আমি আমার ছেলেমেয়েকে গণনা শেখানোর সময় সচেতনভাবে পাঁচের উচ্চারণে চন্দ্রবিন্দুর কথা ভুলিনি। তাদের চন্দ্রবিন্দুসহ পাঁচ উচ্চারণ শুনার জন্যে আমার ভাইবোনেরা বার বার গুণতে বলত আর তাদের চন্দ্রবিন্দুসহ স্পষ্ট উচ্চারণ শুনে খুশিতে হা হা হি হি করত। এখন অবশ্য তারা ঘরে শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলে না। তবে বাইরে বলে। চমৎকার করেই বলে। আমি আবার বাইরেও বন্ধুবান্ধবদের সাথে বলি না। আমি জানি আমি প্রায়শঃই পেট ভরে ‘ভাত’ না খেয়ে পেট বরে ‘বাত’ খাই বলে বন্ধুরা হাসাহাসি করে। সামনাসামনি আমাকে শুধরে দিতে চায়। আমি এও জানি একটু সচেতন হয়ে কথা বললে আমি পেট ভরে ‘ভাতই’ খেতে পারি। তবে সার্বক্ষণিক এ কৃত্রিমতা বজায় রেখে অর্থাৎ বেড়ি নিয়ে চলা বড্ড অস্বস্তিকর। সেটা সোনার হলেও। তাই বন্ধুদের সামনে আমার এ হেন উচ্চারণ।

ছোটবেলায় ঠাকুমা বোনের সাথে বসে আমার ছোট বোন রীতার পান খাওয়ার এক ধরণের শখ ছিল। এ নিয়ে সোনাকাকার ঠাটানিও চলত। পান খেলে জিহ্বা ভারী হয়ে যায় এবং পড়ার সময় ছোটদের উচ্চারণ ঠিক হয় না ধারণা থেকেই ছোটদের পান খাওয়ায় সোনা কাকার আপত্তি ছিল। বলাবাহুল্য উচ্চারণ শুদ্ধ হওয়ার বিষয়টি কাজ করত না। যেমন চন্দ্রবিন্দুর উচ্চারণ নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না, প্রত্যেক দিন শব্দকে পরতেক দিন উচ্চারণে অশুদ্ধতা আবিষ্কৃত হতো না। তবে সংযুক্ত বর্ণ বিশিষ্ট শব্দের উচ্চারণ সঠিক হওয়া চাই। তাছাড়া ছোটদের দাঁতে দাগ পড়বে বলেও পান খাওয়ায় তিনি বিরোধিতা করতেন। এরই মধ্যে ফাঁক ফোকরে রাতে ঘুমাতে যাবার আগে ঠাকুমা বোনের সাথে সে একটু খেয়ে ফেলত।
ছোটরা বিশেষ করে মেয়ে শিশুরা পান খেলে অন্যরা সমস্বরে ক্ষেপাত —–
পান খাওয়নি চুন খাওয়নি কবিরাজের বউ
কবিরাজে মইরা গেলে পান পাবি কই
অর্থাৎ পান খাওয়ার মত বিলাসিতা করতে গেলে স্বামীর আয় লাগবে। এ নারীর অধঃস্তন অবস্থানের চিত্র। আজকের একবিংশ শতাব্দীতে অবশ্য নারী নিজের আয়ে শুধু নিজে পান খায় না, পরিবারের অন্যান্যদের পানেরও যোগান দেয়।

তাছাড়া পান খেলে ঠোঁট, মুখ ও জিহ্বা লাল হলে বলা হতো স্বামী আদর করবে, যদিও পাড়াতো পিসতুত বোন শোভাদির পান খেয়ে ঠোঁট ও জিহ্বা লাল হবার পরও সকাল বিকাল স্বামীর আদরের বিশেষ চিহ্ন শাড়ির আঁচলে টেনে টেনেও ঢাকতে পারত না।

শোভাদিকে কনকনে মাঘের শীতে সারা মাস ভোর রাতে নদীতে স্নান করে মাঘ মন্ডলের পূজা করতে দেখেছি প্রতি বছর। আমাদেরকে সোনাকাকা এ পূজা করতে দিতেন না। সপ্তাহে শুধু রবিবার অর্থাৎ মাঘ মাসের চার দিন এ পূজা করার জন্যে অনুমোদন ছিল। তাও ঠাকুমা বোনের বিশেষ প্রস্তাবে। স্কুল খোলা থাকলে আবার থোবায়ও নমঃ মানে তাড়াহুড়া করে পূজা দিয়ে স্কুলে যেতেই হতো। কুমারী মেয়েরা মাসিক হবার আগে এ পূজা করত । অথচ শোভাদি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে এই পূজা করত। তবুও তার ভগবান তাকে স্বামীর ভাত খেতে দেয়নি। ১৯৭১ সালে ভারতে যাবার পর আর ফিরে আসেননি। শুনেছি উনি হঠাৎ করে মারা গেছেন। পান খেয়ে লাল হওয়া নারীটি স্বামীর শোষণেই মরল।

