যখন ইন্টার এ পড়ি তখন থেকেই আসলে অজ্ঞেয়বাদ থেকে নাস্তিক্যবাদের দিকে বিবর্তন শুরু হয় আমার। তখন একটা সময় ছিল, অনেক তর্ক করতাম , অনেক উৎসাহ লাগতো এসবে। নিজে যা বুঝতাম কিংবা বোঝাতে চাইতাম তা অন্যদেরকে ঠিক ঠিক বোঝাতে পারতাম খুব ভালো করেই। কিন্তু এখন আর পারি না। আমার ধারনা যেইসব জিনিস মানুষ খুব বেশি বোঝা আরম্ভ করে সেইসব জিনিস সে একটা সময় আর অন্যদেরকে বোঝাতে পারে না।অন্যদের কাছে আস্তে আস্তে দুর্বোধ্য হয়ে যায়। ভাষার সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করে যতটা পারে কথা কম বলার চেষ্টা করে। কিন্তু মাঝে মাঝে এত বিরক্ত লাগে কিছু না বলে থাকা যায় না। এখানেই যত বিপত্তি।আর এই বিপত্তির কারনেই লিখতে বসা।

আমাকে কেউ কেউ মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে, আমি নাস্তিক কেন ? কখনো উত্তর দেই, কারন মানুষ আমায় নাস্তিক বলে তাই আমি নাস্তিক।ঈশ্বর নামের জিনিসটা সবাই যেমন কমন ভাবে চিন্তা করে, আমি সেরকম করি না, একটু আলাদা ভাবে ভাবি। এ ছাড়া আর দশটা মানুষের সাথে আমার পার্থক্য খুব বেশি একটা চোখে পড়ার মতো না।
যাই হোক সেদিন একজন আমাকে খুব ভালোকরে জেরা করা শুরু করলো আমি কেন ঈশ্বর মানি না ? আমার খুব একটা ইচ্ছা করে না এইসব নিয়ে তর্ক করার । কারন শেষটা খুব একটা ভালো হয় না। বেশিরভাগই তর্কের শেষে একটা উপদেশ বাণি শুনতে হয়- “যই করো মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে কথা বলো না” তাই ভাবি মানুষের সাথে কথা বলাই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ হয়তো। কারন আস্তিকরা খুব সহজেই কষ্ট পায়( নাকি কষ্ট পাওয়ার ভান করে কে জানে) কিন্তু নাস্তিক হলে কষ্ট পাওয়ার অধিকার আর থাকে না । আমরা ঈশ্বর নাই বললে ওদের মনে কষ্ট লাগে কারন ওরা সেটা বিশ্বাস করে, কিন্তু ওরা ঈশ্বর আছে বললে আমাদের কষ্ট লাগা মানা… আমরা হয়তো মানুষ না। আমাদের মন নাই… খারাপ না যদিও ব্যাপারটা । আসলে আমরা সবাই জানি এইসব ঢং ছাড়া আর কিছুই ন।

