ভূমিকম্প

মোকছেদ আলী*

ফতেহ মুহাম্মদপুরের নয়া জামে মসজিদ। তবলিগ জামাতের একদল মুসল্লী আসিয়াছেন অত্র এলাকায় দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য। তাহারা এই জামে মসজিদে অবস্থান করিতেছেন। চাপে পড়িয়া এই জামাতে আমিও শরীকী হইয়াছি। অনুরোধে ঢেকি গিলিয়াছি, এই আর কি?

২০ আগস্ট। ৫-১০ মিনিটে, ফজরের ফরজ নামাজের জামাত শুরু হইয়াছে। প্রথম রাকাত শেষ হইয়াছে। দ্বিতীয় রাকাতের সুরা ফাতিহা পাঠ শেষ করিয়া অন্য আরেকটি সুরা শুরু করিয়াছে। সহসা পায়ের তলার মাটি কাঁপিয়া উঠিল। তখনই বুঝিলাম, ভূমিকম্প শুরু হইয়াছে। তারপর পায়ের তলার নিচের মাটি দুলিতে লাগিল। ঠিক যেন দোলনা, একবার সামনে একবার পিছনে। এ দোলা উত্তর দক্ষিণে শুরু হইল।

সবাই নামাজে রত। সুতরাং কেহ কোন কথা বলিতে পারিতেছে না। আমি মনে মনে ভয় পাইলাম। নামাজরত অবস্থায় অন্য কোন দোয়া বা কোন কিছুই করা যাইবে না। করিলে নামাজ ফাসেদ হইয়া যাইবে। কিন্তু মনের মধ্যে যে ভয় আসিয়াছে, তাহাতে কি নামাজ ফাসেদ হইবে না?

ইমাম সাহেবও ভীত হইয়াছেন। সুরা দীর্ঘ করিলেন এবং কণ্ঠস্বর খাটো করিয়া পড়িতে লাগিলেন। তৎপর রুকু সেজদায় গিয়া রুকুর তসবিহ পড়ার পর কম্পন থমিয়া গেল।

আমার কেন জানি না, সমস্ত শরীর বমি বমি করিয়া উঠিল।

সালাম ফেরানোর পর সকলেই ভূমিকম্পের কথা কহিল। আমার মনে হইল উত্তর দক্ষিণে দোলা অনুভব করিলাম। সুতরাং এটার উৎপত্তিস্থল, ভারতের আসাম কিম্বা দার্জিলিং রাজ্যে হইবে।

বয়োবৃদ্ধ মুসুল্লীগণ বিগত ৩০/৪০ বৎসরের মধ্যে এরূপ প্রবল ভূমিকম্পের কথা কেহ শুনে নাই বলিয়া মন্তব্য করিল। নামাজ শেষে দোয়া খায়ের বাদ আমি সংবাদ শোনার জন্য বিহারী পাড়ায় পানের দোকানে গেলাম।

সাতটার খবরে কহিল, ৫-১০ মিনিটের সময় প্রবল ভূকম্পন সমগ্র দেশব্যাপী হইয়াছে। এ পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির কোনো সংবাদ পাওয়া যায় নাই।

দুপুরে একজন বিহারী লোক কহিল, ভূমিকম্পে ইন্ডিয়ার খুব ক্ষতি হইয়াছে, মুঙ্গের জেলার বহু ঘর বাড়ি দালান কোটা ধ্বংস হইয়া বহু লোক মারা গিয়াছে। আর নেপালেও হাজার হাজার ঘর বাড়ি ধ্বংস হইয়াছে, কয়েক হাজার লোক মারা গিয়াছে, লাখ লাখ লোক গৃহহীন হইয়াছে, হাজার হাজার লোক আহত হইয়াছে।

আজকের দিনটাতে, ভূমিকম্পের বিষয়টা আলোচনায় প্রাধান্য পাইয়াছে। রাস্তাঘাটে, রেস্তোরায় আলোচনা। ২০ দিন পূর্বে যে মৃদু ভূমিকম্প হইয়াছিল, তাহাতে ক্ষয়ক্ষতি বিশেষ কিছু হয় নাই। ঐদিন ভূতাত্বিক বিজ্ঞানীগণ আগামী কিছুদিনের মধ্যে প্রবল ভূমিকম্প হওয়ার আশংকা ব্যক্ত করিয়াছিল। তাহাদের কথা আজ সত্য হইল।

