ঈশ্বরবাদ খণ্ডন
মূল : ড্যান বার্কার
অনুবাদ : সৈকত চৌধুরী
Dan Barker আমেরিকার মুক্তচিন্তা এবং সেক্যুলার আন্দোলনের অত্যন্ত পরিচিত মুখ। তিনি Freedom From Religion Foundation -এর Public Relation Director । একসময়কার খ্রিস্টান মিশনারিজের সদস্য (দীর্ঘ উনিশ বছর খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কাজে নিয়োজিত), পরবর্তীতে অনেক ঘটনাবহুল পথ অতিক্রম করে মুক্তচিন্তা আর যুক্তির পতাকাতলে সহযাত্রী। তাঁর লেখা Losing Faith in Faith: From Preacher to Atheist গ্রন্থের পাতায় পাতায় সেই দুঃসাহসিক অভিযাত্রার কথাই বর্ণিত হয়েছে, জয়ধ্বনি করেছেন মানবতাবাদের।
আলোচ্য প্রবন্ধটি Dan Barker -এর স্বহস্তে পাঠানো Losing Faith in Faith: From Preacher to Atheist (FFRF, Inc. Wisconsin, USA, 2003) গ্রন্থ থেকে অনুমতিক্রমে “Refuting God” পরিচ্ছেদের অনুবাদ। উল্লেখ্য “Refuting God” পরিচ্ছেদটি লেখকের গোটা বইটিরই সারসংক্ষেপ। সংঙ্গতকারণেই এই পরিচ্ছেদে অনেক আলোচনা সংক্ষিপ্তাকারে বলা হয়েছে; এবং লেখক অন্য পরিচ্ছেদগুলিতে বিস্তৃত পরিসরে পেশ করেছেন। কিন্তু আলোচ্য প্রবন্ধটিকে যুক্তি’র পাঠকদের কাছে সহজবোধ্য-বোধগম্য করার জন্য অনুবাদক প্রথম বন্ধনীর ভিতরে নিজস্ব মন্তব্য যোগ করেছেন।–সম্পাদক, যুক্তি।
( এ অনুবাদটি অনন্ত বিজয় দাশ কর্তৃক সম্পাদিত যুক্তি ম্যাগাজিন, সংখ্যা ৩ এ প্রকাশিত)
——————————————————————————–
ঈশ্বরবাদীরা বা আস্তিকরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব দাবি করেন। নাস্তিকরা তা করেন না। ধর্মবাদীরা প্রায়ই নাস্তিকদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ে দেন ‘ঈশ্বর নেই’- প্রমাণ করার জন্য; কিন্তু এটা আলোচনার বিষয়বস্তুর বাইরে চলে যায়। নাস্তিকরা দাবি করেন ঈশ্বরের আস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না, তারা বলেন না যে ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।’ (যা প্রমাণিত-ই হয় নাই তাকে মিথ্যা প্রমাণের প্রয়োজন নেই, তা যে ‘প্রমাণিত নয়’ তা-ই এর অগ্রহণযোগ্যতার জন্য যথেষ্ট)। আর যে কোনো বিতর্কে “Burden of Proof” বা প্রমাণের দায়িত্ব এর নিয়মানুসারে যিনি কোনো কিছুর অস্তিত্ব দাবি করেন, প্রমাণের দায়িত্ব তার উপরই বর্তায়। (এবং কোন কিছুর অস্তিত্ব প্রমাণের পরই কেউ এর অনস্তিত্ব প্রমাণের জন্য চ্যালেঞ্জ করার অধিকার রাখেন)। একজন লোক যদি দাবি করেন তিনি antigravity device বা অভিকর্ষ-বিরোধী যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন তবে ‘এর অস্তিত্ব বাস্তবে অসম্ভব’- তা প্রমাণের দায়িত্ব অন্য কারো উপর পড়ে না। (দাবিকারক নিজে যদি প্রথমে বিষয়টিকে প্রমাণ করতে না পারেন তবে তা-ই একে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে)।
কিছু নাস্তিক বা নিরীশ্বরবাদী মনে করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ‘ঈশ্বর’ বিষয়টি প্রমাণিত বা বোধগম্য না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ নিয়ে বিতর্কের কোনো মানে হয় না। ‘আত্মা’ এবং ‘অতিপ্রাকৃত’ এগুলোর মত বিষয়গুলো বাস্তবে অর্থপূর্ণ কিছুই প্রকাশ করে না, এবং ‘সর্বজ্ঞানী’ ও ‘সর্বশক্তিমান’ ধারণাদ্বয় পরস্পরবিরোধী (অমূলক); কেন অর্থহীন বিষয় নিয়ে আলোচনা।
তথাপি আস্তিকতামূলক যুক্তি ও প্রমাণের উপর ভিত্তি করে অনেক লিখিত-অলিখিত বক্তব্য পাওয়া যায়। নিন্মোক্ত বর্ণনায় ঐগুলোকে সংক্ষেপে উপস্থাপনপূর্বক খণ্ডন করা হয়েছে। নাস্তিকতা হল একটি নির্দিষ্ট অবস্থান যেখানে এ ধরনের আস্তিকতামূলক দাবি নাকচ হয়ে যায়।
ঐশ্বরিক পরিকল্পনা
“এগুলো সব কোথা থেকে এসেছে? আপনি কিভাবে মহাবিশ্বের এ জটিলতা ব্যাখ্যা করবেন? আমি বিশ্বাস করি না প্রকৃতির সৌন্দর্য শুধুমাত্র দুর্ঘটনার মাধ্যমে হতে পারে। শিল্পকর্মের জন্য একজন শিল্পীর প্রয়োজন।”
এ ধরনের উক্তি থেকে অনুমান করা যায় বক্তা কী প্রমাণ করতে চাচ্ছেন। কোনো কিছু প্রমাণের জন্য এর চেয়ে উচ্চতর সঙ্গতিপূর্ণ ‘বর্ণনা প্রসঙ্গ’ আনলে উক্ত বিষয়টি বোধগম্য হতে পারে; একটি মহাবিশ্বের ব্যাখ্যার জন্য একটি ‘উচ্চতর মহাবিশ্ব’ প্রয়োজন। কিন্তু মহাবিশ্ব হল সবকিছুর মিলিত রূপ যার চেয়ে উচ্চতর কিছু নাই। আর সমস্যার বিষয় হল, মহাবিশ্বের জন্য যদি একজন স্রষ্টা প্রয়োজন হয় তবে স্রষ্টার জন্যও অপর একজন স্রষ্টার প্রয়োজন হবে -যা এমনভাবে অনন্তকাল পর্যন্ত চলতে থাকবে। ঈশ্বরের মন অন্তত প্রকৃতির মত জটিল হতে হবে এবং তা কিছু প্রশ্নের উদ্রেক করে -যেহেতু যে কোনো জটিলতার জন্য একজন স্রষ্টা প্রয়োজন তাই ঈশ্বরের মন তথা ঈশ্বরেরও একজন স্রষ্টা প্রয়োজন। আর যদি ঈশ্বর অসৃষ্ট হতে পারেন তবে মহাবিশ্ব অসৃষ্ট হতে পারবে না কেন?
প্রকৃতিতে শিল্পকর্ম রয়েছে, কিন্তু যখন তা বলা হয় তখন আস্তিকরা বা ঈশ্বরবাদীরা ভিন্ন অর্থে এটি গ্রহণ করেন। প্রকৃতিতে উপলব্ধ শিল্পকর্মের জন্য বুদ্ধিমান কিছুর অস্তিত্ব কল্পনা করার প্রয়োজন নেই। জীবন হল নির্জীব “Natural Selection” -এর ফসল; এর কোন উচ্চতর ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।(পৃথিবীর পরিবেশ জীবকূলের উৎপত্তি ও বিকাশের জন্য অত্যানুকূল হওয়ায় তা-ই ঘটেছে আবার কোন বিরূপ ঘটনায় তা সহজেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। প্রাণীকূলের উৎপত্তি, বিকাশ, ধ্বংস, বুদ্ধিমত্তা কোনোটাই চেতনাহীন প্রকৃতির কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। মানুষের বুদ্ধিমত্তা বা সভ্যতা নিজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, প্রকৃতির কাছে নয় -এটা স্মরণ রাখা প্রয়োজন। আর মহাবিশ্বকে শৃঙ্খলাপূর্ণ বলা অজ্ঞতার পরিচায়ক। মহাবিশ্বে প্রচণ্ড বিশৃংখলা বিরাজমান আর এরকম বিশৃঙ্খলার মধ্যে কিছু শৃঙ্খলা এমনিতেই দেখা যেতে পারে যা ঐ বিশৃঙ্খলারই অংশ) ।
ঈশ্বরবাদী বা আস্তিকদের ‘শিল্পকর্ম বিতর্ক’টি দাঁড়িয়ে আছে অজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে, বাস্তবতার উপর নয়। প্রকৃতির কোনো জটিলতাকে ব্যাখ্যা করতে না পারার মানে এই নয় যে এর কোনো উত্তর নেই। হাজার বছর ধরে মানুষ বজ্র ও উর্বরতার রহস্য বর্ণনার জন্য পৌরাণিক বা কাল্পনিক ব্যাখ্যা তৈরি করেছে। কিন্তু যত বেশি আমরা জানতে পারছি, ততই ঈশ্বরের প্রয়োজন কমে যাচ্ছে। (যেমন, ইদানীং ‘পানিচক্র’ ব্যাখ্যার জন্য এখন আর কেউ ঈশ্বরের শরণাপন্ন হন না)। ‘ঈশ্বর বিশ্বাস’ হলো একটি রহস্য ব্যাখ্যার জন্য আরেক রহস্যের অবতারণা, এবং তাতে কোনো রহস্যেরই সমাধান পাওয়া যায় না। (আমরা যদি প্রকৃতির কোনো ঘটনা না বুঝি তবে যথাযথ নিয়মানুসারে গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে অথবা অপেক্ষা করতে হবে, বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে কী বলেন। অবশ্য বিজ্ঞানীকেও বিজ্ঞানের নিয়মানুসারে গবেষণা ও তা ব্যাখ্যা করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ঘটনার উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না পাওয়া যায় ততক্ষণই আমাদেরকে অপেক্ষায় থাকতে হবে, হতে পারে এ অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ আবার তা হতে পারে স্বল্প। কিন্তু পূর্বেই যদি কেউ ‘ঈশ্বর’ বা অনুরূপ কোনো অতিলৌকিক অনুকল্পের অবতারণা করে ব্যাখ্যা করতে চান তবে এই অতিলৌকিক অনুকল্পটি প্রমাণের দায়িত্ব তারই; আর যদি তিনি প্রমাণ করতে না পারেন তবে তা অগ্রহণযোগ্য এবং দাবিটি ভিত্তিহীন হয়ে দাঁড়ায়। বলা বাহুল্য এখনো কেউ ঈশ্বর বা অনুরূপ কিছুর অস্তিত্বের স্বপক্ষে কোনো নিখুঁত যুক্তি বা প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। প্রমাণের নামে যা উপস্থাপিত হয়েছে তা শুধুই বাজে কথা)।
“এ মহাবিশ্ব প্রাকৃতিক বিধান দ্বারা পরিচালিত। বিধানের জন্য প্রয়োজন একজন বিধান দাতা বা বিধাতা। তাই নিশ্চয়ই একজন ঐশ্বরিক নিয়ন্ত্রক রয়েছেন।”
