপনি একদিকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে কোরানের সব নির্দেশ অবশ্যই পালনীয়, কিন্তু কোন মুসলমান অধ্যূষিত দেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব কায়েম করেন না তাহলে বলতে হবে যে আপনার বিশ্বাস খাঁটি নয়। শায়খ রহমান বাংলা ভাই গং এর খুব বেশী দোষ তো আমি এ হিসেবে দেখি না। তাদের ভক্তকূলও এ কারনে ভালই আছে।
আজকাল কার দিনে ধর্ম মানা হল ছাড় দেবার খেলা। ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী জীবন পূর্ন নিয়ন্ত্রন সম্ভব নয় সেটা সবাই জানে। কেউ সেটা স্বীকার করে, কেউ করে না। পশ্চীমা দেশের লোকজন সেটা স্বীকার করে, করে বলেই ধর্ম নিয়ে তেমন মাতামাতি করে না।
@আদিল মাহমুদ, আপনি বলেছেন, “মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে যে সব ধর্মের শান্তিপূর্ন সহাবস্থান কি আদৌ সম্ভব?” বিশ্লেষন spot on! ধর্মের ভিত্তি অন্ধ বিশ্বাস, অশান্তি অবধারিত। কিন্তু এটা কেন মানুষ মেনে নিতে পারে না বুঝি না। শুধু ধর্মের ক্ষেত্রেই কোন যুক্তি শুনতে কেউ আগ্রহী না। যুক্তি সম্পন্ন খোলা মনের মানুষ ই এই পরধির বাইরে থেকে সত্যিটা দেখতে সম্পন্ন।
লেখাটি ধর্মপ্রান মাত্রই অবশ্য পাঠ্য। চমৎকার ভাবে খুব কম কথায় অনেক বিষয় তুলে এনেছেন।
সব বড় ধর্মগুলোর বিকাশের অন্তরালে রয়েছে সহস্র বছরের নিরবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতা। এ নিরবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতা ব্যতিরেকে এই বড় ধর্ম গুলি অাজকের অবস্থানে পৌছুতে পারত না । যেমন পারেনি এক সময়ের ধর্মীয় পরাশক্তি প্রাচীন পারসিক, গ্রীক কিংবা রোমান ধর্মগুলি । পারসিকরা এখন অবধি তাদের অস্তিত্ব কোন রকমে টিকিয়ে রাখতে পারলেও , গ্রীক কিংবা রোমান পৌত্তলিক ধর্ম গুলি বিলুপ্ত হয়ে গেছে । অর্থাৎ , তাদের অমর দেবকুলের মৃত্য হয়েছে , যা একটা সময় অকল্পনীয় ছিল । একই পরিনতি বরণ করতে হয়েছে মিশরীয় এবং ব্যাবিলনীয় দেবতাদের ।
১৮শ শতকে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বৈদিক ধর্ম গুলিকে প্রায় নিশ্চিত ক্রমশ বিলুপ্তি থেকে বাঁচিয়ে দেয় । ইউরোপে প্রায় একই সময় শুরু হয় এর বিপরীতমুখী ধারা যা পরবর্তীতে নাস্তিকতা প্রসারের পথ প্রশস্ত করে। মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের তুরস্কে ইসলামের বর্তমান ক্রমবর্ধমান পুনরুত্থানের পেছনেও রয়েছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট । বর্তমানে রাশিয়ায় অর্থোডক্স চার্চের ব্যপারে একই প্রকরণ কাজ করছে ।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ধর্মের নিয়ন্ত্রণ রাজনীতিবিদদের হাতে এবং এ ব্যপারে বড় কোন পরিবর্তনের জন্য আমাদের রাজনীতিবিদদের দিকে চেয়ে থাকতে হবে। অন্যদিকে, বিজ্ঞানের সুবিধা সবাই গ্রহন করলেও , এ সংবেদনশীল জায়গায় বিজ্ঞানকে নীরব দর্শকের ভূমিকাই পালন করে যেতে হবে ।
@সংশপ্তক,
আপনার বিশ্লেষণ চমৎকার লাগল।
@সংশপ্তক, thumbs up 🙂
দারূণ। সাংঘাতিক বিশ্লেষণ। ধীরগতিতে প্রত্যেকের পড়া উচিত। তারপর এই নিবন্ধটি নিজ নিজ ধর্মের আলোকে মূল্যায়ন করা যেতে পারে।
@নৃপেন্দ্র সরকার,
অনেক ধন্যবাদ এভাবে উৎসাহ দেয়ার জন্য। আসলে লেখাটায় কিছু বিষয় সংযোজন- বিয়োজন করার ছিল যা আর কখনো হয়ে উঠার সম্ভাবনা দেখা না দেয়ায় আর আদিল ভাইয়ের লেখাটা পড়ার পর মনে পড়ায় দিয়ে দিলাম।
খুব সুন্দর বিশ্লেষন হয়েছে। লেখাটি অনেক ভাল লাগলো। এক লেখার মাধ্যমে মোটামুটি প্রধান ধর্মগুলোর মিলগুলো এবং এদের অসারতা ভাল ভাবে উঠে এসেছে। আমার মতে এ ধরণের লেখাই বেশি করে মুক্তমনায় আসা উচিত। ধন্যবাদ লেখককে।