অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।

 

এই জীবনে কিছুই হতে চাই নি আমিনা মেঘ, না বৃষ্টি, না ছায়া, না রোদ্দুর, না সমুদ্দর, না জল, না নীল, না পাখি, না আকাশকোনো কিছুই নয়

 

কোনো কিছু যে হতে হবে সেই ভাবনাটাই মনে আসে নি কখনো। প্রয়োজনটুকুও অনুভব করি নি কখনো বুকের মাঝে। এতে নিজের হয়তো কোন আক্ষেপ নেই, বেদনা নেই, নেই কোন দীর্ঘশ্বাস কিংবা হতাশাওকিন্তু আশেপাশের মানুষদের বড় সমস্যা হয় আমাকে নিয়ে আমার অপ্রাপ্তিকে নিজেদের অপ্রাপ্তি ভেবে নিয়ে হতাশায় মাটি কাঁপায় তারা। আমার হাল ছেড়ে দেওয়া পরাজয়ে বিক্ষুব্ধ হয় বিপুল পরিমাণে। আমার গুটিয়ে যাওয়া দেখে গুমরে মরে তারা।

 

ক্লান্তিতে হাল ছেড়ে দেওয়া আমার ভারি দুচোখ যখন মুদে আসতে থাকে গভীর ঘুমের আশায়, তারা ঠেলে ঠুলে তুলে দিতে চায় আমাকে। কেউ বুঝতে চায় না যে, বড্ড ক্লান্ত আমি। ক্লান্তির বোঝা টানতে টানতেই নিঃশেষিতপ্রায়। বিশাল বোঝার ভারে নিষ্পেষিত আমি। লড়াই করার আর কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই আমার। লড়াই করতে চাইও না আমি। কেড়ে নেবার কোন অভ্যেস যে নেই আমার। প্রয়োজনটাই আসলে নেই।

 

যে লড়াই করি তা করিয়ে নেওয়া হয় আমাকে দিয়ে। হাজারো দর্শকের উন্মাতাল চোখের সামনে ক্লান্তশ্রান্ত অনিচ্ছুক রোমান ম্যাটাডোরের মত আমাকেও ঠেলে ফেলে দেওয়া হয় ক্ষুধার্ত সিংহের মুখে। দর্শক মনোরঞ্জনের জন্যে, তামাশা দেখার জন্যে। অনাকাঙ্ক্ষিত সেই প্রাণঘাতী লড়াইয়ে আমি ক্ষতবিক্ষত হই, রক্তাক্ত হই, ক্লান্ত হই, রিক্তসিক্ত হই, ঘুমের অতল তলে তলিয়ে যেতে থাকি অনিচ্ছায়।

 

একেকটা অর্থহীন লড়াইয়ের পরে শরীরে ক্ষতের দাগ লুকিয়ে, চোরা রক্তস্রোতকে উপেক্ষা করে উল্লসিত দর্শকদের দিকে বিজয়ীর মত হাত নাড়ি আমি। তারপর ভিতরের পরাজিতকে নিয়ে ফিরে যাই পাঁচ ফুট বাই পাঁচ ফুটের অন্ধকারে। নিজে নিজে ক্ষতে মলম দেই অযত্নে, ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে ফেলি দেহ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া রক্তিম রুধিরস্রোত। শরীরের রক্ত-ঘাম মুছে আরেকটি অপরিবর্তিত দিনের অপেক্ষায় থাকি আমি।  আরেকটি অর্থহীন লড়াইয়ের অনাগ্রহী প্রস্তুতি নেই।

 

 

কেউ ভাবে না, আসলে কি চাই আমি। আদৌ কিছু চাই কি না। কাঠিন্য দিয়ে মোড়ানো যে স্বেচ্ছামোড়ক রয়েছে চারপাশে আমার, তার ভিতরে আসলে ঘুণপোকারা বাসা বেঁধেছে দলবেঁধে। উপরের শক্ত আবরণটুকু সরালেই দগদগে সত্যের মত প্রকাশিত হয়ে যাবে ঝুরঝুরে নরম কাদামাটির ভাঙা বসতবাড়ি।

 

