ছেলেটাকে দেখুন। কেমন একটা সফেদ শার্ট পরে দুরুদুরু বুকে, কাঁপা পায়ে উঠে পড়েছে বিশ্ব আসরে। পিছনে স্লাইড-শোতে একটা ছবি দেখা যাচ্ছে।
‘কিসের ছবি এটা?’ প্রশ্ন করে উপস্থাপক।
‘আমার বাড়ি। এখানে আমরা থাকি।’
ছবির মধ্যে ঠিক কোন যায়গাটা মনুষ্যবাসযোগ্য, বুঝতে পারে না উপস্থাপক।
জিজ্ঞেস করে. ‘কোথায়?’
পরক্ষণেই সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘কোন জায়গায়? মানে, কোন দেশে?’
ছেলেটা বলে, ‘কাসুঙ্গু, মালাউই’…

হ্যা, দেশটার নাম মালাউই। সত্যি বলছি নিজেই এ নাম শুনিনি কখনো আগে। উইকিপিডিয়ায় দেখা যায়, ওখানে এখনো কলেরায় মানুষ মরে সারে সারে। দুর্ভিক্ষে এই তো, কবছর আগেই না খেয়ে ছিলো চার মিলিয়ন(দেশের অর্ধেক) মানুষ। লোনলিপ্লানেট বলে, ওখানে নাকি দেখার মত কিছুই নেই। দেশটা আফ্রিকায়। অবশ্য এই আমাদের দেশেও তো কত মানুষ না খেয়ে থাকে। মঙ্গার কথা ভুলে গেলেন? তাহলে অত দূর গিয়ে আবার সেই পুরানো কাসুন্দি ঘাঁটা কেন?

এসব উত্তর জানতেই বুঝি উপস্থাপক আরো কিছু প্রশ্ন করতে থাকে। আধো স্বরে ওসবের যে উত্তর আসে, তার কিছু বোঝা যায়, কিছু বোঝা যায় না। একসময় সে দৃশ্যের যবনিকাপাত হয়।

সে বছর সালটা ছিলো ২০০৭।

এরপর কেটে যায় আরো দুই বছর। ২০০৯। ছেলেটা সেই দুবছরেই তার দুরুদুরু কৈশোর পেরিয়ে এখন এক সদর্প যুবক। এবার সে আবারো শুরু করে তার গল্প। যে গল্প দু বছর আগে বলতে এসে বিহ্বলতার কাছে পরাজিত হয়েছিলো সে। হবেই বা না কেন? ঐ প্রথম সে বেরিয়েছিলো তার সেই কাসুঙ্গুর নীড় থেকে। সেই প্রথম প্লেনে উঠেছিলো। প্রথম ঘুমিয়েছিলো তারককাখচিত হোটেলে। দেখেছিলো কম্পিউটার, ইন্টারনেট, সাদা মানুষ, আর রাশি রাশি আলো। তার উপর ছিলো ইংরেজির বাধা। তবে এবার আর সে ভয় পায় না। ঝকঝকে একটা হাসি দিয়ে সে বলতে শুরু করে তার জীবনের গল্প। খরা-মারি-দুর্ভিক্ষের মধ্যেও যে জীবন আলোকময়। গল্পটা আমরা তার মুখেই শুনি,

“…বিজ্ঞানের যাদুকরী ক্ষমতা আবিষ্কার করে ফেলার আগে আমি ছিলাম একজন সাধারণ কৃষক। আমাদের দেশটাই তো গরীব কৃষকদের দেশ। সেখানে আর দশজনের মত আমরাও ছিলাম ভুট্টা চাষী। একবার খুব আকাল নামলো। সালটা ২০০১। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হলো চারিদিকে। মাস পাঁচেকের মধ্যেই মালাউইরা সব না খেয়ে মারা যেতে লাগলো। আমরা তখন প্রতিদিন খাবার পেতাম শুধু রাতে। তিন গ্রাস নসিমা (ভুট্টারপিঠা)। ঐটুকু খাবার যে কোথায় চলে যেত, তার কোনো আলামত পেতাম না।

মালাউইতে হাইস্কুলে পড়তে বেতন দিতে হয়। ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হয়েই সেবার আমি স্কুল ছাড়ি। তখন মাঝে মাঝে আমি আমার নিরুপায় বাবাকে দেখতাম, আর দেখতাম পিছনের সেই বন্ধ্যা ধুঁধুঁ মাঠ। এই পরিণতি আমি মেনে নিতে পারছিলাম না কিছুতেই।

পড়তে আমার ভালো লাগতো খুব। প্রতিজ্ঞা করলাম, যে কোনো মূল্যে পড়াটা আমাকে চালিয়ে যেতেই হবে। তাই একটা পাবলিক লাইব্রেরিতে যেতে শুরু করলাম। ওখানে আমি নানান রকম বই পড়তাম, বিজ্ঞানের বই, বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞান। আমার ইংরেজি অতো ভালো ছিলো না। ছবি আর ডায়াগ্রাম দেখে-দেখে তার আশেপাশের শব্দগুলো বুঝে নিতে চেষ্টা করতাম। একটা বই থেকে একবার একটা দারুণ জিনিস শিখলাম। ওতে বলা ছিলো, উইন্ডমিল দিয়ে পানি পাম্প করা যায়, চাই কি তৈরী যায় বিদ্যুৎও। পানির পাম্প মানেই সেচ, আর সেচ মানেই ক্ষুধার সমাপ্তি। সে দুঃসময়ে ক্ষুধাই ছিলো আমাদের সব চেয়ে বড় চিন্তা।

