সৌভাগ্যরহিত এক সূর্যপুত্রের সকরুণ সমাপ্তিগাথা

 

 

দিনকয়েক আগে ক্যাথেরীনার লেখা তর্পণ প্রবন্ধে মন্তব্য করেছিলেন স্নিগ্ধা। সেই মন্তব্যকে অনুসরণ করে অনেকদিন পরে ক্যাথেরীনার আবেগঘন লেখাটি আরেকবার পড়া হয়ে গেল। তাঁর লেখাটাতে একটা তথ্য ছিল। ওটা চোখে পড়তেই অনেকটা হুট করেই এই লেখাটির ভাবনাটা জন্ম হয়ে গিয়েছিল আমার মাথার ভিতরে।

 

পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে আমার আগ্রহ অদম্য এবং সেটা অনেকদিনের পুরোনো। বইপত্রের অভাবে অবশ্য সেই অদম্য আগ্রহে আশার ফুল ফোটে নি কখনো। তারপরেও ছিটেফোঁটা এখানে সেখানে যেটুকু পাই মনের ভালবাসা দিয়ে তুলে নেই তাকে।

 

অনেকদিন ধরেই মনের মধ্যে বাসনা, বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে মুক্তমনায় কেউ না কেউ লিখবেন। গ্রিক মিথোলজি নিয়ে লেখার জন্যে একজনকে তৃতীয় এক পক্ষের মাধ্যমে অনুরোধ পাঠিয়েছিলাম। সেই অনুরোধের অবস্থান কি অনাদর এবং অবহেলায় আস্তাকুঁড়েই হলো কি না জানি না। আশা আছে, এই ভূমিকাটুকু যদি তাঁর চোখে পড়ে কোনভাবে, তবে হয়তো তিনি আমার সেই ছোট্ট অনুরোধটাকে অরুণচ্ছটায় ভরিয়ে দেবেন একদিন।

 

আমার কাছে মহাভারতের কোন বাংলা কপি নেই। এই লেখাটি লেখার জন্য রাজাগোপালচারীর লেখা একটা ইংরেজি বইয়ের উপর অনেকখানি নির্ভর করেছি। ফলে, দেবতা বা মানুষের নাম থেকে শুরু করে জায়গা বা আরো অনেককিছুর ক্ষেত্রেই ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকাটাই স্বাভাবিক। আশা করি সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখবেন অনিচ্ছাকৃত সেইসব ভুলকে। ভুল চিহ্নিত করে দিলে অশেষ কৃতজ্ঞ থাকবো এবং শুধরে দেবো সাথে সাথে।

 

____________________________

 

সূর্যের সন্তান সে। দেবতা তনয়।

 

তার মাতাও ছিল এক দেশের রাজকন্যা। তারপরও নিরায়েসী জীবন কাটাতে হয়েছে তাকে। সব সামর্থ থাকার পরেও ভাগ্যের বিড়ম্বনাতেই বেদনাবিধুর জীবন কেটেছে তার। পিতার স্নেহ পায়নি সে। ক্ষণিকের তরে মাতৃগর্ভে তাকে বুনে দিয়েই উধাও হয়েছেন তিনি। মায়ের ভালবাসাও জোটে নি কপালে তার। কলংকের আশংকায় জন্মমুহুর্তেই নদীর জলে তাকে ভাসিয়ে দিয়েছে তার গর্ভধারিণী মা।

 

সেই যে দুর্ভাগ্যকে সঙ্গী করে জন্মের পরপরই অজানার পথে তার অগম্য যাত্রা, সেই যাত্রার শেষ পরিণতি ঘটেছে দুর্ভাগ্যজনক করুণ মৃত্যুতে।

 

দেবতার ঔরসে জন্ম আর ধমনীতে স্রোতস্বিনীর মত রাজ রক্ত প্রবাহিত হবার পরেও রিক্তের জীবন হয়েছে তার, পায় নি কখনো রাজানুকল্য। তার বদলে অনাদর, অবহেলা আর অপমানকে সইতে হয়েছে। সারাজীবন যা কিছু অর্জন করেছে সে, তার সবই ছিল পরিশ্রমসাধ্য, কষ্টসাপেক্ষ, নিজের সামর্থকে উজাড় করে দিয়ে ভাগ্যের হাত থেকে নিংড়ে নিংড়ে বের করে আনা।

 

যাদব বংশের রাজা সূরা। পৃথা তার কন্যা। রূপে গুণে অনন্যা। সূরার ভাই কুন্তীভূজা নিঃসন্তান। ভাইকে দত্তক দিয়ে দেন নিজ কন্যা সূরাকে। সেই থেকেই দত্তক পিতার নামে পৃথার নাম হয়ে যায় কুন্তী।

 

কুন্তীর কিশোরী বয়সে কুন্তীভূজার আতিথ্য গ্রহণ করেন মহামুনি দুর্বাসা। পরম ধৈর্য্য, মমতা এবং ভক্তি দিয়ে দীর্ঘ এক বছর দুর্বাসা মুনির সেবা করেন কুন্তী। কুন্তীর সেবায় প্রীত মুনি দুর্বাসা স্বর্গীয় এক মন্ত্র প্রদান করেন কুন্তীকে। বলেন যে, এই মন্ত্র পড়ে যে কোন দেবতাকে ডাকলেই সেই দেবতা এসে কুন্তীকে সন্তান দিয়ে যাবেন। সেই সন্তান হবে সেই দেবতার মতই যশময়, কীর্তিমান এবং খ্যাতিবান।

 