প্রাকৃতিক নিয়ম একটি বর্ণনা-মাত্র, তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিধান বা নির্দেশ নয়। (A natural law is a description, not a prescription)। মহাবিশ্ব কোনোকিছু দ্বারা বা নির্দেশ অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে না। ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’ মানুষের তৈরি ধারণা মাত্র, যা প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনাবলী মানুষের কাছে বোধগম্য করে তুলে; এটি সামাজিক নিয়মকানুনের মত কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচরণগত নির্দেশনা নয়। (আজকে কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা যেভাবে ঘটে থাকে, যেমন পৃথিবীর আহ্নিক গতি বা বার্ষিক গতি, ঐ ঘটনা যদি ভিন্নভাবেও ঘটতো – তবে আমরা তাকেও বলতাম ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’)। যদি ঐশ্বরিক পরিকল্পনা ধারণা সঠিক হয় তবে তা সমভাবে ঈশ্বরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ঈশ্বরকেও কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া প্রয়োজন। (তা না হলে ঈশ্বর একটি ‘বিশৃঙ্খল ধারণায়’ পতিত হবে)।
“এটি অপ্রমাণিত যে জীবনের জটিলতা দুর্ঘটনার মাধ্যমে উদ্ভূত; এবং তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রানুসারে সকল সিস্টেম বিশৃঙ্খলার দিকে ধাবিত হয় তা বিবর্তনকে অসম্ভব করে তুলে। তাই অবশ্যই স্রষ্টার অস্তিত্ব রয়েছে।”
এই ছদ্ম-বৈজ্ঞানিক আপত্তি বিজ্ঞানের ভ্রান্ত ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করে বানানো হয়েছে। কোনো জীববিজ্ঞানীই দাবি করেননি, বর্তমানের প্রাণীগুলি হঠাৎ করে সংঘটিত এক ধাপ দুর্ঘটনাজনিত ‘মিউটেশন’-এর ফলে উদ্ভূত হয়েছে। বিবর্তন দীর্ঘ সময় ধরে ছোট ছোট ক্রমপরিবর্তনের ফসল, যার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ প্রজাতি পরিবেশের সাথে খাপ খেয়েছে; যেমন মানুষ বিকশিত না হয়ে অন্য সহস্র-কোটি সম্ভাবনার একটি হতে পারত যা প্রাকৃতিক নির্বাচনের নির্মমতার মধ্যে হয়ত টিকে থাকতে সমর্থ হত। সম্ভাবনার নিয়মানুসারে এবং বাস্তবতার নিরিখে, ধর্মবাদীদের বিষয়টি এরকম -যেন কোনো লটারি বিজয়ী বলছে, ‘লটারি বিজয়ের সম্ভাব্যতা খুবই কম, তাই আমি তা জিততে পারি না।’
সৃষ্টিবাদীরা প্রায়ই তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রটিকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করে থাকেন। এ সূত্রানুসারে ‘বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায় একটি বদ্ধ সিস্টেমের মধ্যে।’ কিন্তু সাধারণভাবে পৃথিবী একটি মুক্ত ব্যবস্থা। তা সূর্য থেকে শক্তি পাচ্ছে। পৃথিবীর ব্যবস্থাগুলো সৌরশক্তি দ্বারা চালিত হচ্ছে, শক্তির রূপান্তর হচ্ছে। শেষে আবার ঐ শক্তি ভিন্নরূপে পৃথিবী থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। (তাই পৃথিবীকে বদ্ধ সিস্টেম ভেবে একে তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের সাথে তুলনা করা সঙ্গতিপূর্ণ নয়)। আবার কখনো হয়তো সূর্য ঠাণ্ডা হবে এবং এতে বা অন্য কোনো কারণে পৃথিবীর জীবজগত বিলীন হয়ে যাবে।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
“লক্ষ লক্ষ লোক ব্যক্তিগতভাবে ঈশ্বরকে আত্মিক অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি দ্বারা জানে।”
বেশিরভাগ ঈশ্বরবাদী দাবি করেন তাদের স্বতন্ত্র ঈশ্বরকে ধ্যান বা প্রার্থনা দ্বারা জানতে পারা যায়; কিন্তু এ ধরনের অভিজ্ঞতা মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া (বিভ্রম) ছাড়া আর কিছুই নয়। অতীন্দ্রিয়বাদকে জটিল করার প্রয়োজন নেই। অনেকে এমনিতেই গুজব তৈরি করতে পছন্দ করেন, অলীক শব্দ শুনতে পান, কল্পিত বস্তু দেখা অথবা কাল্পনিক কারো সাথে কথা বলার দাবি করেন। এগুলো বাস্তব কিছু নয়। ঈশ্বর-বিশ্বাসীর পরিমাণ অসংখ্য কিন্তু এটি মানুষের ব্যাপার, ঈশ্বরের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত নয়। ‘সত্য’ জনসমর্থন দ্বারা নির্ধারিত হয় না। ধর্মগুলো উদ্ভূত হয়েছে মৃত্যু, দুর্বলতা, স্বপ্ন এবং অজানার প্রতি ভয়কে কেন্দ্র করে।
“নাস্তিকদের আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টির অভাব রয়েছে তাই তাদের কাছে আস্তিকদের ঐশ্বরিক অনুভূতি বোধগম্য নয়। এটি একজন বর্ণান্ধ ব্যক্তির রঙের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার মত।”
অনেক আস্তিক বা ঈশ্বরবাদী দাবি করেন ঈশ্বরকে বিশেষ ‘আধ্যাত্মিক’ উপলব্ধির দ্বারা জানা সম্ভব। কিন্তু এ ধরনের উপলব্ধি কি ভিন্ন কোনো জগৎ হতে আসে কিংবা তা বোঝার জন্য ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়’-এর প্রয়োজন? সংশয়বাদীরা এ ধরনের বিশ্বাসকে নাকচ করে দেন। বর্ণান্ধরা কখনো রঙের উপস্থিতিকে অস্বীকার করেন না তাই ধর্মবাদীদের তুলনাটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বর্ণান্ধ ও বর্ণদৃষ্টিক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা একই পৃথিবীতে বসবাস করে এবং উভয়ই প্রাকৃতিক নিয়মগুলোকে আয়ত্ব করে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও বর্ণালী দ্বারা দৃষ্টি ব্যতীতই ‘বর্ণ’ ব্যাখ্যা করা সম্ভব। (তাছাড়া দেখা যায়, অনেক নাস্তিক জীবনের প্রথমাংশে আস্তিক ছিলেন। কোনো কোনো নাস্তিক তখন আস্তিকদের মতোই তথাকথিত আধ্যাত্মিক অনুভূতি উপলব্ধি করতেন। আস্তিক-নাস্তিক উভয়ের উপলব্ধি ক্ষমতা ও প্রক্রিয়া একই ধরনের এবং কারোই পঞ্চ ইন্দ্রিয় ব্যতীত অতিরিক্ত কোনো দৈহিক বা মানসিক ইন্দ্রিয় নেই। নাস্তিকরা যুক্তিবাদী আর আস্তিকরা পরিবার বা সমাজ তথা পরিবেশ থেকে ধর্মীয় অযৌক্তিক ধারণা পেয়ে থাকেন ও যাচাই-বাছাই না করেই তা গ্রহণ-পালন ও চর্চা করে থাকেন। বিধায় আস্তিকদের ‘বৌদ্ধিক অন্ধ’ বলা যায় – যে অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন মুক্তবুদ্ধির চর্চা। এছাড়া আস্তিকদের অভিযোগটি যদি ঠিকও হত তবে নাস্তিকদের কোনভাবেই অপরাধী বলা যেত না – যা ধর্মীয় ধারণার সাথে সংঘর্ষিক) ।
কোনো ধর্মবাদী ব্যক্তি আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টির কোনো নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা প্রদান করেন না, ফলে তা প্রথমেই দার্শনিক বৈধতা হারায়। কোনো সংশয়বাদী ‘মানসিক ধর্মীয় অভিজ্ঞতাকে’ অস্বীকার করেন না কিন্তু তারা জানেন তা শুধু অতীন্দ্রিয় জগৎ সম্পর্কে গভীর বিশ্বাসের ফলেই ঘটেছে, যার ব্যাখ্যা মনোবিজ্ঞান দিতে পারে। আর আস্তিকরাই শুধু ‘সম্পূর্ণ মানুষ’ এ ধারণা অবৈজ্ঞানিক, উদ্ধতপূর্ণ ও হাস্যকর।
নৈতিকতা
“আমাদের সবারই ভালো ও মন্দের ধারণা তথা বিবেকবোধ আছে যা আমাদের উচ্চতর আইনের অধীন করে দেয়। বিশ্বজনীন নৈতিকতার আকাঙ্ক্ষা মানবতার ঊর্ধ্বে কিছু ইঙ্গিত করে। এটি ঈশ্বরের সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ যা অদৈহিক এবং আমাদের ঐরকম মহিমান্বিত প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত করে।”
আরেকটি ‘অজ্ঞতাভিত্তিক ভুল যুক্তি’। নৈতিক প্রক্রিয়া মানুষের জীবন ধারণের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে : যা জীবনকে সমৃদ্ধ করে তাই ভালো আর যা জীবনকে ব্যাহত করে তাই মন্দ। মিথ্যা বলা বা চুরি করা অপরাধ তা বোঝার জন্য দৈব নির্দেশের প্রয়োজন নেই। কোন আচরণ যৌক্তিক অথবা সদয়চিত্ত তা বোঝার ক্ষমতা মানুষের রয়েছে।
‘বিশ্বজনীন নৈতিকতা বোধ’ বলতে আসলে কিছু নেই এবং সব নৈতিকতা পরস্পরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বহুবিবাহ, নরবলি, নরমাংসভোজন, স্ত্রী পেটানো, অঙ্গহানি করা, যুদ্ধ, খৎনা, খোজাকরণ এবং অজাচার অনেক জাতির সংস্কৃতিতে যথারীতি নৈতিক এবং প্রচলিত। তাহলে ঈশ্বর কি বিভ্রান্ত?
ঈশ্বরকে ‘অদৈহিক’ বলা অসঙ্গতিপূর্ণ। সময় এবং স্থানের মধ্যে যে কোনো কিছুকেই কোনো এক রূপে থাকতে হয়। (দৈহিক আকার ব্যতীত কোনো সচেতন সত্তা আমাদের ধারণায় অসম্ভব, তাই ঈশ্বরের এরূপ ধারণা আমাদের কাছে অমূলক এবং দার্শনিকভাবে অবাস্তব)। নৈতিক মূল্যবোধ আমাদের দৈহিক মস্তিষ্কে নিরূপিত, তাই নৈতিকতা যদি ঈশ্বরকে ইঙ্গিত করে তবে আমরাই ‘ঈশ্বর’। ঈশ্বরের ধারণা কেবল একটি মানবিক প্রক্ষেপণ মাত্র।
“যদি কোনো পরম নৈতিক আদর্শ না থাকে তবে চূড়ান্ত অর্থে কোনো ন্যায় বা অন্যায় থাকবে না। ঈশ্বর ব্যতীত নৈতিক ভিত্তি ও সামাজিক শৃঙ্খলা দুর্বল হয়ে পড়বে।”
এটি ঈশ্বরকে ‘বিশ্বাসের’ জন্য করা উক্তি, ঈশ্বরের ‘অস্তিত্ব’ প্রমাণের জন্য নয়। পরম নৈতিকতার দাবি আসে বিপদজনক ধর্মবাদীদের কাছ থেকে। প্রাপ্তবয়ষ্ক সচেতন লোকেরা মানুষের জন্য যা কল্যাণকর তার প্রতি ঝোঁক প্রদর্শন করেন, কেননা এটাই সঙ্গতিপূর্ণ, যৌক্তিক এবং নৈতিক মানবিক গঠন কাঠামোর প্রতি দিক নির্দেশ করে, দৈব অস্তিত্ব ছাড়াই। (আর কোনো ভালো কাজ করার জন্য আমাদেরকে যদি স্বর্গের প্রলোভন এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য নরক বা ঈশ্বরভীতির প্রয়োজন হয় তবে আর কিসের মনুষ্যত্ব?)
কোনো ধর্মগ্রন্থ কোনো একটি ভালো আইনকে সমর্থন করতে পারে কারণ ঐ ধর্মগ্রন্থ তৈরির সময় অনেক মানবিক আইন ও মূল্যবোধের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে। এখানে বাইবেলের তথাকথিত দশটি আদেশের কথা বলা যায়। উন্নত দেশগুলোর আইন ও সংবিধান সংগত কারণেই ধর্মনিরপেক্ষ (এবং অনেক ধর্মের ধর্মীয়-বাণীর তুলনায় বেশি মানবিক)।
এমন কোনো প্রমাণ নেই যে আস্তিকরা নাস্তিকদের চেয়ে অধিক নৈতিক। বাস্তবিকপক্ষে এর উল্টোটাই বোধ হয় সঠিক; যা শতবর্ষ ধরে ধর্মীয় হিংস্রতা ও নাস্তিকদের মানবতাবোধ থেকে টের পাওয়া যায়। অধিকাংশ নাস্তিকই সুখী, সৃজনশীল ও নৈতিক ব্যক্তি। (সকল ধর্মের যেহেতু নিজস্ব ঈশ্বর রয়েছে এবং প্রতিটি ধর্মের বিভিন্ন শাখার মধ্যে ঈশ্বর বা ধর্মের ধারণা ভিন্ন তাই তা শৃঙ্খলার পরিবর্তে সমাজে শুধু বিশৃঙ্খলাই সৃষ্টি করে।)
আস্তিকদের দাবি যদি সঠিক হতো তারপরও তা খুব একটা প্রয়োগসিদ্ধ হত না। ধর্মপ্রাণ শাস্ত্রবিশ্বাসীরা শাস্ত্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর একমত হন না। বিশ্বাসীরা প্রায়ই শান্তিবাদ, গর্ভনিরোধ, পশু অধিকার, পরিবেশ রক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমকামীদের অধিকার, নারী অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলোর বিরোধিতা করেন। আস্তিকদের নৈতিকতার টানাপোড়ন দেখে এটাই মনে হয় হয়তো তাদের বহু সংখ্যক ঈশ্বর রয়েছেন যারা নৈতিক উপদেশ প্রদানের ব্যাপারে দ্বন্ধে রয়েছেন অথবা মাত্র একজন ঈশ্বর রয়েছেন যিনি নৈরাশ্যজনকভাবে বিভ্রান্ত।
আদি কারণ
“সব কিছুরই কারণ আছে এবং সব কারণ এর পূর্ব কারণেরই ফল, তাই সবকিছুর একটি আদিকারণ আছে। ঈশ্বর হলেন সেই আদি কারণ, বিশ্বের স্রষ্টা ও ধারক”।
বিতর্কের মূল ভিত্তি হল -‘সবকিছুর কারণ আছে’ এবং তা সিদ্ধান্ত বা ফলাফল – ‘ঈশ্বরের কোনো কারণ নেই’- এর সাথে সাংঘর্ষিক। বিতর্কের ভিত্তি থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না, কারণ সবকিছুর যদি কারণ থাকতেই হয় তবে অবশ্যই কোনো ‘আদিকারণ’ দাঁড় করানো যায় না। যদি ঈশ্বরের কোনো কারণ বা স্রষ্টা নেই ভাবা যায় অথবা কোনো স্রষ্টা ছাড়াই ঈশ্বরের আবির্ভাব হয়েছে এরকম ভাবতে হয় তবে মহাবিশ্বের কোনো কারণ বা স্রষ্টা নেই ভাবতে সমস্যা কোথায়? (আমরা প্রতিটি ক্রিয়া বা ঘটনার অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন কারণ দেখতে পাই। একটি ঘটনার অনেকগুলো কারণ আমরা সচরাচর দেখতে পাই। তাহলে বহুসংখ্যক আদিকারণের ধারণা একইভাবে উত্থাপন করা যায়। এছাড়া ‘মহাবিশ্বের কারণ’ বিষয়টি বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়। এ ব্যাপারে ভাবতে হলে মহাবিশ্ব সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখা প্রয়োজন। তাই বিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্বারা যখন যে সিদ্ধান্ত দিবেন আমাদেরকে তা-ই বুঝতে হবে)। এমন কোনো সত্তা আমাদের অভিজ্ঞতায় নেই যিনি ‘অকারণিত কারণ’ হতে পারেন। তাই আমরা ঈশ্বরের ব্যাপারে এমন সিদ্ধান্তে যেতে পারি না কারণ আমরা আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করেই সিদ্ধান্ত নেই বা নিতে পারি।
প্যাসকেলের বাজি
“ঈশ্বরকে প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু যদি ঈশ্বর থাকে তাহলে বিশ্বাসীরা সব কিছু পেয়ে যাবেন (Heaven বা স্বর্গ) আর অবিশ্বাসীরা সব কিছু হারাবে (Hell বা নরক)। ঈশ্বর যদি না থাকেন তবে সেজন্য বিশ্বাসীরা কিছুই হারাবে না এবং অবিশ্বাসীরাও কিছু পাবে না। সুতরাং ঈশ্বরকে বিশ্বাসের মাধ্যমে সবকিছুই অর্জন করা যায় এবং তাতে কিছুই হারানোর নেই।”
আর্গুমেন্টটি প্রথমে প্রদান করেছিলেন ফরাসি দার্শনিক ব্লেইস প্যাসকেল, যা কোনো যুক্তি নয়, স্রেফ হুমকি মাত্র। এটি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য নয় বরং তার অস্তিত্বে বিশ্বাসের জন্য অযৌক্তিক ভয়ের উপর ভিত্তি করে গঠিত ভুল ধারণা। এ ধরনের উক্তি দ্বারা আমরা ধর্মকে শুধু ‘নরকের মন্দ ধারণা’র সাথে গুলিয়ে ফেলি।
এটি সত্য নয় যে বিশ্বাসীরা কিছুই হারায় না। প্রমাণের পূর্বেই বিশ্বাসের দ্বারা আমরা পরকালের মিথ্যাগুলোকে ধারণ করে জীবনকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিই, এবং মিথ্যাকে বজায় রাখার জন্য সত্যকে জলাঞ্জলি দিই। ধর্ম প্রচুর মূল্যবান সময়, শক্তি এবং অর্থ নষ্ট করে। (একটিবার নির্মোহ হয়ে হিসেব করে দেখুন, মুসলমানরা মসজিদ বানাতে, অথবা প্রতি বছর হজের সময়, কোরবানি দিতে কিংবা হিন্দুরা মন্দির বানাতে, ঝাঁকঝমক করে দূর্গা পূজা করতে কি পরিমাণ অর্থের অপচয় ঘটিয়ে থাকেন। ভয়াবহ রকমের এত অর্থ খরচের কি বিকল্প পথ খোলা নেই? এই অর্থ কি নিজেদের মানবিক চাহিদা পূরণ, জ্ঞান চর্চা করা অথবা গরীবকে সহযোগিতা করার জন্য ব্যয় করা যেত না?)। ধর্মীয় জগতকে সমৃদ্ধ করার জন্য অনেক মূল্যবান জীবনের অপচয় ঘটে। ধর্মবিশ্বাস মানুষকে নিপীড়নের হাতিয়ার, ব্যক্তি-স্বাধীনতার প্রতি হুমকিস্বরুপ।
এটাও ঠিক নয় যে অবিশ্বাসীরা (তাদের অবিশ্বাসের জন্য) কিছুই অর্জন করেন না। ধর্মকে প্রত্যাখানের মাধ্যমে তারা একটি ইতিবাচক উদার ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করেন এবং স্বাধীন অন্বেষণের সুযোগ পান। নাস্তিকেরা সামাজিক ও নৈতিক উন্নতির বিষয়ে সর্বদাই অগ্রবর্তী। (একজন নাস্তিক মনে করেন আমরা মানুষেরা এই পৃথিবীর বাসিন্দা, পৃথিবীতে বসবাসকারী আরো মিলিয়ন মিলিয়ন প্রাণীর মত আমরাও এই পৃথিবী থেকে রঙ, রূপ, রস, খাদ্য গ্রহণ করে বেঁচে আছি। এই পৃথিবী কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এটা আমাদের সকলের। জন্মেছি এই সুজলা সফলা শস্য শ্যামলা এই ধরণীতে, মৃত্যুর পর অন্য কোনো স্থান নেই, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এখানেই জীবনের সমাপ্তি, তাই এই পৃথিবীকে আমাদের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থ-সুন্দর করে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে আমাদেরই। বলাবাহুল্য আস্তিকেরা এই চেতনার বিপরীতে অবস্থান করেন।)
কোন ধরনের মানুষ অনন্তকাল নরক ভোগের উপযুক্ত-একজন সত্যের পথের পথিক? ঈশ্বর যদি এমন অবিচারী-অবিবেচক হন তবে আস্তিকরাও এখানে নাস্তিকদের মতই বিপদের মধ্যে রয়েছেন। এমন কী হতে পারে না, ঈশ্বর সকলকে নরকে পাঠাতে চাচ্ছেন বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী নির্বিশেষে। অথবা ঈশ্বর শুধু তাদেরই রক্ষা করবেন যারা অবিশ্বাস করার মত সাহস রাখে।
প্যাসকেল একজন ক্যাথলিক খ্রিস্টান এবং অনুমান করেছিলেন যে ঈশ্বর বলতে শুধু খ্রিস্টানদের ‘ঈশ্বর’ বোঝায়। তবে যদি অন্য কোনো ধর্মের ঈশ্বর সঠিক হয় তাহলে সুবিধা লাভের জন্য যে ঝুঁকি প্যাসকেলের বাজির মধ্যে রয়েছে তা আশাতীতভাবে ব্যর্থতায় প্রতিপন্ন হয়।
যে কোন দৈব বিশ্বাস যদি ভয়ের উপর নির্ভরশীল হয় তবে তা প্রকৃত ভক্তির উদয় করে না এবং এরকম একটি বিষয় উপাসনার যোগ্য হতে পারে না। (আর একজন ব্যক্তি যদি মুক্তভাবে গভীর চিন্তার পর ঈশ্বরকে অবিশ্বাস করেন তবে ঈশ্বর যদি থেকেও থাকেন তবুও তার কোনো অধিকার থাকবে না ঐ ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদানের, যদি তিনি ন্যায় বিচারক হন যেমনটি ধর্মগ্রন্থে বলা হয়।)
সত্তা সংক্রান্ত প্রমাণ
“ঈশ্বর হল এমন ধারণা, যার চেয়ে ঊর্ধ্বে আর কিছু কল্পনা করা যায় না। ঈশ্বর যদি বাস্তবে না থাকেন তাহলে তিনি হয়তো বিদ্যমান ধারণার ঊর্ধ্বে। সুতরাং ঈশ্বর আছেন।”
সত্তাসংক্রান্ত প্রমাণের ডজন খানেক রূপ আছে কিন্তু খ্রিস্ট পুরোহিত আনসেল্ম একে উপরোক্ত রূপ দিয়েছেন। এই যুক্তিবিন্যাসের ক্রটি হল তা বিমূর্ত গুণকে বাস্তবে আরোপিত করেছে। কোনো কিছুই অস্তিত্ব সম্পন্ন হওয়ার পূর্বেই ‘মহান’ বা ‘উৎকৃষ্ট’ হতে পারে না। কিন্তু এ যুক্তিতে তাই করা হয়েছে বা ধরা হয়েছে।
যে কোনো ‘অস্তিত্ব’কে ‘ঈশ্বর’- এ প্রতিস্থাপন হল এ ধরনের যুক্তিবিন্যাস প্রদর্শনের একটি উত্তম উপায়। আপনি এভাবে নিখুঁত শূন্যতাকেও প্রমাণ করতে পারেন যেখানে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। যুক্তিটি নিজে নিজেই ভেঙ্গে পড়ে। কারণ ঈশ্বরকে সবদিক থেকে অসীম ধরা হয় যা আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতায় নেই; তাই এ রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ দার্শনিকভাবে ভুল। কোনো কাল্পনিক ধারণা পোষণ করার মানে এটা নয় যে বিষয়টির কোনো বাস্তবতা আছে। ঈশ্বরের অস্তিত্বটি ধারণায় না হয়ে বাস্তবে হল কিভাবে? এটি আশ্চর্যের বিষয় নয় যে বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন সত্তাসংক্রান্ত প্রমাণটি ভুল ব্যাকরণের ফসল।
প্রত্যাদেশ
“আমাদের ধর্মগ্রন্থ ঐতিহাসিকভাবে নির্ভরযোগ্য। এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণগুলোর উপর সন্দেহ পোষণ করা যায় না। ঈশ্বর বাস্তবে রয়েছেন কেননা তিনি এগুলোর মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছেন।”