সংবাদপত্রে ভূমিকম্পের কথা সংবাদের শিরোনামে দেওয়া হইয়াছে। নেপালে ভূকম্পের ক্ষতিগ্রস্থদের সাহায্যের জন্য বিশ্বের দাতা দেশগুলো বহু সাহায্য নেপাল ও ভারতে পাঠাইয়াছে।

রেডিও, সংবাদপত্রে এবং লোক মুখে শুনিয়া শেষ তথ্য পাইলাম- এভূমিকম্প হইয়াছে ইন্ডিয়া নেপালের বর্ডার অঞ্চলে। এই ভূমিকম্প রেক্টর স্কেলের পরিমাণ ৬.৬। আর লোকসংখ্যা মারা গিয়াছে প্রায় ১৪৫০ জন।

আমাদের সরকারও নেপালে সাহায্য পাঠাইয়াছে।
ভূমিকম্প কেন হয়?

এই প্রশ্নের জবাব দুই প্রকারের পাওয়া যায়।

এক, ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসীগণ।

দুই, বিজ্ঞান ভিত্তিক।

ধর্মীয় বিশ্বাসের বিশ্বাসীগণের মধ্যে আবার শ্রেণী বিভাগ আছে। হিন্দু ধর্মের অনুসারীগণের দৃঢ় বিশ্বাস, এই পৃথিবী একটা বৃষের স্কন্ধপরি স্থাপিত। ঐ বৃষ যখন সামান্যতম নড়াচড়া করে, তখনই ভূকম্পন হয়। এই নড়াচড়ার পরিমাণ একটু বেশি হইলে পৃথিবীর স্থানে স্থানে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে।

মুসলমানগণের ধারণা, কোন স্থানের লোক গুরুতর পাপ করিলে আল্লাহতায়ালা, সেই স্থানের অধিবাসীদিগকে শাস্তি প্রদান কল্পে ভূমিকম্প প্রদান করেন। এ বিষয়ে কোরানে অতীতকালের আদ সামুদ লুত জাতীর ধ্বংসের কথা উল্লেখ আছে। ঐ সমস্ত জাতী যখন ন্যায় ও সত্যকে জলাঞ্জলি দিয়া পাপে মজিয়া গিয়াছে, নবীদের আহ্বান স্বত্বেও তাহারা পাপ পরিত্যাগ করিয়া সত্যের পথে আসে নাই, তখনই আল্লাহপাক ভূমিকম্প দ্বারা তাহাদের উপর ধ্বংস দিয়া দুনিয়ার বুক হইতে একেবারে নিশ্চিহ্ন করিয়া দিয়াছেন। সুতরাং ধর্মের সহজ সরল পথ পরিত্যাগ করিয়া মানুষ যখন অন্যায় করে, পাপের পঙ্কিলে ডুবিয়া যায়, তখনই ভূকম্পন দ্বারা তাহাদের শাস্তি প্রদান করা হয়। আর যাহারা বাঁচিয়া থাকে- তাহারাও তখন পাপ পরিত্যাগ করিয়া সংশোধিত হইবার সুযোগ পায়।

বৌদ্ধ ধর্মের আস্তিক্যবাদীরা ভূকম্পের কারণ সম্পর্কে বিবৃত করিয়াছে- মানুষ যখন বুদ্ধের অহিংসার আদর্শ ত্যাগ করিয়া হিংসার আশ্রয় গ্রহণ করে, তখনই ভূমন্ডল তাহার ভূগর্ভস্থ অগ্নিদ্বারা কম্পিত হইয়া, হিংসায় জর্জরিত নরাধম মনুষ্যকূলকে সতর্ক করিয়া দেয়।

ইয়াহুদি, খৃষ্টিয়ান ধর্মের অনুসারীগণেরও বিশ্বাস- পাপে যখন পৃথিবী ভারাক্রান্ত হয়, তখন সে তার ভার লাঘবের জন্য ভূকম্পন দ্বারা পাপিষ্ঠ মনুষ্যকূলকে ধ্বংস করিয়া দেয়।

মোটামুটি জানা গেল- ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসীগণ বিশ্বাস করে, পাপের কারণেই ভূমিকম্প হয়। সকল ধর্মের সার তত্ব একই কথা।

কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণা দ্বারা যে তথ্য উদঘাটন করিয়াছে তাহা এরূপ-

ভূবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভিত্তিশিলা চ্যুতি বা ফাটল বরাবর আকস্মিক ভূ-আলোড়ন হলে ভূমিকম্প হয়। মাটির গভীর অভ্যন্তরে এখনও প্রচন্ড অগ্নি আছে- তাহা হইতে গ্যাস উৎপন্ন হয়। এই গ্যাস যখন মাটির অভ্যন্তরে বিস্ফোরণ ঘটে তখনই ভূকম্পন হয় এবং ইহার পরিমাণ বেশি হইলে ভয়ানক বিপর্যয় ঘটে।

আবার আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের সময় ভূকম্পন হয়। ইটালির বিসুভিয়াস নামে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের সময় নিকটস্থ শহর পম্পেই ধ্বংস হইয়া যায়। জাপানের ফুজিয়ামা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের সময় হেক্কাইডো প্রদেশ ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়। পৃথিবীর মধ্যে জাপানে ভূমিকম্পের আধিক্য।

পৃথিবীর সবদেশেই কম বেশ ভূমিকম্প হয়। বিজ্ঞানীগণ আবহাওয়ার উপর ব্যপকভিত্তিক গবেষণা চালাইয়া সাইক্লোন বা প্রবল ঝড় কখন হইবে, কিরূপ গতিতে হইবে তাহার ভবিষ্যৎ সতর্ক সংকেত দেবার মত যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করিয়াছে। আবহাওয়া অফিসের সতর্ক সংকেত জানিয়া বা শুনিয়া সাবধান হইয়া বহু জীবন রক্ষা পাইয়াছে। তদ্রুপ, ভূমিকম্পের ব্যাপারে যদিও সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাষ সব সময় দেওয়া সম্ভব নয়, তবুও গ্রহণযোগ্য একটা আগাম সতর্কীকরণ জানমালের ক্ষতি কমাইয়া আনিতে সক্ষম হইবে। ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায় ভূমিকম্পের সংঘটন ঠেকাইয়া রাখা সম্ভব নয়।

অতীতের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, পৃথিবীর বহু শহর গ্রাম ভূমিকম্পের ছোবলে বিধ্বস্ত হইয়াছে। হাজার হাজার মানুষ নিহত হইয়াছে। ১৮৩৬ সালে কোয়েটায় ভূমিকম্প হইয়া বহু দালান কোটা বিধ্বস্ত হয়। মুঙ্গের, দ্বারভাঙ্গা, পাটনা প্রভৃতি শহরও দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পশ্চিম আফ্রিকার আগাদীর শহর, লোকসংখ্যা ১৮ হাজার। প্রচন্ড ভূমিকম্পে ১ মাইল মাটির অভ্যন্তরে দাবিয়া যায়। ৮ বর্গমাইল এলাকা সমতলভূমিতে পরিণত হয়। তুরস্কে প্রচন্ড ভূমিকম্পে কয়েকটি শহর বিধ্বস্ত হয়। কয়েক হাজার লোক নিহত হয়। আহতের সংখ্যা লাখের উপরে। ১৯৮১ সনে চীনে প্রচন্ড ভূমিকম্প হয়। বহু ঘর বাড়ি বিধ্বস্ত হয়। বহু লোকজন গবাদী পশু মারা যায়। এই ভূমিকম্পে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের দ্বিতীয় আশ্চর্য চীনের মহাপ্রাচীরের কয়েকস্থানে ফাটল ধরিয়া যায়।

১৯৪৮ সনে আসামের আসামে প্রচন্ড ভূমিকম্পে উত্তর আসামের পাহাড়ী এলাকার বনাঞ্চল ধ্বংস হইয়া যায়। যমুনা নদী দিয়া, গাছের গুড়ি ভাসিয়া যায়। প্রায় ১০ দিন যাবত যমুনায়, নৌ চলাচল বন্ধ থাকে। নদীর দুই তীরের লোকজন ঐ কাঠ তুলিয়া লয়। ঐ কাঠের বদৌলতে অনেকই সম্পদশালী হয়। বহু হাতি, বাঘ প্রভৃতি বন্য প্রাণীর মৃত দেহ যমুনা নদী দিয়া কাঠের সহিত ভাসিয়া যায়। আসামের ভূমিকম্প সম্পর্কে ভূতাত্ত্বিক বৈজ্ঞানিকগণ বলেন যে, হিমালয় পর্বতের একটি শিকড় সহসা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হওয়ায় এই বিপর্যয় ঘটে।

ভূগর্ভস্থ কয়লার খনি তথা যাবতীয় তেল ও গ্যাসের খনিগুলিও ভূমিকম্পের অবদান। লক্ষ লক্ষ বৎসর পূর্বে, এই পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব ছিল না। তখন প্রাগৈতিহাসিক জীবজন্তু ডিপ্লোডোক্কাস, এ্যমিনোডোক্কাস, পিথাগোরাস, প্রভৃতি সরিসৃপ জাতীয় জীব বাস করিত। এক একেকটি ডিপ্লোডোক্কাসের দেহের দৈর্ঘ ছিল আধ মাইল হইতে দেড় মাইল, আর উচ্চতা ছিল নাকি প্রায় এক মাইল। অর্থাৎ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পাহাড় পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘কিওক্রাডাং’ পাহাড়ের সমান।

ভূমিকম্পের ফলে ঐসকল অতিকায় জীবকূল ভূগর্ভে গ্রথিত হইয়া যায়। ভূগর্ভের উত্তাপে ঐ সকল প্রাণীর দেহ গলিয়া তৈল হয়। যাহা আজ আমরা কেরোসিন, ডিজেল পেট্রোল প্রভৃতি খনিজ তেল ব্যবহার করিতেছি। ভূমিকম্প না হইলে আমরা ঐ সমস্ত তেল কোথায় পাইতাম?

আর অতিকায় জীব জন্তুর সামনে আমরা মনুষ্যকূল কষ্মিকালেও টিকিয়া থাকিতে পারিতাম না। অতীতকালের প্রচন্ড ভূমিকম্পই আধুনিককালের মনুষ্যের জন্য মহাকল্যাণ বহিয়া আনিয়াছে।

পাথর কয়লার খনির সৃষ্টিও ভূমিকম্পের ফল। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে পৃথিবীর স্থানে স্থানে এরূপ বিশালকায় বৃক্ষ ছিল, যাহার যে কোন একটির বেড় ছিল ৫ শত হাত। অর্থাৎ পুরো এক বিঘা জমি জুড়িয়া ছিল মাত্র মাত্র বৃক্ষ। আর উচ্চতা ছিল চার শত মিটার। ডালপালা বেশি ছিল না, তাল নারিকেল জাতীয় সরলবর্গীয়। এই সব বৃক্ষের মহাঅরণ্য ভূমিকম্পের ফলে, ভূগর্ভে তলাইয়া যায়। দীর্ঘ বৎসর অর্থাৎ ৬০ হইতে ৮০ হাজার শতাব্দী ভূগর্ভে থাকিয়া আভ্যন্তরিণ উত্তাপে কয়লায় পরিণত হইয়াছে। কোন কোন পাথর কয়লার প্রতি লক্ষ্য করিলে স্পষ্টই বোঝা যায় এইগুলি এককালে বৃক্ষ ছিলো। গাছের আশ ও গিরাগুলি পরিস্কার স্পষ্ট বোঝা যায়।

বড় বড় বৃক্ষ পোড়াইয়া কাঠ কয়লা প্রস্তুত করা হয়। এই কাঠ কয়লা কিছুদিন আর্দ্র মাটির অভ্যন্তরে রাখিয়া দিলে, পাথর কয়লার রূপ ধারণ করে, ওজনে ভারী হয়, পাথর কয়লার ন্যায় উজ্জ্বল হয়। সুতরাং পাথর কয়লা যে বৃক্ষ হইতে সৃষ্টি হইয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই।

আজ আমরা আধুনিককালের আদমগণ কয়লা, তেল ব্যবহার করিয়া বিদ্যুৎ উৎপাদন করিয়া উন্নতির গতিধারায় যে বেগের সঞ্চার করিতেছি ইহারও মূলে রহিয়াছে ভূমিকম্প। সুতরাং ভূমিকম্প বর্তমান মানুষের অকল্যাণ করিলেও ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য মহাকল্যাণ সাধিত করে।

দুনিয়ার সব কিছুরই দুই দিক আছে, ভালো ও মন্দ। ভূমিকম্পও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নহে। ভূমিকম্পের মন্দ দিকটাই আমরা তাৎক্ষনিকভাবে প্রত্যক্ষ করিতে পারি। কিন্তু ইহার ভাল দিক অর্থাৎ ইহার সুদূরপ্রসারী সুফলও আমরা ভোগ করিতে পারি।

প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে পূর্ব দক্ষিণে হাওয়াই নাম একটি দ্বীপ আছে। ঐ দ্বীপটি খুবই উর্বরা এবং আর হাওয়া মনুষ্যকূলের জন্য স্বাস্থ্যকর। কিন্তু উর্বর জমিন ও চমৎকার স্বাস্থ্যকর আবহাওয়া সত্বেও অধিবাসীগণ নিরুদ্রুপ শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করিতে পারিত না। সমগ্র দ্বীপটিতে বিষয়ধর সর্পে পরিপূর্ণ ছিল। বিষাক্ত সাপের ছোবলে প্রতি বৎসর বহু লোকের প্রাণহানি ঘটিত। মাঠের ফসলের সর্বাপেক্ষা বড় শত্র“ ধেড়ে ইদুরের উৎপাত ছিলা ভয়াবহ। কৃষকগণ তাহাদের কঠোর পরিশ্রমলব্ধ খাদ্যশস্য গম, ধান, আলু এবং অন্যান্য নিত্ত প্রয়োজনীয় ফল ফসল ষোল আনা ঘরে আনিতে পারিত না। মাঠের ইঁদুর অর্ধেকেরও বেশি ধ্বংস করিয়া দিত। উর্বর ভূমি থাকা ও কঠোর পরিশ্রম করা সত্বেও তাহাদের দারিদ্রতা মোচন হইত না। ইদুরের অত্যাচারে তারা অতিষ্ট থাকি। বিষধর সাপের ছোবল, মাঠের ইদুরের অত্যাচার শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া তাহার কষ্টভোগ করিত।

১৮৩৭ খৃষ্টাব্দে এই হাওয়াই দ্বীপে এক প্রবল ভূমিকম্প হয়। এই ভূমিকম্পে স্থানে স্থানে মাটি ফাটিয়া গরম পানি ও গ্যাস উত্থিত হয়। প্রচন্ড ভূমিকম্প হওয়া সত্বেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খুবই সামান্য। কিছুদিন পর হাওয়াইনগণ বিস্ময়ের সহিত প্রত্যক্ষ করিল যে, তাহাদের দারিদ্রতার মূল কারণ, তাহাদের চীরশত্রু সাপ ও ইঁদুর সমূলে ধ্বংস হইয়াছে। হাওয়াই দ্বীপ হইতে চিরতরে অস্তিত্ব বিলুপ্ত হইবার কারণ অনুসন্ধান করিয়া এই সিদ্ধান্তে পৌছিয়াছে যে, ভূমিকম্পের ফলে মাটির অভ্যন্তর হইতে যে গরম পানি ও গ্যাস উত্থিত হয়, তাহাতে সাপ ও ইঁদুর ধ্বংসকারী এক প্রকার ব্যাকটেরিয়া ছিল। এই ব্যাকটেরিয়ার কারণেই সাপ ও ইঁদুর হাওয়াই দ্বীপ হইতে চীরতরে বিলুপ্ত হইয়াছে। হাওয়াইনগণ পুস্তকের পাতায় সাপ ও ইদুরের ছবি দেখিয়াই বুঝিতে পারে যে, এককালে এই দুইটি জীব তাহাদের দেশের মনুষ্যকূলের পরম শত্রু ছিল।

বর্তমান বিশ্বে হাওয়াইই একমাত্র দেশ যেখানে সাপ ও ইঁদুর জাতীয় কোন জীবের অস্তিত্ব নাই বলিলেই চলে। কেন যে নাই এর মূল কারণ কি? মূল কারণ ভূমিকম্প।

