কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং পাহাড়ের ওপর ঝুঁকিপূর্ণভাবে গড়ে তোলা ঘিঞ্জি রোহিঙ্গা শিবিরটির নীচে দাঁড়াতেই বিশাল বস্তিটির বিশ্রী বোটকা গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দেয়। তথ্য-সাংবাদিকতার পেশাগত কাজে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবির এবং ১৯৯৬-৯৭ সালে ত্রিপুরার পাহাড়ি শরনাথী শিবির একাধিকবার পরিদর্শন করা গেছে। কিন্তু ‘আন-রেজিস্ট্রার্ড রোহিঙ্গা টাল’ নামক উখিয়ার এই বস্তিটির চরিত্রর সঙ্গে আগের অভিজ্ঞতার তেমন কোনো মিল নেই।

ওপারে মিয়ানমার থেকে এখানে এসে বছর তিনেক ধরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা কেউই শরনার্থীর মর্যাদা পাননি। সরকারি খাতাপত্রেও তাদের শরনার্থী হিসেবে নাম নেই। একই কারণে তাদের যেনো দুর্ভোগেরও কোনো শেষ নেই।

‘বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ বস্তিবাসীর উৎসুক শত শত উপক্ষা করে, নানান প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ঢালু পথ বেয়ে খানিকটা ওপরে যেতোই ছোট্ট একটি দোকান ঘরের দোকানী ফাতেমা খাতুনের (৫৫) আরাকান ও টেকনাফ-চিটাগনিয়ান ভাষার দুর্বোধ্য মিশ্রনের অনর্গল বাক্যবানের সামনে থমকে যেতে হয়। তিনি আঁতিপাতি করে খুঁজে বের করেন সাদাকালো ছবি অলা বর্মী ভাষার একটি পরিচয়পত্র। ছবিতে এক যুবককে দেখা যায়। তার কথা বুঝতে সহায়তা করেন দোকান ঘরের বেঞ্চে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা দুটি কিশোর।

rohingya-1

ফাতেমা খাতুন, কারাবন্দী ছেলের পরিচয়পত্র হাতে

জানা গেল, কার্ডটি ফাতেমার বড় ছেলে আবু তাহেরের (২০)। মাস খানেক আগে সে তার চাচাতো ভাই নূর হোসেন নামক আরেক যুবকের সঙ্গে কাজের খোঁজে চট্টগ্রামে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। তাদের কাছে নাকি পুলিশ ‘বাংলাদেশী কার্ড’ (জাতীয় পরিচয়পত্র) দেখতে চেয়েছিল। সেটি দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় সীমান্ত আইন লংঘনের দায়ে পুলিশ তাদের কারা-হাজতে পাঠিয়েছে। মাঝে বুড়ি-বুড়ি একবার ছেলেদের সেখানে দেখেও এসেছে। এখন এই অধম ‘সরকারি স্যার’ তাদের সেখান থেকে মুক্ত করতে পারবেন কী– এটিই ফাতেমার জিজ্ঞাসা।

জবাবে তাকে জানিয়ে দেয়া হয় পেশাগত পরিচয়। পরামর্শ দেয়া হয় মানবাধীকার কোনো সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আরো জানা যায়, তার কর্মহীন ও দোকান নির্ভর স্বামী উকিলের সন্ধানে এখন চট্টগ্রামে গেছেন। এতোদিন উকিলের ফিস জোগাড় করতে না পারায় তিনি কিছুই করতে পারছিলেন না।

বলা ভাল, গত দুই দশকে আবু তাহেরের মতো অসংখ্য যুবক এখন সীমান্ত আইনে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের কারাগারে বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন। তবু সীমানা পেরিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধ করা যাচ্ছে না। খোদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা এদেশে অবৈধভাবে বসবাস করছেন। এদের মধ্যে প্রায় চার হাজার বন্দীর কারাবাসের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও তারা দেশে ফিরতে পারছেন না।

প্রায় সাত হাজার ৮০০ পরিবারের আশ্রয় স্থল বস্তিটি ঘুরে চোখে পড়ে, রোহিঙ্গা নামক দেশহীন মানুষের মানবেতর জীবন। বস্তির প্রায় অর্ধেকই শিশু-কিশোর। পুষ্টি, চিকিৎসা, স্কুল– সবই যেনো তাদের জন্য এক অলীক স্বপ্ন। বড়দের মতোই তাদেরও কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হয়। প্লাস্টিক শিট দিয়ে তৈরি, জানালা বিহীন একেকটি নীচু ছাদের আট ফুট বাই আট ফুট ঘরে পাঁচ-সাত জনের গাঁদাগাদি করে বাস। একটি এনজিও সেখানে এসে এতোগুলো মানুষের জন্য চারটি স্যানিটারি ল্যাট্রিন তৈরি করে দিয়েছে। আরেক এনজিও বসিয়ে দিয়েছে তিনটি টিউবয়েল। পুরো বস্তিতে নাগরিক সুবিধা বলতে এইটুকু। …