কৈশোরের চাপল্যে আর অদম্য কৌতুহলে মন্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার ইচ্ছা জাগে কুন্তীর। মন্ত্র পড়ে স্বর্গে জাজ্বল্যমান সূর্য দেবতাকে কামনা করে সে। তার সেই ডাক শুনে সারা আকাশ জুড়ে নেমে আসে কালো মেঘের দল। ঢেকে দেয় অন্ধকারে সমস্ত দিক। আর সেই অন্ধকারের আড়াল থেকে অপূর্ব এক রূপবান রাজকুমারের বেশে সূর্য দেবতা নেমে আসেন কুন্তীর কাছে। হতবিহ্বল কুন্তী আড়ষ্ঠ কণ্ঠে জানতে চায় কে সে, কী প্রয়োজনে সে এসেছে তার কাছে। রাজকুমার জানায়, সূর্য দেবতা সে, মন্ত্রের আকর্ষণে নেমে এসেছে মর্তধামে, তার সন্তানকে রোপণ করতে কুন্তীর গর্ভে। আতংকিত কিশোরী কুমারী্ত্ব ভঙ্গ করে মাতা হতে অস্বীকৃতি জানায়। কাতর মিনতিতে বলে, চলে যাও হে দেবতা। সন্তান চাই না আমি। সে যে বড় কলংক হবে। কুমারী আমি, কুমারীত্ব হারাতে চাই না বিয়ের আগে কিছুতেই। ক্ষমা কর কিশোরীর এই মূঢ়তা দেবতা। দেবতা জানায়, মন্ত্রের কাছে আমিও অসহায় কন্যা। তোমাকে সন্তান না দিয়ে যে মুক্তি নেই আমার। ফিরে যেতে পারবো না কিছুতেই। তবে, এই কাজটুকু করে যাবো আমি। আমার সন্তান ধারণ এবং তাকে জন্মের পরে আবারও কুমারীতে রূপান্তরিত হবে তুমি। কোন গ্লানি, কোন কলংকের ভারই সইতে হবে না তোমাকে।

 

সূর্যের অবদানে গর্ভবতী হয় কুন্তি। নয়মাসের কষ্টকর গর্ভকালীন সময়কে এড়িয়ে যায় কুন্তী দেবতার কল্যানে। গর্ভাবস্থা এবং সন্তানের জন্ম হয় সাথে সাথেই। তাঁর কুমারীত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার উদ্দেশ্যে যোণীপথের পরিবর্তে কর্ণকুহর দিয়ে সন্তান জন্ম দেয় কুন্তী। কানে সোনার দুল আর বুকে অভেদ্য বর্ম নিয়ে সূর্যের মতই ঔজ্বল্যময় এক সন্তান জন্ম নেয়। কানে দুল থাকার কারণে কিংবা কর্ণ দিয়ে প্রসবিত হবার কারণেই তার নাম হয় কর্ণ। সন্তান জন্মের পরপরই আবার কুমারী কিশোরীতে রূপান্তরিত হয়ে যায় কুন্তী।

 

সদ্যপ্রসূত সন্তানকে নিয়ে হতচকিত হয়ে পড়ে কুন্তী। পরিচয়হীন এই সন্তানকে নিয়ে কী করবে সে, সেটা ভেবেই আতংকে শিউরে উঠে। ভীত কিশোরী নিজেকে শুদ্ধ রাখতে অবশেষে তার অনাহুত এবং অবাঞ্চিত সন্তানকে একটা বাক্সে ভরে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়।

 

নিঃসন্তান এক রথচালক অধিরথ নদীতে ভেসে যেতে থাকা বাক্স থেকে অনিন্দ্যসুন্দর শিশুকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় বাড়িতে। তুলে দেয় তার মাতৃত্বের স্বাদবঞ্চিত স্ত্রী রাধার হাতে। নিজ সন্তানের মত তারা লালন পালন করতে থাকে এই শিশুর। রাধার সন্তান হিসাবে রাধেয় নামে বেড়ে উঠতে থাকে সূর্যপুত্র রথচালকের ছায়াচ্ছন্ন ঘরে। 

 

বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠতেই কুন্তীর জন্য স্বয়ংবরা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন কুন্তীভূজা। আশেপাশের সমস্ত এলাকার বিবাহযোগ্য সব রাজকুমারকে আমন্ত্রণ জানানো হয় সেই অনুষ্ঠানে। কুন্তীর রূপ এবং গুণের খ্যাতি এর মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছিল আশেপাশের সমস্ত জায়গায়। ফলে, অসংখ্য রুপমোহিনী এবং গুণমুগ্ধ আগ্রহী রাজপুত্র এসে জড়ো হয় স্বয়ংবরা সভায়। ব্যক্তিত্বে সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়া রাজা পাণ্ডুর গলায় বরমাল্য পরিয়ে দেয় কুন্তী। পাণ্ডুর সাথে তাঁর রাজধানী হস্তিনাপুরে চলে আসে সে। কুন্তি ছাড়াও পরে মাদ্রিকেও বিয়ে করে পাণ্ডু।

 

দুই স্ত্রীসহ একদিন পাশের বনে শিকারে গিয়েছেন পাণ্ডু। এক সাধু এবং তাঁর স্ত্রী হরিণের বেশে ঘুরছিল সেই বনে। না বুঝেই পাণ্ডু তীর দিয়ে আঘাত করে ফেলে পুরুষ হরিণবেশি সাধুকে। মৃত্যুর আগ মুহুর্তে সাধু অভিশাপ দিয়ে যান পাণ্ডুকে এই বলে যে, যৌনকর্মে লিপ্ত হলেই মৃত্যুর মুখে পতিত হবে সে। অভিশাপের ফলে এতই মন ভেঙে যায় পাণ্ডুর যে, সে তাঁর ভাই ধৃতরাষ্ট্রের হাতে হস্তিনাপুরের সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে দুই স্ত্রীকে নিয়ে বনবাসী হয়ে যান।

 

পাণ্ডুর কাছ থেকে কোন সন্তান পাবার আর কোন আশা নেই দেখে মুনি দুর্বাসার স্বর্গীয় মন্ত্রের কথা কুন্তী জানায় পাণ্ডু এবং মাদ্রিকে। পাণ্ডুর সম্মতিতে সন্তান আকাঙ্ক্ষায় একে একে বিভিন্ন দেবতাদের আহ্বান জানায় কুন্তি এবং মাদ্রি। ধর্ম দেবতার ঔরসে যুধিষ্ঠির, বায়ু দেবতার ঔরসে ভীম এবং ইন্দ্রের ঔরসে অর্জুনের জন্ম হয় কুন্তীর গর্ভে। অন্যদিকে অশ্বিণী যমজ দেবতার ঔরসে মাদ্রির গর্ভে জন্ম নেয় নকুল এবং সহদেব। এক অসতর্ক মুহুর্তে মাদ্রির আগ্রহে তার সাথে যৌনকর্মে মিলিত হতে গিয়ে ঋষির অভিশাপে মারা যান পাণ্ডু। সেই অনুতাপে এবং অনুশোচনায় পাণ্ডুর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নেয় মাদ্রি। ফলে পাঁচ সন্তানকেই মানুষ করার পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে কুন্তীর ঘাড়ে। কুন্তীর এই পাঁচ সন্তানই মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডব নামে পরিচিত।

 

পাণ্ডব এবং কৌরব দুইপক্ষই তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শিখেছিল প্রথমে কৃপাচার্য এবং পরে দ্রোণাচার্যের কাছে। তাদের সেই শিক্ষা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় হস্তিনাপুরে। রাজপরিবারের সদস্যদের সাথে সাথে জনসাধারণের জন্যও উন্মুক্ত ছিল সেই অনুষ্ঠান। অর্জুন অমানুষিক দক্ষতা প্রদর্শন করে তাক লাগিয়ে দেয় উন্মত্ত জনসাধারণকে। অর্জুনের এই সাফল্যে মুখ কালো হয়ে যায় দুর্যোধনের। দিনের প্রায় শেষ লগ্নে বিপুল শব্দ নিনাদে প্রদর্শনীক্ষেত্রে হাজির হয় এক অনিন্দ্যকান্তি তরুণ। কানে সোনার দুল, বুকে অভেদ্য বর্ম তার। উদ্ধত মস্তকে আকাশসম গর্বে চারিদিকে গৃবা উঁচিয়ে তাকায় সে। কৃপ এবং দ্রোণের দিকে অবহেলার প্রণাম দিয়ে অর্জুনের মুখোমুখি হয় সে। হেলাফেলা করে অর্জুন যা যা করেছিল সব করে দেখায় সে। সেখানেই থেমে থাকে না সে। অর্জুনকে মল্লযুদ্ধেও আহ্বান জানায় সে।

 

তাঁদের সন্তানদের মুখোমুখি হতে দেখে স্বর্গের দেবতারাও নড়েচড়ে বসেন। ইন্দ্র এবং সূর্যদেবতা দুজনেই উৎকণ্ঠিত চিত্তে তাকিয়ে থাকেন তাঁদের সন্তানদের আসন্ন মল্লযুদ্ধের দিকে। রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে কুন্তীও উপস্থিত ছিল সেখানে। কানের দুল এবং বুকের অভেদ্য বর্ম দেখে কর্ণকে চিনতে তাঁর ভুল হয় না কোন। অনাদরে ছুড়ে ফেলে দেয়া তার  প্রথম সন্তানকে লড়াকু মেজাজে অন্য সন্তানের মুখোমুখি দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। দাসীদের শুশ্রুষায় জ্ঞান ফিরে পান তিনি। স্থানুর মত নিজ গর্ভের সন্তানদের একে অপরের বিরুদ্ধে আসন্ন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দেখা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না তাঁর।

 

মল্লযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগ মুহুর্তে হস্তক্ষেপ করেন কৃপ। কর্ণকে উদ্দেশ্য করে বলেন, হে বীর তরুণ, আপনার মুখোমুখি যে যোদ্ধা তিনি উচ্চবংশজাত। পৃথা এবং পাণ্ডুর সন্তান। রাজরক্ত প্রবাহিত তার ধমনীতে। আপনার বংশপরিচয় জানার পরেই শুধুমাত্র তিনি লড়াই করবেন আপনার সাথে। রাজবংশের একজন আপনার মত অজানা কারো সাথে লড়াইয়ে নামবে না এটা বলাই বাহুল্য। বংশ পরিচয়ের কথাতে কর্ণের উদ্ধত মস্তক অবনত হয়ে যায় নিমেষেই। বৃষ্টির জলের ভারে গুটিয়ে যাওয়া পদ্মের মতই সংকুচিত হয়ে যায় সে।

 

সেই মুহুর্তে কর্ণের পক্ষাবলম্বন করতে এগিয়ে আসে দুর্যোধন। অঙ্গ রাজ্যের রাজা হিসাবে ঘোষণা দেয় এবং অভিষিক্ত করে তাকে। বলে যে, এর ফলে অর্জুনের সাথে লড়াইয়ে আর কোন বাধাই থাকলো না তার। তখনই সেখানে হাজির হয় রথচালক অধিরথ। কর্ণকে জড়িয়ে ধরে সে আমার সন্তান বলে। কর্ণও সসম্ভ্রমে অধিরথের পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়ে প্রণাম জানায়। এই দৃশ্যে হাসির রোল পড়ে যায় চারিদিকে। বিব্রত, অপমানিত কর্ণ গোধূলির অস্তমিত সূর্যের পানে তাকিয়ে মাথা নত করে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে।

 

কুলবংশ নিয়ে অপমানের এখানেই শেষ হয় না কর্ণের। দ্রৌপদীর স্বয়ংবরা সভায় পঞ্চপাণ্ডবের মত সেও গিয়েছিল। আশা ছিল তীর ছুঁড়ে মাছের চক্ষুভেদ করে জিতে নেবে দ্রৌপদীকে। কিন্তু তীর ছোড়ার ঠিক আগ মুহুর্তে কৃষ্ণের পরামর্শে সূতপুত্র বলে তাকে ডেকে বসে দ্রৌপদী। আর তাতেই চুল পরিমাণ কেঁপে যায় কর্ণের ধনুকের ছিলা। সামান্যের জন্য মাছের চোখকে ফাঁকি দিয়ে যায় তার তীর। জেতা হয় না দ্রৌপদীকে তার।