অভিশপ্ত জীবন আমার। থিকথিকে অন্ধকারের মধ্যে অনিচ্ছুক এবং অবাঞ্ছিত জন্ম পেয়েছি আমি। আশাহীন, স্বপ্নহীন এক জীবনকে হাতে ধরিয়ে দিয়ে এই ধরায় পাঠিয়ে দিয়েছেন বিধাতা আমাকে। চোখ মেলেই দেখেছি চারিদিকে অন্ধকারের শক্ত কালো দেয়াল। জন্মান্ধ ইঁদুর ছানার মত মাথা কু্টে মরেছি সেখানে কতযুগ, কত অনন্ত সময়। শুধুমাত্র একটু মুক্তির আশায়। মুক্তি চাই, মুক্তি চাই বলে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছি অসহায় আমি। না, আলোর জন্য কো্নো আকুতি ছিল না আমার, ছিল না কোনো অদম্য ভালবাসাও। তীব্র প্রয়োজন ছিল শুধু অসহ্য আঁধার থেকে বের হয়ে আসার। পৌরাণিক কাহিনির কোন অভিশপ্ত চরিত্রের মত নক্ষত্র নিয়ন্ত্রিত পথে হেঁটেছি আমি টালমাটাল, তালচিহ্নহীন। একাকী, এলোমেলো, সঙ্গীবিহীন। দ্বিধাগ্রস্ত, দ্বন্দ্বমুখর আর দিশাহীন ছিল সেই যাত্রা। এক জীবনের অর্ধেকটাই কেটে গিয়েছে আমার সেই আঁধারের রাজ্যের সীমানা পেরোতেই।

 

এত কিছু না চাওয়ার মধ্যে একজনকেই চেয়েছি আমি। শুধু একজনকেই। আর কাউকেই নয়। তীব্রভাবে, মনের সমস্ত আকুতি দিয়ে, বুকের মধ্যে জমানো সবটুকু ভালবাসা দিয়ে চেয়েছি তাকে। বরষাভেজা এক স্বপ্নিল রাতে অচেনা অরণ্য পেরিয়ে সে এসেছিল করুণাধারায় সিক্ত করতে। স্বেচ্ছামৃত্যুর চোরাবালিতে গেঁথে যাওয়া একজনকে গভীর ভালবাসায় হাত ধরে টেনে তুলেছিল। মমতামাখানো কোমল হাতের স্পর্শে স্পন্দিত করেছিল আমাকে, পালটে দিয়েছিল  আমার পুরোনো পৃথিবীকে। বিপুল বিস্ময়ে পুরো চোখ মেলে বদলে যাওয়া ভূবনকে দেখেছিলাম আমি তখন।

 

শুধুমাত্র তার কারণেই ঝুম বৃষ্টিতে মিলপুকুরের পাড়ে ভিজতে ইচ্ছে করে আমার। শুধুমাত্র তার কারণেই বিরান কোন বনের বনভাসানো নেশাময় বুনোগন্ধ নাকে নিয়ে তার হাতে হাত রেখে আঁকাবাঁকা সরু বুনোপথ ধরে হাঁটতে ইচ্ছে করে অনাদিকাল। চাঁদনী রাতে দূর সাগরের মাঝের নির্জন কোন দ্বীপের বিশাল কোন বৃক্ষের উপর করা গাছবাড়ির বারান্দায় পা ছড়িয়ে দিয়ে বসে গল্প শুনতে ইচ্ছে করে ভোর অবধি। জোছনাগুলোকে হাতের মুঠোয় ধরে ফুল বানিয়ে গুঁজে দিতে ইচ্ছে করে তার রেশমের মত মখমলে চুলের মাঝে। মাতাল করা গন্ধ নিতে ইচ্ছে করে ওই চুলের ঘন অরণ্যে নাক ডুবিয়ে।  সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া নীল জলের সুখস্পর্শধন্য রুপোলি বালুতে শুয়ে কোলের মধ্যে মাথা রেখে কোমর জড়িয়ে ধরে ঘুমঘুম চোখে কবিতা শুনতে ইচ্ছে করে।

 

বদলে দেওয়া আমার এই পৃথিবী যে শুধু তার কারণেই পাওয়া। সে না এলে এগুলোর কিছুই যে জানতাম না আমি। জীবন থেকে যেত অনাড়ম্বরহীন, অতৃপ্ত। স্বাদগন্ধবর্ণহীন শুকনো পাতার মতন । প্রকৃতির সমস্ত সৌন্দর্য থেকে যেত অনালোকিত, অনাবিষ্কৃত আর অনাস্বাদিত।

 

বন্ধু, তোমাকে হারাতে দেবো না কিছুতেই।

 

 

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

 

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA