লেখা নিয়ে বকবকানী

-মোকছেদ আলী*

ধুত্তুরী, ঘুম চাপছে। লিখতে মন চাচ্ছে না। ভেঙ্গে ভেঙ্গে লিখতে গেলে লেখাও ভাল হয় না, ভাষাও শুদ্ধ বা প্রাঞ্জল হয় না। সকালে লিখতে বসলাম। বলপেনের কালি গেলো ফুরিয়ে। লেখার সময় একটা মুড বা ভাব আসে, লিখতে লিখতে যদি বাধা প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহলে সেই মুডও আর থাকে না। বলপেন কেনা খুব ঠকা। কেন ঠকা বলছি- ইকোনো বা ইকোল্যাক যে নামেরই হোক না কেন, সবই এক, কারণ একই মেসিনে একই কাঁচামাল দিয়ে তৈরী করে শুধু নাম আর প্রচারের জোরে কোনো কোনোটা ভাল মনে হয়। একটা বলপেন তা যে কোন প্রতিষ্ঠানের হউক না কেন খুচরা দাম তিন টাকা নেয়। ঐ পেন দ্বারা ২ তা কাগজের বেশি লেখা যায় না। তারপর গোটা কলমটাই ফেরত দিতে হয়, মানে ফেলে দিতে হয়। ফেলে দিতে হয় লিখতে গিয়ে ফ একারে ফে লিখেই ল একার দিব কিন্তু হঠাৎ মনটা চলে গেল এক দূর অতীতে, দ্রুত লিখতে গিয়ে ফেরত দিতে লিখলাম। যাহোক ফেরত আর ফেলে দেওয়া প্রায় একই সমান। ফেলে দিলে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফেরত দিলেও তাই। সুতরাং ফেরত আর ফেলে দেয়ার মধ্যে বানানের দিক দিয়ে যদিও তুচ্ছ মনে করে, কিন্তু অর্থের দিক থেকে সমার্থবোধক।