ধর্মগ্রন্থগুলো অন্যান্য গ্রন্থের তুলনায় একেবারেই সাধারণ, শুধু এটাই যে ধর্মগ্রন্থগুলোতে ‘অলৌকিকতা’ আরোপ করা হয় আর অন্যান্য গ্রন্থে তা করা হয় না। শাস্ত্রগুলোকে বিশ্বাস করতে হলে অনেক অলৌকিক বিষয় চলে আসে; যেমন দেবদূত ঈশ্বরের কাছ থেকে তা নিয়ে এসে আরেকজনের কাছে তা পৌঁছে দিচ্ছেন যা একজন বাস্তববাদী মেনে নিতে পারেন না। টমাস পেন ‘দ্য এইজ অফ রিজন’-এ উল্লেখ করেছেন ধর্মশাস্ত্র প্রত্যাদেশ হতে পারে না। প্রত্যাদেশ (যদি বাস্তবে থাকত) কিছু মানুষের সাথে সরাসরি দৈব যোগাযোগ, যদি প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তা বর্ণনা করে তবে তারা এতে দ্বিতীয় ব্যক্তি বলে পরিগণিত হবেন। কেউই তা মানতে বাধ্য নন বিশেষত যদি তাতে উদ্ভট কাল্পনিক বিষয় যাকে। আর শাস্ত্রগুলো ঐতিহাসিকভাবে মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়। কিছু কিছু শাস্ত্র ধর্মপ্রচারেকের মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল ধরে লিপিবদ্ধ হয়েছে, তখন তার নানা অংশ বাদ পড়েছে, নতুন অনেক কিছু সংযোজিত হয়েছে এবং অনেকাংশে পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়গুলো গোঁড়া ধমবিশ্বাসীরা মানতে নারাজ এমনকি এর ঐতিহাসিক দলিল থাকলেও। এছাড়া ধর্মশাস্ত্রগুলো তা তৈরি হওয়ার সময়কালীন প্রচলিত সমস্যা, কাহিনী ও গল্পে ভরপুর, আধুনিককালে যেগুলোর কোনো প্রয়োজনই নেই। ধর্মগ্রন্থের অনেক কথা পরস্পরবিরোধী এবং বিজ্ঞানবিরোধী-শাস্ত্রগুলোকে নির্ভুল দেখানোর জন্য ধর্মব্যবসায়ীরা নিত্যনতুন ব্যাখ্যা আবিষ্কারে সিদ্ধহস্ত। ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত ‘অলৌকিকতা’ প্রকৃতির সাধারণ নিয়মকে লঙ্ঘন করে এবং এগুলো বাস্তবে অসম্ভব সুতরাং তা অগ্রহণযোগ্য। ধর্মগুলোতে বর্ণিত কোনো জ্ঞান কিংবা বর্ণিত কোনো ইতিহাসকেও গ্রহণ করা যায় না কারণ এগুলোর স্বপক্ষে যথেষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। তাছাড়া শাস্ত্রগুলোতে অনেক ব্যাকরণগত ও তথ্যগত ভুল পরিলক্ষিত হয়।
বিজ্ঞান
“অনেক বিজ্ঞানীই ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। পৃথিবীর বেশিরভাগ ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরা যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন তবে অবশ্যই ঈশ্বরে বিশ্বাস যুক্তিসম্মত।”
এটি কর্তৃত্বের দোহাই মাত্র; নাস্তিকরা ঐ বিষয়ে তাদের চেয়ে ঊর্ধ্বে বলতে হয়। বিদ্বান শ্রেণীর লোকেরা সাধারণ মানুষের চেয়ে সচরাসচর কম ধার্মিক হন। ঈশ্বর-বিশ্বাসী বিজ্ঞানী খোঁজে পাওয়া গেলেও তাদের কেউই তাদের বিশ্বাসকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করতে পারেন না। বিশ্বাস (পেশা থেকে বিছিন্ন) একটি সাংস্কৃতিক বা ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং কেউই এমন কী একজন বিজ্ঞানীও ধর্মের অযৌক্তিক ও মায়াবী প্রলোভন থেকে সুরক্ষিত নন।
“কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানে দেখানো হয় যে বাস্তবতা অনিশ্চিত এবং কমই মূর্তমান। এখানে অলৌকিকতা চলে আসছে। আস্তিকদের জগৎ বিজ্ঞানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়।”
এটি অর্থহীন কথাবার্তা। অলৌকিকতাকে ধরা হয় প্রকৃতির নিয়মের ব্যতিক্রম হিসাবে, যা অতীন্দ্রিয় জগতকে নির্দেশ করে। যদি নতুন বিজ্ঞান অলৌকিকতাকে প্রাকৃতিকভাবে সম্ভব করে ফেলে (একটি স্ববিরোধী ধারণা) তাহলে কোনো অতিপ্রাকৃত জগৎ বা ঈশ্বর নেই। কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানে ‘অনিশ্চিয়তা’কে বাস্তবে প্রয়োগ করা হয় না; বরং বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। আস্তিকতা অতীন্দ্রিয় জগতকে ইঙ্গিত করে আর বিজ্ঞান নিজেকে প্রাকৃতিক জগতে সীমাবদ্ধ করে। তাই আস্তিকতা কখনো বিজ্ঞানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে না – সংজ্ঞা অনুসারে।
বিশ্বাস
“ঈশ্বরে বিশ্বাস বুদ্ধিবৃত্তিক নয়; যুক্তির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ঈশ্বরের সত্যতা শুধু বিশ্বাসের মাধ্যমে জানা সম্ভব, তা যুক্তিকেও ছাড়িয়ে যায়; তবে যুক্তির সাথে বিরোধ সৃষ্টি করে না।”
এটি কোনো যুক্তি নয়। এখানে স্বীকার করা হচ্ছে, যা বুদ্ধিবৃত্তিক নয় তা আলোচ্য জগৎ ছেড়ে ভিন্ন জগতে (নির্বুদ্ধিতায়) চলে যায়। আর ‘যুক্তি’ সীমাবদ্ধ; তা বাস্তবতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যদি বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন তবে আপনি কল্পনা বা স্বপ্নচারিতার দ্বারাই প্রতারিত হবেন।
বিশ্বাস হল ‘অপর্যাপ্ত বা স্ববিরোধী’ প্রমাণ সত্ত্বেও কোনো কিছুর বিবরণ শুনেই তা গ্রহণ করা, যা বাস্তবতার সাথে কখনো সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে না। বিশ্বাসের সকল দোহাই সত্ত্বেও এটি পরিষ্কার যে ধর্মীয় দাবি কখনো নিজের দু’পায়ের উপর দাঁড়াতে পারে না। ফরাসি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্ত্রে বলেছেন ‘বিশ্বাস হল এটা জানা যে আপনি বিশ্বাস করেন আর আপনি বিশ্বাস করেন এটা জানার মানে হল অবিশ্বাস করা।’
যদি কখনো এমন হয় যে আস্তিকতার একটি সঙ্গতিপূর্ণ অনুকল্প রয়েছে (বস্তুত যা নেই এখনো) তাহলে এটা এখনো প্রমাণ হবার প্রয়োজন রয়েছে। তাই অধিকাংশ আস্তিক প্রমাণ ও যুক্তিকে দূরে রেখে বিশ্বাসের প্রতি জোর দেন।
আত্মিক ক্ষমতা
“আত্মিক ক্ষমতা, পুনর্জন্ম এবং এ রকম অনেক কিছুর দৃঢ় প্রমাণ রয়েছে। আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে এখানে ভিন্ন কিছু একটা রয়েছে।”
অধিকাংশ বিজ্ঞানী (বা বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি) এরকম দাবির অনুকূলে কোন প্রমাণ রয়েছে বলে মনে করেন না। যখন সর্তকভাবে কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এগুলো পরীক্ষা করা হয় তখন এই ধরনের দাবি ভুল ব্যাখ্যা বা অবৈধ প্রতারণা বলে প্রতীয়মান হয়। (এ বিষয়ে প্রবীর ঘোষের ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’, চতুর্থ খণ্ডে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে)।
যদি তা ন্যায়সঙ্গত হয় তবে রহস্যময় ব্যাপারগুলোর নিখুঁত প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দিতে হবে। এ রকম বিষয়ে সংশয়বাদীরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সিদ্ধান্তে ঝাঁপ না দিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-পর্যবেক্ষণ-পরীক্ষণ অব্যাহত রাখেন এবং যৌক্তিকভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছেন।
উপসংহার
পরিশেষে বলা প্রয়োজন, যদি আস্তিকদের উপরোক্ত বক্তব্যগুলো এমনকি ঈশ্বরকে প্রমাণ করতো, তারপরও ঈশ্বরকে স্রষ্টা হিসেবে ব্যক্তিগত, মহোত্তম, সদয়, অথবা বর্তমানে জীবন্ত বা সক্রিয় প্রমাণ করা যায় না। এগুলোর কোনোটিই বিশৃঙ্খলা, কদর্যতা, দুঃখ, দুর্দশা, বেদনা ইত্যাদির ব্যাখ্যা দিতে পারে না বরং তার জন্য আরেকজন মন্দগুণসম্পন্ন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রয়োজন হয়।
অধিকাংশ আস্তিক বা ঈশ্বরবাদীরা যখন উপলব্ধি করতে পারেন তাদের দার্শনিক সিদ্ধান্তগুলো ব্যর্থ; তখন তারা গৎবাঁধা আক্রমণের পথ বেছে নেন। নাস্তিকদের সম্পর্কে প্রচারণা চালানো হয়, তারা অসুখী, অনৈতিক, রাগী, খ্যাপাটে, দানবীয়, নির্দয় লোক, তাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই। এই ধরনের অভিযোগ সম্পূর্ণ অসত্য এবং অন্যায্য। তবে, অভিযোগটি যদি সত্যিও হত, তাতেও কিন্তু আস্তিকদের দাবিগুলির কোনটিই সঠিক বলে প্রমাণিত হয় না।
এখন পর্যন্ত সর্তকতামূলক পরীক্ষণের মাধ্যমে দেখা গেছে ঈশ্বরবাদীদের দাবি সর্বৈব অসত্য, নাস্তিকতাই যৌক্তিক অবস্থানে বিদ্যমান।
সংজ্ঞা
ধর্ম : চিন্তা প্রক্রিয়া বা চর্চা যা দাবি করে অতিপ্রাকৃত জগতের অস্তিত্ব এবং যা কোনো মতবাদ, ধর্মশাস্ত্র এবং পবিত্রতায় আস্থা রাখতে, উপাসনা করতে বা অনুসরণ করতে বলে।
ঈশ্বর : যিনি বিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন বা পরিচালনা করছেন বলে আস্তিকরা বিশ্বাস করে। একে সাধারণত বুদ্ধিমত্তা, ইচ্ছা, জ্ঞান, ভালোবাসা এবং ঘৃণার মত মানবীয় এবং সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞতা, অমরতা, পরম দয়ালুতা, সর্বব্যাপ্তিতার মত অতিমানবীয় গুণ দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়। এই সত্তাকে প্রায়ই মানুষের সাথে কথপোকথন, বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সম্পর্কিত বলে চিত্রায়িত করা হয়। আবার কখনো কখনো অব্যক্তিগত ‘শক্তি’ বা স্বয়ং ‘প্রকৃতি’ বলেও ধরা হয়।
আস্তিকতা : ঈশ্বরে বিশ্বাস।
নাস্তিকতা : ঈশ্বরে বিশ্বাসহীনতা।
অজ্ঞেয়বাদ : যা প্রমাণ বা যৌক্তিক প্রতিপাদন অপর্যাপ্ত, সে প্রস্তাবনাকে সত্য বলে স্বীকারে অসম্মতি। অধিকাংশ অজ্ঞেয়বাদী ঈশ্বরে বিশ্বাস নাকচ করে দেন।
মুক্তচিন্তা : ধর্ম ও ঈশ্বর বিষয়ে যুক্তির উপর নির্ভর করে এবং কর্তৃত্ব বা প্রতিষ্ঠান, ঐতিহ্য, প্রথা, প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস নিরপেক্ষ হয়ে মতামত গঠন প্রক্রিয়া।
সত্যতা : কোন মাপকাঠি অথবা প্রক্রিয়ার স্তর বা পর্যায়, যার সাথে বাস্তবতা এবং যুক্তির সামঞ্জস্যতা আছে।
বাস্তব প্রমাণ : সুগভীর চিন্তার উপায় যা কোনো প্রস্তাবনার সত্যতাকে নিম্নোক্ত পরীক্ষণ দ্বারা যাচাই করে :
১।প্রতিপাদন : প্রমাণ বা বারবার পর্যবেক্ষণযোগ্য পরীক্ষণ একে নিশ্চিত করেছে কি?