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম নিজের জন্য একটা উইন্ডমিলই বানিয়ে ফেলব। কিন্তু এটা বানানোর কোনো উপকরণ আমার হাতে ছিলো না। বাধ্য হয়েই আমি একটা ভাংড়ির স্তুপ থেকে এটা ওটা সংগ্রহ করতে শুরু করি। সে সময় আশেপাশের লোকজন, এমনকি আমার মাও, আমাকে পাগল বলতে লাগলো।

আমার সম্বল বলতে ছিলো একটা ট্রাকটরের ফ্যান, একটা শক অ্যাভজর্ভার, একটা বাইসাইকেলের ফ্রেম, কিছু পিভিসি পাইপ(যেটা গলিয়ে উইন্ডমিলের পাখা বানিয়েছিলাম) আর একটা পুরাতন বাইসাইকেলের ডায়নামো। এগুলো দিয়েই একসময় আমি আমার যন্ত্রটা বানিয়ে ফেলি। শুরুতে এটা শুধু একটা বাতিই জ্বালাতে পারতো। পরে কিছু সুইচ আর সার্কিট ব্রেকার যোগ করে চারটা বাতি জ্বালাই। এর পর আরেকটা মেশিন বানাই যেটা পানি পাম্প করতে পারে। আমার বাড়ির সামনে মানুষের লাইন পড়ে যেতে লাগলো। তারা আসতো তাদের মোবাইল চার্জ দিতে। যন্ত্রণায় আমি একরকম অতিষ্ঠই হয়ে গেলাম। এক সময় কিছু সাংবাদিক এলো। তাদের সূত্রে কিছু ব্লগার। আর সে সুবাদেই আমার ডাক পড়ে টেড(TED) নামের এই সংগঠনে।

আমি আগে কখনো উড়োজাহাজ দেখিনি। কখনো হোটেলে থাকিনি। তাই সেদিন আরুশাতে স্টেজে উঠে হঠাৎ আমি ভাষা হারিয়ে ফেলি। অনেক কষ্টে শুধু এটুকুই বলতে পারি, ‘আমি চেষ্টা করেছি আর বানিয়ে ফেলেছি…’। কিন্তু আমি তো বলতে চেয়েছিলাম তোমদেরকে, সবাই যারা আমার মত। আফ্রিকান। দরিদ্র। যারা তাদের স্বপ্নগুলোকে নিয়ে ধুঁকছো প্রতিদিন। ঈশ্বর তোমাদের সহায় হোন। হয়তো কোনো দিন তুমি এটা দেখবে ইন্টারনেটে। হ্যা, তোমাকেই বলছি। নিজের উপর আস্থা রাখো। আর যাই ঘটুক না কেন, হাল ছেড়ো না কখনো।”

ছেলেটার নাম উইলিয়াম কামকাওয়াম্বা। একটুখানি বিজ্ঞান যার জীবনকে বদলে দিয়েছে, উৎসাহিত করেছে আরো শত ভাগ্যাহত অনাহারী যুবককে।

আমাদের দেশেও এমন অনেকেই আছে। পত্রিকার পাতায় আনাচে কানাচে মাঝে মাঝে তাদের খবর দেখি। আমরা মধ্যবিত্তরা কেউ কেউ সে খবর পড়ে পুলকিত হই। আশান্বিত হই। কেউ কেউ পাত্তাই দিই না, উলটে চলে যাই খেলার পাতায়। আমরা ভাবি প্রচার তো হলো। আরো হাজার জন এবার উৎসাহিত হয়ে গেলেই হয়! কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি সেই ছেলেটা, সেই মেয়েটার কথা, ক্ষুধা-তৃষ্ণা-সামাজিক ছিছিক্কার আর ‘তুমি পারবেনা’-র প্রতিধ্বনিকে তুচ্ছ করে যারা আলো জ্বালে। তাদের গল্প শুনে তার মতই ভাগ্যাহত যারা উৎসাহিত হতে পারতো তারা কজন পত্রিকা পড়ে? কজন নজর রাখে টিভিপর্দায়? কান পাতে রেডিওয়? যেখানে পৌছালে সব চেয়ে কার্যকর হতো সেই খবর, সেটা সেখানে কি পৌছায়?

