বিজ্ঞান পত্রিকা মহাবৃত্ত’: কেমন হলো অঙ্কন

 

বিজ্ঞানপত্রিকাঃ মহাবৃত্ত

আইনস্টাইন সংখ্যা

দ্বিতীয় বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, এপ্রিল-জুন, ২০১০

 

সমাজের মধ্যে বেড়ে উঠছি, আমরা সামাজিক জীবপ্রতিনিয়ত কিছু না কিছু দেয়ার সাথে সাথে সমাজ আমাদের কাছে পাওয়ার দাবীও করেআর সেখান থেকে সৃষ্টি হয় দায়বদ্ধতারসমাজের সেই চাহিদা কিংবা দাবী আমি বা আমরা মেটাতে না পারলেও, দায়িত্ব হাতে নিয়েছে বিজ্ঞান পত্রিকা মহাবৃত্তকতটুকু সফল হয়েছে বা সফল হবে সেটা পরের বিষয়, কিন্তু চেষ্টাতো করেছেচেষ্টা করাটাইতো এখানে সবচেয়ে বড় সফলতাতাদের সেই চেষ্টায় শামিল হয়ে হয়তো আমরাও চেষ্টা করতে পারি কিছুটা দায়মুক্তিরমহাবৃত্তের লেখাগুলো কতটুকু সঠিক অথবা যুক্তিসংগত হয়েছে সেটা যাচাই করার মত জ্ঞান আমার নেইকিন্তু সাধারণ একজন পাঠক হিসেবে আমার কাছে কিভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, কিভাবে ধরা দিয়েছে মহাবৃত্তসেটুকুই তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি এই লেখায় 

 

প্রথমেই বলে নিই, সবচাইতে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে পত্রিকার উপস্থাপনালেখার বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে দেয়া হয়েছে বেশ কিছু মজার মজার ছবি, যেগুলি বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা পড়ার ক্লান্তি থেকে পাঠককে মুক্তি দিতে পারে সহজেইএবার আসি শুরুর প্রসঙ্গেপত্রিকাটি শুরু হয়েছে, খ্যাতিমান অধ্যাপক এ এম হারুন অর রশীদ এর সাক্ষাৎকার দিয়েকিন্তু সাক্ষাৎকারের শুরুটা কোনভাবেই প্রাণবন্ত বা স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেনিমনে হয়েছে আগে থেকে কাগজে কলমে পদার্থবিজ্ঞানের কিছু কথা একঘেয়েভাবে লিখে রাখা হয়েছে; তারপর সেটাকে উপস্থাপন করার জন্য একটি একটি করে প্রশ্নের অবতারণা করা হয়েছেকিছু কিছু বাক্য মনে হয়েছে সরাসরি কোন অনুবাদের সফট্ওয়ার দিয়ে অনুবাদ করে তুলে দেয়া হয়েছেযেমন, প্লাংকের তত্ত্বের বেলায় বলা হয়েছে, ‘প্লাংকের কোয়ান্টাম তত্ত্বে বলা হয় যে, মানুষের পক্ষে কোনো বিকিরণ কম্পকের শক্তির পরিমাণ সীমিত নির্ভুলতা ছাড়া চিহ্নিত করা যায় না’(পৃঃ ৯) নীলক্ষেতের সস্তা অনুবাদের বইয়ের সাথে আমি এর কোন পার্থক্য দেখি নাবিজ্ঞান জনপ্রিয় করতে হলে, প্রয়োজনে কম বিজ্ঞানকে বেশি কথায় বুঝিয়ে লেখাটা জরুরীতবে সত্যেন বসু, পল ডিরাক, ওয়ার্নার হাইসেনবার্গ এবং প্রফেসর আবদুস সালামের সাথে তাঁর সাক্ষাতের ঘটনা সত্যিই চমৎকার 

  

গতানুগতিক, গুরুগম্ভীর বিজ্ঞানের লেখার ধারণা থেকে বের হয়ে এসে মফিদুল হক খুব চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন আইনস্টাইন ও মিলেভাঃ এক জটিল সমীকরণনিসন্দেহে লেখাটি পত্রিকায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেতবে মিলেভা ও আইনস্টাইনের বিবাহ বিচ্ছেদের সাল একবার ১৯১২ (পৃঃ ২১) আবার ১৯১৮ (পৃঃ ২৩) বর্ণনা করা হয়েছে

 

