মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা- (২ য় পর্ব)
-মোকছেদ আলী*
১ম পর্ব। ২য় পর্ব। ৩য় পর্ব। ৪র্থ পর্ব।
আত্মসমর্পনের আগের কয়েকটি দিন আমাদের ভেড়ামারাতে পাকবাহিনী পশ্চাৎপসারণ করতে লাগল। মাঝে মাঝে প্রচন্ড বিস্ফোরণে আমার দালান থর থর করে কাপতে লাগল। ঐ সময় পরিবারসহ ফিরে এসেছিলাম জগন্নাথপুর থেকে। লোকমুখে শুনেছিলাম যুদ্ধ থেমে যাচ্ছে। তাই ফিরে এসেছিলাম।
বিকালে একজন মুক্তিযোদ্ধা এসে আমাকে বলেছিল, “দুলাভাই, আপনি ভেড়ামারা বাজারে থাকবেন না। আমরা আল্লাহরদর্গা থেকে শেল ছুড়বো। কোথায় যে গিয়ে পড়বে তার তো ঠিক নাই।”
সন্ধ্যার সময় পাক বাহিনীর একজন বৃদ্ধমত লোক আমাকে দেখে বলল, “তুম হিয়াসে, বাল বাচ্চা লেকে দেহাত মে চলে যাও। হিয়া জবরদস্ত জঙ্গ হোগা। দেখ, খানা পিনাকা সামান লেকে জলদি জলদি ভাগ যাও।” দেখলাম, লোকটির হৃদয়ে দয়া মায়া আছে। সেনাবাহিনীর লোক হলেই নিষ্ঠুর হবে এই ধারণা আমার ছিল, কিন্তু ঐ পাকসেনাকে সেরূপ মনে হলো না। মুক্তিযোদ্ধা নাম শুনলেই বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা সাহস অনুভব করতাম। কোন ভয় করতো না। আর পাকসেনা নাম শুনলেই ভয়ে কেঁপে উঠত আত্মা। মুক্তিযোদ্ধা ছিল আপন, আর পাকসেনা ছিল পর।
আমি আমার ছেলেমেয়ে নিয়ে শ্বশুড় বাড়ী গেলাম। দেখি- আমার শ্বশুড় একা একা রয়েছে। শ্বাশুড়ী ভয়ে বাড়ি ছেড়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে।
আমাদের দেখে শ্বশুড় কিছুটা খুশি হলেন। আমরা ঘরের দরজা জানালা এবং গেটের দরজা বন্ধ করে মনে মনে শুধু আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম।
রাত আটটার সময় মুক্তিযোদ্ধা আর বৃদ্ধমত পাকসেনার কথা বাস্তবে পরিণত হলো। পাড়ায় লোক নেই। সবাই চলে গেছে। প্রাণের ভয়, কার না আছে? প্রাণের ভয়ে বাড়ী ঘর ধন সম্পদ ফেলে ছেলেমেয়ে নিয়ে কোথায় গেছে কে জানে! এই নির্জন নীরব পাড়ায় শুধু আমরাই কয়টি প্রাণী। প্রচন্ড শীত। ছেলেমেয়েদের লেপের তলায় শোয়ায়ে আমি আমার স্ত্রী ও শ্বশুড় শুধুমাত্র রক্ষাকর্তা আল্লাহকে ডাকছি।
সহসা আমাদের কানে তালা লাগনোর মত বাশ ঝাঁড়ের মধ্যে প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরণ হল। লেপের তলা থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কেঁদে উঠল। তাড়াতাড়ি ওদের চৌকির উপর হতে চৌকির নিচে স্থান করে দিলাম। ঘরে অনেক তক্তা ছিল, সেগুলি দিয়ে চৌকির চারদিকে বেড়া দিয়ে দিলাম। যদি ঘরের উপরে পড়ে তবে তো রক্ষা নাই। ঘরের বাইরে পড়া বোমার টুকরা এবং বোমার মধ্যে যে সব জিনিস থাকে সেগুলি ছিটকে এসে আঘাত হানতে না পারে সেইজন্য এই সতর্কতা অবলম্বন করলাম।
সহসা আরেকটি বিস্ফোরন হল আমাদের হল বাজারের দিক থেকে। আরেকটা হইল বামনপাড়ার দিকে, আরেকটা হইল স্টেশনের দিকে, আরেকটা হইল হাইস্কুলের দিকে। আমরা শুধু কলেমা পড়ছি আর আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা চাচ্ছি।
আমার স্ত্রী খুব সাহসী। সে আমাকে দারুন সাহস দিল- “দেখ, আমরা তো কারো ক্ষতি করি নাই। আমাদের উপর কোন গজব হবে না। স্মরণ কর সেই পাবনার কথা, যেদিন হিন্দুদের তুমি আশ্রয় দিয়েছিলে [১] সেদিন তারা তোমাকে নিশ্চয়ই দোয়া করেছিল। ইচ্ছা করলে তো তুমি তাদের গুন্ডা দ্বারা সকলকে হত্যা করে ওদের বাড়ী ঘরের শয় সম্পদ লুট করতে পারতে কিন্তু তা তুমি করনি। সুতরাং শুধু আল্লাহকেই ভয় কর। শেল বল, বোমা বল কিছুই আমাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না।”