২।মিথ্যাপ্রতিপন্নকরণ যোগ্যতা : সম্পূর্ণ মুক্তভাবে কোনো বিষয়কে বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে মিথ্যায়ণ করার জন্য সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা গ্রহণ সম্ভব কি-না এবং এরকম সকল প্রচেষ্টা এখন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে কি-না?
৩।হিসেবী : কোন বক্তব্যের সবচেয়ে সরল ব্যাখ্যা কি-না, এবং এর জন্য সবচেয়ে কম অনুমানকরণের প্রয়োজন রয়েছে কি?
৪।যুক্তি : কোন বক্তব্য-সিদ্ধান্ত স্ববিরোধিতা, অবয়ববিরুদ্ধ অনুমান থেকে মুক্ত কি?
সেক্যুলার মানবতাবাদ : সেক্যুলার মানবতাবাদ হল যৌক্তিক বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি, যা মানবতাবোধকে সব ধরনের মূল্যবোধের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে।
অতিরিক্ত পাঠের জন্য :
1)The Age of Reason, Thomas Paine.
2)An Anthology of Atheism and Rationalism, edited by Gordon Stein, Prometheus Books, New York, 1980.
3)A Second Anthology of Atheism and Rationalism, edited by Gordon Stein, Ph.D., Prometheus Books, New York, 1987.
4)Atheism: The Case Against God, George Smith, Prometheus Books, New York, 1979.
5)Atheism: A Philosophical Justification, Michael Martin, Temple University Press, Philadelphia, 1991.
6)Bertran Russell on God and Religion, edited by Al Seckel, Prometheus Books, New York, 1986.
7)Critiques of God, edited by Peter Angeles, Prometheus Books, New York, 1976.
8)Ten Common Myths about Atheists, Annie Laurie Gaylor, Freedom From Religion Foundation, Madison, Wisconsin (booklet), 1987.
প্রবন্ধটি পড়ে খুবই ভালো লাগলো। আগষ্ট মাসে শাশ্বতিকীর অনুবাদ সংখ্যা প্রকাশিত হবে। প্রবন্ধটি রিপ্রিন্ট করার অনুমতি চাচ্চিলাম। আপনার যদি আপত্তি না থাকে তবে আমার নিচের মেইলে এক কপি পাঠাবেন দয়া করে । শুভ কামনা রইল।
মোজাফফর, সম্পাদক
শাশ্বতিকী
mjafor@gmail.
@মোজাফফর হোসেন,
পাঠালাম। ধন্যবাদ।
ড্যান বার্কারের এই লেখা অনেক আগেই পড়েছিলাম। ভাল যুক্তি নিঃসন্দেহে এবং এগুলো বেশ সুবিদিত, বার্কার এগুলিকে সুন্দর ভাষায় আবার ব্যক্ত করেছেন। যাহোক, যুক্তিপূর্ণ এই লেখার এক জায়গা নিয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই, যেটা ঠিক যুক্তিপূর্ণ নয়, এবং বিতর্কিত। সেটা হলঃ
অনেক বিজ্ঞানীই এটার সঙ্গে একমত হবেন না। যেমন Roger Penrose, Paul davies প্রমুখ। বিশেষ করে ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’ মানুষের তৈরি ধারণা মাত্র বলার মানে হল মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারা তৈরী নয়। কারণ মানুষ যদি প্রাকৃতিক নিয়মের ফলেই সৃষ্ট তাহলে তো প্রাকৃতিক নিয়ম মানুষ সৃষ্টির আগে থেকেই অস্তিমান। মানুষ আবার সেই প্রাকৃতিক নিয়মকে কিভাবে তৈরী করবে? এটা এক চক্রাকার উক্তি হয়ে যায়। আরেকটা ব্যাপার হল যে প্রাকৃতিক নিয়ম যদি বোঝার সুবিধার জন্য মানুষের তৈরী বর্ণনা মাত্র তাহলে প্রাকৃতিক নিয়ম দিয়ে অতীতকে ব্যাখ্যা করা বা ভবিষ্যৎবাণী করা যেতনা যেটা পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম দ্বারা করা হয়। আদি অতীতে বিশ্ব সৃষ্টির যে ব্যাখার চেষ্টা পদার্থবিজ্ঞানীরা করছেন সেটা অর্থহীন হয়ে যায়। এবং পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র দিয়ে এমন অনেক ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে যা পরে পর্যবেক্ষণের দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। বেশীর ভাব বিজ্ঞানীরাই এটা ধরেই নেন যে বিজ্ঞানীরা ‘প্রাকৃতিক নিয়মকে (পদার্থ বিজ্ঞানের বিধিসমূহকে) আবিষ্কার করেন, তৈরী করেন না। তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা এই দলেই পড়েন। যারা মানুষের তৈরী বলে, তাঁরা প্রায় সবাই ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানী বা পদার্থবিজ্ঞানের বাইরের বিজ্ঞানী। আমি মনে করি পদার্থবিজ্ঞান ও অধিবিদ্যার এই সীমান্তে তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদেরই এই সূক্ষ্ণ ব্যাপারটি ভাল বোঝার কথা।
@অপার্থিব,
মানুষ আবার সেই প্রাকৃতিক নিয়মকে কিভাবে তৈরী করবে?
বিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক নিয়ম তৈরী করে নি। প্রাকৃতিক নিয়মকে ধারনা করেছে শুধুমাত্র জগতকে বোধগম্যভাবে ব্যখ্যা করার সুবিধার জন্য। বিষয়টা অনেকটা এরকম- আমাদের পৃথিবীর মাঝখান দিয়ে একটা রেখা বৃত্তাকারে চলে গেছে যাকে আমরা বিষুব রেখা বলি। বাস্তবে কি সেধরনের কোন রেখা আকা আছে নাকি গোটা পৃথিবী জুড়ে ? না তা নেই , এটা হলো পৃথিবীর ভৌগোলিক অবস্থাকে ব্যখ্যা বা বোঝার সুবিধার জন্য রেখাটি কল্পনা করা হয়েছে। প্রাকৃতিক নিয়ম মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর মুহুর্ত থেকেই ছিল যার বিভিন্ন বিধি সমূহ ক্রমশ: পদার্থ বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করছেন। আর গোটা বিষয়টাকে প্রাকৃতিক নিয়ম নাম দিয়েছেন তাদের বা সাধারন মানুষের বোঝার স্বার্থে।
@অপার্থিব,
আমি উদ্ধৃতিটির সপক্ষে, অন্য এক জায়গায় অনন্ত নির্বাণের সাথে এ ব্যাপারে কথা হয়েছিল। আমি অনেক বিজ্ঞানীকে জানি যারা মনে করেন পদার্থবিদ্যার আইন গুলি কোন এক platonic অর্থে “সত্য”, কিন্তু এর মানে যে কি হতে পারে আমার তো মাথায় আসেনা। বিজ্ঞান আমার কাছে বাস্তবতার একটি বিবরণ, এবং একমাত্র এই অর্থেই সত্য।
তাত্বিক পদার্থবিদরা গত কয়েক শতাব্দী ধরে একটি সফল aesthetic মেনে কাজ করে চলেছেন, সেটা হল এই যে প্রকৃতিকে গাণিতিক ভাষায় খুব সহজে বর্ণনা করা যায়, এবং এই চিন্তার সাফল্যের কারণে তাদের মধ্য একটা দার্শনিক বিভ্রম ঘটেছে বলে আমি মনে করি। তাদের aesthetic শেষ অবদি একটি heuristic -এর বেশি কিছু নয়।
এটা বুঝলাম না কিন্তু। বর্ণনা টা তো গ্রহণযোগ্য এবং সফল একারণেই যে সেটা অতীত-ভবিষ্যতের সঠিক বিবরণ দেয়!