 

কুলবংশ নিয়ে কর্ণের সমস্যার শুরু আরো আগে থেকেই। যুদ্ধ কৌশল শেখার জন্য দ্রোণের কাছে গিয়েছিল সে। কিন্তু শুধুমাত্র ক্ষত্রিয়দেরকেই তিনি শিক্ষা দেন এই অজুহাতে কর্ণকে ছাত্র হিসাবে নিতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। দ্রোণের কাছ থেকে প্রত্যাখাত হয়ে নিজে  নিজেই যুদ্ধ কৌশল শেখার সিদ্ধান্ত নেয় কর্ণ। কিন্তু সেই সময়কার রীতি অনুযায়ী যে কোন শিক্ষার জনই গুরু থাকা প্রয়োজন ছিল। ফলে সূর্য দেবতাকে তার গুরু বানিয়ে নেয় কর্ণ। দিনের বেলায় সমস্ত অস্ত্রসস্ত্রের খোঁজখবর নিত সে, আর রাতের আঁধারে চলতো তার প্রশিক্ষণ। কিন্তু এগুলো পর্যাপ্ত ছিল না। তীরচালনার উন্নততর প্রশিক্ষণ এবং স্বর্গীয় অস্ত্র চালনা জানার জন্য একজন গুরু আবশ্যক হয়ে পড়ে তার। ফলে, ব্রাক্ষ্মণ সেজে সে হাজির হয় দ্রোণের গুরু পরশুরামের কাছে। পরশুরামের প্রশিক্ষণে কর্ণের এতই উন্নতি হয় যে, পরশুরাম পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, তীর চালনায় কর্ণ তাঁর সমান দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছে। পরশুরামের কাছ থেকে ব্রক্ষ্মাস্ত্রও জেনে নেয় কর্ণ।

 

তবে এখানেও সেই ভাগ্যই আবার প্রতারণা করে কর্ণের সাথে। প্রশিক্ষণের প্রায় শেষ পর্যায়ে একদিন পরশুরাম গাছের ছায়ায় ঘুমোনোর জন্য কর্ণকে বালিশ নিয়ে আসতে বলে। বালিশের পরিবর্তে নিজের উরু পেতে দেয় কর্ণ তার গুরুর জন্য। এই সুযোগটাই গ্রহণ করে কৃষ্ণ। বিশাল এক মৌমাছি সেজে কাপড়ের নীচ দিয়ে কর্ণের উরুতে গিয়ে কামড়াতে থাকে সে। গুরুর ঘুম ভেঙে যাবে বলে অসহ্য যন্ত্রণাকে মুখ বুজে সহ্য করতে থাকে কর্ণ। কামড় আরো গভীর হতে হতে রক্তারক্তি পর্যায়ে চলে যায়। কর্ণের উরু থেকে নিঃসরিত রক্ত মাথায় লাগতেই ঘুম ভেঙে যায় পরশুরামের। পুরো দৃশ্য দেখে তাঁর বুঝতে সময় লাগে না যে কর্ণ একজন ক্ষত্রিয়। এরকম অসহ্য বেদনা সহ্য করার ক্ষমতা ক্ষত্রিয় ছাড়া আর কারো নেই। ক্ষত্রিয়দের প্রতি প্রতিশোধের শপথ নেয়া পরশুরামের মাথায় আগুন চেপে যায়। অভিশাপ দেন তিনি কর্ণকে। যে বিদ্যা সে শিখেছে তাঁর কাছ থেকে, প্রয়োজনের মুহুর্তে তা কোনই কাজে আসবে না তাঁর। তখনও কর্ণ তাঁর ক্ষত্রিয় বংশ পরিচয়ের কিছুই জানে না। বার বার শুধু বলতে থাকে যে সে রথচালক আধিরথের সন্তান। শান্ত হয় পরশুরাম, কিন্তু শাপ ফিরিয়ে নেবার ক্ষমতা তাঁর আর ছিল না। গুরুর এই অভিশাপই একদিন কর্ণের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

 

অভিশাপ শুধু পরশুরামই দেয় নি কর্ণকে। ভূমিদেবীরও অভিশাপ ছিল তার উপর। ছোট এক বাচ্চা ঘি ফেলে দিয়েছিল মাটিতে। সৎ মায়ের ভয়ে ঘরে ফিরতে পারছিল না। তার অনুরোধে ঘি মেশানো মাটি তুলে নিয়ে মুঠিতে চাপ দিয়ে ঘিকে আলাদা করছিল কর্ণ। হঠাৎ করে নারীর আর্তনাদ শুনে মুঠি আলগা করে দেখে যে সেখানে ভুমদেবী। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে কর্ণকে অভিশাপ দিচ্ছে এই বলে যে, সে যেরকম করে মাটিকে চেপে ধরে আছে, গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে মাটিও সেভাবেই তার রথের চাকাকে চেপে ধরবে। এছাড়া দুর্ঘটনাক্রমে নিরীহ এক গাভীকে হত্যা করার জন্য গাভীর মালিকও অভিশাপে জর্জরিত করেছিল কর্ণকে। ওই অসহায় গাভীর মতই অসহায়ভাবে একদিন সে মারা যাবে বলে শাপশাপান্ত করেছিল তাকে।

 