অভিজিৎ রায় প্রিন্সিপাল অব রিলেটিভিটিকে বলতে গেলে বাল্যশিক্ষার বইয়ের মত সহজ করে তুলে ধরেছেনগল্পের ছলে উপস্থাপন করে গেছেন বিজ্ঞানের এই কঠিন তত্ত্ব, যদিও রাম যদি দ্রুতগতিতে চলতে থাকে, রহিমের তুলনায় রামের ঘড়ি কিন্তু আস্তে চলবে’(পৃঃ ৩১) বলেই থেমে গেছেনকেন আস্তে চলবে তার আরেকটু বিশদ বিবরণ হলে ভালো হতোঅন্যদিকে, ‘হ্যাপিয়েস্ট থট অব মাই লাইফ’-সমতুল্যতার নীতিব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি হঠাৎ করে রক্ষনশীলই হয়ে গেলেনআপেক্ষিকতাব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি পাঠকের যে আকাঙ্খাকে বাড়িয়ে দিলেন, ‘সমতুল্যতার নীতিব্যাখ্যা করতে গিয়ে সে আকাঙ্খা পূরণ করলেন না

 

আলী আসগরের নতুন শতাব্দীর আলোকে আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বশুধু পড়ে গেলেই হবে না, পড়ার সাথে সাথে মস্তিষ্কের যথেষ্ট ব্যবহারও করতে হবেতাঁর লেখায়ও আক্ষরিক অনুবাদের ছড়াছড়ি দেখতে পাই, সাধারণ পাঠকের জন্য যেগুলো বুঝতে পারা খুবই কঠিনযেমন লেখা হয়েছে, ‘বিশ্বব্যাপী কাল-প্রবাহের অভিন্নতা ও স্থানিক ব্যবধানে অবস্থিত জায়গায় সময়ের যুগপত্ততা বজায় থাকল নাপর্যবেক্ষকের সঙ্গে সময় পরিমাপক ঘড়ির আপেক্ষিক গতি থাকলে সময়ের প্রবাহ সেই ঘড়িতে মন্থরিত হলো’(পৃঃ ৪২) আবার লেখা হয়েছে, ‘স্থান-কাল কীভাবে গতিশীলতায় বণ্টিত সব বস্তুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় অভিব্যক্তি লাভ করছে, তাই বিধৃত গাণিতিক সমীকরণেএই সমস্ত বাক্যগুলোর আগে পরে আরো বেশ কিছু সহায়ক বাক্য ব্যবহার করা যেতো, তাহলে এ-বাক্যগুলো বুঝতে সুবিধা হতো

 

গণিতের অমনোযোগী ছাত্র যেমন পরীক্ষার খাতায় ইচ্ছে মতন লিখে শেষ লাইনে গিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে, ‘অতএব বামপক্ষ = ডানপক্ষ (প্রমাণিত)’; শামসুদ্দিন আহমেদ মনে হলো সেরকমটাই করে শেষ লাইনে গিয়ে লিখেছেন, ‘আর এটাই হলো আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্বের ভিত্তিভূমিলেখার ব্যাপারে আরো যত্নবান হলে এবং সবধরণের পাঠকের বোধগম্য হবে কি-না সে ব্যাপারে লেখকরা আরো মনোযোগী হতে পারলে ভালো

 

নাসরিন সুলতানা মিতু, আহসান হাবীব, মুনির হাসান, খালেদা ইয়াসমিন ইতি, ফাতেমা বেগম জুম্মি, আবদুর রাজ্জাক, মাজেদুল হাসান, সীমান্ত দীপু- এদের লেখাগুলো পত্রিকায় বৈচিত্র এনে দিয়েছে দারুণভাবেলেখকদের এ-সমস্ত লেখাই আসলে বিজ্ঞান পত্রিকার প্রাণতারেক অণুতো আইনস্টাইনের বাড়িতে না গিয়েই সুন্দরভাবে লিখে ফেলেছেন আইনস্টাইনের বাড়িতে

 

অজয় রায় খুব যত্ন এবং পরিশ্রম করে লিখেছেন ভৌত বাস্তবতাআইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথকে তিনি এক সূতোয় বেঁধে ফেলেছেন নিপুণ হাতেখুব যথার্থভাবে লেখক মন্তব্য করেছেন, ‘আশ্চর্য হতে হয় কবি এত বিজ্ঞান জানলেন কি করে, আর বিজ্ঞানী এত কাব্যিক হলেন কি করে?’ লেখার পরিশিষ্টে দেয়া আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথের আলাপচারিতার বঙ্গানুবাদ আগ্রহী পাঠকের মনের খোরাক যোগাবে নিশ্চিতভাবে

 