@রৌরব,
লেখক এখানে মানুষের বা কারো দ্বারা নির্দেশিত আইনের বা নিয়মের সাথে প্রকৃতির নিয়মের ব্যবধানটা বোঝাতে চেয়েছেন। দেখুন প্যারাটি –
@সৈকত চৌধুরী,
সেটা বুঝতে পারছি 🙂
আমি উদ্ধৃতিটিকে সঠিক বলেই মনে করি। আলোচনাটি অবশ্য ঈশ্বর-বিষয়ক অংশটি নিয়ে হচ্ছিল না। “প্রাকৃতিক নিয়ম” মানুষের তৈরি ধারণা মাত্র — অপার্থিব এটির ব্যাপারে যা মন্তব্য করেছেন তার প্রেক্ষিতে ছিল আমার মন্তব্য।
@রৌরব,
এর মানে তো বিজ্ঞানীদের ঐ উক্তিটির ব্যখ্যাতেই পাওয়া যায়। অন্তত আমার তো বুঝতে অসুবিধা হয় নি । একভাবে চেষ্টা করা যাক। মূল উক্তিটা ছিল ঃ
(A natural law is a description, not a prescription)। মহাবিশ্ব কোনোকিছু দ্বারা বা নির্দেশ অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে না। ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’ মানুষের তৈরি ধারণা মাত্র, যা প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনাবলী মানুষের কাছে বোধগম্য করে তুলে;
এটা বুঝতে অসুবিধা নাই নিশ্চয়। এটা একটি বচন উক্তি। মানে এটাকে সত্য বা মিথ্যা বলে দাবী করা যায় বা হচ্ছে। এর উল্টোটাই platonism, যেটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে আপনার। কোনটা সত্য কোনটা মিথায় সেটা আরেক ব্যাপার, অন্তত উক্তিটি বা তার উল্টোটা কি বোঝায় সেটা তো বোঝা গেল। যে কোন বচন উক্তি বুঝলে তার বিপরীত বচন উক্তিও বোঝা যায়। এক কথায় platonism মানে হল মহাবিশ্ব একটা মহাজাগতিক বিধির দ্বারা (পদার্থবিজ্ঞানী হাইনয্ পেগেলস্ যাকে Cosmic Code বলতেন, আসলে পদার্থ বিজ্ঞানের বিধিসমূহ) পরিচালিত। এই বিধি মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বা তৈরী নয়, মানুষ শুধু এটা আবিষ্কার করে।
এখন আসি অতীত ব্যাখ্যা বা ভবিষ্যৎবাণী নিয়ে আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নে। এটা একটু কষ্টকর হতে পারে বোঝাতে, ভাষার সমস্যার জন্য। বলতে চেয়েছিলাম, যে ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’ যদি মানুষের তৈরি ধারণা হয়, তাহলে সেই প্রাকৃতিক নিয়ম তো মানুষ সৃষ্টির আগে না থাকারই কথা। সুদূর অতীতে , যখন বিগ ব্যাং সংঘটিত হয়, তখন তো মানুষ ছিল না। তাহলে সেই বিগ ব্যাং পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়মে ঘটে কি করে, যদি না সে পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম তখনো কার্যকারী থেকে থাকে। তার মানেই তো এটা স্বীকার করা যে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের স্বতন্ত্র এবং সর্বকালীন অস্তিত্ত্ব ঙ্গাছে, মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে তার কোন যোগাসূত্র নেই। মানুষ কেবল তা উদ্ঘাটিত করছে। আরেকটা ব্যাপর আমি উল্লেখ করেছিলাম, যেটা আবার পুন্রুক্তি করছি, সেটা হল, মানুষকে তো বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অন্য সব জড় বস্তু বা জন্তুর মত বৈজ্ঞানিক বিধির একটা প্রডাক্টই আমরা মনে করি। বিবর্তনের মাধ্যমে। বিবর্তন তো নিজেই পদার্থবিজ্ঞানের এক প্রকাশ। তাহলে মানুষ যার দ্বারা সৃষ্ট সেটা আবার মানুষই সৃষ্টি করে বলাটা চক্রাকার হয় কি না। মানুষ তা আবিষ্কার করতে পারে। আমি আগেও এই কথাটিই উল্লেখ করেছিলাম, এটা এখনো বুঝতে অসুবিধা হলে জানান, দেখি অন্যভাবে ব্যক্ত করতে পারি কি না। একই যুক্তি দেয়া যায় ভবিষ্যৎ বাণীর ব্যাপারে। যদি পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম কেবল বর্ণনাই হত, তাহলে যা ঘটেনি সেটা তো বর্ণনার মধ্য পড়ার মধ্য কথা না। কিন্তু মহাকর্ষের সাধারণ তত্বের দ্বারা সূর্য দ্বারা নক্ষত্রের আলো বাঁকানোর ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছিল এবং তা পরে প্রমাণিত হয়েছিল। তার মানে মহাকর্ষের সাধারণ তত্ব একটা প্রেস্ক্রিপশান, ডেস্ক্রিপশন নয়।
@অপার্থিব,
এমন হতে পারে যে গণ্ডগোলটা পুরোটাই ভাষাগত 🙂 তাহলে একটু বিব্রত হতে হবে! তাও, শুরু করা যাক।
বিশ্ব যে মানুষ সৃষ্ট নয়, সেটা তো অবশ্যই। এ ব্যাপারে সন্দেহ থাকলে ডাক্তার দেখাতে হবে 😉
কিন্তু “বিধি” মানুষ সৃষ্ট। পরিষ্কার করি। বিজ্ঞানের শুরু পর্যবেক্ষণ থেকে। কিছু পর্যবেক্ষণ পেলাম, সেখান থেকে মাথা ঘামিয়ে E=mc^2 সূত্রটি বের করলাম, যার সাথে আরো নতুন পর্যবেক্ষণ মিলে যাচ্ছে। এখন, আমি বুঝতে ব্যর্থ, এই যে পর্যবেক্ষণ মিলে যাচ্ছে, এছাড়া কি প্লাটোনিক বৈধতা এই সূত্রের থাকতে পারে?
“মহাজাগতিক বিধির দ্বারা (পদার্থবিজ্ঞানী হাইনয্ পেগেলস্ যাকে Cosmic Code বলতেন, আসলে পদার্থ বিজ্ঞানের বিধিসমূহ) পরিচালিত” এই বাক্যের শব্দগুলি পড়ছি, কিন্তু মানে বুঝতে পারছি না। এটা কিভাবে প্রমাণ করা সম্ভব (যে descriptive অর্থে এগুলি প্রমাণিত বলে আমিও মেনে নিচ্ছি, সেটা ছাড়া)? এটা কি একটা বিশ্বাস ছাড়া অন্য কিছু? আমি তো এটার একমাত্র সম্ভব প্রমাণ ভাবতে পারি, যদি আমরা আবিষ্কার করি, একটি বিশাল কম্পিউটার মহাবিশ্ব চালাচ্ছে, সেখানে এই সূত্রগুলি স্পষ্টাক্ষরে লিখিত।
কেন? আমি কি বলেছি বর্ণনা অতীত আর বর্তমানের বর্ণনা 8-)? সফল বর্ণনা, সব ডিমেনশনে সম্পূর্ণ বিবরণ দেবে। যত সম্পূর্ণ, তত ভাল বর্ণনা, তত ভাল বিধি। এখানে সময়টা আর কটা মাত্রার মতই একটা মাত্রা। বিবরণ ভাল হলে সেটা যেমন ডানে-বাঁয়ে সঠিক হবে, তেমনি অতীতে-ভবিষ্যতেও সফল হবে।
@রৌরব,
E=mc^2 কোন মৌলিক সুত্র নয়। এটা আপেক্ষিক গতিবিদ্যার (Relativistic Mchanics) এক লব্ধ ফল। আর Relativistic Mchanics আইন্সটাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে লব্ধ। আর আইন্সটাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আইন্সটাইন কোন পর্যবেক্ষণের দ্বারা বের করেন নি। স্বজ্ঞার (Intuition) দ্বারা। কাজেই এই উদাহরণ দিয়ে platonism ভুল প্রমাণ তো করা গেল না। বস্তুত platonism বা এর উল্টোটা (Constructivism) বৈজ্ঞানিক সূত্রের দ্বারা ভুল বা সত্য প্রমাণ করা যায় না। দুটোই একধরণের বিশ্বাস। কোনটা বাস্তবতা এবং যুক্তির সাথে বেশী সঙ্গতিপূর্ণ তা দিয়েই পরোক্ষভাবে বিচার করতে হবে কোনটা বেশী যুক্তিসঙ্গত। এই দৃষ্টিতে আমার মতে, এবং প্রায় সকল তাত্বিক পদার্থবিদেরা এবং বিশুদ্ধ গণিতবিদেরা platonism এর পক্ষেই রায় দিয়েছেন। যুক্তির দিকটা অন্তত Roger Penrose মত চৌকশ গাণিতিক পদার্থবিদেরা মনে রেখেই platonism এর পক্ষে রায় দেন নিশ্চয়ই। ভাষার কারণে যদি এই মতপার্থক্য হয়ে থাকে তাহলে আমি সাজেস্ট করব Roger Penrose, Paul Davies, বা John Barrow এর বই বা এ ব্যাপারে তাঁদের বক্তব্য পড়া। আমার ভাষার দক্ষতা সীমাবদ্ধ।
@অপার্থিব,
এটা কি সত্যিই প্রাসংগিক? এটা একটা উদাহরণ মাত্র, আপনার পছন্দ সই সূত্রই নিন না কেন। আর দ্বিতীয় হল, এটা যদি পর্যবেক্ষণের সাথে না মিলত, তাহলে একমাত্র বিশ্বাস ছাড়া একে “সত্য” ভাবতে পারতেন কি?