আমার লেখা নাকি ভালো লাগে পড়তে, বলল আমার নাতি উৎসব। যাহোক লিখতে যখন শুরু করেছি, লিখি। কেননা হাতের লেখাটাও ভালো করা চাই। ঘুমের আলিস ধরেছে, কি করি আটটায় আজান হবে। তারাবীর নামাজ পড়তে যেতে হবে, সেজন্য লেখা বন্ধ করে, হেরিকেনটা বাম হাতে নিয়ে মসজিদ অভিমুখে রওনা দিলাম। বাম হাতে হেরিকেন, ডাইনে ছায়া পড়েছে, আমি হাটছি, আমার পায়ের বিশাল ছায়া প্রেতবৎ নাচছে। আব্বাছদের মহিষের গোরার নিকট দিয়ে পথ। গোরার নিকট উপস্থিত হতেই, গোবর চোনা, পচা জাবের গন্ধ মিলে এক বিকট গন্ধ ছড়িয়েছে। নাক ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে সমুখ পানে হাটতে লাগলাম। কিছুদূর এসে নাক থেকে হাত সরিয়ে নিলাম।
ওয়াজেদের বাগানের হাসনাহেনা ফুলের সুবাসে মন প্রাণ মেতে উঠল। সেই জন্যই বলে দুঃখের পর সুখ। বিকট গন্ধে পেটের নাড়িভুড়ি বের হওয়ার জোগাড়। আর এখন কি অপূর্ব মন মাতানো সৌরভ।
আমার নিকট যত ফুলই থাকুক; হাসনা হেনা, মাধবী লতা ও কামিনী ফুলের সৌরভ খুব ভালো লাগে। হাসনা হেনা, কামিনী, মধু মালতী, রজনীগন্ধা, প্রভৃতি ফুল রাত্রে সুগন্ধ ছড়ায়। যেই সূর্য অস্ত গেলো অমনি ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়লো। আবার যেই মাত্র সূয পূর্ব গগণে উদিত হয়ে আলো ছড়িয়ে দিল, আধার দূরে পালিয়ে গেলো, অমনি আধারের সাথেও এই সব ফুলের সুবাস অন্তরহিত, বানানটা কি ভুল হলো, অন্তর্হিত হবে, নাকি অন্তরহিত হবে, আমি সঠিক বুঝতে পারছি না। বুঝতে, মানে সঠিক কিনা বুঝতে হলে একজন বাংলা ভাষায় অভিজ্ঞ শিক্ষক নিকটে থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সেটা সম্ভব নহে। মাষ্টার বা পণ্ডিত রাখতে গেলে, অনেক অসুবিধা আছে, যেমন মাষ্টারের বেতন, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা, সর্বক্ষণ আমার নিকটে থাকা। যেমন ধরো- ভোর ৪ টার সময় সেহরী খেয়ে আবোল তাবোল লিখতে শুরু করলাম। আবোল তাবোল হাবি জাবি অশ্লিল, না না অশ্লীল, যাই লিখি না কেন সেই শব্দগুলিতো শুদ্ধ হতে হবে। অশুদ্ধ বা ভুল লিখলে সেটা থেকে তো কোনই জ্ঞান আহরণ করা যাবে না। তা হলে শুদ্ধ অশুদ্ধ বুঝিয়ে দিয়ে সংশোধন করবেন যিনি, তিনিই তো ভাষার ব্যাকরণবিদ বা নৈয়ায়িক। আগেই বলেছি এই নৈয়ায়িক সাহেবকে তো সর্বক্ষণ কাছে রাখা সহজও নয়, সম্ভবও নয়। তাহলে আমি শিখবো কেমন করে। শুদ্ধ অশুদ্ধ নির্ণয় করবো কিরূপে?
আছে, আছে, খুব সহজ পন্থা আছে। তোমরা হয়তো চেঁচামেচি করে জিজ্ঞেস করবে, কি, কি, কী, সেটা কি?
সেটা কি তা কি তোমরা এখনও বুঝতে পারছো না? আর পারবেই বা কি? বর্তমানে তোমাদের চিন্তাধারা তো সুষ্ঠু নয়। তোমাদের চিন্তাধারা শুধু মারিং কাটিং। কাকে ধরবো, কাকে মারবো, কার টাকা পয়সা জমি জমা কেড়ে নিয়ে নিজের সম্পদ বৃদ্ধি করবো। এই সব স্বার্থপর চিন্তাই তো তোমাদের ব্যস্ত করে রেখেছে। সুতরাং সদচিন্তা কোরতে তোমাদের মন মগজ ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। তাহলে আমি বলি, আর আমি না বলে তো পারছি না। কারণ জিজ্ঞেস করলে সহজ উত্তর, আমি না বললে তোমরা, মানে আমার নাতি নুতকার, ভাইস্তা, ভাজতি, ভাইগনা, ভাগনি, পাড়ার ছোট বাচ্চা কাচ্চারা শিখবে কোথা থেকে। আমার বয়স যে সাড়ে তিন কুড়ি। আমি এই বিপদ সংকুল দুনিয়ায় মোট মাট ৫ কুড়ি বছর বসবাস করতে চাই। কিন্তু বাওয়া, চাইলেই তো আর হবে না। সেটা তো আর আমার নিজের উপর নির্ভর করছে না। প্রকৃতির নিয়মে একদিন যেতেই হবে। তার চেয়ে এক সেকেন্ডও বেশি থাকা যাবে না। ঠিক কিনা বল?

তোমরা আজকাল টাইট প্যান্ট পরা ছেলে পেলে তো, মানে মিজান সাহেবের ভাষায়, খাড়া মুতুইন্যারা বলবে, আরে দীর্ঘ জীবন লাভের তো সহজ উপায় বৈজ্ঞানিকগণ বাতলে দিয়েছেন। ভিটামিনযুক্ত পুষ্টিকর খাদ্য খাও। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য খাও। তাহলে ১০০ বছর দুনিয়ার উপর ঘোরাফেরা করতে পারবে।

