লেখাটি ব্লগে দিব কিনা এ নিয়ে একটু দ্বিধায় ছিলাম। কারণ প্রথমতঃ লেখাটি হাতীর মতই বিশালকায়, আর এই লেখাটি ব্লগের জন্য নয়, আমার বিবর্তনীয় মনোবিদ্যা বিষয়ক বইয়ের কথা মাথায় রেখে লেখা। কিন্তু ব্লগে দিতে গেলে খন্ডিত আকারে বা ছোট ছোট করে দিতে হয়। আর খন্ডিত আকারে দিলে যেটা হয় – পর্বগুলোতে এক ধরনের অসম্পূপুর্ণতার ভাব থেকে যায়। তার চেয়েও মারাত্মক ব্যাপারটি হল – সম্পূর্ন লেখাকে খন্ড করে ব্লগে দেওয়ার ফলে লেখার ভুল ইন্টারপ্রিটেশন হতে পারে। যেমন, এ পর্বটি পড়ে অনেকেরই মনে হতে পারে লেখায় সংঘাত বা ভায়োলেন্সের বৈজ্ঞানিক বৈধতা দেয়া হচ্ছে। আসলে তা নয়। এই পুরো সিরিজটির মাধ্যমে আমি ভায়োলেন্সের একটি নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক বিশ্লেষণ হাজির কারার চেষ্টা করবো মূলতঃ আধুনিক বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের পটভুমিকায়। অনেকেরই হয়তো মনে আছে যে, আমি বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের উপর একটি ই বই লিখেছিলাম। এ লেখাটি সেটারই সম্প্রসারণ বলা যায়। তবে শুধু ভায়োলেন্সের উৎস সন্ধান করাই এই লেখার উপজীব্য নয়, বরং ভায়োলেন্সের রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিতে গিয়েই কীভাবে মানব সমাজে পরার্থতা, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের উদ্ভব ঘটেছে সেটাও এই সিরিজের মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করা হবে।
 
:line:

যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা,
যুদ্ধ মানেই আমার প্রতি তোমার অবহেলা’
… (নির্মলেন্দু গুণ)

মানবিকতার নমুনা

অনেকেই খুব সরল চিন্তাভাবনা থেকে ধরে নেন, মানুষ বোধ হয় খুব শান্তিপ্রিয় একটা জীব,  আর সহিংসতা জিনিসটা পুরোটাই কেবল পশুদের প্রবৃত্তি। এই পশুপ্রবৃত্তিকে মানুষ আবার আলাদা করে ‘পাশবিকতা’ বলে ডাকে। এমন একটা ভাব যে, আমরা মানুষেরা তো আর পশু নই, আমরা সৃষ্টির সেরা জীব। আমরা কি আর পশুদের মতো সহিংসতা, খুন ধর্ষণ, হত্যা – এগুলোতে জড়াই?  আমরা মানব। পাশুদের কাজ ‘পাশবিক’ আর আমাদের কাজ সব ‘মানবিক’। তো,সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের এই খোদ বিংশ শতাব্দিতে ঘটানো কিছু ‘মানবিক’ কাজের খতিয়ানে নজর দেয়া যাক[1] –

  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মারা যায় দেড় কোটি লোক, আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি লোক । 
  • পাকিস্তানী বাহিনী ১৯৭১ সালের নয় মাসের মধ্যে ৩০ লক্ষ বাংলাদেশীকে হত্যা করে, ধর্ষণ করে প্রায় ২ লক্ষ নারীকে। 
  • ল্যান্সেট সার্ভে অনুযায়ী আমেরিকার ইরাক দখল এবং যুদ্ধে এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৬ লক্ষের উপর । 
  • খেমারুজ বাহিনী কম্বোডিয়ায় ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে হত্যা করে অন্ততঃ ২০ লাখ মানুষকে। 
  • চীনে চেয়ারম্যান মাও এর শাসনামলে গৃহযুদ্ধ দুর্ভিক্ষসহ নানা কারণে মারা যায় ৪ কোটি লোক। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়েই মৃত্যু সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ৩০ লক্ষের উপর। এছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নে ২ কোটি লোক, ১০ লাখ লোখ ভিয়েতনামে, ২০ লাখ লোক উত্তর কোরিয়ায়, ২০ লাখ লোক কম্বোডিয়ায়, ১০ লাখ লোক পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে, দেড় লাখ লোক পূর্ব ইউরোপে, ১৭ লাখ লোক আফ্রিকায়, ১৫ লাখ লোক আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসনামলে নিহত হয়। 
  • বিশ্বযুদ্ধত্তোর পৃথিবীতে আমেরিকার আধিপত্যের ঝান্ডার উদাহরণগুলোও এখানে প্রাসঙ্গিক। মার্কিন আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে শুধু ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ই উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রতি বর্গমাইল জায়গার উপর গড়ে ৭০ টনের বেশি বোমা ফেলেছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্য ভাষায় বললে, মাথাপিছু প্রতিটি লোকের জন্য ৫০০ পাউন্ড বোমা। এমন কি গাছপালা ধ্বংসের রাসায়নিকও ছড়িয়ে দিয়েছিলো দেশের অনেক জায়গায়। নিউজ উইকের এক সাংবাদিক যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে কাজ করতেন, তিনি লিখেছেন নাৎসীরা বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের উপর যে অত্যাচার চালিয়েছিলো, ভিয়েতনামে মার্কিন নির্যাতন তাকেও হার মানিয়েছিল। ভিয়েতনামের মাইলাই হত্যাকান্ড মানব সভ্যতার ইতিহাসের এক ঘৃন্য অধ্যায়। ১৯৬৮ সালের ১৬ই মার্চ সকাল সাড়ে তিনটায় সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনবাহিনী দক্ষিণ চীন সাগরের উপকুলে একটি ছোটট গ্রাম মাইলাইতে প্রবেশ করে, এবং গ্রামের নিরস্ত্র সাধারণ লোকের উপর হামলা চালিয়ে নারী, শিশু বৃদ্ধসহ ৩৪৭ জন গ্রামবাসীকে কয়েকঘন্টার মধ্যে হত্যা করে। নারী আর শিশুদের বিকৃত উপায়ে ধর্ষন করে ওই আবু-গারীবের কয়েক ডিগ্রী উপরের মাত্রায়। গ্রামের সাধারণ মানুষের উপর নির্যাতন এতই ভয়াবহ ছিল যে, খোদ মার্কিনবাহিনীরই দুই-একজন (হিউ টমসন) এর বিরোধিতা করে গ্রামবাসীর পক্ষে অস্ত্র হাতে রুখে দাঁড়ায়। অনেকদিন ধরে সারাবিশ্ব এই ঘটনা সম্পর্কে বিন্দু-বিসর্গ জানতে পারে নি। এ ধরণের বহু নজিরবিহীন ধ্বংসলীলা ঘটেছে দেশে দেশে রক্তলোলুপ মার্কিন সাম্রাজ্যের হাতে এই বিংশ শতাব্দীতে। 
  • সাড়া বিশ্বে প্রতি বছর পাঁচ হাজার নারী মারা যায় ‘অনর কিলিং’-এর শিকার হয়ে। মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে এই মৃত্যুর হার সর্বাধিক। 
  • সাড়া বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১৪ লক্ষ নারী ধর্ষণ এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। হাই স্কুলে গমনরত প্রায় ১৭ ভাগ ছাত্রী কখনো না কখনো শারিরীক নির্যাতনের শিকার হয়, ১২ ভাগ ছাত্রী শিকার হয় যৌন নিগ্রহের। 
  • আন্তর্জাতিকভাবে প্রতি বছর সামাজিক নিপীড়ন, ধর্ষণ, হেনস্তাসহ বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় দশ লক্ষ লোক। 
  • সাড়া বিশ্বেই প্রায় ১৬ লক্ষ লোক সহিংসতার শিকার হয়ে মারা যায়। তার অর্ধেকই মারা যায় আত্মহত্যায়,এক তৃতীয়াংশ গনহত্যায়, এবং এক-পঞ্চমাংশ সসস্ত্র সঙ্ঘাতে। 
  • প্রতি বছর সাড়া দুনিয়া জুড়ে চোদ্দ হাজারেরও বেশি সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ড ঘটে, মৃত্যুবরণ করে ২২০০০ লোক। 
  • দলীয় কোন্দল, অস্ত্রবাজি প্রভৃতির শিকার হয়ে জাপান, অষ্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে প্রতি বছর মারা যায় পনের থেকে পচাত্তুর জন লোক, আর ব্রাজিল, দক্ষিন আফ্রিকা, কলম্বিয়া আর আমেরিকায় এই সংখ্যা বছরে দশ হাজার থেকে শুরু করে চল্লিশ হাজার ছাড়িয়ে যায়।
  •  
    চিন্তা করে দেখুন – উপরে আমাদের ‘মানবিক’ কীর্তিকলাপগুলোর যে গুটিকয় হিসাব কিতাব উল্লেখ করেছি তা কেবল এই বিংশ শতাব্দী বা তৎপরবর্তী সময়ের ঘটনা। বিশাল সিন্ধুর বুকে কেবল বিন্দুমাত্র, তাই না? কিন্তু তারপরেও ‘মানবিক বিভৎসতার’ সামান্য নমুনা দেখেই যে কারো চক্ষু চরকগাছ হতে বাধ্য।
     