বিজ্ঞানীরা কি পদ্ধতি ব্যবহার করেন, সেটা বৈজ্ঞানিক সত্য নির্ধারণ করেনা। অনেকে স্বপ্নে দেখে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছে, কিন্তু সেটার সঠিকতার একমাত্র মাপকাঠি পর্যবেক্ষণ। আমি আগের পোস্টেই লিখেছি, পদার্থবিজ্ঞানীরা একটা সফল heuristic অনেক কাল যাবৎই ব্যবহার করে আসছেন, যেটা কিনা গণিত ও যুক্তিবিদ্যার ব্যবহার। অনেক ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণের আগেই গাণিতিক সূত্র এসেছে, কিন্তু এটা শুধু এটাই প্রমাণ করে যে আলোচ্য phenomon গুলি সহজে বর্ণনা যোগ্য, কাজেই গুলি লেগে গেছে। পদ্ধতি হিসেবে এটার সমালোচলা আমি করছিনা কিন্তু।
তাহলে তো হয়েই গেল। বিশ্বাস করার দরকার কি কোনটাকেই? contructivism এর কথা আমি তুলিনি, কাজেই ও নিয়ে আমি চিন্তিত নই। আমি বলেছি, বিজ্ঞান বর্ণনা দেয়, এবং এটা আপনি নিশ্চয় অস্বীকার করেননা। তাহলে ড্যান বার্কারের বাক্যের প্রথমাংশে যদি আমরা একমত হই, আর দ্বিতীয়টা যদি বিশ্বাস হয়ে থাকে, তাহলে নাস্তিকরা আস্তিকদের যে যুক্তি দেয় সেটা প্রয়োগ করলে এই মুহূর্তে দ্বিতীয়টাকে আমরা (কার্যত) অবিশ্বাস করতে বাধ্য।
ওয়েবে কোন প্রবন্ধ আছে কি? তাহলে সহজ হয়। ধন্যবাদ।
@রৌরব,
সার্চ দিয়ে এই মাত্র
http://www.friesian.com/penrose.htm
পেলাম। পুরোটা আস্তে আস্তে পড়ব, কিন্তু প্রথম দিকেই কমপিউটার সম্বন্ধে যে মতামত ব্যক্ত করেছেন Penrose তা হতাশাজনক। মনে হচ্ছে যে বিষয়ে কথা বলছেন সে ব্যাপারে অনেক কিছুই জানেন না। যাহোক, কমপিউটারের ব্যাপারটা মূখ্য না, আমি বাকিটা পড়ে দেখব।
@রৌরব,
@রৌরব,
গাণিতিক সূত্রের সাথে পর্যবেক্ষণের সম্পর্ক তো খুবই ক্ষীণ। পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রের সাথে পর্যবেক্ষণের সম্পর্ক আছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে, যিদিও ব্যতিক্রম আছে যেমন আইন্সটাইনের বেলায়। আমি স্বজ্ঞার কথা এইজন্য তুলেছিলাম যে এতে অন্তত দেখান যায় যে বিজ্ঞানের সুত্র সবসময়েই বর্ণনা নয়, কারণ আইন্সটাইনের আপেক্ষিকতা কিছুই বর্ণনা করেনি যখন তা তিনি প্রকাশ করেন।
ড্যান বার্কারের বাক্যটিই তো contructivism । তার সঙ্গে একমত হয়া মানেই তো contructivism এ বিশ্বাস করা। কে কোনটা বিশ্বাস করবে সেটা তো আর দরকারের ব্যাপার নয়।
“আমি বলেছি, বিজ্ঞান বর্ণনা দেয়,” এটাই contructivism এ বিশ্বাস। আসলে বর্ণনা কথাতেই সমস্যা। ইতিহাস অতীতের ঘটনার বর্ণনা দেয়। যেখানে কোন অন্তর্নিহিত সূত্র বা বিধির প্রয়োগ নেই সেখানেই বর্ণনা কথাটা খাটে। সুত্র বা বিধিহীন বর্ণনা একটা নির্বোধ রোবটকে দিয়ে করান যেতে পারে। কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞানে বর্ণনা কথাটার ব্যবহারেই আপত্তি। এটা অ-পদার্থবিদেরাই (অপদার্থ নয়!) ভাষা। পদার্থ বিজ্ঞানে সুত্র আবিষ্কার করে তা দিয়ে পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করা হয়, অথবা নতুন পর্যবেক্ষণের ভবিষ্যৎবাণী করা হয়। এখানে ব্যাখ্যাটাকে বর্ণনা বলা যেতে পারে এক ঢিলা ঢালা অর্থে। কিন্তু না বলাই সমীচিন হবে।
আমার মনে হয় এ নিয়ে আর বেশি তর্কের স্কোপ নেই। আমার যা বলার বললাম, আপনার বক্তব্যও শুনলাম। এখন বরং আমাদের আরেকটু গভীর ভাবে চিন্তা ভাবনা করাই ভাল।
@অপার্থিব,
একমত।
রৌরব এবং অপার্থিবের বিতর্কের মধ্যে না ঢুকেই কিছু মন্তব্য করি। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোর উদ্ভব আর অস্তিত্বের আলোচনা পদার্থবিজ্ঞানের প্রান্তিক সমস্যাগুলোর একটি। এটি নিয়ে স্বাধীনের সাথে আগে আলোচনা করেছিলাম। প্রাসঙ্গিক বিধায় আলোচনা করছি এখানেও।
ড্যান বার্কার যে অর্থে বলেছেন ‘মানব নির্দেশিত’ তার একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, পদার্থবিদদের একটা অংশ আসলেই মনে করেন যে, পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো আসলে পদার্থের ব্যবহারজনিত কোন নিষেধাজ্ঞা তৈরি করে না, বরং পদার্থবিদরা কিভাবে তাদের মডেল নির্মাণ করবেন তার নিষেধাজ্ঞা তৈরি করে এই প্রাকৃতিক সূত্রগুলো। ব্যাপারটা সাধারণভাবে একটু কফিউজিং মনে হতে পারে। কারণ এই ব্যাখ্যা হিসেবে এই প্রাকৃতিক সূত্রগুলো আসলে মানব নির্দেশিত সংজ্ঞা ছাড়া আর কিছু নয় (আর সে হিসেবে ড্যান বার্কারের উক্তিটি সেভাবে ভুল নয়) কিছু সহজ উদাহরণ দেয়া যাক। আমরা নিউটনের মাধ্যাকর্ষণসূত্রকে প্রাকৃতিক সূত্র মনে করলেও এটা আসলে জড়জগতের জন্য ‘আপেল মাটিতে পড়ে কেন?’ – এ ধরনের বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করার এক ধরনের মডেল। কিন্তু এক সময় দেখা গেল অন্তিম কিছু পরিস্থিতিতে (যেমন বস্তু যখন ছুটতে থাকে আলোর বেগের কাছাকাছি ) নিউটনের মডেল কাজ করে না। আমরা স্মরণাপন্ন হলাম আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে পাওয়া মডেলের। আবার আইনস্টাইনের মডেলও প্লাঙ্ক স্কেলের চেয়ে ছোট জায়গায় কাজ করে না, আমরা স্মরণাপন্ন হই, কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার কিছু সূত্রের। কাজেই দেখা যাচ্ছে আমাদের ‘ইন্টারপ্রিটেশন’ বদলে যাচ্ছে। অর্থাৎ, সূত্রগুলো আমাদের মডেলের রেস্ট্রিকশন তৈরি করছে, পদার্থের নয়। আরো কিছু উদাহরণ এমনিতেই দেয়া যায়। কনজারভেশন অব লিনিয়ার মোমেন্টাম নামের সূত্রের কথা যে আমরা জানি, তা আর কনজার্ভড থাকে না যখন স্পেস ট্রান্সলেশন সিমেট্রি ভেঙ্গে যায়। ঠিক একইভাবে এংগুলার মোমেন্টামও যে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে লংঘিত হয়, তা পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টান্ত খুঁজেই দেখানো যায়। কোয়ান্টাম টানেলিং এর সময় নিউটোনিয়ান ব্যারিয়ার কাজ করে ন, সেট আমরা জানি। এমনকি, যে শক্তির নিত্যতার সূত্রকে আমরা ধ্রুব সত্য বলে জানি, সেতারও বত্যয় ঘটে কোয়ান্টাম স্কেলে। এমনকি পল ডেভসও সেটা স্বীকার করেছেন তার বইয়ে –
‘In the everyday world, energy is always unalterably fixed; the law of energy conservation is a cornerstone of classical physics. But in the quantum microworld, energy can appear and disappear out of nowhere in a spontaneous and unpredictable fashion’ (Davies, Paul. 1983. God and the New Physics. London: J.M. Dent & Sons).
কাজেই উপরের উদাহরণগুলো গোনায় ধরলে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলকে যে ভাবে চিরায়ত বা ‘abstract Platonic’ বলে উল্লেখ করা হয় সেগুলো কি সেরকমই নাকি আসলে মডেল তৈরির প্রয়োজনে পদার্থবিদদের বর্ণন, তা এখনো সেভাবে আমাদের কাছে পরিস্কার নয়। অন্ততঃ কিছু পদার্থবিদ আছেন আমরা জানি, যারা ব্যাপারটাকে সেরকম দেখেন না। যেমন, অধ্যাপক ভিক্টর স্টেংগর ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করে একটি বই লিখেছেন ‘The Comprehensible Cosmos: Where Do the Laws of Physics Come From?’ সেটা পড়া যেতে পারে। তার সাইটে একটি পেপার আছে : Where Do the Laws Of Physics Come From? এগুলোর কথা অবশ্য অপার্থিব আগেই জানেন।
পাশাপাশি আমি ভিক্টর স্টেঙ্গরের ‘গড – দ্য ফেইল্ড হাইপোথিসিস’ থেকে উদ্ধৃত করি –
“So where did the laws of physics come from? The came from nothing! Most are statements composed by humans that follow from the symmetries of the void out of which universe spontaneously arose. Rather than being handed down from above, like the Ten Commandments, they look exactly as they should look if they are not handed down from anywhere” (page 131)
পেনরোজ এবং ডেভেসেরা প্রথম দলে পড়েন, যারা মনে করেন, ব্যাপারটা প্লেটোনিক, অর্থাৎ, পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো সবসময়ই নিয়ম হিসেবে ছিল, পদার্থবিজ্ঞানীদের কাজ সেগুলো খুঁজে বের করা। আর স্টেঙ্গর এবং অন্যান্যরা দ্বিতীয় দলে, যারা মনে করেন, প্রাকৃতিক সূত্রগুলো মডেল নির্মাণের প্রয়োজনে মানব নির্দেশিত সংজ্ঞা । অপার্থিব সম্ভবতঃ প্রথম দর্শনটিকে উপরে তুলে ধরতে চাইছে, এবং রৌরব দ্বিতীয়। যেহেতু ব্যাপারটি পদার্থবিদদের প্রান্তিক গবেষণার বিষয়, আমাদের সেজন্য বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ ফলাফলের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে, ব্লগে এ নিয়ে তর্ক করে খুব বেশি লাভ হবে না। এ ব্যাপারে অভিমত দেয়া যায়, কিন্তু মীমাংসায় পৌঁছুনো যায় না। এ ছাড়া আরো অনেক ব্যাপার আছে। যেমন, সাম্প্রতিক মাল্টিভার্স এর ব্যাপারটা যদি বিবেচনায় আনি, তবে এটাও ভাবা অসম্ভব নয় যে, আমাদের মহাবিশ্বের ‘চিরায়ত’ নিয়মগুলো অন্য মহাবিশ্বে একই রকম হবে না। তা না হওয়াটাই বরং অধিকতর সম্ভাব্য। অর্থাৎ, আমাদের মহাবিশ্বের জন্য যে নিয়মগুলো প্লেটনিক বলে ভাবা হচ্ছে, বহু মহাবিশ্ব গোনায় ধরলে হয়তো আর সেরকম মনে হবে না। কিন্তু, আবারো – এ ব্যাপারগুলো একেবারেই পদার্থবিজ্ঞানের প্রান্তিক গবেষনার বিষয় এখনো। যৌক্তিক উপসংহারে পৌঁছুনোর জন্য আমাদের হয়তো ভবিষ্যতের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে। কাজেই, এ নিয়ে আর বেশি তর্কের স্কোপ বোধ হয় সত্যই নেই।
@অভিজিৎ,
এ তর্কটা বার বারই উঠছে দেখে মনে হচ্ছে এ ব্যাপারে একটা ভাল পোস্ট পড়তে পারে। অভিজিৎ বা অপার্থিব কি চেষ্টা করে দেখবেন?