বিজ্ঞানের কঠিন লেখাও যে লেখনীশক্তির কল্যাণে হয়ে উঠতে পারে সহজবোধ্য এবং সুখপাঠ্য, তার প্রমাণ সৈয়দ তোশারফ আলীর লেখা মানবতন্ময় বিজ্ঞানী আইনস্টাইনচমৎকার তারা বিন্যাস ও বর্ণনাঠিক একই মানের আরেকটি লেখা মোস্তফা আমিনুর রশীদের পদার্থবিজ্ঞানের ষষ্ঠ বিপ্লববিজ্ঞানপত্রিকায় এ-ধরনের নিবেদিত লেখকদের লেখা যত বেশি থাকবে, তত বেশি সফলভাবে ফুটে উঠবে পত্রিকার আদর্শ, উদ্দেশ্য

 

অন্যদিকে, রজনীশ রতন সিংহ, ডাঃ হাসান শাহরিয়ার কল্লোল, নাসিম সাহনিক, নোমান মোত্তাকী, জাহাঙ্গীর আলমদের লেখাগুলো পাঠকদের বিজ্ঞানের হরেকরকমের দিকের সাথে একটু করে হলেও পরিচয় করিয়ে দেবার সুযোগ করে দিয়েছেবিশেষ করে পত্রিকার অন্য লেখাগুলো সমসাময়িককালে লেখা না হলেও, এদের লেখাগুলো সাম্প্রতিক বিষয়াবলী নিয়েই

 

সম্পাদক আসিফের দুটি লেখাই পত্রিকার শেষের দিকেএকটা কিছুটা প্রথম দিকে এবং অন্যটা শেষের দিকে থাকলে, পাঠকদের একই লেখকের পরপর দুটি লেখা পড়ার ক্লান্তি থেকে মুক্তি দেয়া যেতযদিও দুটি লেখার বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারারঅপরদিকে, পত্রিকার লেখাগুলোর ক্রম দেখে বুঝা যায়, পত্রিকার প্রথম অংশে অনেক আগের কিছু মানসম্পন্ন লেখার সাথে পরবর্তীতে নতুন কিছু লেখা যোগ করে পত্রিকাটি ছাপানো হয়েছেপুরোনো ও নতুন লেখা সমভাবে বণ্টিত করতে পারলে ভালো হতোতাছাড়া, পত্রিকার এ-সংখ্যাটি আইনস্টাইনের নামে দেয়া হলে সম্পাদকের দুটি লেখাই বিশেষভাবে আইনস্টাইন কেন্দ্রিক নয়অবশ্য, প্রথম লেখাটিতে আইনস্টাইন চলে এসেছে, আসতে হয় বলে

 

সর্বোপরি, মহাবৃত্তের সাইজ কিংবা সাজ-সজ্জা যথেষ্টই পরিপাটি এবং মানসম্পন্নতবে, সম্পাদকের পক্ষ থেকে লেখকদের বলে দেয়া উচিৎ, যত বেশি সম্ভব উদাহরণ দিয়ে এবং প্রতিদিনকার বাস্তব কোন ঘটনার সাথে মিল দেখিয়ে যদি বিজ্ঞানের জিনিসগুলো ব্যাখ্যা করা যায়, তাহলে পাঠকদের জন্য অনেক বেশি সুখকর হয়ে উঠবে বিজ্ঞানের পত্রিকা, পাঠক অনেক বেশি আগ্রহবোধ করবেবিজ্ঞান পত্রিকা শুধু বিজ্ঞানের পাঠক সৃষ্টি করবে না, বিজ্ঞানের লেখকও সৃষ্টি করবেডিসকাশন প্রজেক্টএর এই প্রকাশনাকে স্বাগত জানাই এবং কৃতজ্ঞতা জানাই সমস্ত লেখক, কলাকুশলীদের প্রতি যারা নিজেদের শ্রম ও মেধা দিয়ে এ-ধরণের একটি মহৎ উদ্যোগের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেনদ্বিজেন শর্মা তাঁর শুভেছা সম্পাদকীয়তে যথার্থভাবেই আমাদের সংস্কৃতিতে বিজ্ঞানের দুর্বল অবস্থানের কথা বলেছেনমহাবৃত্তসেই অবস্থান কিছুটা হলেও শক্ত করবে; যা-কিছু সত্য, যা-কিছু সুন্দর, সে-সব সত্য-সুন্দরকে কেন্দ্র করেই অঙ্কিত হবে ভবিষ্যতের মহাবৃত্ত’; সেই প্রত্যাশাই থাকলো আমাদের সকলের

 

 

মইনুল রাজু

জুন ১৯, ২০১০

[email protected]