ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন [০১] [০২] [০৩] [০৪] [০৫] [০৬] [০৭] [০৮] [০৯] [১০][১১][১২][১৩][১৪]
১৫
২২ জুলাই ১৯৯৮ বুধবার
উইলির ফ্ল্যাট
সকাল আটটায় ডিপার্টমেন্টে এসে নিজের ডেস্কে বসে পড়াশোনা করার চেষ্টা করছিলাম। এতদিন স্কুল থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত সবপর্যায়েই সর্বোচ্চ ফাঁকিবাজী করেও কোন রকমে পার পেয়ে গিয়েছি। সারাবছর পড়াশোনা না করে পরীক্ষার ডেট দিলে পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন করেছি। গৎবাঁধা কিছু প্রশ্নের উত্তর লাইনের পর লাইন মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখে দিয়ে পাস করে ফেলেছি। কিন্তু এখানে তো সে সুযোগ নেই। মুখস্থ করে কি গবেষণা করা যায়? বুঝতে পারছি এখানে ফাঁকিবাজি চলবে না। আমার দাদা-দিদিরা এত কষ্ট করে আমাকে এখানে পাঠিয়েছে লেখাপড়া করার জন্য। তাদের অসম্মান আমি কিছুতেই করতে পারবো না। তাই একটু সিরিয়াস হয়ে পড়তে বসেছিলাম।
মাইক্রোস্কোপিক অপটিক্যাল থিওরি সম্পর্কে কিছুটা পড়েছিলাম মাস্টার্সের নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে। পড়া মানে স্যার যেভাবে ক্লাসে এসে রয় এন্ড নিগমের নিউক্লিয়ার ফিজিক্স বই থেকে লাইনের পর লাইন বোর্ডে লিখে গেছেন, আমরাও লাইনের পর লাইন মুখস্থ করেছি। কিন্তু শিখিনি কিছুই। এখন মজা বেরোচ্ছে। এই থিওরির ভিত্তিতে লেখা গবেষণাপত্রগুলোর মাথামুন্ড কিছুই বুঝতে পারছি না।
লাইব্রেরি থেকে রয় এন্ড নিগমের বইটা নিয়ে এলাম। পুরনো বই দেখলে হয়তো মাথার জট কিছুটা খুলবে। বইয়ের অপটিক্যাল মডেল অধ্যায়ে অনেকবার রেফারেন্স হিসেবে এসেছে কেন্ এমোসের নাম। তখন তো এসব রেফারেন্সের দিকে চোখও পড়েনি। নিউক্লিয়ার থিওরির এমন বিখ্যাত প্রফেসরের কাছে গবেষণা শুরু করেছি ভাবতেই কেমন একটা ভালোলাগা ঘিরে ধরলো আমাকে। মনের ভেতর স্বপ্নের পাখিরা ডানা মেলতে শুরু করলো- ‘একদিন আমিও’-
ঠিক তখুনি মাথার ওপর আলতো ব্যাগের বাড়ি।
“হেই প্রাডিব। ইউ আর স্লিপিং হিয়ার?”
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মাথা তুলে তাকালাম ম্যান্ডির দিকে। ব্যস্ত হাতে জ্যাকেটের চেইন খুলছে আর খিলখিল করে হাসছে।
“গুড মর্নিং ম্যান্ডি”
“মর্নিং। ডিড ইউ গো হোম লাস্ট নাইট?”
এই মেয়ে কি বিদ্রুপ করছে আমাকে? জানতে চাচ্ছে আমি রাতে এখানে ঘুমিয়েছি কি না? এ জাতীয় প্রশ্নের যুৎসই উত্তর দেবার মত ইংরেজি আমার জানা নেই। কোন রকমে বললাম, “আমি ঘুমাচ্ছিলাম না। পড়ছিলাম”
“আমি জানি। মজা করছিলাম তোমার সাথে। আমি কী ঠিক করেছি জানো? এখন থেকে এই রুমেই বসবো। এটাই আমার ডেস্ক। এতদিন ওদিকে চার নম্বর রুমে বসতাম। ওখানেও আমার একটা ডেস্ক আছে। এখন থেকে এখানে বসবো কেন জানো? মনে হচ্ছে এখানে সময়টা অনেক মজায় কাটবে। তুমি কি মজা করতে পছন্দ করো? পিক্ যে চলে যাচ্ছে তুমি জানো? পিকের সাথে পরিচয় হয়েছে না? পিক্ মানে পিটার…”
ম্যান্ডির সাথে পরিচয় হয়েছে মাত্র গতকাল। অথচ সে এমন ভাবে কথা বলছে যেন শৈশব থেকেই দেখছে আমাকে। অস্ট্রেলিয়ানরা জাতিগতভাবেই বেশ খোলামেলা স্বভাবের। কিন্তু ম্যান্ডি মনে হচ্ছে তার চেয়েও বেশি। এত কথা যে কীভাবে বলে মেয়েটা!
রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা শুরু হয়েছে এভাবে, “আমার পাঁচ বছর বয়সের ছোটো মেয়ে মিনি এক দন্ড কথা না কহিয়া থাকিতে পারে না। পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া ভাষা শিক্ষা করিতে সে কেবল একটি বৎসর কাল ব্যয় করিয়াছিল, তাহার পর হইতে যতক্ষণ সে জাগিয়া থাকে এক মুহূর্ত মৌনভাবে নষ্ট করে না”
সকাল ন’টা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত ম্যান্ডির বক-বক শুনতে শুনতে কাবুলিওয়ালার মিনির কথাই মনে পড়লো। মিনির আদলে ম্যান্ডিকে নিয়েও লেখা যায়ঃ “আমার পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সের সহপাঠিনী ম্যান্ডি এক দন্ড কথা না কহিয়া থাকিতে পারে না। আমার সহিত পরিচয় হইবার পর একটা মাত্র দিন অতিবাহিত হইয়াছে। এর পর হইতে যতক্ষণ সে আমার ডেস্কের পাশে কম্পিউটারের সামনে বসিয়াছে, এক মুহূর্ত মৌনভাবে নষ্ট করে নাই”
ম্যান্ডি কম্পিউটার দখল করে বসে আছে দেখে পিটার এসে ‘হাই ম্যান্ডি, হাই প্রাডিব’ বলে একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে চলে গেছেন। আমি ভেবেছিলাম পিটারকে দেখে ম্যান্ডি কম্পিউটার ছেড়ে উঠে যাবে। আমি হলে তাই করতাম। কিন্তু ম্যান্ডি পিটারকে পাত্তাই দিলো না। কম্পিউটারের পর্দায় চোখ রেখে অনবরত কথা বলেই চলেছে।
কোন কাজ সে আসলে করছে না। ইন্টারনেটে কিছুক্ষণ সাজ-পোশাক দেখেছে। এখন ওয়ার্ল্ড জিওগ্রাফি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করছে।
“হেই প্রাডিব, ইউ আর ফ্রম ব্যাঙলাড্যাশ- রাইট?”
“ইট্স বাংলাদেশ ম্যান্ডি। বাং-লা-দে-শ। নট ব্যাঙলাড্যাশ। বাংলা ইজ আওয়ার ল্যাংগুয়েজ এন্ড কালচার, দেশ মিন্স কান্ট্রি”
ম্যান্ডিকে বাংলাদেশ সম্পর্কে জ্ঞান দিতে গিয়ে এই শীতের সকালেও ঘাম বের হয়ে যাবার জোগাড়। আমার ইংরেজি শব্দের ভান্ডার যে এত ছোট আগে বুঝতে পারিনি।
ম্যান্ডি ইন্টারনেটে বাংলাদেশ সম্পর্কিত অনেক তথ্য বের করে পড়তে শুরু করেছে আর একটু পর পর আমাকে জিজ্ঞেস করছে-বাংলাদেশের কোথায় বাড়ি তোমাদের? চিটাগং শব্দের অর্থ কী? এত ছোট একটা দেশে তোমরা এত বেশি মানুষ কীভাবে থাকো?
তার প্রশ্নের উত্তরে “যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় নয় জন” জাতীয় কিছু একটা বলতে পারতাম। কিন্তু তেঁতুলের ইংরেজি জানা না থাকায় কিছু না বলে চুপ করে রইলাম।
“আই নিড এ কাপ অব কফি। ডু ইউ ওয়ান্ট?”
“থ্যাংক ইউ ম্যান্ডি”
“ইয়েস থ্যাংক ইউ, অর নো থ্যাংক ইউ?”
“নো থ্যাংক ইউ”
“ওকেই”
কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গেলো ম্যান্ডি। সে কি একটু মনক্ষুন্ন হলো? সুন্দরী মেয়েরা নাকি কোন প্রস্তাবেই ‘না’ শুনতে অভ্যস্ত নয়।
পৌনে এগারোটায় পিটার এসে দাঁড়ালেন রুমের সামনে। কেনের কলোকুইয়াম এগারোটায়। পিটার বললেন, “তুমি কি জানো যে কলোকুইয়ামের আগে ফ্রি খাবারের ব্যবস্থা আছে?”
“তাই নাকি? কোথায়?”
“চলো। উপরের স্টাফ রুমে”
কেন্ও বেরোলেন একই সময়ে। সাত তলায় উঠে হেড অব দি স্কুলের অফিসের সামনে স্টাফ রুম। মিকি দেখিয়েছিলেন সেদিন। এর মধ্যেই ভীড় জমে গেছে সেখানে। টেবিলে রাখা ডোনাটের উপর প্রায় হামলে পড়ছে সবাই। আমি কেন্ আর পিটারের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। বাকি সব মুখ এখনো অপরিচিত।
“গুডাকেন্, হোয়াট ইয়া টাকিন টু ডাই?”
প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হলাম। চোখে পুরু চশমা, মাথায় ধবধবে সাদা চুল, বাচ্চাদের মত মুখ, পরনে হাফ-শার্ট আর হাফ-প্যান্ট। প্যান্ট-টা কাঁধের সাথে বেল্ট দিয়ে আটকানো। কেনের একেবারে কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বুঝতে চেষ্টা করছি তিনি কেন্কে কী জিজ্ঞেস করলেন। ‘টু ডাই’ কথাটা প্রায়ই শোনা যায় এখানে। সবাই শুধু শুধু মৃত্যুর কথা বলবে কেন? নিশ্চয় শুনতে ভুল করছি আমি। দেখি কেন্ কী উত্তর দেন।
“হাই জেফ্। হাউ থিংস?”
“থিংস আ ফাইন। কান্ট কম্প্লাইন। সো হোয়াট ইয়া টাকিন টু ডাই?”
“সাম নিউ স্টাফ, পিটার এন্ড মি ডুয়িং লেইট্লি”
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রাডিব ইজ স্টার্টিং সুন। প্রাডিব, মিট জেফ। এ ভেরি গুড ফ্রেন্ড অব মাইন”।
জেফের সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে হঠাৎ পরিষ্কার হয়ে গেলো ‘টু-ডাই’ মানে কী। হায়রে অস্ট্রেলিয়ান উচ্চারণ, ‘ডে’ যদি ‘ডাই’ হয়ে যায় কীভাবে বুঝবো! ‘হোয়াট ইয়া টাকিন টু ডাই’ অর্থাৎ ‘হোয়াট ইউ টকিং টুডে?” গতকাল ম্যান্ডি যখন জিজ্ঞেস করেছিল ‘হ্যাভ ইয়া কাম টু-ডাই?’- ভেবেছিলাম ঠাট্টা করে জানতে চাচ্ছে মরতে এসেছি কি না। অথচ সে জিজ্ঞেস করছিলো “আজকে এসেছো?”
এগারোটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে হারকাস থিয়েটারে এসে ঢুকলাম সবার সাথে। একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, ডোনাট খাওয়ার জন্য যারা এসেছিলেন তাদের অনেকেই মাঝপথে হাওয়া হয়ে গেছেন। বিনে পয়সার বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা শোনার আগ্রহের চেয়ে বিনে পয়সার খাবারের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবুও এখানে এটা আশা করিনি।
কেনের বক্তৃতা শুরু হবার পর বুঝতে পারলাম এরকম খটমটে বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা শোনার আগ্রহ সবার হবার কথা নয়। বিষয়ভিত্তিক কোন পূর্ব-ধারণা ছাড়া এ ধরণের বক্তৃতা বোঝা সম্ভব নয়। নিউক্লিয়ার থিওরি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা সত্ত্বেও আমি তেমন কিছুই বুঝতে পারলাম না। বক্তৃতা শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বটা মূল বক্তৃতার চেয়েও আকর্ষণীয়। প্রশ্ন করার জন্যও একটা নূনতম জ্ঞান দরকার হয়। আমি জানি না আমার সে পরিমাণ জ্ঞানার্জন কবে হবে বা আদৌ হবে কি না।
লাঞ্চের সময় স্টুডেন্ট সাপোর্ট সেন্টারে গিয়ে পার্ট-টাইম জবের বিজ্ঞপ্তিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লাম। বেশ ভীড় এখানে। আমার মত সবারই চাকরি দরকার। বাংলাদেশে ছাত্রাবস্থায় পার্ট-টাইম চাকরি বলতে টিউশনিই বুঝতাম। এখানে মনে হয় টিউশনি ব্যাপারটাই নেই। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতেই কি সবকিছু পড়িয়ে দেয়া হয়? গৃহশিক্ষক লাগে না এদেশে? বেবি সিটারের চাহিদা মনে হচ্ছে অনেক বেশি। কয়েকজন সম্ভাব্য চাকরিদাতার ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর লিখে নিয়ে এলাম। রুমে যখন কেউ থাকবে না তখন ফোন করতে হবে। কারো সামনে ফোন করতে গেলে সংকোচে গলা দিয়ে শব্দ বেরোবে না। ম্যান্ডির সামনে তো নয়ই।
ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে ‘বুক সর্টার’ পদে পার্ট-টাইম লোক দরকার। বইয়ের নম্বর মিলিয়ে শেল্ফে তুলে রাখার কাজ। এখানে নিশ্চয় কথ্য ইংরেজিতে চৌকশ হওয়ার দরকার নেই। আমি বই ভালবাসি। বাবার বইয়ের দোকানের সুবাদে ছোটবেলা থেকেই আমি বই গোছাচ্ছি। মনে হচ্ছে এই চাকরিটা অপেক্ষা করছে আমার জন্যই। বিলিউ লাইব্রেরিতে গিয়ে মিগ্যান স্টিফেনসনের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
বেরিয়ে পড়লাম। আর্কিটেকচার বিল্ডিং এর পাশ দিয়ে এডমিনিস্ট্রেশান বিল্ডিং পার হয়ে এক দৌড়ে পৌঁছে গেলাম বিলিউ লাইব্রেরিতে। বিশাল পাঁচতলা বিল্ডিং এর পুরোটাই লাইব্রেরি। তিরিশ লাখ বই আছে এখানে। রিসেপশানে গিয়ে মিগ্যান স্টিফেনসনের সাথে দেখা করতে চাই বলতেই রোগা পাতলা ছেলেটা জানতে চাইলো পার্ট-টাইম চাকরির ব্যাপারে কি না। বুঝতে পারলাম আমার আগেই এসে গেছে অনেকে। কিছুটা দমে গেলাম। চাকরিটা মনে হয় আর খালি নেই। কিন্তু ছেলেটা আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে টেলিফোনে কথা বললো কারো সাথে। একটু পরে ভেতরের দিকের একটা রুম থেকে একজন অসম্ভব মোটা মহিলা কাউন্টারে এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন।
“হ্যালো, আই এম মিগ্যান স্টিফেনসন” খুবই মিষ্টি মোলায়েম কন্ঠ মিগ্যানের।
“হ্যালো। মাই নেম ইজ প্রদীপ দেব” বলে মিগ্যানকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে বুক সর্টার হিসেবে আমার যোগ্যতা অনেক। এবং চাকরিটা পেলে আমার জন্য খুব ভাল হয়।
মিগ্যান ঝানু ম্যানেজার। মনযোগ দিয়ে আমার কথা শুনলেন। তারপর বললেন, “দেখো, আমরা আন্ডারগ্রাজুয়েট স্টুডেন্টদের প্রাধান্য দিচ্ছি। কারণ তোমরা পোস্টগ্রাজুয়েটরা তো ডিপার্টমেন্টে টিউটরিং ডেমনেস্ট্রেশান ইত্যাদি করতে পারছো। তাছাড়া ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসেবে তুমি তো সপ্তাহে বিশ ঘন্টার বেশি কাজ করতে পারবে না। এখানে বিশ ঘন্টা করলে ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে পারবে না। ডিপার্টমেন্টে কিন্তু পেমেন্ট অনেক বেশি। ভেবে দেখো। তারপরও যদি ইচ্ছে করো এপ্লিকেশান ফর্ম ফিল-আপ করে জমা দাও। পরে আমরা যোগাযোগ করবো তোমার সাথে”।
মিগ্যানকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে এলাম। সপ্তাহে সবোর্চ্চ বিশ ঘন্টা কাজের সীমাবদ্ধতার কথা আমার মনেই ছিল না। ডিপার্টমেন্টে এই সেমিস্টারে কাজ পাচ্ছি সপ্তাহে মাত্র একটা তিন ঘন্টার ডেমোনেস্ট্রেশান। সপ্তাহে আরো সতেরো ঘন্টা কাজ আমি করতে পারবো। কিন্তু মিগ্যান তো বলেই দিয়েছেন যে আন্ডারগ্র্যাজুয়েটদের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এর পরেও দরখাস্ত করার কোন মানে হয় না।
হতোদ্যম হবার কোন কারণ নেই। হাতে এখনো তিনটি ঠিকানা আছে। বেবি সিটিং। খুবই সোজা কাজ, অথচ ঘন্টায় সাড়ে বারো ডলার বেতন। এ কাজেও আমার অভিজ্ঞতা অনেক বছরের। আমার ভাগ্নে-ভাগ্নি-ভাইজি বাবু-রুপু-পূজা তাদের কয়েক ঘন্টা বয়স থেকে শুরু করে এই দু’সপ্তাহ আগেও আমার তত্ত্বাবধানে থেকেছে কোন না কোন সময়। ছোটবেলায় তারা অবলীলায় প্রাকৃতিক কাজ-কর্ম সেরেছে আমার কোলে, গায়ে, মাথায়। এখানে কাজে লাগবে জানলে আসার সময় দিদি আর বৌদির কাছ থেকে বেবি সিটার হিসেবে অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতার সনদপত্র নিয়ে আসতে পারতাম।
তিন জায়গাতেই বলা হয়েছে বিকেল পাঁচটার পর ফোন করতে। পাঁচটা বাজার অনেক আগেই রুম খালি হয়ে গেছে। ইমাজিনের ক্লাস একটার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। বিকেলে তাকে দেখা যায় না। ম্যান্ডি চলে গেছে আমি লাইব্রেরি থেকে ফিরে আসার একটু পরে। কেন্ চলে গেছেন পৌনে পাঁচটার দিকে। যাবার সময় আমার রুমে উঁকি দিয়ে ‘গুড নাইট’ বলে গেছেন। যদিও বাইরে দিনের আলো নিভে গেছে, তবুও বিকেল পৌনে পাঁচটায় কি শুভরাত্রি বলা চলে? কিন্তু না বলেও তো উপায় নেই। ইংরেজির নিয়মে বিদায়ের সময় তো আর গুভ ইভনিং বা শুভসন্ধ্যা বলা যায় না।
পাঁচটা বাজার কিছুক্ষণ পর রুমের দরজা বন্ধ করে টেলিফোন নিয়ে বসলাম। খাতায় যেভাবে লিখে এনেছি সে অর্ডারেই ফোন করা শুরু করলাম। প্রথমটা ডেফ্নি জোন্স।
“হ্যালো, মে আই স্পিক টু ডেফ্নি জোন্স প্লিজ”
“স্পিকিং। হু ইজ ইট?”
বললাম, “ম্যাডাম, বেবি সিটারের বিজ্ঞপ্তি দেখে ফোন করছি”
ও প্রান্তে কিছুক্ষণ কোন সাড়াশব্দ নেই।
“ম্যাডাম, হ্যালো, হ্যালো, ম্যাডাম”
“সরি, দি পজিশান ইজ নো লংগার এভয়েলেভল”
কী সুন্দর কথা। চাকরিটি এখন আর খালি নেই। মানে হলো আমাকে পছন্দ হয়নি ম্যাডাম ডেফ্নি জোন্সের।
নো প্রোবলেম। দ্বিতীয় নম্বরে ডায়াল করলাম।
“হ্যালো, আই এম কলিং এবাউট দি বেবি সিটার পজিশান। মে আই স্পিক টু নিকি ফার্নান্ডেজ প্লিজ”
“স্পিকিং। হোয়াট্স ইওর নেম?”
ভদ্রমহিলার উচ্চারণে ইন্ডিয়ান টান। নিকি ফার্নান্ডেজ কি ভারতীয় নাম? শ্রীলংকানও হতে পারেন। বললাম, “আমার নাম প্রদীপ দেব”
“মনে হচ্ছে ঠিক মত শুনতে পাচ্ছি না। আপনিই কি চাকরিপ্রার্থী?”
“হ্যাঁ, আমার বিশেষ অভিজ্ঞতা আছে শিশু-রক্ষণাবেক্ষণ কাজে”
“আপনার নাম প্রদীপ দেব। কিন্তু আপনার গলার স্বর ঠিক মেয়েদের মত লাগছে না। আপনার কি ঠান্ডা লেগেছে?”
“না ম্যাডাম। আমার ঠান্ডা লাগে নি। আমার গলা মেয়েদের মত লাগছে না কারণ আমি মেয়ে নই। আমি পুরুষ”
“কিন্তু এ কাজ তো মেয়েদের”
“ম্যাডাম, বিজ্ঞপ্তিতে তো এরকম কিছু লেখা নেই”
“সরি মিস্টার দেব। আইনগত কারণে বিজ্ঞপ্তিতে অনেক কিছু লেখা যায় না। বেবি সিটিং আসলে মেয়েদের কাজ। আমি একটা ছোট্ট বেবি কেয়ার সেন্টার চালাই। সেখানে একদম বাচ্চা বাচ্চা শিশুদের দেখাশোনা করার কাজ। আমি খুব দুঃখিত মিস্টার দেব”
লাইন কেটে গেলো। বাকি নম্বরে ফোন করার কোন মানে হয় না। বেবি সিটিং মিশন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ‘ফেইলিওর ইজ দি পিলার অব সাকসেস’ বাক্যটি যদি সত্য হয় তাহলে আমার ভবিষ্যৎ সাফল্যের ভিত্তিতে আরো কয়েকটা পিলার যোগ হলো আজ! যে হারে ব্যর্থ হচ্ছি তাতে তো মনে হচ্ছে কয়েক দিনের মধ্যেই আমার সাফল্যের ক্ষেত্র পিলারময় হয়ে যাবে। কিন্তু শুধুমাত্র পিলার দিয়ে কি বিল্ডিং তৈরি করা যায়?