    হয়তো অনেকে ভাবতে পারেন যে,পারমানবিক অস্ত্র আর আধুনিক অস্ত্র সস্ত্রের ঝনঝনানি বৃদ্ধি পাওয়াতেই বোধ হয় সহিংসতা বিংশ শতাব্দীতে এত মাত্রাতিরিক্ত বেড়ছে। আগেকার পৃথিবীর সময়গুলো নিশ্চয় খুব শান্তিময় ছিলো। আমাদের বুড়ো দাদা দাদী কিংবা বয়োবৃদ্ধদের প্রায়ই সুর করে বলতে শুনি – ‘তোরা সব গোল্লায় যাচ্ছিস, আমাদের সময়ে আমরা কত ভাল ছিলাম’।তো  আপনিও যদি আপনার দাদা দাদী আর বয়োজ্যেষ্ঠদের মত সেরকমই ভেবে থাকেন যে,  ‘দিন যত এগুচ্ছে সমাজ তত অধঃপতিত হচ্ছে’, তাহলে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে বড় সড় বিস্ময়।  স্টিভেন পিঙ্কারের উদ্ধৃতি দিয়েই বলি[2] – 

    ‘আসলে আমরা আমাদের এই বিংশ শতাব্দীতেই তুলনামুলকভাবে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ এবং সহিষ্ণু সময় অতিক্রম করছি, আমাদের পূর্বপুরুষেরা ছিলো আক্ষরিক অর্থেই বর্বর’।

     
    হয়তো পিঙ্কারের কথাটা অত্যুক্তি মনে হবে। কিন্তু আপনি যদি নিরপেক্ষভাবে মানব জাতির ইতিহাসের পাঠ নেন,এবং তথ্য বিশ্লেষণ করেন তাহলে আর সেটাকে অবাস্তব কিংবা অত্যুক্তি কোনটাই মনে হবে না। আসুন, সেটার দিকে একটু নজর দেই।
     