শুধু অভিশাপই নয়, প্রতারণা এবং মায়ামমতার মায়াজালের কারণেও কর্ণ প্রয়োগ করতে পারে নি তার পুরো শৌর্যবীর্য। হস্তিনাপুরের যুদ্ধকৌশল প্রতিযোগিতার মাঠে অর্জুনকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানানোতে ভীত হয়ে পড়েছিল অর্জুনের জনক দেবতা ইন্দ্র। কর্ণকে অক্ষম করার বাসনায় ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে কর্ণের কাছে এসে উপস্থিত হন তিনি। তাঁর জানা ছিল যে, ঠিক দুপুরবেলায় কর্ণের কাছে কেউ কিছু চাইলে সে খালি হাতে ফেরে না। দ্বিপ্রহরে ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে কর্ণের কানের দুল এবং অভেদ্য বর্মকে চেয়ে বসেন তিনি। ভিক্ষুক যে ইন্দ্র সেটা বুঝে ফেলেও নিজের প্রতিজ্ঞা থেকে টলে নি কর্ণ। কানের দুল আর অভেদ্য বর্ম খুলে ইন্দ্রের হাতে দিয়ে দেয় সে। কর্ণের মহানুভবতায় অবাক হয়ে যান ইন্দ্র। অনুশোচনায় ভোগেন তিনি তাঁর প্রতারণায়। ফলে, কর্ণকে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র বাসবী শক্তি দান করেন তিনি। তবে শর্ত দেন যে কর্ণ এই অস্ত্র মাত্র একবারই ব্যবহার করতে পারবে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের আগেই ঘটোৎকচের উপর এই অস্ত্র প্রয়োগ করে ফেলেছিল কর্ণ।

 

তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করেছিল তার জন্মদাত্রী মা-ই। জেনে অথবা না জেনে, বুঝে অথবা না বুঝে। কুরুক্ষেত্রের ময়দানে যখন কৌরব এবং পাণ্ডবেরা চুড়ান্ত যুদ্ধের জন্য মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে, তখনই তার নিজ সন্তানেরা একে অন্যকে না জেনে হত্যা করবে এই ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে কুন্তী। রাতের আঁধারে হাজির হয় কৌরব শিবিরে। দেখা করে কর্ণের সাথে। তাকে খুলে বলে তার জন্ম পরিচয়। একদিন লোকলজ্জার ভয়ে যে শিশুকে ভাসিয়ে দিয়েছিল নদীর জলে তার কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমা চায় মাতা। ফিরে আসতে বলে পাণ্ডব শিবিরে বড় পাণ্ডবের মর্যাদা নিয়ে। রাধার সন্তান হিসাবে রাধেয় নামে নয়, বরং কুন্তীর সন্তান হিসাবে কুন্তেয় নাম নিয়ে। হতভম্ব কর্ণ জানায় তা আর সম্ভব নয়। কৌরব শিবিরের দায়িত্ব তার কাছে পাণ্ডবের মর্যাদার চেয়েও বেশি বড়। দুর্যোধনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। রাধেয়-র বদলে কুন্তেয় নাম নিতেও অস্বীকৃতি জানায় সে। বলে, বড় দেরি হয়ে গেছে মাগো। অর্জুনের সাথে মোকাবেলার প্রথম দিনেই যদি স্বীকৃতি দিতে আমাকে তবে হয়তো ভিন্ন হতো সবকিছু। এখন আর সে সময় নেই। কুন্তীর কোলে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানলেও দুটো কথা দেয় সে তার জননীকে। অর্জুন ছাড়া বাকি চার পাণ্ডবের কাউকেই সে হত্যা করবে না। কুন্তীকে অর্জুন অথবা তাকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আর তার নাগাস্ত্র সে মাত্র একবারই ব্যবহার করবে অর্জুনের বিপক্ষে। সেই সাথে কুন্তীকে অনুরোধ জানায় তার সত্যি পরিচয় যেন জীবিত থাকা অবস্থায় কাউকে না জানায়। সন্তানকে নিজ বক্ষে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ কুন্তী ফিরে যায় অশ্রুসজল চোখে।

 

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বার বার অর্জুনকে নাজেহাল করে ফেলে কর্ণ। একবার অর্জুনকে অসহায় অবস্থায় পেয়ে তার নাগাস্ত্রও প্রয়োগ করে সে, কিন্তু কৃষ্ণ অর্জুনের রথের চাকাকে মাটিতে পাঁচ ইঞ্চি দাবিয়ে দিয়ে বাঁচিয়ে দেয় অর্জুনের মাথাকে। ঠিক এসময়ই ভাগ্যদেবী তার নিষ্ঠুর খেলা শুরু করেন কর্ণকে নিয়ে। তার রথের বাদিকের চাকা দেবে যায় নরম মাটিতে। লাফ দিয়ে রথ থেকে নেমে চাকা উঠানোর চেষ্টা করে সে। কর্ণের এরকম অস্ত্রহীন অবস্থায় রথ নিয়ে কাছে চলে আসে কৃষ্ণ এবং অর্জুন। কর্ণ অর্জুনের কাছে আবেদন জানায় ধর্মের। এরকম কাপুরুষিত আক্রমণ না করার জন্য অনুরোধ জানায় তাকে। বলে যে, আমার রথের চাকা তুলে নেই, তারপর পুরুষের মত লড়াই করার সুযোগ পাওয়া যাবে অনেক। কর্ণের কথায় দ্বিধান্বিত হয় অর্জুন, নিরস্ত্র শত্রকে হত্যা করতে ইতঃস্তত করে সে। কিন্তু কৃষ্ণ প্ররোচিত করতে থাকে অর্জুনকে। শেষ চেষ্টা হিসাবে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে চাকা উঠানোর প্রয়াস নেয় কর্ণ। সামান্যতম নড়াতে পারে না চাকাকে সে, বরং আরো শক্তভাবে কাদায় গেঁথে যেতে থাকে তা। ভূমিদেবীর অভিশাপের কথা মনে পড়ে যায় কর্ণের। বাঁচার আর কোন উপায় না দেখে ব্রক্ষ্মাস্ত্র প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় সে। কিন্তু গুরু পরশুরামের অভিশাপে তাও মনে করতে পারে না সে। জন্মমুহুর্ত থেকে ভাগ্যবঞ্চিত বীর জীবনের শেষ মুহুর্তে, সবচেয়ে বড় প্রয়োজনের সময় এসেও তার দেখা পায় না। দুর্ভাগ্যই যেন নিয়তি তার। অভেদ্য বর্ম দিয়ে একদিন সুরক্ষিত ছিল যেই বুক, এখন তা অরক্ষিত। সেই অরক্ষিত বুকে এসে বেধে যুদ্ধের প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গকারী অর্জুনের কাপুরুষিত তীর।