ভারত মহাসাগরে সারাওয়াক নামে একটি দ্বীপ আছে। দ্বীপটি পূর্বেও ওলন্দাজগণ কর্তৃক শাসিত হইত। ১৯৪৮ সনে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা লাভ করিলে সারাওয়াক দ্বীপটিও স্বাধীনতা লাভ করে এবং ইহা ইন্দোনেশিয়া প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভূক্ত হয়। ইন্দোনেশিয়ার মূল ভূখন্ড হইতে দ্বীপটি দক্ষিন পশ্চিম দিকে ৮৫ কিলোমিটার দূরে। দ্বীপটির আয়তন বাংলাদেশের ভোলা দ্বীপের সমান। লোকসংখ্যা ৩ লক্ষাধিক। অধিবাসীর শতকরা ৯৬ ভাগ মুসলমান। অবশিষ্ট ৪ ভাগ আদিম যুগের জড় উপাসক।

স্বাধীনতা লাভের পূর্বে এই দ্বীপে মশা ও মাছির উপদ্রব ছিলো অত্যধিক। মশার কামড়ে অধিকাংশ লোক ম্যালেরিয়ায় ভুগিত। দ্বীপের অধিকাংশ এলাকা জুড়িয়া বনাঞ্চল, কোন কোন লোক ধারণা করিত অরণ্যের আধিক্যহেতু মশকের উপদ্রব বেশী।

একবার সরকারী প্রচেষ্টায় মশক নিধন অভিযান চালানো হয়। কিন্তু অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মশক নিধনের বিরুদ্ধে মশককূল নতুন অভিযান চালায়। তাহাদের বংশ এরূপ বৃদ্ধি পাইতে লাগিল যে একটি মশা বধ করিলে দশটি মশা বৃদ্ধি হইত। অজস্র অর্থ ব্যয় করিয়াও যখন মশকের বংশ ধ্বংস করা সম্ভব হইল না, তখন সরকার হাল ছাড়িয়া দিল।

রাজ্যে মাছির উৎপাতও ভীষণভাবে বৃদ্ধি পাইল। খাবারের দোকানগুলিতে মাছির উৎপাত বেশি হইল। হোটেলে রেষ্টুরেন্ট, মিষ্টান্নের দোকানগুলিতে বেশি পরিমাণে মাছির উৎপাত হইল। মশা ও মাছির উপদ্রুব অত্যাচারে রাজ্যের জন মন্ডলী অতিষ্ট হইয়া উঠিল। এই বিপদ হইতে রক্ষা পাওয়ার কোন পন্থাই কার্যকরী হইল না। মশা মাছির অত্যাচারে অতিষ্ট হইয়া সামর্থবান লোকেরা দেশ ত্যাগ করিয়া পাশ্ববর্তী রাজ্য ইন্দোনেশিয়ায় চলিয়া গেল। পর্যটকেরা সারাওয়াকের ভূমিতে পদার্পন করিয়া মশামাছির নিদারুন উৎপাত দেখিয়াই যে পথে আসিয়াছিল সেই পথেই ফিরিয়া গেল।

হলান্ডের রাজধানী দিহেগ শহরে মন্ত্রীসভার বৈঠক বসিল, বৈঠকে হলান্ডের অধিকৃত রাজ্য সারাওয়াকের মশা মাছির উপদ্রব লইয়া আলোচনা করা হইল। মন্ত্রী সভার বৈঠকে, মশা মাছি দূর করার জন্য একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হইল। কমিটি তাহাদের কার্য আরম্ভ করিবার পূর্বেই সমসগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এক প্রবল ভূমিকম্প হয়। ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালোশিয়া, বর্ণিও, সিলিবিস প্রভৃতি দ্বীপে ভূমিকম্পহেতু অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

এই ভূমিকম্পের ফলে সামুদ্রিক জলোচ্ছাস হয়। সারাওয়াকের উপর দিয়া এই জলোচ্ছাস প্রবাহিত হয়। এই ভূমিকম্পের ফলে উদ্ভূত জলোচ্ছাসে কিছু লোক নিহত হয়।