    আমাদের আদিম পূর্বপুরুষ যারা প্লেইস্টোসিন যুগের পুরো সময়টাতে শিকারী সংগ্রাহক হিসেবে জীবন যাপন করতো তাদের জীবনযাত্রা থেকে কিছু বাস্তব পরিসংখ্যান হাজির করা যাক। ১৯৭৮ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্যারোল এম্বার তার গবেষণায় দেখান যে, আদিম যুগে শিকারী সংগ্রাহক সমাজের শতকরা ৯০ ভাগ গোত্রই হানাহানি মারামারিতে লিপ্ত থাকতো আর এর মধ্যে শতকরা ৬৪ ভাগ ক্ষেত্রে যুদ্ধ সংগঠিত হতো প্রতি দুই বছরের মধ্যেই[3]। প্রত্নতত্ত্ববিদ লরেন্স কিলী (Lawrence Keeley) আধুনিক বিশ্বে বিংশ শতাব্দিতে ঘটা ইউরোপ আমেরিকার সহিংসতার সাথে আমাদের পূর্বপুরুষদের সহিংসতার তুলনা করে দেখিয়েছেন যে, বিংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন যুদ্ধে যে হারে মানুষ মারা গেছে (দুই বিশ্ব যুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা গোনায় ধরেও) সেটা আদিম কালে আমাদের পূর্বপুরষদের সহিংসতার তুলনায় অত্যন্ত নগন্য[4]।

    deaths_warfare_lawrencekeele

    ছবি – আদিম কালের শিকারী-সংগ্রাহক সমাজ এবং আধুনিক বিংশ শতাব্দীর সমাজের তুলনামূলক রেখচিত্র (প্রত্নতত্ত্ববিদ লরেন্স কিলীর ‘ওয়ার বিফোর সিভিলাইজেশন’ থেকে সংগৃহিত)।

    উপরের গ্রাফটি লক্ষ্য করুন। উপর থেকে শুরু করে প্রথম আটটি গ্রাফ শিকারী সংগ্রাহক সমাজের। আর শেষটি যেটি ‘প্রায় অদৃশ্যমান’ অবস্থায় কোন রকমে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে, সেটি আধুনিক কালের সহিংসতার নিদর্শন। গ্রাফটি দেখলেই আপনি তুলনামূলক সহিংসতার নমুনাটি বুঝতে পারবেন, আধুনিক কালের তুলনায় আদিমকালে সহিংসতা কি হারে বেশি ছিলো। এখনো মানব সমাজে নিউগিনি হাইল্যান্ডস এবং আমাজন এলাকায় কিছু আদিম শিকারী সংগ্রাহক সমাজের অস্তিত্ব দেখা যায়। সেখানকার জিভারো (Jivaro) কিংবা ইয়ানোমামোর (Ya̧nomamö) শিকারী সংগ্রাহক সমাজে যে পরিমাণ সহিংসতা হয় তাতে একজন ব্যক্তির অন্তত শতকরা ৬০ ভাগ সম্ভাবনা থাকে আরেজন শিকারির হাতে মারা যাবার, সেখানে গেবুসিতে (Gebusi) সেই সম্ভাবনা শতকরা মাত্র ১৫ ভাগ। আর আধুনিক সমাজে সেটা ২ ভাগেরও কম। আদিম সমাজে যে হারে মারামারি কাটাকাটি চলতো, সেই হারে আধুনিক সমাজ পরিচালিত হলে বিংশ শতাব্দীতে একশ মিলিয়ন নয়, দুই বিলিয়ন মানুষ মারা যেত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সেই হিসেবে আমরা পিছাইনি, বরং এগিয়েছি।
     