 

পুত্রের এই করুণ মৃত্যু সইতে না পেরেই যেন কুরুক্ষেত্রের দিগন্ত থেকে মুখ নামিয়ে নেন সূর্যদেবতা। আর তাঁর অস্তমনের সাথে সাথে সূর্যপুত্রও চিরবিদায় নেয় বসুন্ধরা থেকে। পিছনে ফেলে রেখে যায় শুধু একরাশ অভিমানী দীর্ঘশ্বাস আর হতাশ্বাস।

 

মহাভারতের পাতায় যার নায়ক হবার কথা, খলনায়ক হয়ে থেকে যায় সে চিরতরে। যার বীরত্বে কেঁপে কেঁপে উঠতো বসুন্ধরা, সেই বসুন্ধরার বিশ্বাসঘাতকতায় অসহায়ের মত একদিন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে সে। মহাভারত তাই শুধু আর্যপুত্র অর্জুনের অর্জনের কাহিনিই নয়, সূর্যপুত্র কর্ণের করুণ কান্নায় সিক্ত এক বিষাদগাথাও বটে।

 

______________

 

রবীন্দ্রনাথের কাহিনী কাব্যগ্রন্থে কর্ণ এবং কুন্তীকে নিয়ে কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ নামে বিশালাকৃতির একটি দুর্দান্ত কবিতা আছে। কবিতাটির আবৃত্তি ইস্নিপ্স থেকে তুলে দিলাম। আবৃত্তি করেছেন পার্থ ঘোষ এবং গৌরী ঘোষ।

 

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

 

মহাভারতের কাহিনি নিয়ে সব্যসাচী দেবের একটা অনন্য কবিতা কৃষ্ণা। এই কবিতাটি্র অসাধারণ আবৃত্তি করেছেন ক্যাথেরীনা। আমার অসম্ভব পছন্দের আবৃত্তি এটি। কবিতাটি হয়তো পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক নয় আমার এই লেখার সাথে, আবার একেবারে অপ্রাসঙ্গিকও নয় সেটাও বলা যায়। অনেকেই হয়তো আগেও শুনেছেন এই আবৃত্তিটি। আবার শুনুন, নিশ্চয়তা দিচ্ছি ভাল লাগবেই।

 

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

 

 

কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

কর্ণ পুণ্য জাহ্নবীর তীরে সন্ধ্যাসবিতার

বন্দনায় আছি রত কর্ণ নাম যার

অধিরথসূতপুত্র , রাধাগর্ভজাত

সেই আমি কহো মোরে তুমি কে গো মাতঃ!

কুন্তী বৎস , তোর জীবনের প্রথম প্রভাতে

পরিচয় করায়েছি তোরে বিশ্ব-সাথে

সেই আমি , আসিয়াছি ছাড়ি সর্ব লাজ

তোরে দিতে আপনার পরিচয় আজ

কর্ণ দেবী , তব নতনেত্রকিরণসম্পাতে

চিত্ত বিগলিত মোর , সূর্যকরঘাতে

শৈলতুষারের মতো তব কণ্ঠস্বর

যেন পূর্বজন্ম হতে পশি কর্ণ-পর

জাগাইছে অপূর্ব বেদনা কহো মোরে

জন্ম মোর বাঁধা আছে কী রহস্য-ডোরে

তোমা সাথে হে অপরিচিতা!

কুন্তী ধৈর্য ধর্ ,

ওরে বৎস , ক্ষণকাল দেব দিবাকর

আগে যাক অস্তাচলে সন্ধ্যার তিমির

আসুক নিবিড় হয়ে কহি তোরে বীর ,

কুন্তী আমি

কর্ণ তুমি কুন্তী! অর্জুনজননী!

কুন্তী অর্জুনজননী বটে! তাই মনে গণি

দ্বেষ করিয়ো না বৎস আজো মনে পড়ে

অস্ত্রপরীক্ষার দিন হস্তিনানগরে

তুমি ধীরে প্রবেশিলে তরুণ কুমার

রঙ্গস্থলে , নক্ষত্রখচিত পূর্বাশার

প্রান্তদেশে নবোদিত অরুণের মতো

যবনিকা-অন্তরালে নারী ছিল যত

তার মধ্যে বাক্যহীনা কে সে অভাগিনী

অতৃপ্ত স্নেহক্ষুধার সহস্র নাগিনী

জাগায়ে জর্জর বক্ষে কাহার নয়ন

তোমার সর্বাঙ্গে দিল আশিস্‌-চুম্বন

অর্জুনজননী সে যে যবে কৃপ আসি

তোমারে পিতার নাম শুধালেন হাসি ,

কহিলেন রাজকুলে জন্ম নহে যার

অর্জুনের সাথে যুদ্ধে নাহি অধিকার

আরক্ত আনত মুখে না রহিল বাণী ,

দাঁড়ায়ে রহিলে , সেই লজ্জা-আভাখানি

দহিল যাহার বক্ষ অগ্নিসম তেজে

কে সে অভাগিনী অর্জুনজননী সে যে

পুত্র দুর্যোধন ধন্য , তখনি তোমারে

অঙ্গরাজ্যে কৈল অভিষেক ধন্য তারে

মোর দুই নেত্র হতে অশ্রুবারিরাশি

উদ্দেশে তোমারি শিরে উচ্ছ্বসিল আসি

অভিষেক-সাথে হেনকালে করি পথ

রঙ্গমাঝে পশিলেন সূত অধিরথ

আনন্দবিহ্বল তখনি সে রাজসাজে

চারি দিকে কুতূহলী জনতার মাঝে

অভিষেকসিক্ত শির লুটায়ে চরণে

সূতবৃদ্ধে প্রণমিলে পিতৃসম্ভাষণে

ক্রূর হাস্যে পাণ্ডবের বন্ধুগণ সবে

ধিক্কারিল ; সেইক্ষণে পরম গরবে

বীর বলি যে তোমারে ওগো বীরমণি

আশিসিল , আমি সেই অর্জুনজননী

কর্ণ প্রণমি তোমারে আর্যে রাজমাতা তুমি ,

কেন হেথা একাকিনী এ যে রণভূমি ,

আমি কুরুসেনাপতি

কুন্তী পুত্র , ভিক্ষা আছে

বিফল না ফিরি যেন

কর্ণ ভিক্ষা , মোর কাছে!

