২০০৯ সালের নভেম্বরে নাইব ভাই (আলোকচিত্র শিল্পী নাইব উদ্দিন আহমেদ) তাঁর জীবনের সর্বশেষ আলোকচিত্র প্রদর্শনীটি করলেন ঢাকা মিউজিয়ামে। মাত্র এক মাস পরে ডিসেম্বরে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। চিত্রশিল্পী হিসেবে নাইব ভাইএর কোন তুলনা মিলেনা। তিনি নিজেই তাঁর একমাত্র তুলনা।naib
বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যা্লয়ে উনার একটাই নাম ছিল – “নাইব ভাই”

পেশাদার হিসেবে উন্নতির সোপান বেয়ে উঠার সময় বা অভিপ্রায় কোনটাই তাঁর ছিল না। বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্রশিল্পী হিসেবে একটা চাকুরী করে গেছেন মাত্র। তাঁর আসল নেশা ছিল চিত্রশিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগেই আঙ্কারা এবং ইউরোপে্র বিভিন্ন দেশে চিত্রশিল্প প্রদর্শনী করে তিনি প্রচুর প্রশংসা এবং বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু তাঁর মেধার প্রকৃত সদ্ব্যবহার করেছেন বাংলাদেশ স্বাধীনতার ইতিহাসের অনন্য দলিল সৃষ্টির মাধ্যমে।

১৯৭১ সালে পাক হানাদারদের অত্যাচারের দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করার নেশায় মেতে উঠেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিদেশী পত্রিকায় ছবি পাঠানো প্রচুর ঝুকি তখন। তাই তিনি খোদ পশ্চিম পাকিস্তানে এসে পশ্চিমা সাংবাদিকদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেন। ঐ সময় পাকবাহিনী এবং তার দোসরদের অত্যাচারের যত ছবি দেশের বাইরে পাঠানো হয় তার এক বিরাট অংশ নাইব ভাইএর।

আজ ফটোশপ দিয়ে বাচ্চারা পর্য্যন্ত কী না করতে পারে। অবাক বিস্ময়ে ভাবি, ফটোশপ উদ্ভাবনকারীদের যখন জন্মই হয়নি তখন এই মেধাবী মানুষটি বাংলদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে ছবি নিয়ে কী অসাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন! এখন ফটোশপেও যা সম্ভব নয় তা তিনি প্রায় চল্লিশ বছর আগে নিজ হাতে করে গেছেন।

স্বাধীনতার প্রসব বেদনা তিনি যে ভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন তেমনটি কেউ কোনদিন পারেনি। স্বাধীনতার লক্ষ-কোটি ছবি তুলেছে মানুষেরা। তিনিও তুলেছেন প্রচুর ছবি। ভাবলেন – তিনি এমন একটি ছবি সৃষ্টি করবেন যা একাই হবে পাক-বাহিনী আর রাজাকার, আলবদরদের নৃশংস অত্যাচার আর বাংলদেশ অভ্যূদয়ের স্বাক্ষর। ১৯৭২ সালে কৃষিবিদ্যালয়ের লাইব্রেরীর নীচ তলায় একটি প্রদর্শনী করলেন। সেখানেই প্রথম তিনি তাঁর সেই অসাধারণ সৃষ্টিটি রাখলেন।

ছবিটির সামনে স্থাপন করলেন প্রস্ফুটিত শাপলা ফুল, তারপর ভাঁজে ভাঁজে হাজারো অত্যাচার আর মুক্তিযুদ্ধের ছবি। ছবিটি গোটা মুক্তি যুদ্ধের একটি সমগ্র দলিল হয়ে রইল। নাইব ভাইয়ের ছেলে নিপুণ পাঠিয়েছে ছবিটি ।

swadhinota1 নাইব ভাই ছবিটির নাম দিয়েছেন – “স্বাধীনতা”

শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল হওয়ার নেপথ্য কাহিনী স্বাধীনতা যুদ্ধে নাইব ভাই ও তাঁর ভাই ডঃ নওয়াজেশ উদ্দিন আহমদের অবদানের স্বীকৃতি। নীচের একটি মন্তব্যে কাজল ব্যাপারটি পরিস্কার করল। কাজল নাইব ভাইয়ের পুত্রবধু।

কুলদা রায় বিবরণসহ নাইব ভাইএর কয়েকটি ছবি কিশোরী শাহীন, কাশফুল এবং নূরেমবার্গ ট্রায়ালের রেকর্ডভুক্ত নারীর ছবি শিরোনাম নিবন্ধে মুক্তমনায় প্রকাশ করেছেন।

kuloda5
গ্রামটির নাম নিলক্ষ্যা। এখানেই পাক আর্মি চলে যাওয়ার পরে এই ছবিটি তুলেছিলেন নাইব চাচা (কুলদা রা্যের বর্ণনা)

কৃষিবিশ্ববিদ্যালয় অংগনে সদা প্রফুল্ল সংস্কৃতি সেবী প্রফেসর আব্দুল কুদ্দুস মিয়া নাইব ভাইএর সব চাইতে প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। কুদ্দুস ভাইকে সারা ক্যাম্পাসে একমাত্র তিনিই ‘তুমি’ সম্ভোধন করতেন। কুদ্দুস ভাইএর মধ্যমেই কুলদা রায় নাইব ভাইএর সান্নিধ্যে আসেন।
kuddusbhai1
অবসর নিয়ে কুদ্দুস ভাই এখন মুহম্মদপুরে বসবাস করছেন। ৩ জুন ২০০৭।