ক্ষুধা আর অনটনের সাগরে একবার ডুবেছে যে, উঠে আসার জন্য সে খড়কুটোও আঁকড়ে ধরে। তার এই মরিয়া অবস্থার সুযোগ নিয়ে ফায়দা লোটে কুংস্কারের ব্যবসায়ীরা। দাদন আর ঋণব্যবসায়ীরা। মধ্যবিত্তকে আপনি বিজ্ঞান শেখাতে যান। দেখবেন সেখানে হাজার রকম বাধা। গোঁড়ামির বাধা, ভাড়ামির বাধা; যত না বনের বাঘ, তারচেয়ে হাজার গুণ মনের বাঘ। কিন্তু, এই মরিয়া মানুষগুলোকে দিন না একটু খড়কুটো। নিজের দহনের একটু খানি দিয়ে ওদেরকে জ্বালিয়েই দেখুন না। নতুন যে কোনো কিছু, যার সাহায্যে শেষ পর্যন্ত পেটের ক্ষুধা মেটে, দারিদ্রের গ্লানি কাটে, সে সব গ্রহণ করতে ওদের একটুও সমস্যা হবে না দেখবেন। বিজ্ঞান কিন্তু পারে। সব শ্রেণীতেই আর্লি অ্যাডপ্টার আছে। মরিয়া মানুষের মধ্যে আরো বেশি।

গণিতের সমীকরণ নেই, কিন্তু প্রচুর ছবি আছে, সহজ শব্দ আছে, আর কাজেও লাগানো যায় সহজে। লিখেই দেখুন না এমন বিজ্ঞানের বই। আমাদের ‘কামকাওয়াম্বা’রা লুফে নেবে ঠিকই।

বেশিরভাগ স্কুলেই অতটা ভালো বিজ্ঞান শেখাতে পারে না স্যারেরা। অনেক জায়গায় তো পারেনই না। বিজ্ঞানের সেইসব প্রাথমিক বিষয় নিয়ে আমরা ছোটো ছোটো ভিডিও বানাতেই পারি। এযুগে এইসব ছড়িয়ে দেয়া/ডিস্ট্রিবিউশন কোনো ব্যাপারই না। মোবাইল ফোনে করে, সিডিতে করে, ডিভিডিতে করে, পেনড্রাইভে করে, কোনো না কোনো ভাবে সেসব পৌছে দেওয়াই যায় একদম ঘাস-মূলে। দিন না এদের বিজ্ঞানের সৌন্দর্যের সাথে, ক্ষমতার সাথে, বাস্তবতার সাথে, সত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে। আমাদের একজন ‘কামকাওয়াম্বার’ কন্ঠস্বর পৌছে দেওয়াই যায় আরো হাজারো ‘কামকাওয়াম্বা’র কাছে।

প্রতিটা মানুষ সে যতটা অলসই হোক, যত অথর্ব গোড়াই হোক জীবনে কখনও না কখনও পিছনে ফিরে চায়। উপলব্ধি করে আত্মউন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা। তার জন্য ‘বই পড়ার’ চেয়ে সহজ উপায় আছে কি? এ যুগে কিন্তু আছে। একটা মোবাইলফোন থাকলেই ছোটো ছোটো ভিডিও বানিয়ে ফেলা সম্ভব।

যখন কলেজে পড়ি। মফস্বল এলাকা। আমার স্যাররা কেউ কম্বিনেটরিক্স (বিন্যাস-সমাবেশ) পারে না। বলবিদ্যা পারে না। আমাদের বইগুলোও তো সেলফ স্টাডির জন্য তেমন স্বয়ংসম্পূর্ণ করে বানানো হয় না। ওই দুয়েকটা উদাহরণে মাথা কুটে কুটে শিখেছি তখন। বন্ধুদের অনেককেই দেখেছি ধৈর্য হারিয়ে বিজ্ঞানের হাল ছেড়ে দিতে।

ঢাকায় এসে দেখেছি কোচিং এর ভাইয়ারাই কত সুন্দর জানে সব অঙ্ক। যেটা শিখতে আমার মাস কেটে গেছে। এক লেকচারে তার চেয়ে কত বেশি, কত কিছু শিখে ফেলেছি। সেসব লেকচারে বসে ভাবতাম কোনও ভাবে যদি এগুলোই ভিডিও করে রাখা যেত। সে যুগে এত হাজার উপায় ছিলো না। এখন আছে।

মরিয়াদের বাঁচার জন্য নতুন কিছু শিখতে অনীহা নেই। অনীহা তো তাদের যারা লেখা-পড়া করে আরো বড়ো গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ার জন্য; এমনকি লেখাপড়া না করলেও যারারা গাড়ি-ঘোড়ায় চড়বে ঠিকই।

আমরা গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়তে চাই। অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়তে চাই। হতদরিদ্র মানুষ বাধ্য হয়েই কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ওরা কখনো আলো দেখেইনি। ওদের হাতের কাছেই ‘মিথ্যে আলো’ দেখানোর লোক মজুদ আছে। আসুন না সেই মিথ্যে লোকগুলোর চেয়ে উচ্চকন্ঠ হই। নিশ্চিত করি সবার জন্য একটুখানি বিজ্ঞান।

আমাদের সবার জীবন দীপান্বিত হোক।

টেডের ভিডিও দুটি-
দুরুদুরু কিশোর
সদর্প যুবক
এখানে সরাসরি ভিডিও এম্বেড করতে পারিনি.