আপন পৌরুষ ছাড়া , ধর্ম ছাড়া আর

যাহা আজ্ঞা কর দিব চরণে তোমার

কুন্তী এসেছি তোমারে নিতে

কর্ণ কোথা লবে মোরে!

কুন্তী তৃষিত বক্ষের মাঝে লব মাতৃক্রোড়ে

কর্ণ পঞ্চপুত্রে ধন্য তুমি , তুমি ভাগ্যবতী ,

আমি কুলশীলহীন ক্ষুদ্র নরপতি

মোরে কোথা দিবে স্থান

কুন্তী সর্ব-উচ্চভাগে

তোমারে বসাব মোর সর্বপুত্র-আগে

জ্যেষ্ঠ পুত্র তুমি

কর্ণ কোন্‌ অধিকার-মদে

প্রবেশ করিব সেথা সাম্রাজ্যসম্পদে

বঞ্চিত হয়েছে যারা মাতৃস্নেহধনে

তাহাদের পূর্ণ অংশ খণ্ডিব কেমনে

কহো মোরে দ্যূতপণে না হয় বিক্রয় ,

বাহুবলে নাহি হারে মাতার হৃদয়

সে যে বিধাতার দান

কুন্তী পুত্র মোর , ওরে ,

বিধাতার অধিকার লয়ে এই ক্রোড়ে

এসেছিলি একদিন সেই অধিকারে

আয় ফিরে সগৌরবে , আয় নির্বিচারে

সকল ভ্রাতার মাঝে মাতৃ-অঙ্কে মম

লহো আপনার স্থান

কর্ণ শুনি স্বপ্নসম ,

হে দেবী , তোমার বাণী হেরো , অন্ধকার

ব্যাপিয়াছে দিগ্‌বিদিকে , লুপ্ত চারি ধার

শব্দহীনা ভাগীরথী গেছ মোরে লয়ে

কোন্‌ মায়াচ্ছন্ন লোকে , বিস্মৃত আলয়ে ,

চেতনাপ্রত্যুষে পুরাতন সত্যসম

তব বাণী স্পর্শিতেছে মুগ্ধচিত্ত মম

অস্ফুট শৈশবকাল যেন রে আমার ,

যেন মোর জননীর গর্ভের আঁধার

আমারে ঘেরিছে আজি রাজমাতঃ অয়ি ,

সত্য হোক , স্বপ্ন হোক , এসো স্নেহময়ী

তোমার দক্ষিণ হস্ত ললাটে চিবুকে

রাখো ক্ষণকাল শুনিয়াছি লোকমুখে

জননীর পরিত্যক্ত আমি কতবার

হেরেছি নিশীথস্বপ্নে জননী আমার

এসেছেন ধীরে ধীরে দেখিতে আমায় ,

কাঁদিয়া কহেছি তাঁরে কাতর ব্যথায়

জননী , গুণ্ঠন খোলো , দেখি তব মুখ ‘ —

অমনি মিলায় মূর্তি তৃষার্ত উৎসুক

স্বপনেরে ছিন্ন করি সেই স্বপ্ন আজি

এসেছে কি পাণ্ডবজননীরূপে সাজি

সন্ধ্যাকালে , রণক্ষেত্রে , ভাগীরথীতীরে

হেরো দেবী , পরপারে পাণ্ডবশিবিরে

জ্বলিয়াছে দীপালোক , এ পারে অদূরে

কৌরবের মন্দুরায় লক্ষ অশ্বখুরে

খর শব্দ উঠিছে বাজিয়া কালি প্রাতে

আরম্ভ হইবে মহারণ আজ রাতে

অর্জুনজননীকণ্ঠে কেন শুনিলাম

আমার মাতার স্নেহস্বর মোর নাম

তাঁর মুখে কেন হেন মধুর সংগীতে

উঠিল বাজিয়া চিত্ত মোর আচম্বিতে

পঞ্চপাণ্ডবের পানে ভাই লে ধায়

কুন্তী তবে চলে আয় বৎস , তবে চলে আয়

কর্ণ যাব মাতঃ , চলে যাব , কিছু শুধাব না

না করি সংশয় কিছু না করি ভাবনা

দেবী , তুমি মোর মাতা! তোমার আহ্বানে

অন্তরাত্মা জাগিয়াছে নাহি বাজে কানে

যুদ্ধভেরী , জয়শঙ্খ মিথ্যা মনে হয়

রণহিংসা , বীরখ্যাতি , জয়পরাজয়

কোথা যাব , লয়ে চলো

কুন্তী ওই পরপারে

যেথা জ্বলিতেছে দীপ স্তব্ধ স্কন্ধাবারে

পাণ্ডুর বালুকাতটে

কর্ণ হোথা মাতৃহারা

মা পাইবে চিরদিন! হোথা ধ্রুবতারা

চিররাত্রি রবে জাগি সুন্দর উদার

তোমার নয়নে! দেবী , কহো আরবার

আমি পুত্র তব

কুন্তী পুত্র মোর!

কর্ণ কেন তবে

আমারে ফেলিয়া দিলে দূরে অগৌরবে

কুলশীলমানহীন মাতৃনেত্রহীন

অন্ধ এ অজ্ঞাত বিশ্বে কেন চিরদিন

ভাসাইয়া দিলে মোরে অবজ্ঞার স্রোতে

কেন দিলে নির্বাসন ভ্রাতৃকুল হতে

রাখিলে বিচ্ছিন্ন করি অর্জুনে আমারে

তাই শিশুকাল হতে টানিছে দোঁহারে

নিগূঢ় অদৃশ্য পাশ হিংসার আকারে

দুর্নিবার আকর্ষণে মাতঃ , নিরুত্তর ?