    প্রাচীন কালে শুধু যুদ্ধ বিগ্রহ নয়,যুদ্ধের পর  যুদ্ধবন্দীদের উপর যেভাবে অত্যাচার করা হত তা শুনলে আজকের নরম হৃদয়ের মানুষেরা অক্কা পাবেন নিঃসন্দেহে। এক গোত্র আরেক গোত্রের উপর আক্রমণ চালিয়ে শুধু ‘স্পয়েল ওব ওয়ার’ হিসেবে নারীদের ধর্ষণ, উপভোগ কিংবা দাস তো বানাতোই (এগুলো ছিলো একেবারেই মামুলি ব্যাপার), যুদ্ধবন্দীদের বসিয়ে রেখে তাড়িয়ে তাড়িয়ে চোখ উপড়ে ফেলা হতো, হাত পা কেটে ফেলা হত, অনেক সময় আবার আয়েশ করে উপড়ানো মাংস ভক্ষণও করা হতো আনন্দের সাথে[5],[6]। পাঠকদের হয়ত বর্ণনাগুলো পড়ে বিকৃত হরর ছায়াছবির মত মনে হতে পারে, কিন্তু মনে রাখতে হবে আজকের দিনের হরর ছায়াছবিগুলোই ছিল সেসময়ের  নির্মম বাস্তবতা। সে সময় যুদ্ধের ব্যাপারে কোন নিয়ম নীতি ছিলো না, ছিলো না কোন ‘জেনেভা কনভেনশন, ছিলো না নারী কিংবা শিশুদের প্রতি কোন বিশেষ সুব্যবহারের নির্দেশ। একতরফা ভাবে যুদ্ধে করে প্রতিপক্ষকে কচুকাটা করাই ছিলো যুদ্ধের একমাত্র লক্ষ্য।
     
    বিংশ শতাব্দীতে আমরা পারতপক্ষে মারামারি হানাহানি খুনোখুনি একদম বাদ না দিতে পারলেও অনেকটাই কমিয়ে এনেছি বলা যায়। এমনকি যুদ্ধের সময়ও কিছু ‘এথিক্স’ পালন করি, যেমন, বেসামরিক জায়গায় হত্যা, লুন্ঠন, বোমাবাজিকে নিরুৎসাহিত করি, যুদ্ধবন্দিদের উপর যতদূর সম্ভব আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মানবিক ব্যবহার করার চেষ্টা করি। এর পেছনে গনতান্ত্রিক আইন প্রয়োগ,শিক্ষার বিস্তার, মানবিক অধিকারের প্রতি সচেতনা বৃদ্ধি প্রভৃতিকে উল্লেখ করা যায়।  শুধু তাই নয়, আমাদের সভ্য জীবনযাত্রা লক্ষ্য করুন।  অনেক কিছুতেই আমরা প্রাণপণে  ‘পলিটিকালি কারেক্ট’ থাকার চেষ্টা করি। বক্তব্যে কিংবা লেখায় উপজাতির বদলে বলি আদিবাসী, নিগ্রো শব্দের বদলে বলি আফ্রিকান আমেরিকান। সভ্য সমাজে অফিস আদালতে কাজ যারা করেন তারা সচেতন থাকেন আরো একধাপ বেশি – লক্ষ্য রাখেন কারো ধর্ম, বর্ণ, জেন্ডার কিংবা বয়স নিয়ে  কোনক্রমেই যেন বক্রোক্তি যেন প্রকাশিত না হয়ে যায়। আমরা আজ সমবেতভাবে গ্লোবাল ওয়্যামিং নিয়ে দুশ্চিন্তা করি,  বিলুপ্তপ্রায় পান্ডা কিংবা মেরু ভল্লুকদের রক্ষার ব্যাপারে আমাদের মন কেঁদে উঠে অহর্নিশি। অথচ এই ষোড়শ শতকে আমাদের  ‘মহা শান্তিপ্রিয়’ পূর্বপুরুষেরাই প্যারিসের রাস্তায়  জীবন্ত বিড়াল দড়িতে ঝুলিয়ে দিতো, তারপর তাতে তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিতো। সেই জীবন্ত বিড়াল যখন আগুনে পুড়ে ব্যাথায় কোঁকাতে থাকতো, সেটা ছিলো তাদের বিনোদনের উৎস। বিড়ালের চারপাশে সমবেত জনতা হাততালি দিয়ে চিৎকার করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতো। তাদের চোখের সামনে অসহায় বিড়ালটি  একদল পাষন্ড লোকের বিনোদনের খোড়াক যোগাতে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যেতো[7]।