সপ্তাহ খানেক পরে রাজ্যের জনগণ দেখিল, মশা ও মাছি রাজ্যের কোন অঞ্চলেই নাই। ভূমিকম্পের ফলে কি এক অজ্ঞাত কারণে দেশের সমস্ত মশা মাছি ও আরো বহু ক্ষতিকর কীট পতঙ্গ নিশ্চিহ্ন হইয়া গেছে। লোক সকল মাছির মশার অত্যাচার হইতে পরিত্রাণ লাভ করে। আজ পর্যন্ত সেখানে তেমন কোন মশা মাছির উপদ্রুপ নাই।

বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া সরকার সারাওয়াকের সমুদ্রপকূলে পর্যটন কেন্দ্র গড়িয়া তুলিয়াছে। বিশ্বের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির মধ্যে সারাওয়াক এক উৎকৃষ্ট স্বাস্থ্যনিবাস। যে রাজ্য এক-কালে মশা মাছির উপদ্রবে লোক সকল দেশ ত্যাগ করিয়া অন্য রাজ্যে চলিয়া গিয়াছিল, এখন সেই রাজ্য ভূমিকম্পের বদৌলতে বিশ্বের অন্যতম সেরা স্বাস্থ্য নিবাস।

এই কথা শুনিয়া বাংলাদেশের এক যুবক, বাংলাদেশ হইতে মশা মাছি, সাপ ও ইদুরের উৎপাত অত্যাচার হইতে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে আকুল আবেদন করিয়াছে। আবেদনে আর্জি পেশ করিয়াছে- হে আল্লাহ আমাদের দেশে ভূমিকম্প দিয়া আমাদের দেশ হইতে অতিসত্বর
১) সাপ
২) ইঁদুর
৩) মশা
৪) মাছি;
অনুগ্রহ করিয়া দূর করিয়া দাও।

ভূগর্ভস্থিত গর্তমধ্যে সাপ ও ইঁদুর বেশি সময় অবস্থান করে। ভূকম্পন শুরু হইলে, তাহারা গর্ত হইতে বাহির হইবার চেষ্টা করে, কিন্তু তাহাদের চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, কারণ ভূকম্পনের ফলে অধিকাংশ গর্তের মুখ বন্ধ হইয়া যায়। কিম্বা তাহারা এতই ভীত হয় যে, হার্টফেল করে।

যাহা হোক যুবকের আবেদন যিনি এই বিশ্ব বৃহ্মান্ড সৃজন করিয়াছেন তিনি মঞ্জুর করিয়া আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে সাপ ও ইঁদুরমুক্ত করুন। প্রতি বৎসর বাংলাদেশে সর্পাঘাতে ১০ হইতে ১৫ শত লোক মারা যায়। এই মৃতের সংখ্যা দিনাজপুর এলাকায় বেশি।

মশা মাছির কথা কি আর বলিব। যাহাদের মশারী আছে তাহারা তো শান্তিতেই ঘুমায় কিন্তু যাহাদের নাই, তাহাদের অবস্থা কিরূপ সেটা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে।

যাহা হোক, আমরা আশা করি আগামীতে বাংলাদেশে প্রবল ভূমিকম্প হইবে এবং উহার কল্যাণে বাংলাদেশের বুকে হাওয়াই দ্বীপের মত সাপ ও ইঁদুর মুক্ত হইবে এবং সারাওয়াক দ্বীপের ন্যায় মশা-মাছি মুক্ত হইবে। সেই সময় যদি মানুষেরা একবেলা আহার করে তবুও পরম শান্তিতে নিদ্রা যাইতে পারিবে। কারণ সর্পাঘাতে মৃত্যুবরণ করিতে হইবে না। ইঁদুর মাঠের ফসল ধ্বংস করিবে না। আর মাছি নাকের ডগায় বসিয়া সুরসুরি দিবে না। মশা দংশন করিবে না। পরম শান্তি হইবে।

ওঁ শান্তি।

এরূপ শান্তির উদ্দেশ্যে ভূমিকম্প কবে হইবে, সেই আশায় দিন গুনিতে থাকিব।

২১-২৪ আগস্ট ১৯৮৮। আমবাগান, ঈশ্বরদী।

*মোকছেদ আলী (১৯২২-২০০৯)। স্বশিক্ষিত। সিরাজগঞ্জ জেলার বেলতা গ্রামে জন্ম। বর্তমানে গ্রামটি নদীগর্ভে বিলীন।