আমি platonism এর ব্যাপারে weak atheist। সূত্রগুলি যে বিশ্বকে যে মডেল করে, সে কথাটা তো আর মিথ্যা নয়। তাহলে একমাত্র প্রশ্ন হল, মডেল করা ছাড়াও এর কোন “গভীর” সত্যতা আছে কিনা? যাঁরা এই দাবী করবেন, তাঁরা প্রমাণ দিলেই মেনে নেব! ঠিক ঈশ্বরে বিশ্বাসের মতই ব্যাপার।
এ ব্যাপারে এই পোস্টে সত্যিই এটা আমার শেষ মন্তব্য। তবে অভিজিৎ বা অপার্থিবকে (বা অন্য কাউকেও) আবারো অনুরোধ করব এ ব্যাপারে পোস্ট দেয়া যায় কিনা চিন্তা করতে।
@অভিজিৎ,
অভিজিতের শেষ লাইনের সঙ্গে একমত (যেটা আমারই পূর্বের মত ছিল) পোষণ করেই আর বিতর্কে না জড়িয়ে ভিক্টর স্টেঙ্গারের উপর একটা মন্তব্য করতে চাই। স্টেঙ্গার একজন কট্টর বস্তুবাদী ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানী। ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানীদের প্রথম মন্ত্র হল থিওরী টিওরী বলে কিছু নাই। পরিমাপণ ও ডেটাই সব। ডেটা থেকে মডেল বানানোই আসল কাজ তাঁদের মতে। ব্যতীক্রম নেই যে তা নয়, কিন্তু বেশির ভাগ ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে এই মাইন্ডসেটই কাজ করে। তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের সাথে তাদের এক বিরাট দার্শনিক পার্থক্য আছে, যেটা স্টেঙ্গারের সাথে ডেভিস বা পেনরোজ এর চিন্তার পার্থক্য থেকেই বোঝা যায়। এবার স্টেঙ্গারের ব্যপারে আসল কথায় আসি। আমি স্টেঙ্গারের এক মাইলিং লিস্টে (avoid-l) ছিলাম যেখানে দিনে প্রায় শ দুএক মেইল আসত। সেখানে আমি স্টেঙ্গারের উপরের সেই উক্তি যে পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রের কোন উৎস নেই বা থাকতে পারে না, কারণ পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র জ্যামিতির দ্বারা এবং প্রতিসাম্যের কিছু স্বতঃসিদ্ধএর দ্বারা লব্ধ করা যায় এটা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। এটা তিনি তাঁর উল্লেখিত বইতে প্রমাণ করেছিলেন। “প্রমাণ” টা আমি দেখেছিলাম। সেই প্রমাণে তিনি একটা Lagrangian ধরে নিয়ে ACTION Principle এর দ্বারা প্রতিসাম্য নীতি প্রয়োগ করে পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র লব্ধ (Derive) করলেন। আমি লিস্টে (স্টেঙ্গার যার মডারেটর) এই ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছিলাম যে Lagrangian, ACTION Principle এগুলি তো পদার্থবিজ্ঞানেরই ধারণা। পদার্থবিজ্ঞান জানা না থাকলে এগুলির অর্থ বা প্রয়োগ কেমন করে করা যায়। তাহল তাঁর কথা মত পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রকে স্রেফ গণিতের মৌলিক নীতির দ্বারা এবং প্রতিসাম্যের কিছু স্বতঃসিদ্ধএর দ্বারা লব্ধ করা যায় বলাটা অসঙ্গত। তিনি যা করলেন, তা পদার্থবিজ্ঞানে আগেই অনেক করেছেন, পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রগুলিকে অপরিবর্তনীয় (Invariant) রূপে RESTATE করে এক রূপ থেকে আরেক রূপে আনা বা পুনর্ব্যক্ত করা। কিন্তু এটা কখনই বলা যায় না যে পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রগুলিকে একেবার গোড়া থেকে শুধু গণিতের এক্সিয়ম আর প্রতিসাম্যের এক্সিয়ম থেকেই বের করে আনা সম্ভব। Lagrangian, বা ACTION Principle ছাড়া এটা সম্ভব নয়। আর এই দুটো ধারণার মধ্যেই ত পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র লুকিয়ে আছে। বলা বাহুল্য লিস্টে আমার প্রশ্নের উত্তর কেউ দেন নি। আমি অবশ্য বেশি দিন ফলো করিনি। তা ছাড়া দিনে কয়েকশ পোস্ট সামলানো কষ্টের ব্যাপার।
@অপার্থিব,
চমৎকার আলোচনা। এই থ্রেডে এটাই আমার শেষ উত্তর। যেহেতু পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের উদ্ভব এবং অস্তিত্বের আলোচনা প্রান্তিক গবেষণার বিষয় বলে এখানে এ নিয়ে বিতর্কের খুব বেশি স্কোপ নেই বলে আমরা তিনজনই (রৌরব, অপার্থিব এবং আমি) স্বীকার করে নিয়েছি, সেহেতু এ নিয়ে আর ‘ত্যানা প্যাচাচ্ছি না’।
তবে আনুষঙ্গিক বিষয়ে প্যাচাতেই হচ্ছে 🙂 । তাত্ত্বিকপদার্থবিদদের সাথে ব্যবহারিক পদার্থবিদদের বিভেদটাকে ‘বৈরিতা’ হিসেবে না দেখে আমি দেখি অনেকটা এরকম যে, দুই দলই দুদলের কাজকে খানিকটা ব্যালেন্সড করার চেষ্টা করে। এটা ঠিক কাজের ধরণ আলাদা বলেই ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানীরা অনেক সময়েই বস্তুবাদী হয়ে পড়েন, আর তত্ত্বকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা মাঝে মধ্যেই রঙ বেরঙ-এর তত্ত্বের পাখায় ভর করে অধিপদার্থবিদ্যার জগৎ পার হয়ে সময় সময় আধ্যাত্মিক জগতেও চলে যেতে চান। তখন তাদের বাস্তব জগতে অনেক সময় ফিরিয়ে আনেন ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানীরাই। কারণ ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানীরা কেবল তত্ত্ব নয়, জোর দেন তত্ত্বের ফলসিফিকেশনের উপর। ফলসিফিকেশন ছাড়া তত্ত্বের গুরুত্ব তাদের কাছে সামান্যই। দুই একটা উদাহরণ দিলে মন্দ হয় না এ প্রসঙ্গে-
* এম্পেররস নিউ মাইন্ডে রজার পেনরোজ দাবী করেছেন, পদার্থবিদ্যার প্রচলিত সূত্রগুলো মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিকে ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট নয়। ব্যাপারটি তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছে। কারণ মানুষের উদ্ভব আর বিবর্তন যদি পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের ফসল হয়ে থাকে (যেটা প্লেটনিক ধারার তাত্ত্বিক পদার্থবিদেরা জোরে সোরে দাবী করেন) তাহলে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশও তার বাইরে নয়। অথচ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিকে যদি প্রচলিত সূত্রগুলো দিয়ে ব্যাখ্যা না করা যায়, তবে বুঝতে হবে আধ্যাত্মিক কোন শক্তির লীলাখেলা আছে। যদিও পেনরোজ সেভাবে বলেননি, কিন্তু অনেকেই সেই অর্থে ব্যবহার করেছেন তার ইণ্টারপ্রেটেশনকে।
* পেনরোজ এবং স্টুয়ার্ট হ্যামারহফ মনুষ্য-চেতনার মাইক্রো-টিউবলস কেন্দ্রিক তত্ত্বের কথাও এ প্রসঙ্গে বলা যায়, যেখানে দাবী করা হয়েছে মাইক্রো-টিউবলসসমূহের মধ্যে কোয়ান্টায়িত মহাকর্ষ থাকার ফলে দরুন যে মনুষ্য-চেতনার উদ্ভব ঘটে সেটা ধবংস হয় না। ভাববাদীরা স্বভাবতই এতে ‘আত্মার নিত্যতা’ খুঁজে পেয়েছেন। পেনরোজ দাবী করেছেন, মানুষের মস্তিস্কের চলন ব্যখ্যা করার জন্য কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রয়োগ লাগবে। পেনরোজের অধিপদার্থবিদ্যার এ সব ব্যাখ্যা বিভিন্ন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অধিকাংশ বিজ্ঞানীই এগুলো গ্রহণ করেননি। যেমন, পদার্থবিজ্ঞানী লী স্মোলিন বলেন, “আমাদের মস্তিষ্কের আবাস তো আর পরমশূন্যের কাছাকাছি কোথাও নয়, এজন্য বিবর্তনের ফলশ্রুতিতে মস্তিষ্কের আচরণ কোয়ান্টায়িত হয়ে যাবে এমন প্রত্যাশা খুব একটা যৌক্তিক হতে পারে না।” আরেক পদার্থবিদ ম্যাক্স টেগমার্ক Physical Review পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধে হিসাব কষে দেখিয়েছেন যে, নিউরনের সক্রিয়ন ও উদ্দীপনের(firing and excitation) জন্য প্রয়োজনীয় সময় decoherence জন্য প্রয়োজনীয় সময় থেকে কমপক্ষে ১০,০০০,০০০,০০০ গুণ বেশী। পেনরোজ মস্তিস্ককে ‘কোয়ান্টাম কম্পিউটারের’ সাথে যে তুলনা করেছিলেন সে অনুমানে ভুল ছিল। তিনি উপসংহারে এসেছেন এই বলে – brain that relate to cognitive processes should be thought of as a classical rather than quantum system। এছাড়াও ইন্টারনেটে পেনরোজ-হ্যামারফের আরো ফলসিফিকেশন আছে। ভিক্টর স্টেঙ্গরের ‘Quantum Gods: Creation, Chaos, and the Search for Cosmic Consciousness’ বইয়েও পেনরোজের কাজের সমালোচনা আছে।
* একই কথা বলা যায় পল ডেভিসের কাজ সম্বন্ধেও। Cosmic Jackpot: Why Our Universe is Just Right for Life এ বেশ কিছু বিতর্কিত ধারনার প্রকাশ ঘটান। স্কেপ্টিক পত্রিকায় Sid Deutsch বইটির সমালোচনা করছিলেন Jackpot or Crackpot? শিরোনামে (volume 14 number 1)।
* জন ব্যারো আর টিপলারের মত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের কাজ সম্বন্ধে যত কম বলা যায় ততই মনে হয় ভাল। ব্যারো তাও ততটা নন, কিন্তু টিপলার তার তত্ত্বের ‘গাঁজাখুরি’তে মনে হয় সবাইকেই ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি পদার্থবিজ্ঞানে অবদানের জন্য যত না বিখ্যাত, তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন খ্রীষ্টধর্মকে ‘বিজ্ঞান’ বানানোর জন্য। ওমেগা পয়েণ্ট নামে একটি তত্ত্ব দিয়েছেন টিপলার যা মহাসংকোচন (বিগ ক্রাঞ্চ)-এর সময় সিংগুলারিটির গানিতিক মডেলকে তুলে ধরে। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু টিপলার মনে করেন এই ওমেগা পয়েন্টই হচ্ছে ‘গড’। শুধু তাই নয়, যীশুর অলৌকিক জন্মকে (ভার্জিন বার্থ) তিনি বৈজ্ঞানিক বৈধতা দিতে চান যীশুকে বিরল xx male বানিয়ে, যীশুর পুনুরুত্থানকে ব্যারন এনিহিলেশন প্রক্রিয়ার সাথে তুলনা করেছেন, ইনকারনেশন বা অবতারকে বলেছেন বিপরীতমুখি ডিম্যাটারিলিজেশন পদ্ধতি, ইত্যাদি। এ সমস্ত রং-বেরং এর গালগপ্প নিয়ে তিনি বইও লিখেছেন – The Physics of Christianity (2007) নামে! বলা বাহুল্য মাইকেল শারমার, ভিক্টর স্টেংগর, লরেন্স ক্রাউস সহ অনেক বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকই টিপলারের যুক্তিকে খন্ডন করেছেন।
কাজেই দেখা যাচ্ছে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা প্রায়শঃই কল্পণার ফানুসে চড়ে রঙ বেরঙের তত্ত্বের পসরা সাজিয়ে বসেন পাঠকদের জন্য। আর তাদের বাস্তবে নিয়ে আসার দায়িত্বটি নেন ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানীরা অনেক সময়ই। কাজেই আমি মনে করি এদের ভিন্নধর্মী মাইন্ডসেট একধরণের ব্যালেন্স প্রদান করে। এটার দরকার আছে।
যুক্তি ম্যাগাজিন, সংখ্যা ৩ এর সূচীর সাথে লেখাটি লিঙ্কায়িত করা হল।
খুব ভাল ও যুক্তিপূর্ন নিবন্ধ। ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু মুসকিল হলো এসব নিবন্ধ আস্তিকরা পড়ে না বা পড়তেই চায় না। তারা ভয় পায় এটা পড়লে গুনাহ হবে, মরার পর জাহান্নামের আগুনে পুড়তে হবে।