স্ত্রীর কথায় কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা পেলাম। সহসা আরেকটি বিস্ফোরণ হল জামালদের বাড়ির দিকে। এরপর আর কোন বিস্ফোরণ ঘটেনি। হয়ত মুক্তিবাহিনী বুঝতে পেরেছিল যে, পাকবাহিনী আর ভেড়ামারাতে নেই। চলে গেছে। যদি থাকত তবে তাদের নিকট হতে প্রত্যুত্তর পেত। তাই তারা আর অযথা শেল নষ্ট না করার সিদ্ধান্ত নেয় কিম্বা ভেবেছিল, অযথা শেল ফাটিয়ে ঘর বাড়ির ক্ষয়ক্ষতি না করা ভাল। শেল পড়া বন্ধ হবার পরও আমরা তিনজন, আমি আমার স্ত্রী আর শ্বশুড় বসে বসে শুধু আল্লাহকে ডেকেছি- আল্লাহ আমাদের উপর গজব দিও না।
দেখতে দেখতে ভোর হয়ে গেল। পাখীরা কল কোলাহল করতে লাগলো। কয়েকটি কাক কা কা করতে করতে আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে উড়ে গেল।
আমাদের ভেড়ামারায় দুইটি মসজিদ। কোন মসজিদ হতেই আজানের সুমধুর ধ্বনী দেহমনে শিহরণ তুলল না। মোয়াজ্জেন প্রাণভয়ে কোথায় পালিয়ে গেছে, কে জানে। ঐ রাত্রিতে আর ঘুম হয় নাই। বিনিদ্র রজনী যাপন করেছি কত উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে । সে সব কথা মনে হলে আজও শরীরের রক্ত হিম হয়ে যায়। ভোরে উঠে বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখি রাস্তাঘাট জনশূণ্য। কোথাও কোন মানুষের কোলাহল নাই। কবরের নীরবতা যেন সমগ্র ভেড়ামারাকে গ্রাস করেছে।
আমি দোকান খুলে বসে আছি। একজন এসে বলল- ভাই, মুক্তিযোদ্ধারা এসেছে। পাক বাহিনী আর নাই। তারা সব নদী পার হয়ে ঢাকায় চলে গেছে। ঢাকা মুক্ত হলেই দেশ স্বাধীন হবে। বেলা ক্রমে উপরে উঠতে লাগলো। দলে দলে মুক্তি যোদ্ধারা এসে ভেড়ামারায় প্রবেশ করলো।
সেদিনের কথা মনে হলে আজও গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। (চলবে….পরবর্তীতে ৩য় পর্ব)
—————
*মোকছেদ আলী (১৯২২-২০০৯)। স্বশিক্ষিত। সিরাজগঞ্জের বেলতা গ্রামে জন্ম। গ্রামটি বর্তমানে নদীগর্ভে বিলীন।
১. সম্ভবত ১৯৬০-৬২ সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়। ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার’ উপর লেখকের আরেকটি স্মৃতিচারণমূলক পাণ্ডুলিপি রয়েছে।
মাহফুজ,
মোকছেদ আলীর আর্থিক অবস্থার আঁচ পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালে দালানের মালিক ছিলেন। আমি রচনার বিষয়বস্তু ছাড়াও স্বয়ং মোকছেদ আলী সম্পর্কে বেশি কৌতূহলী।
@গীতা দাস,
ঐ সময় তিনি ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। ঐটাকেই তিনি ‘আমার দালান’ বলছেন।
লেখাটি অসাধারণ, মনে হচ্ছিল আমি স্বয়ং বিদ্যমান ছিলাম ঐ সময় । যদিও আমি এ কালের ছেলে।
@আফরোজা আলম,
(আগে একবার মন্তব্য করেছি লগ ইন ছাড়া। এবার লগ ইন করে মন্তব্য করলাম।)
এই তো আপনি মন্তব্য করে বলছেন- লেখাটা চমৎকার হয়েছে। এটাই বা কম কিসের?
মূল লেখক তো আর আপনার মন্তব্য দেখতে আসছে না। কিম্বা আপনার মন্তব্য নিয়ে কোন অনুভূতি ব্যক্ত করবে এমন সম্ভাবনা তো নেই। মন্তব্য করলেই কি আর না করলেই কি? দুটোই সমান।
তবে একটা বিষয়ে ভাবনা এসেছে- সেটা হচ্ছে, জগন্নাথপুর গ্রাম নিয়ে। আকাশ মালিক ভাইও তার স্মৃতির পাতায় জগন্নাথপুর গ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন। আবার এখানে মোকছেদ আলীর লেখার মধ্যেও জগন্নাথপুর নামে একটি গ্রাম পাচ্ছি। নাম এক, জায়গা ভিন্ন। আমাদের দেশে এরূপ জগন্নাথপুর নামে কতটি গ্রাম আছে, খুঁজে দেখতে মন চায়।
ভালো লাগলো।এতো চমৎকার লেখা মন্তব্যবিহীন।আশ্চর্য লাগলো।
@আফরোজা আলম,
এই যে আপনি মন্তব্য করলেন। লেখাটাকে চমৎকার বললেন, এটাই বা কম কিসের?
তাছাড়া মূল লেখক মন্তব্য দেখতে এসে অনুভূতি ব্যক্ত করবে, এমন সম্ভাবনা তো নেই। মন্তব্য করলেই কি আর না করলেই কি? দুটোই সমান।
তবে একটা বিষয় নিয়ে আমি ভেবেছি- জগন্নাথপুর গ্রাম নিয়ে। আমাদের আকাশ মালিক ভাইও স্মৃতির পাতায় জগন্নাথপুর গ্রামের কথা বলেছেন। নাম এক, জায়গা ভিন্ন। আমাদের দেশে এরূপ জগন্নাথপুর নামে কয়টি গ্রাম আছে, একটু খুঁজে দেখতে মন চায়।