তোমাদের সেই সহজ কথাটা বলে দেই। হায়াত মউতের কথাতো বলা যায় না। যদি সুযোগ সুবিধা না পাই তখন তোমরা আফসোস করতে করতে পেটের অসুখ করে ফেলবে। তার চেয়ে উত্তরটা দিয়েই দেই। ভালো দেখে একখানা বাংলা অভিধান কাছে রাখলে শিক্ষকের কাজ হবে। অভিধানে যা লেখা আছে প্রায় সব শুদ্ধ। ভুল থাকে না তেমন। যাহোক বর্তমানে একখানা বাংলা অভিধানের মূল্য ২০০ টাকা হবে। বাংলা টু ইংরেজী ও ইংরেজী টু বাংলা অভিধান রাখলেও চলবে। তবে বাংলা টু বাংলা, ইংরেজী টু ইংরেজী, ইংরেজী টু বাংলা মোট ৫ খানা, নাকি ছয় খানা; আচ্ছা হিসাব করে দেখা যাক- বাংলা টু বাংলা ১ টা, ইংরেজী টু ইংরেজী ১ টা, মোট হলো ২ খানা। আর বাংলা টু ইংরেজী ১ খানা, হলো ৩ খানা। আর ইংরেজী টু বাংলা ১ খানা, মোট ৪ খানা। এই ৪ খানা অভিধানের দাম গড়ে সরে হাজার টাকা। যদি বাড়িতে এই কয়খানা কেতাব থাকে তাহলে পড়াশোনায়, লেখার সময় ভুল ত্র“টি হলে কিম্বা সন্দেহ হলে; বাস্, কেতাব খুলে দেখো। মাষ্টার সাহেব কাছে না থাকলেও আসল মাষ্টার তো তোমার হাতেই রয়েছে। অসুবিধা সহজেই দূরীভূত করে দেয়া সহজ হবে।
আমার এক চাচা, তার একখানা বাংলা টু বাংলা অভিধান ছিল। আশুতোষ দেবের সংকলিত। সেই অভিধান আমার কাছে ছিলো। আমি সময়ে অসময়ে ঐ অভিধান দেখে ভুল শুধরে নিতাম। কি বলব, বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের দিন, কোথা থেকে কারা এসে দিল আমার ব্যক্তিগত পাঠাগারে আগুন। হা হা করে সব গ্রাস করে খেয়ে নিল। খালি কি ঐ অভিধান গেছে? আমার সখের কত সংগ্রহ ছিলো তার তো কোনো হিসাব নেই। সব শেষ।
আগে আমার একটা নেশা বা হবি ছিলো। সেটা get to word বা শব্দ পুরণ প্রতিযোগীতা খেলা। এই খেলায় লোকসানের চেয়ে লাভ বেশি। লেখাপড়ার দিকে আগ্রহ বাড়ে। যেমন- ইতিহাস, ভুগোল, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, কবিতা, সাহিত্য প্রভৃতি বিভিন্ন সাবজেক্ট থেকে সূত্র নির্বাচন করে দেয়। সঠিক উত্তর লেখার জন্য ঐ বিষয়গুলি পড়াশোনা করে আলোচনা করা দরকার। তাহলে পুরস্কার পাওয়া যেতে পারে। আর পুরস্কার যদি নাও পাওয়া যায় তাতে কোনো দুঃখ নাই। জ্ঞান তো আহরণ হোল। একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেই। একটা clue ছিলো এরূপ। the pilot should know of his plane . হাইট – ওয়েট।
হাইট মানে উচ্চতা। আর ওয়েট মানে ওজন। সাধারণভাবে উত্তরটা ওজন বলেই মনে হয়। কারণ একটা প্লেন কতখানি ওজন নিয়ে আকাশে উড়লো এটা তার অবশ্যই জানা দরকার। তাই খেলায় ওয়েট লিখে দিলাম। রেজাল্ট বের হলো। উত্তর হাইট দিয়েছে। আমার রাগ হলো- এরা সঠিক উত্তর দেয় নাই। নিজেদের মনগড়া উত্তর দিয়েছে। তখন চিন্তা করতে লাগলাম। হাইট হয় ক্যামনে? বিমান বিষয়ে নানা প্রবন্ধ পড়তে লাগলাম। অবশেষে এক পাইলটের লিখিত চমৎকার একটা আকাশ ভ্রমণ কাহিনী পড়লাম। পাইলট লিখেছেন- আমার প্লেন ৮ হাজার ফিট উপর দিয়ে চলছিল। রাডারে আবহাওয়ার তথ্য পেয়ে প্লেনকে ১২ হাজার ফুট উচ্চে নিয়ে এলাম। তারপর গভীর মনোযোগ দিয়ে মিটার লক্ষ্য করলাম আর কত উচুতে উঠলে আমার প্লেন ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পাবে, আরো দ্রুত ১ হাজার ফিট উচুতে উঠে গেলাম। একজন বিমান চালককে তার বিমানের মাটি থেকে কত উঁচুতে অবস্থান করছে সে সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান রাখা একান্ত প্রয়োজন। এই প্রবন্ধ বা ভ্রমণ কাহিনী পড়ে জানতে পারলাম- ওয়েট নয়, হাইট-ই ঠিক উত্তর।
কাজেই দেখ, গেট এ ওয়ার্ড খেললে বই পুস্তক পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আর শব্দের অর্থ না জানলে তো সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। সুতরাং আমেরিকার বিশ্ববিখ্যাত লেক্সিকোগ্রাফার, জন ওয়েবস্টার সম্পাদিত বৃহৎ ডিকশনারী তৎকালীন সময়ে ১৫৫ টাকা দিয়ে কিনলাম পাবনার বিপিন বিহারী লাইব্রেরী থেকে। আমার সেই শখের কেতাব ওয়েবষ্টার ডিকশনারী খানাও পুড়ে ছাই ভষ্ম হয়ে গেছে।
যাহোক মোদ্দা কথা, হাতের কাছে যদি একখানা অভিধান থাকে তবে জ্ঞান আহরণের সুবিধা হয়। যারা এই অভিধান তৈরী করে বাজারে বিক্রয় করে, আসলে তারা ব্যবসা করে না। যা করে তা হলো মানুষের কল্যাণ বা মঙ্গল। দুনিয়ার সমস্ত প্রধান প্রধান ভাষার অভিধান আছে। বাংলায় আশুতোষ দেব সম্পাদিত দেব সাহিত্য কুটির হতে প্রকাশিত অভিধানই বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ অভিধান। অনেকেই অভিধান সংকলন করে বাজারজাত করে কিন্তু দেব সাহিত্য কুটিরের অভিধানের মত এত বেশি শব্দ, নিখুঁত ছাপা, মনোরম বাঁধাই সুলভ মূল্য অন্য কোন অভিধানে পাওয়া যাবে না। তবে সুবলচন্দ্র মিত্র রচিত অভিধান মোটামুটি ভালো। মোটামুটি ভালো বললাম এ কারণে যে আমি সুবলচন্দ্র রচিত বাংলা অভিধানে আমার প্রয়োজনীয় বা কাঙ্খিত কয়েকটি শব্দ পাই নাই। যাহোক তবুও সুবলচন্দ্রের অভিধান দ্বারা শতকরা ৯৭ ভাগ কার্য উদ্ধার হয়।
ইংরেজী বাংলা অভিধান বা ইংলিশ টু ব্যাঙ্গলী ডিকশনারীতে যে সমস্ত শব্দ আছে তাতে মনে হয়, আচ্ছা হিসাব করলেই পাওয়া যাবে- একটি পাতায় মোটামুটি ১০০ টা শব্দের অর্থ দেয়া আছে। তাহলে ৩০০০ পাতায় কতগুলি শব্দ থাকতে পারে। আচ্ছা হিসাব করেই দেখা যাক, ৩০০০ গুণন ১০০, তিন লক্ষ শব্দ আছে। এই তিন লক্ষ শব্দ চয়ন করতে, এ্যালফাবেটিক্যালি শব্দ বাছাই করতে তাদের কিরূপ পরিশ্রম করতে হয়েছে, ভেবে দেখো। বুঝা গেছে তো আমার কথা। আর আমার মতো পাগলের বকবকানী বুঝার কি-ই বা দরকার আছে তাই না?

——-
*মোকছেদ আলী (১৯২২-২০০৯)। স্বশিক্ষিত। সিরাজগঞ্জ জেলার বেলতা গ্রামে জন্ম। গ্রামটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

অনুলেখক: মাহফুজ।