    ইতিহাস পরিক্রমায় দেখা যায় ফোনিকান, হিব্রু, ক্যানানাইট, মায়া, ইনকা, এস্টেক, ওলমেক্স, গ্রীক, রোমান কার্থাগিনিয়ান, টিউটন্, সেল্ট, ড্রুইড, গল, থাই, জাপানি, মাউরি, তাহিতিয়ান, হাওয়াই অধিবাসী – সবাই নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী দেদারসে শিশু, নারী, পুরুষ বলি দিয়েছে তাদের অদৃশ্য দেব-দেবীদের তুষ্ট করতে। কিছু সভ্যতায় দেখা যায়, যখন কোন নতুন প্রাসাদ কিংবা ইমারত তৈরি করা হত, তার আগে সেই জায়গায় শিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়া হত – এই ধারণা থেকে যে, এটি প্রাসদের ভিত্তি মজবুত করবে। অনেক আদিম সমাজেই বন্যা কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কুমারী উৎসর্গ করার বিধান ছিল; কেউ কেউ সদ্যজন্মলাভ করা শিশুদের হত্যা করত, এমনকি খেয়েও ফেলত। কোন কোন সংস্কৃতিতে কোন বিখ্যাত মানুষ মারা গেলে অন্য মহিলা এবং পুরুষদেরও তার সাথে জীবন্ত কবর দেওয়া হত, যাতে তারা পরকালে গিয়ে পুরুষটির কাজে আসতে পারে। ফিজিতে ‘ভাকাতোকা’ নামে এক ধরনের বিভৎস রীতি প্রচলিত ছিল যেখানে একজনের হাত-পা কেটে ফেলে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে সেই কর্তিত অংগগুলো খাওয়া হত। আমাদের ভারতবর্ষেই এক সময় প্রচলিত সতীদাহের কথা তো আমাদের সকলেরই জানা। সেই ভীতিকর বর্বর অবস্থা থেকে আমরা অনেকটাই নিজেদের সরিয়ে আনতে পেরেছি, এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। 

    আজকে বরং এ পর্যন্তই থাকুক।  পাঠকদের জন্য স্টিভেন পিঙ্কারের ভায়োলেন্স নিয়ে বক্তৃতা –

    httpv://www.youtube.com/watch?v=ramBFRt1Uzk
     

    চলবে …

    তথ্যসূত্র

    [1] cited from various known statistics including –
    Case Study: Genocide in Bangladesh, 1971;
    Lancet surveys of Iraq War casualties;
    Surveillance for Fatal and Nonfatal Injuries – 2001, Centers for Disease Control and Prevention National Vital Statistics System;
    World Report on Violence and Health, World Health Organization, 2002;
    Report on Terrorist Incidents, 2006 (issued April 2008), National Counterterrorism Center (NCTC);
    Selected Death Tolls for Wars, Massacres and Atrocities Before the 20th Century
    Marc Hauser, Moral Minds: How Nature Designed Our Universal Sense of Right and Wrong, Harper Perennial, 2007 etc.
    [2] A Biological Understanding Of Human Nature: A Talk With Steven Pinker, Science at the Edge, 2008
    [3] Ember, Carol R. 1978 Myths about Hunter-Gatherers Ethnology. 17 (4) 439-448
    [4] Lawrence H. Keeley, War Before Civilization: The Myth of the Peaceful Savage, Oxford University Press, USA, 1997
    [5] Michael Ghiglieri, The Dark Side Of Man, Basic Books, 2000
    [6] Lawrence H. Keeley, War Before Civilization, পূর্বোক্ত।
    [7] Sam Harris, The End of Faith: Religion, Terror, and the Future of Reason (2004), pp. 170