পৌনে ছ’টার দিকে বাসায় যাবার জন্য নিচে নেমে এলাম। দেখি স্কুল ড্রেস পরা কয়েক শ’ ছেলে-মেয়ে ভীড় করে লেবি থিয়েটারে ঢুকছে। ফিজিক্স জিমনেশিয়াম। স্কুলের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য ফিজিক্সের বিশেষ লেকচার সিরিজ। আমিও মিশে গেলাম শিক্ষার্থীদের ভীড়ে।
কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে লেবি থিয়েটার। গ্যালারির তিনশ’ সিটের সবগুলো ভর্তি হয়ে সিঁড়ির ওপরও বসে গেছেন অনেকে। শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের শিক্ষক এবং অভিভাবকরাও এসেছেন অনেকে। আজকের লেকচারার এসোসিয়েট প্রফেসর রে ভলকাস ও জেফ টেইলর। রে ভলকাস থিওরেটিক্যাল পার্টিক্যাল ফিজিসিস্ট, আর জেফ টেইলর হলেন এক্সপেরিমেন্টাল পার্টিক্যাল ফিজিসিস্ট। দু’জনই নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিখ্যাত। স্কুলের শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে কণা-পদার্থবিদ্যার তত্ত্বীয় ও পরীক্ষামূলক প্রাথমিক ব্যাপারগুলো এমন সুন্দর করে বোঝালেন যে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বক্তৃতা যে শুধু শোনার নয়, দেখারও বিষয় তা এর আগে বুঝিনি।
কম্পিউটার টেকনোলজি শিক্ষার একটা প্রধান অঙ্গ হয়ে উঠছে। এখানকার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বাড়াবার জন্য ইউনিভার্সিটির বড় বড় প্রফেসরদের কত সহযোগিতা। আমাদের দেশে তো এরকম কোন ব্যাবস্থা নেই। আমরা ভালো রেজাল্ট করার জন্য দিন-রাত মুখস্থ করি, শিক্ষকদের বাসায় বাসায় গিয়ে প্রাইভেট পড়ি। শিক্ষাজীবনের অনেকগুলো বছর ধরে কেবল পড়ি আর পড়ি আর পড়ি, কিন্তু কিছু শিখি কি?
জানি তুমি বলবে আমি একপেশে তুলনা করছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এদের মত সম্পদ আমাদের থাকলে আমরাও এদের মত হতে পারতাম। এদের ইউনিভার্সিটিতে বছরে প্রায় পনেরো হাজার ডলার বেতন দিয়ে পড়তে হয়। পনেরো হাজার ডলার মানে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা। আর আমরা বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় দিয়েছি বছরে মাত্র একশ’ আশি টাকা।
এরকম কত-শত ভাবতে ভাবতে বাসায় এলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় প্রশ্রাবের উৎকট গন্ধ নাকে এসে লাগলো। কেউ কি সিঁড়িতে প্রশ্রাব করেছে? কোন বাচ্চার কাজ হয়তো। কিন্তু পরিষ্কার করে দেয়ার দরকার ছিল না? নাকি এখানেও ‘সরকারি মাল দরিয়ামে ঢাল’?
রুমে ঢুকে মনে হলো রুমের তাপমাত্রা বাইরের কনকনে ঠান্ডার চেয়েও আরো কয়েক ডিগ্রি কম। রুম হিটিং এর কোন ব্যবস্থা নেই। চাকরি পেলে নিজেকেই একটা ব্যবস্থা করে নিতে হবে। ক্ষুধায় পৃথিবী গদ্যময় লাগছে। রান্না করার সুযোগ নেই এখন। ফিল আমার রান্নার জন্য সময় বরাদ্দ করে দিয়েছেন সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটা। এখন রান্নাঘরে ঢুকলে নিয়মভঙ্গ করা হবে। নিয়ম ভাঙার জন্য যে মজবুত পেশী দরকার তা আমার এখনো হয় নি। তাছাড়া রান্নার দরকারও নেই। কাল রাতের অবশিষ্ট খাবার রুমেই আছে। রুম-হিটার না থাকাতে ভালোই হয়েছে। পুরো রুমটাই একটা ফ্রিজের মত হয়ে গেছে। খাবার নষ্ট হয়নি। জীববিজ্ঞানে অভিযোজন বা এডাপ্টেশান নামে একটা ব্যাপার পড়েছিলাম। টিকে থাকার জন্য আমাদের শরীরের কোষগুলো যে কোন পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেবার চেষ্টা করে। বুঝতেই পারছো, এখন আমার অভিযোজন কাল চলছে। দেশে ফিরলে হয়তো দেখবে শীতকালেও ফ্যান চালিয়ে শুয়ে আছি।
ক্রমশঃ_____________
এই লেখাট আমি বরাবর পড়ে থাকি।কখনো মন্তব্য দেই কখনও বা দেয়া হয়ে ওঠেনা। তবে,খুবই ভালো লাগে। কেমন জানি একটা আশ্চর্য টান অণূভব করি। আরো লিখুন আরো পড়ি।
@ ব্লাডি সিভিলিয়ান
আপনার এই নিক নেয়ার কারনটা একটু নেগেটিভ হয়ে গেল না ? পাঞ্চিং ব্যাগে মানুষ কেন ঘুসি মারে? হাত শক্ত করার জন্য, ঘুসিতে ঘুসিতে ওদের হাত আরো শক্তই হবে, তার চেয়ে আপনি যদি নিজেকে চীনের প্রাচীর হিসেবে ঘোষনা করেন তাহলে ভাল হয়, ঘুসিতে ঘুসিতে ওদের হাতই ভাঙ্গবে আপনি ভাঙ্গবেন না, চীনের প্রাচীরকে কে না ভালবাসে, আপনি নিজেও হয়ত নিজেকে ভালবাসতে পারবেন তখন।
@সখা,
আবার জিগ্স!!!