একটা সময়ে শুধু কাল রঙের একটা ব্লাউজই সব শাড়িতে পরতাম। মানে পরতে হতো। বাবা মারা যাবার পর মোটামুটি ভাল চাকরি করলেও নিজের জন্যে অনেক কিছু কিনতাম না। আমার ছোটভাইবোনদের মৌলিক চাহিদা মেটাতেই ছিল আমার এ বাধ্যতামূলক কৃচ্ছতাসাধন। আর চাকরির প্রতি আমি বরাবরই নিষ্ঠাবান। আমার নিষ্ঠা, কর্তব্যপরাণয়তা, দক্ষতা ও একাগ্রতাকে মূলধন করেই আমার যা কিছু অর্জন, প্রাপ্তি নয়। আমার কোন হঠাৎ প্রাপ্তি নেই। জীবনের প্রত্যেকটা সিঁড়ি পার হয়েছি নিজের পায়ে ভর দিয়ে।

আমার পরিবারে আমার চাকরিটি সব সময়ই প্রয়োজনীয় পেশা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। যদিও নারীর চাকরি বা আয়ের উৎস নিয়ে অনেক নারীর নিজেদেরই চেতনাগত অবস্থান শক্ত নয়। নিজের পোশাক, গয়না ইত্যাদিতে তারা ব্যয় করে আর ব্যাংক ব্যালেন্স নিয়ে অহংবোধে ভোগে। একজন নারীর আয় যদি সংসারের কাজে না লাগে তবে সংসারের অন্য সবার কাছে ঐ নারীর আয়ের উৎস বা চাকরির গুরুত্ব থাকে না। অন্যরা নারীটির বেড়াতে যাওয়া আর অফিসে যাওয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য করে না। এ সত্যটি নারীকে উপলব্ধি করতে হবে। আবার তেমনি চাকরীজীবী নারীকে ঘিরে আবর্তিত লোকজন তাকে শুধুমাত্র একজন নারী হিসেবে নয়, একজন চাকরিজীবী নারী হিসেবে বিবেচনা করে তার প্রাপ্য সুযোগ ও অধিকার দিতে হবে।

ঘষা আলাপ। অর্থাৎ ঘষে ঘষে কথাবার্তা। আমি এ ঘষালাপ অনেক করলাম। অনেকে বা অনেক এলাকায় এমন ঘষালাপকে বলে খাজুইরালাপ। আমি দীর্ঘ সময় ধরে আমাকে ঘিরে থাকা স্মৃতি নিয়ে আমার মনোভাব, আমার মনোভার,আমার মনোবেদনা, আমার মননের মর্মগাঁথা প্রকাশ করেছি। আরও বহুক্ষণ, বহুজন, বিবিধ বিষয় রয়েছে যা আমাকে ঘিরে ঘটেছে, আমার পরিজন ও পরিবেশের ভিড়ে লুকিয়ে আছে। আমি মহাদেব সাহার কবিতাটির সাথে গলা মিলিয়ে বলতে পারি —
‘স্মৃতি ছাড়া কোনো নোটবুক নাই
টুকে রাখি কোথা ইট বা খোয়াই
ভাঙা বাড়িটার ধুলি জঞ্জাল
বুক ভরা যারা ছিলো এতকাল;
কোথা লিখে রাখি এত প্রিয় নাম
যার পাশাপাশি একদা ছিলাম।‘
————-
————-
স্মৃতি ছাড়া আর নোটবুক নাই
কিছু মনে পড়ে, কিছু ভুলে যাই!

আমার তখনকার মানে ছোটবেলার অনেক জনের মধ্যে কিছু ভুলে গেছি আর কিছু ভোলা পথকে চেনা পথে এনেছি। আর এখনকার পরিচিত পরিজনের বহুজনের মধ্যে মুষ্টিমেয় জনের সংস্পর্শের ছোঁয়া বুলাতে সক্ষম হয়েছি। (শেষ)