অনেক আবোল-তাবোল এর পরে আবার জিজ্ঞেস্ করলো, কেন ঈশ্বর মানি না। বললাম, তোমার ঈশ্বরের একটা রোগ হয়েছে। ঈশ্বর সেই রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করুক। এরপর হয়তো বিশ্বাস করতে পারি।
আবার প্রশ্ন; মানে ? ঈশ্বরের আবার কিসের রোগ ? বললাম , আমার যেই রোগ তোমার ঈশ্বরের ঠিক সেই রোগ!
বুঝলো না এবারো। বললাম… তোমার ঈশ্বরও আমার মতো নাস্তিক… নিজের স্রষ্টাকে মানে না।
আর খুবই স্বাভাবিক , এই ধরনের কথা শুনলে ওনাদের যেইরকম রি-একশন হয়, অনেকটা সেরকমই দেখা গেল। কিন্তু মজার একটা জিনিস শুনলাম ওর কাছ থেকে।
ঈশ্বরের নাস্তিকতার পেছনেও ওর ভালো রকমের যুক্তি আছে। আর সেটা হলো ঈশ্বর এমন একটা জিনিস যা আমাদের এই মনুষ্য মস্তিস্কে ধরবার নয়। আমাদের সেই ক্ষমতাই নেই।মোট কথা মানুষের সীমাবদ্ধতার বিশাল একটা লেকচার শুনতে হলো। খারাপ লাগলো না… আমরা কি কি পারি , কি কি পারি না এইসব। আরো অনেক কিছু। কিন্তু এইসব শুনতে বেশিক্ষন ধর্য্য থাকে না। আমি এমনিতেই খুব তাড়াতাড়ি ধর্য্য হরানোর মানুষ। তাই ওকে বললাম, যাও ফিলসফি ক্লাস নাও… আমি তোমার মনযোগি ছাত্র হতে পারি। কিন্তু তর্ক করতে এসে ফিলসফি করো না।

আসলে মানুষের কিংবা বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা বলে এই ধার্মিক মানুষগুলো অনেক শান্তি পায়। আর সেখানেই ঈশ্বরকে আমদানি করে ফেলে এককথায়। কিন্তু সেই জায়গাটাও কোন না কোন ভাবে ঈশ্বরকে ছেড়ে দিতে হয় বিজ্ঞানের কাছে , আমাদের জ্ঞানের কাছে। এটাই হয়ে এসেছে… আল্লাহ ভালো করার মালিক ছিল অনেকদিন… এখন ডাক্তার আর ওষধ কিছুটা হলেও সেই জায়গায় ভাগ বসিয়েছে… দিনে দিনে এমন আরো অনেক হবে। কিন্তু মজার ব্যপার এগুলো ওদের জন্য শুধু ইগনোর করার জিনিস !!

কিন্তু কতক্ষন মানুষের সীমাবদ্ধতাকে পুজি করবে মানুষ ঈশ্বরকে বাচাতে ? আমি ভেবেছি এই জিনিসটা নিয়ে। মানুষের জ্ঞানের ঠিক কোন পর্যায়ে এই ঈশ্বরের অবস্থান হতে পারে ? আর মানুষের এই জ্ঞানের জগৎটা খুব বেশি বড় নয়… অল্প কিছু খন্ডে বিভক্ত। যদিও এই ক্লাসিফিকেশনটা আমার নিজের না। কোন এক জায়গায় শুনেছি… আমি এখন যেভাবে লিখছি সেটা হয়তো একটু আলাদা হতে পারে।
পুরো জ্ঞানের জগৎটা এরকমভাবে সাজানো যায়;

১. সেইসব জিনিস যা আমরা জানি
২. সেইসব জিনিস , যা আমরা জানি না এখনো কিন্তু জানবো
৩. সেইসব জিনিস, যা আমরা কখনেই জানবো না

আর খুবই আক্ষেপের বিষয় ঈশ্বরের এই তিন নম্বর অপশনটাই একমাত্র আবাস্থল।যেটা একটা গানিতিক ডেড এন্ড, ইনফিনিটিও বলা যায়। কিন্তু গনিতবিদরা ইনফিনিটি খুব একটা পছন্দ করেন না সমাধান হিসেবে।
১ নং আর ২ নং এর সাথে আমাদের জিবনের অনেক কিছুর সম্পর্ক আছে। এইগুলো আমাদের জন্য অবশ্যই ম্যাটার করে। কিন্তু এই ৩ নং জিনিসটার সাথে আমাদের আসলেই কোন সম্পর্ক নেই।