বাকিটা আপনাআপনিই আসে।
ধন্যবাদ সখাসুলভ মন্তব্যের জন্যে।
বদ্দা, অনর বারি হডে? ফরাহুনা হডেত্তুন গইর্গন? অস্ট্রেলিয়াত কি নোয়া নোয়া গিয়ন্না?
@ব্লাডি সিভিলিয়ান বদ্দা, আঁর লেখা পরি ন বুইঝদলাইগ্যন অস্ট্রেলিয়াত নোয়া নোয়া আস্সি কি না? আস্সিদে বার বছর হইযারগই।
অন’র খবর কী?
@সবার জন্যঃ ব্লাডি সিভিলিয়ান (আমি ঠিক জানি না এরকম একটা ছদ্মনাম কী কারণে তিনি নিয়েছেন) চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় জানতে চেয়েছেন আমার বাড়ি কোথায়, পড়াশোনা কোথায় করেছি, অস্ট্রেলিয়ায় নতুন এসেছি কিনা। উত্তরে আমিও আঞ্চলিক ভাষায় লিখলামঃ আমার লেখা পড়ে কি বুঝতে পারছেন না অস্ট্রেলিয়ায় নতুন এসেছি কি না? এসেছি বারো বছর হয়ে যাচ্ছে। আপনার খবর কী?
@প্রদীপ দেব,
আপনি কিন্তু আমার প্রথম প্রশ্নের জবাব দেন নি। আমি আপনার গ্রাম/উপজেলা ইত্যাদি জানতে চেয়েছিলাম।
আমি দুঃখিত, খেয়াল করি নি যে আপনি লেখার তারিখটা সঙ্গেই দিয়ে দিয়েছেন। এখন বুঝলাম আপনি আসলে ওসব বৌদির উদ্দেশেই (তখন হয়েছেন বা হন নি) লিখতেন।
আপনি মেলবোর্নে থাকেন। আমার কয়েক বন্ধু সিডনিতে আছে। আপনার মেল আইডিটা দেওয়া যায় কি?
আমাদের ভাষার রূপান্তর করে আপনি মোটেও ভালো কাজ করেন নি দাদা। আমি চেয়েছিলাম সবাই জানতে চাইবে আসলে আমরা কী বলছি, একটু শিক্ষামূলক ভাব নেওয়া যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। দিলেন তো সব মাটিং চকার করে।
আমার নামটা নেওয়ার মূল কারণ হলো, সব দিকে থেকে মার খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত দুহাত তুলে বলেই দিলাম, “নে বাবা, আমি হচ্ছি ঘোষিত পাঞ্চিং ব্যাগ। এবার মার আমায় সামনে পেছনে যত পারিস।” যন্ত্রণা সইতে সইতে বুঝলাম, মৃত্যুতেই আসলে পূর্ণ শান্তি মেলে। তাই নিজেকেই অপছন্দ, ঘেন্না করতে, গঞ্জনা দিতে নিজেকে আর অন্যদেরও প্রণোদনা দিয়ে যাই।
বলুন তো, নিজেকে অপছন্দ করলে কোথায় গিয়ে মুক্তি মেলে, শান্তি পাওয়া যায়? উত্তরটা বোধহয় আগেই দিয়ে ফেলেছি।
ভালো থাকবেন।
@প্রদীপ দেব , আপনার লেখা বরাবর ই পছন্দ করি পড়তে, ক্যামেরার পেছনে না দাড়িঁয়েও কিভাবে শুধু মাত্র লেখনীর মাধ্যমেই একটা চলচিত্র তৈরী করা সম্ভব তা’ আপনার লেখা পড়লেই বিশ্বাস করতে শুরু করি।
আপনার অনুমতি নিয়ে আপনার লেখায় ব্লাডি সিভিলিয়ান কে একটা মন্তব্য করছি।
ব্লাডি সিভিলিয়ান ,
আমি বোধ করি এই মন্তব্য টা করতাম না যদি না জীবনের ক্ষয় বিশেষতঃ মেধাবী জীবনের ক্ষয় আমাকে বিচলিত না করত। আমি আপনার চেয়ে বয়েসে অনেক বড় তবে যোগ্যতায় ক্ষুদ্র জেনেও একটা তাগাদা অনুভব করলাম বলেই মন্তব্য করছি।
কি জানেন সবার ই জীবনে কিছু ক্ষেদ থাকে, জীবন অনেকের সাথেই কৃপণতা করে । একটি বিষয়ে ভাগ্যবান হলেও, ভাগ্যের বিড়ম্বনা কিন্তু অন্য বিষয়ে থাকতেই পারে।
কিছু জলধারা আনন্দ না হয়ে অশ্রু হয়ে ঝড়তে পারে, কিছু জোনাকী বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যেয় মলিন হয়ে যেতেই পারে, কিছু আশাকলি ফোটবার আগেই ঝরে পড়ার আয়োজন করতে পারে। না, আমি আপনার সঙ্গে “মানুষের থেকে না পাওয়ার ভার”অথবা “দুঃক্ষের পসরা”” খুলে পাল্লা দিতে বসছি না । আমি শুধু বলতে চাইছি ” জীবন এমন ই” ।
জীবন এমন বলেই মনের মুকুরে মানুষ নতুন করে দেখতে শেখে, ইচ্ছে ঘুড়ি আকাশে ওড়ায়।
নচিকেতা র গানের রেষ ধরে বলি ” একলা মানুষ মাতৃ গর্ভে একলা মানুষ চিতায়। আর বাকীটা সময় একলা না থাকার অভিনয়” ভেবে দেখুন চিন্তায় আমরা সবাই একলা -কিনতু বোধ হয় একাকী নই। আপনার নিজের কথাই ধরুন এই যে আপনি মুক্ত মনার সাথে আত্মার আত্মীয় হয়ে জড়িয়ে আছেন, কজনের সাথে ই বা আপনার সাক্ষাত যোগাযোগ । কিন্তু লেখনীর মাধ্যমে কতজনের সঙ্গে আপনার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। আপনার প্রয়োজনীয়তা আপনি নিজেই তৈরী করে নিয়েছেন । এই তো পুষিয়ে গেলো অনেক কিছু, সবাই আপনাকে খুচিয়ে পাঞ্চিং ব্যাগ বানিয়েছে এই কথা তো আর টিকলো না।