কুলদা রায়ের উপস্থাপিত মৃতপ্রায় মেয়ের ছবিটির প্রতি কুদ্দুস ভাইএর মনোযোগ আকর্ষণ করি টেলিফোনে (৫ জুন ২০১০)। তিনি যা বললেন তা নিম্নরূপঃ

ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল অরোরা ময়মনসিংহ আসেন ১০ই ডিসেম্বর ১৯৭১। তার আগের দিন ৯ই ডিসেম্বর পাক বাহিনী ময়মনসিংহ কৃষিবিদ্যালয়স্থিত অতিথি ভবনের ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। আর তখনই নাইব ভাই, কুদ্দুস ভাইরা কেউ কোথাও বেঁচে আছে কিনা খুঁজে বের করার জন্য বেড়িয়ে পরেন। তাঁরা অতিথি ভবনের কাছে মৃতপায় এই মেয়েটিকে খুঁজে পান। এখানে মেয়েদেরকে এনে আটকিয়ে রেখে দিনের পর দিন মাসের পর মাস অত্যাচার করা হত। এই মেয়েটি্র তখন কথা বলার শক্তিটুকুও নিঃশেষিত হয়ে গেছে। কোন পরিচয় মিলেনি।

নীচের চিত্রটির অনুলিপি কুলদা রায়ের নিবন্ধের প্রথম ছবি।
farid1

ফরিদ আহমদ একই ছবি আমাদের বীরাঙ্গনা নারী এবং যুদ্ধ শিশুরা শিরোনামে মুক্তমনায় প্রথম প্রকাশ করেন। কুলদা রায় মেয়েটির নাম দিয়েছেন – শাহীন। ছবিটি বাংলাদেশ অভ্যূদয়ের করুণ ইতিহাসের মূর্ত প্রতীক। নাইব ভাই মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক-বাহিনী আর আলবদর, রাজাকার, আল-শামসদের কূ-কীর্তির হাজারো ছবি তুলেছেন। এগুলোর কোনটি রেখে কোনটি বাদ দিবেন! তাই তিনি সবগুলো লাঞ্ছনার ছবি একটি ছবিতে উজ্জীবিত করলেন। ছবিটি তাঁর মেধাপ্রসুত আরো একটি অসাধারণ সৃষ্টি। এটি সমগ্র বাংলাদেশের শত সহস্র লাঞ্ছিতা মা-বোনদের সম্মিলিত ছবি। স্বাধীনতা যুদ্ধে চরম আত্মত্যাগের ইতিহাস। এটি কোন একক শাহীনের চিত্র নয়। এই ছবিতে শাহীন, সালমা, আনোয়ারা, কুলসুম, সুবর্না, মায়া, সাবিত্রী, বিসকিসেরা একাকার হয়ে আছে। অসাধারণ প্রতিভাদীপ্ত আলোচিত্রশিল্পী নাইব উদ্দিন আহমদের লেখা স্বাধীনতার ইতিহাস এটি।

নাইব ভাইয়ের ছেলে নিপুণের পাঠানো সংক্ষিপ্ত জীবন-বৃত্তান্তঃ

Naib Uddin Ahmed

Naib Uddin Ahmed is one of the pioneers of photography in Bangladesh. His expedition of photography started in pre-1947 undivided Bengal. Since then, in the fifties and sixties, he preserved in his numerous creative photographs the diverse faces of Bangladesh. Life in agro-centric rual Bengal, and its heritage and culture has been portrayed in his photography with a special artistic flavor. Boats and the lives of fishermen and other river centered working people constitute one of the major stems of his photographs. With all these, a vibrant Bengal life, a positive and beautiful Bangladesh is found in his photographs.

In 1971, he risked his life to take numerous domentary photographs of freedom fight. He was so shocked by the brutality of the invading Pakistani army that since then this creative artist of photography has almost left.

Naib Uddin Ahmed was born in a village named Paril in the present Singair Upazilla of the Manikganj district in 1925. Since childhood he grew up with the touch of rural environment, the beauty and taste of the rural Bengal. After completing matriculation from Manikganj Victoria High School in 1943, he started study in the Islamia College of Calcutta. During this time, he came in contact with great artists like Zoinaul Abedin and Quamrul Hasan. Gradually he came closer to them. With Zoinul Abedin he wandered in the roads and lanes of Calcutta to take photographs of the famine of 1946.

Following the division of 1947, he came back to his own village Paril. He worked as an artist at the Public Health Department for a few years since 1951. It was from this time that his photographs started to be published in the renowned journals and periodicals home and abroad including Dawn, the Times, the Illustrated Weekly of Pakistan and Times of Milon. Some of his famous photographs titled, Amar Bangla, Edesh Amar, Bathing Beauty, etc. were published during this time. In 1956, while attending a course on social welfare in Sri Lanka his solo photography exhibition titled, “Rural Life of Pakistan” was held on the United Nations Day.

Afterwards a number of solo and joint exhibitions of his photographs were held in different places including London, Mosco, Karachi and Delhi.

Mr. Naib Uddin was awarded as the best photographer of Pakistan at the World Photo Contest in 1958. After working as photographer at Public Information Department (PID) since 1958, he joined the newly established Bangladesh Agricultural University of Mymensingh in 1961 as Research Photographer. After passign a long career of 32 years with the University, this nature-loving artist moved back to his own village Paril, Manikganj.

Mr. Ahmed died of old age ailment at the Comfort Hospital Dhaka on Monday 14 December 2009 at 7:50pm (Innah Lillahe ……. Razeun). He was 84. He left behind three sons, relatives, friends, colleagues and well-wishers to mourn death.


টেক্সাস ৬ জুন ২০১০। নৃপেন্দ্র নাথ সরকার বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৯ জানুয়ারী পর্য্যন্ত সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে চাকুরীরত ছিলেন।