rohingya-3

রোহিঙ্গা শিশু, সামনে দীর্ঘ অনিশ্চিত ভবিষ্যত

সেখানের সবচেয়ে সুশ্রী ঘরটি মসজিদ ও মাদ্রাসা। সেটি মাটির তৈরি, ওপরে ছনের ছাদ। কথা হয় মসজিদের ইমাম মো. রফিকের সঙ্গে। পরিস্কার বাংলায় তিনি বললেন এর নাম — কুতুপালং মসজিদ ও মাদ্রাসা। তার মাদ্রাসাটিতে রয়েছে ৭০ জন ছাত্র ও ১৩ জন শিক। ছাত্র বেতন মাসে ১০ টাকা। মো. রফিক নিজে কোরানে হাফেজ। আরাকানী ভাষায় কাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছিলেন। পরে বছর সাতেক আগে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী নাসাকাদের অত্যাচারে দেশ ছেড়েছেন তিনি।

বস্তির যারই সঙ্গে কথা হয়, তিনিই জানান অনেকটা একই রকম জীবন কাহিনী। ওপারে মিয়ানমারে তাদের নিজস্ব চাষবাস ছিল। ছিল হালের গরু, পোষা ছাগল, হাঁস-মুরগী এবং প্রচুর গাছ-গাছালি। কিন্তু নাসাকা বাহিনী প্রায়ই গ্রামে ঢুকে তাদের ক্ষেতের ফসল কেটে নেয়, মেয়েদের অনেককে ধর্ষণ করে, গরু-ছাগল লুঠ করে, ছেলেদের দিয়ে ক্যাম্পে বিনা পয়সায় ‌‌’লেবারি’ করায়। প্রতিবাদ করলেই বেত মারে, গুলি ছোঁড়ে, নয়তো জেলে পাঠায়। ওপারে জীবন রাখাই দায়। এখন জমি-জমাও বর্মীরা দখল করে নিয়েছে।

সিতারা বেগম (২০) বলেন, এপাড়ে তা-ও তো আমরা কোনো রকমে আধপেটা খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। কিন্তু ওপাড়ে গেলেই আমাদের মরণ। আমরা মরি-বাঁচি, এপাড়ে বাংলাদেশেই থাকতে চাই। তিনি জানান, ভোর হলেই বস্তির ছেলেরা এদিক-সেদিক বেরিয়ে পড়েন দিন-মজুরির আশায়। আর মেয়েরা বাচ্চা কোলে অনেকেই বেরিয়ে পড়েন আশেপাশের গ্রামে ভিক্ষার আশায়।

রোহিঙ্গা বস্তিটি ঘুরে আরো জানা গেলো, নিরর বস্তিবাসীদের কাছে রিপ্যাট্রিয়েশন, রেশন কার্ড, ন্যাশনাল আইডি কার্ড, লেবার, বিডিআর, পুলিশ, নাসাকা — ইত্যাদি ইংরেজী শব্দগুলো খুব পরিচিত। তাদের সবার একটিই দাবি, বাংলাদেশ সরকার যেনো তাদের নাগরিকত্ব দেয়। আর যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন যেনো তাদের দেওয়া হয় শরনার্থীর মর্যাদা।

rohingya-2

কিশোরী বিধবা রাবেয়া এখন যাবেন কোথায়?

শিবিরের আরো কয়েকজন নারী-পুরুষ ও শিশুর সঙ্গে কথা বলে পেশাগত কাজ সেরে ফিরে আসার সময় দুপুরের খর রোদে চোখে পড়ে দলবদ্ধ শিশুদের মাটির ওপর ছক কেটে এক্কা-দোক্কা খেলা। তারই পাশে লোকাল বাসের জন্য পোটলা-পুটলি নিয়ে শিশু কোলে অপেমান কিশোরী বিধবা রাবেয়া (১৬) ইতিকথাও জানা হয়।

তিনি জানান, তার দিন কাটে ভিক্ষে করে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে এক-দেড় কেজি চাল ও সামান্য তরি-তরকারি ভিক্ষে মেলে। তা দিয়েই মা-মেয়ে এতোদিন ধরে বেঁচে আছেন। বছর খানেক আগে স্বামী মো. আমিন বান্দরবানের আলীকদমে গাছ কাটার ‘লেবারি’ করতে গিয়ে গাছ চাপা পড়ে মারা গেছেন। রাবেয়া চেষ্টা করছেন, কোনো লোকাল বাস ধরে বাস হেলপারকে অনুরোধ করে বিনা পয়সায় টেকনাফ পৌঁছাতে। সেখানের আরো এক ‘আন-রেজিস্ট্রার্ড টাল’ এ রয়েছেন তার বাবা-মা ও ভাইবোন। রাবেয়ার ইচ্ছা, বাবা-মা, ভাইবোনসহ টেকনাফের টালেই একেবারে থেকে যাওয়া। কিন্তু এই দুর্দিনে বাবা-মা এতে রাজী হবেন কী না কে জানে? …

ছবি: লেখক।

আরো পড়ুন: ১। রোহিঙ্গা, উইকিপিডিয়া।
২। বাংলাদেশে ৪ লাখ অবৈধ রোহিঙ্গা বাস করছে: দীপুমনি, বিডিনিউজ।