আমিও অনেক সময় বলি আমরা মরি না বলেই বেঁচে আছি। বাঁচার আনন্দে বাচিঁ না । কিন্তু ওই যে বললাম মেধার ক্ষয় আমাকে পিড়ীত করে, আপনি যখন হতাশার কথা বলছেন, মুক্ত মনার সাধারন একজন পাঠক হিসেবে আমার শুনতে ভালো লাগছে না।
পাতা বলে শাখার সাথে থাকবো না আর ঝুলে
এই কথাটি বলে, আপনা থেকেই একটি পাতা ঝরে গেলো তলে
যেমনি পড়ে যাওয়া -সাথে সাথেই পাতা টিকে উড়িয়ে নিলো হাওয়া।
অনিমেষ আইচের ছোট একটা কবিতা।
আপনি আমার চেয়ে মেধা, মনন, মহিমা, অর্জন, অভিজ্ঞতায় অনেক বড় ।
আপনাকে জ্ঞান দান সাজে না তবু একটা গল্প বলি —
এক শিষ্য জীবন বিরুপ হয়ে গুরুদেব কে বললেন – গুরুদেব আমি তো আর সহ্য করতে পারছি না” জনশ্রুতি আছে যে, গুরু বললেন – গ্রামের বাড়ি গুলো তে খোঁজ কর- যে বাড়িতে দুঃখ নেই , ক্ষেদ নেই সে বাড়ী থেকে এক দানা চাল নিয়ে এসো । সন্ধ্যে ডুবুডুবু, শিষ্য বাটি হাতে এসে দাড়িঁয়েছে গুরুর কুটিরের সামনে , বল্লেন–প্রতি বাড়ীতে পুঞ্জীভুত দুঃখ, ছোপ ছোপ কষ্ট – শুনতে শুনতে আমার শোক কোথায় মিলিয়ে গেলো বলুন তো গুরু?
আমি জানি কেউ অন্য কারো আহত হ্রিদয়ে রজনী গন্ধার শুভেচ্ছা রাখতে পারে না যদি না সে নিজেই তা না চায়। কিন্তু যে যাত্রা কুয়াশা ভোরে শিশিরে পা ডুবিয়ে শুরু হয়, তাকে উদিত সুর্য্যের মুখ দেখতেই হয় । সুতরাং আর ক্ষেদের কথা বলবেন না। ব্লগে আপনার লেখায় মানুষ শত সহস্র সুর্য্যের সানাই শুনুক সেটাই চাইবো।
শেষ কথা– কাল সন্ধ্যেয় ঝুম বৃষ্টি নামলো সন্ধ্যের বৃষ্টি বুঝতেই পারছেন। চারদিক ধুপ ছায়া আলো আধারীরঁ লুকোচুরি, এর মাঝে থোকা থোকা হলদেটে কমলা ফুলের চমক নিয়ে বৃষ্টি ভেজা অভিমানে কৃষ্ণচুড়া গাছ গুলো মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে । দেখতে এত্তো ভালো লাগছিলো । ঝড় জলের দিন কোথায় মন বিষণ্ণ হবার কথা -হোল উল্টোটা । অফিস থেকে বেড়িয়েই মনটা এমন ভালো হয়ে গেলো।
প্রকৃতি আনন্দ দেয়। কেননা আমাদের সবার ভেতরের বাউলটা পথে নামতে চায়, জানালা খুলে নয়ন মেলে দেখতে চায়।
মানুষ বৃদ্ধ হলে বলে বেশী, এই বিবেচনায় আমার এই উপযাজকের মত অতিকথন মার্জনা করবেন।
@কেয়া রোজারিও,
দুঃখজনক অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতার কাহিণী আমাদের শুনানো যায় না? অনেকদিন পর কেয়াকে পেয়ে ভাল লাগল।
প্রদীপ দেব,
আমি মন্তব্য না করলেও আপনার লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়ি কারণ আমার ছেলে তিন মাস হল পড়তে অষ্ট্রেলিয়া গেছে। বৃত্তির টাকায় পুরোপুরি চলে যায় বলে আর্থিক কষ্ট করতে হচ্ছে না বা হবে না, কিন্তু তার মানসিক কষ্টের আঁচ আমি পাই। আপনার লেখায় সে আঁচ আর একটু দেওয়া যায় না কি? তাহলে ষোল কলা পূর্ণ হতো।না কি সময় তা ভুলিয়ে দিয়েছে?
@গীতা দাস,
দিদি, অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। মানসিক কষ্টটা আসে মৌলিক সমস্যাগুলোর প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে একটু স্থিতাবস্থায় পৌঁছানোর পর। অন্তঃত আমার ক্ষেত্রে সেরকমই হয়েছে।
আপনার ছেলে কোন্ ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন?
ভালো থাকবেন।
@গীতা দাস,
স্বাক্ষর শতাব্দ-এর লেখাপড়ার বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম, আজ তা জানলাম।
@ প্রদীপ দেব,
গম আচুননি বদ্দা।
এই লেখাটি যেদিন পোষ্ট দেন সেদিনই পড়ি। আপনার এডেলাইডে সাতদিন, মুক্তমনা ও মুক্তমনার সিরিজগুলি, অনুবাদিত- বিজ্ঞান কি ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছে? ধর্মবিশ্বাস, বিজ্ঞানবিশ্বাস ও এক চিল্তে ইতিহাস পড়েছি। তাই জানিয়ে দিলাম।
ব্লাডিসিভিলিয়ান আর আপনার মধ্যে চাটগাইয়া কথপোকথন ভালই লাগলো। আপনারে তো চিনতে পারলাম, কিন্তু হেই ব্যাডার আসল চেহারা এখনও উন্মোচন হয়নি।
@মাহফুজ,
ল্যাঙ্গোয়েজ! ল্যাঙ্গোয়েজ!!
@কেয়া রোজারিও,
দিদি, আপনি আমার লেখা পড়েন জেনে কী যে খুশি হয়েছি। অনেক ধন্যবাদ আমার লেখা সম্পর্কে আপনার উদার মন্তব্যের জন্য।
আর ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’র জন্য যা লিখেছেন তার সাথে পূর্ণ সহমত প্রকাশ করছি।
@প্রদীপ দেব,
ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো আমি আসলেই গোপন রাখতে চাই। আজ আবেগপ্রবণ হয়ে কিছু কথা বলে ফেললাম বলে নিজেরই লজ্জা লাগছে। দ্যাটস সো আনস্মার্ট, ম্যান। সো আনসফিস্টিকেটেড!
নিজেকেই বললাম।
আপনি কিন্তু এখনো জানান নি আপনার বাড়ি কোন উপজেলায় বা গ্রামে। এখনো মেলবোর্নে থাকেন কি না?
@কেয়া রোজারিও,
কী বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না। সব ব্যক্তিগত কথা বোধহয় বলাও যায় না। তাছাড়া, পিরে মুর্শিদ সৈয়দানা মুজতবা আলী-জাঁ তো পূর্বতন মহাপুরুষদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেই গেছেন: “হাতের সামনে ধরা বদ্ধমুষ্টি দূরের হিমালয়কেও ঢেকে ফেলে।”
আমার জন্যে আপনার সহানুভূতি অনন্য। অপাত্রে দান হলো যদিও। এজন্যেই নারীদের শ্রদ্ধা করি এতো। বিশ্বাস করি ফরাসি কবি লুই আরাগঁ-র মতো, “পুরুষের ভবিষ্যত হচ্ছে নারী।”
কে বলে? আমার মেধার বা অন্য কিসব বললেন, ওগুলো শুনতে ভালো লাগে বটে, তবে, কোন প্রমাণ আমার জীবনে তেমন একটা পাই নি। কাজেই বিব্রত ও লজ্জিত হলাম।
আসলে, সবার জীবনেই একটা বোধহয় ঘাট থাকে, যেখানে সে নোঙর ফেলতে সবচে বেশি ভালোবাসে। কারোর জীবনে সে-ঘাট জ্ঞান, কারো পরিবার, কারো ভালোবাসা, কারো ক্যারিয়ার-এমনি নানা কিছু। এক ঘাটে নাও না ভিড়লে সে অগত্যা অন্য ঘাটে ভেড়াতে চায়। কিন্তু, কারোর প্রিয় ঘাটগুলো যদি কুয়াশায় হারায় চিরতরে, তবে সে কী করে? কিংবা, যদি কোন ঘাটে নাও ভেড়ানোর ইচ্ছেটাই হারিয়ে যায় পুরোপুরি, তাহলে তার জন্যে কী বিধান? ব্যাখ্যা করতে পারলাম না বোধহয় সবটা। পুরোটা না শুনলেও যাবেও না বোঝানো সবটা।
বাইরে থেকে দেখলে আমি বোধহয় একজন সুখী মানুষ, হয়তো আমার বর্তমান অবস্থা ঈর্ষাও জাগাতে পারে অনেকের হৃদয়ে। বেশ নামকরা একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি, পরিবারেও শান্তি, আর্থিক অনটনও তেমন একটা নেই। মানুষ আর কী চায়? শ্লা, পড়িসনি তো আসল কষ্টে, দেখতাম তখন তোর রোম্যান্টিক কষ্টবিলাস …দানো কই যায়। খাওয়া, পরা, থাকা-সব ঠিকঠাক আছে তো, তাই খুঁজে খুঁজে কষ্ট বের করিস! হ্যাঁ, এভাবেও আমায় আক্রমণ করা বা আমার সমালোচনা করা যায়।
কিন্তু, আমার কী হারিয়েছে, কেন এতো ব্যথাজর্জর এই সত্তা, কেন এতো শূন্যতাকষ্ট বুকে নিয়ে আর ভন্ডামি, অভিনয় মুখে নিয়ে অহরহ নিজের মৃত্যু কামনা করি, তা নিজের কাছে বোঝা যতোটা সহজ, অন্যের কাছে বোধগম্য করা হয়তো ততটাই কঠিন।
আমার জন্যে সহানুভূতি প্রকাশের জন্যে ধন্যবাদ। তবে, আশা করি এপ্রসঙ্গ ভবিষ্যতে আর কেউ তুলবেন না। কারণ, আমার জন্যে এটা এক অচিকৎস্য, অসংশোধনীয় বেদনার্ত, কর্কশ অসহনীয় দিনলিপির অমোচনীয় ছাপ।
ধন্যবাদ।
আমার হাতে অনেক কাজ, শুধু একটা ডু মারার জন্যে এসেছিলাম, এসে আপনার পোষ্ট পেয়ে পরতে লেগে গেলাম শেষও করলাম এখন আবার ধন্যবাদ দেবার জন্য মন্তব্য লিখছি, আপনার লেখার ধরন অনেক সুন্দর সহজ সরল। শুরু করলে শেষ করতেই হয়। এর চেয়ে বেশি কিছু লেখার ক্ষমতা এখনও হয়নি আমার 🙂 ।
@সখা, খুব ভালো লাগলো আপনার উদার মন্তব্য দেখে। অনেক ধন্যবাদ।