যার ব্যপারে আমরা কিছুই জানতে পারবো না তা আছে কি নাই এই নিয়া মারামারির কি দরকার ? থাকলেই কি আর না থাকলেই কি ? আর যা আমরা কখনোই জানবো না তা নিয়ে কেন সময় নষ্ট করবো ? আমাদের কি বেকার সমস্যা এতই তীব্র ? আর তীব্র বেকার সমস্যায়ও বোধয় এই জিনিসটা নিয়ে কেচাল বাধানোর কোন ফায়দা নেই। ইনফিনিটি থেকে কিছু গেলে আর আসলে তাতে কিছুই আসে যায় না। তার চেয়ে বরং যদি এই আস্তিকের দল প্রথম দুইটা জিনিসের দিকে মনযোগ দেয় , তাহলে বোধয় সেটা তাদের এবং সকলের জন্য মঙ্গল। কিন্তু আসলেই এরা মঙ্গল চায় কিনা কে জানে ? রিচার্ড ফাইনম্যান এর একটা কথা খুব মনে পড়ে ওদের স্বভাবটা দেখলে… তিনি মিডিয়া আর সাধারন মানুষদের ওপর বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন;

“ এরা কখোনো সেইসব জিনিস নিয়ে প্রশ্ন করে না যা আমরা জানি , বরং সেইসব জিনিস নিয়ে প্রশ্ন করে যেটা আমরা জানি না, এবং আমরা যে সেটা জানি না সেটা তারাও জানে। তারপরেও হাসি হাসি মুখ করে এইসব প্রশ্ন করে।“

আসলেই কি এদের জানার ইচ্ছা আছে ? যখন বিজ্ঞানীরা নতুন কিছু একটা আবিষ্কার করে তখন সেইটা নিয়ে আর আগ্রহ থাকে না মানুষের , বরং বিজ্ঞানিরা কি জানে না , সেইটা গুগল সার্চ দেয়। আর সেইটা নিয়ে কথা বলা শুরু করে… তাহলে আমরা যা কিছু জানলাম তার মুল্য কি রইল এদের কাছে ? এরা আসলে কি চায় ? জানতে চায় ? নাকি জানতে চায় বলে ভন্ডামি করে ?
আরো একটা কারনে আমি এই তৃতীয় অপশনটাকে পছন্দ করি না। কারন এই যে জায়গাটা এটা একটা অন্ধকার ঘরের মতো… এখানে যে কেউ যেকোন কিছু করতে পারে অন্যেরা সেটা দেখার সুযোগো পাবে না। সেইভাবেই আমাদের সমাজের সব কুসংস্কারগুলো গড়ে উঠেছে। তাই একজন বুদ্ধিমান মানুষ কেন যে জেনেশুনে এই অন্ধকার ঘরে ঢুকতে চায় সেইটা অবশ্যই সন্দেহের বিষয়। আমার ভাই অন্ধকার ভালো লাগে না খুব একটা। তাই এই জায়গায় আমার চরম বিতৃষ্ণা।

জানি না কবে এরা আসলেই বিজ্ঞানকে বুঝবে, বিজ্ঞান কিভাবে কাজ করে সেইসব বুঝবে। বিজ্ঞানের সুত্রগুলো দিয়ে শুধু গানিতিক সমস্যা সমাধান করে শুধু নাম্বার তুলবে না বরং সেইসব সূত্র কে ভালোবাসবে, সেইসব সূত্রের পেছনের কষ্টগুলোকে বুঝবে…
সবকিছুর ব্যাখ্যা আল্লাহ হলেও তাতে কিছু যায় আসে না অন্তত এই ব্যপারটা বুঝবে… ফ্যানের বাতাস , টিভির সিরিয়া কিংব আজকের এই ইন্টারনেট এর কোনটাই আল্লাহ এসে কোন নবীর কানে বলে দিয়ে যায় নি। আমার জানা মতে কোন বিজ্ঞানীই নবুয়াত লাভ করে বিজ্ঞানী হয় নি। এটা চোখে পড়াড় জিনিস হলেও কেন যে চোখে পড়ে না কে জানে ?