লজ্জা তব ভেদ করি অন্ধকার স্তর

পরশ করিছে মোরে সর্বাঙ্গে নীরবে

মুদিয়া দিতেছে চক্ষু থাক্‌ , থাক্‌ তবে

কহিয়ো না কেন তুমি ত্যজিলে আমারে

বিধির প্রথম দান এ বিশ্বসংসারে

মাতৃস্নেহ , কেন সেই দেবতার ধন

আপন সন্তান হতে করিলে হরণ

সে কথার দিয়ো না উত্তর কহো মোরে

আজি কেন ফিরাইতে আসিয়াছ ক্রোড়ে

কুন্তী হে বৎস , ভর্ৎসনা তোর শতবজ্রসম

বিদীর্ণ করিয়া দিক এ হৃদয় মম

শত খণ্ড করি ত্যাগ করেছিনু তোরে

সেই অভিশাপে পঞ্চপুত্র বক্ষে করে

তবু মোর চিত্ত পুত্রহীন তবু হায় ,

তোরি লাগি বিশ্বমাঝে বাহু মোর ধায় ,

খুঁজিয়া বেড়ায় তোরে বঞ্চিত যে ছেলে

তারি তরে চিত্ত মোর দীপ্ত দীপ জ্বেলে

আপনারে দগ্ধ করি করিছে আরতি

বিশ্বদেবতার আমি আজি ভাগ্যবতী ,

পেয়েছি তোমার দেখা যবে মুখে তোর

একটি ফুটে নি বাণী তখন কঠোর

অপরাধ করিয়াছি বৎস , সেই মুখে

ক্ষমা কর্ কুমাতায় সেই ক্ষমা বুকে

ভর্ৎসনার চেয়ে তেজে জ্বালুক অনল ,

পাপ দগ্ধ করে মোরে করুক নির্মল

কর্ণ মাতঃ , দেহো পদধূলি , দেহো পদধূলি

লহো অশ্রু মোর

কুন্তী তোরে লব বক্ষে তুলি

সে সুখ-আশায় পুত্র আসি নাই দ্বারে

ফিরাতে এসেছি তোরে নিজ অধিকারে

সূতপুত্র নহ তুমি , রাজার সন্তান

দূর করি দিয়া বৎস , সর্ব অপমান

এসো চলি যেথা আছে তব পঞ্চ ভ্রাতা

কর্ণ মাতঃ , সূতপুত্র আমি , রাধা মোর মাতা ,

তার চেয়ে নাহি মোর অধিক গৌরব

পাণ্ডব পাণ্ডব থাক্‌ , কৌরব কৌরব

ঈর্ষা নাহি করি কারে

কুন্তী রাজ্য আপনার

বাহুবলে করি লহো , হে বৎস , উদ্ধার

দুলাবেন ধবল ব্যজন যুধিষ্ঠির ,

ভীম ধরিবেন ছত্র , ধনঞ্জয় বীর

সারথি হবেন রথে , ধৌম্য পুরোহিত

গাহিবেন বেদমন্ত্র তুমি শত্রুজিৎ

অখণ্ড প্রতাপে রবে বান্ধবের সনে

নিঃসপত্ন রাজ্যমাঝে রত্নসিংহাসনে

কর্ণ সিংহাসন! যে ফিরালো মাতৃস্নেহ পাশ

তাহারে দিতেছ , মাতঃ , রাজ্যের আশ্বাস

একদিন যে সম্পদে করেছ বঞ্চিত

সে আর ফিরায়ে দেওয়া তব সাধ্যাতীত

মাতা মোর , ভ্রাতা মোর , মোর রাজকুল

এক মুহূর্তেই মাতঃ , করেছ নির্মূল

মোর জন্মক্ষণে সূতজননীরে ছলি

আজ যদি রাজজননীরে মাতা বলি ,

কুরুপতি কাছে বদ্ধ আছি যে বন্ধনে

ছিন্ন করে ধাই যদি রাজসিংহাসনে ,

তবে ধিক্‌ মোরে

কুন্তী বীর তুমি , পুত্র মোর ,

ধন্য তুমি হায় ধর্ম , এ কী সুকঠোর

দণ্ড তব সেইদিন কে জানিত হায় ,

ত্যজিলাম যে শিশুরে ক্ষুদ্র অসহায়

সে কখন বলবীর্য লভি কোথা হতে

ফিরে আসে একদিন অন্ধকার পথে ,

আপনার জননীর কোলের সন্তানে

আপন নির্মম হস্তে অস্ত্র আসি হানে

এ কী অভিশাপ!

কর্ণ মাতঃ , করিয়ো না ভয়

কহিলাম , পাণ্ডবের হইবে বিজয়

আজি এই রজনীর তিমিরফলকে

প্রত্যক্ষ করিনু পাঠ নক্ষত্র-আলোকে

ঘোর যুদ্ধ-ফল এই শান্ত স্তব্ধ ক্ষণে

অনন্ত আকাশ হতে পশিতেছে মনে

জয়হীন চেষ্টার সংগীত , আশাহীন

কর্মের উদ্যম হেরিতেছি শান্তিময়

শূন্য পরিণাম যে পক্ষের পরাজয়

সে পক্ষ ত্যজিতে মোরে কোরো না আহ্বান

জয়ী হোক , রাজা হোক পাণ্ডবসন্তান

আমি রব নিষ্ফলের , হতাশের দলে

জন্মরাত্রে ফেলে গেছ মোরে ধরাতলে

নামহীন , গৃহহীন আজিও তেমনি

আমারে নির্মমচিত্তে তেয়াগো জননী

দীপ্তিহীন কীর্তিহীন পরাভব- পরে

শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে

জয়লোভে যশোলোভে রাজ্যলোভে , অয়ি ,

বীরের সদ্‌গতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই ।