প্রথম পর্ব এখানে

দ্বিতীয় পর্ব এখানে

‘পাপ’-এর ধারণার যুক্তিটাতেই গলদ আছে। আমাদের শেখানো হয়েছে যে ‘পাপ’ হচ্ছে ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরোধিতা, আবার এটাও বলা হচ্ছে যে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। যদি তিনি তাই হবেন, তবে কিছুই তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে হতে পারে না; তাই যখন পাপী তাঁর আদেশের অবাধ্য হয়, তাঁর ইচ্ছানুসারেই তো তা ঘটলো। সেন্ট অগাস্টিন এ-মতের দৃঢ় সমর্থক, এবং তাঁর মতামত হচ্ছে ঈশ্বর মানুষের মধ্যে যে-অন্ধত্ব পুরে দিয়েছেন, তাতেই তারা পাপ করে। কিন্তু আধুনিক বেশিরভাগ ধর্মতত্ত্ববিশারদেরা বুঝতে পেরেছেন যে, যদি খোদার খায়েশেই মানুষ পাপ করে, তাহলে তাদের অপারগতার জন্যে তাদের জাহান্নামে পাঠানো উচিত হয় না। আমাদের বলা হয় যে, পাপ হচ্ছে ঈশ্বরেচ্ছার বিরোধিতা। তাতেও কিন্তু ধাঁধার উত্তর মেলে না। স্পিনোজার মতো যাঁরা ঈশ্বরের সর্বশক্তিমানত্বের ওপর জোর দেন, তাঁদের হিসেবে পাপ বলে কিছু থাকতেই পারে না। ফলাফল ভয়ঙ্কর। কী! বলে উঠলেন স্পিনোজার সমসাময়িকেরা, নিরো যে তার মা-কে খুন করলো, এটা বুঝি খারাপ না? আদম যে আপেল খেলো, এটা বুঝি অকল্যাণময় নয়? একটা কাজ বুঝি অন্যটার মতোই ভালো? স্পিনোজা হাত-গা মোচড়ালেন, কিন্তু সন্তোষজনক কোন উত্তর দিতে পারলেন না। যদি ঈশ্বরের ইচ্ছায় সব কিছু ঘটে, তবে ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই নিরো তার মা-কে খুন করেছে; তা ঈশ্বর যেহেতু মঙ্গলময়, তাই খুনও নির্ঘাৎ ভালো কাজ। এই যুক্তির হাত থেকে রেহাই নাই।

অন্যদিকে, যাঁরা আন্তরিকভাবে ভাবেন যে পাপ হচ্ছে ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরোধিতা তাঁদের একথা বলতেই হবে যে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান নন। এতেই সব যৌক্তিক ধাঁধা থেকে মুক্তি ঘটে, এবং এটাই অনেক উদারপন্থী ধর্মতত্ত্ববিদদের দৃষ্টিভঙ্গি। এটারও অবশ্য কিছু ঝামেলা আছেই। কিভাবে জানবো যে ঈশ্বরের ইচ্ছে আসলেই কোনটা? যদি শয়তানি শক্তির কিছুটা তাগদ থাকে, তাহলে তারা তাদের বানানো শাস্ত্রগ্রন্থ ধোঁকা দিয়ে আমাদের কাছে চালিয়ে দেবে। এই মতে বিশ্বাসী ছিলেন জ্ঞেয়বাদীরা (Gnostics), যাঁরা ভাবতেন ওল্ড টেস্টামেন্ট মূলত শয়তানি রুহের কারসাজি।

নিজেদের যুক্তিবোধ বাদ দিয়ে যদি কর্তৃপক্ষের ওপর ভরসা করে খুশি থাকতে চাই, তাহলে সমস্যার আর অন্ত নেই। কার কথা মানি? ওল্ড টেস্টামেন্ট? নিউ টেস্টামেন্ট? কোরান? বস্তুত, জনগণ যে-সম্প্রদায়ে জন্ম নেয়, সেই সম্প্রদায়ের গৃহীত গ্রন্থই তারা পবিত্র হিসেবে মানে, আর সেই বই থেকেই তারা অপছন্দের অংশগুলো বাদসাদ দিয়ে পছন্দের অংশগুলোই বেছে নেয়। একটা সময়ে বাইবেলের সবচে’ প্রভাবশালী অংশ ছিলো এটা: “কোনো ডাকিনীকে নির্যাতন করিয়া মৃত্যুমুখে প্রেরণ না করিয়া ছাড়িও না“। আজকাল লোকজন লাইনটা বাদ দিয়ে যায়, সম্ভব হলে নিঃশব্দে, সম্ভব না হলে ক্ষমা চেয়ে। আর তাই, আমাদের যদি পবিত্র কোন গ্রন্থ থাকেও, নিজেদের পছন্দের সাথে খাপ খায়, শুধু এমন অংশটাই বেছে নিই আমরা। উদাহরণ: কোন ক্যাথলিকই শাস্ত্রের সেই লাইনটা এখন আর গুরুত্বের সাথে নেন না যেটা বলছে কোন বিশপের মাত্র একজন স্ত্রী-ই থাকবে।

মানুষের ইমানের নানান কারণ থাকে। একটা হচ্ছে, বিশ্বাসের স্বপক্ষে কিছুটা হলেও প্রমাণ থাকবে। এটা আমরা কাজে লাগাই তথ্যগত সত্যের বেলায়, যেমন: “অমুকের টেলিফোন নম্বরটা কত?” কিংবা, “বিশ্বকাপ কে জিতলো?” কিন্তু যখনই ব্যাপারটা আরো বিতর্কমূলক কিছুতে এসে ঠেকে, সেখানে বিশ্বাসের পেছনের কারণগুলো মোটেও যুক্তিসহ থাকে না। আমরা প্রথমত এবং প্রধানত সেসব ব্যাপারগুলোই বিশ্বাস করি যেগুলো আমাদের নিজেদের চমৎকার মানুষ হিসেবে ভাবতে সাহায্য করে। যদি জনাব আদমির হজমশক্তি হয় দারুণ আর টাকা-পয়সা কামান ভালোই, নিজের মনে তিনি ভাবেন তাঁর প্রতিবেশী অমুক চন্দ্র তমুকের চাইতে তিনি অনেক বুঝদার, ও ব্যাটার বউটার কেমন উড়ুউড়ু ভাব আর ও টাকাপয়সার ক্ষতিতে পড়ে প্রায়ই। তিনি ভাবেন পঞ্চাশ মাইল দূরের শহরটার চাইতে তাঁর নিজের শহরটা কত ফাটাফাটি: এটার চেম্বার অব কমার্সটা অনেক বিরাট আর রোটারি ক্লাবটা বিনোদনের কত ব্যবস্থা করে, আর এখানকার মেয়র জেলের ভাত খান নি কখনো। তিনি ভাবেন তাঁর নিজের দেশটা কী অমেয়ভাবে অন্য সব দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। যদি ইংরেজ হন, ভাবেন শেক্সপিয়র আর মিল্টনের কথা, কিংবা নিউটন আর ডারউইনের ব্যাপারে, বা নেলসন আর ওয়েলিংটন সম্পর্কে, যাঁর যেমনটা রুচি। যদি হন ফরাসি, তবে নিজেকে অভিনন্দন জানান এই বলে যে, কয়েক শতাব্দী ধরে ফ্রান্স পৃথিবীর নেতৃত্ব দিয়ে আসছে সংস্কৃতি, ফ্যাশন আর রন্ধনবিদ্যায়। রাশিয়ান হলে ভাবেন পৃথিবীর একমাত্র জাতির তিনি অন্তর্গত যারা প্রকৃত অর্থেই আন্তর্জাতিক। যুগোস্লাভ হলে গর্ব করেন নিজের জাতির শুয়োরগুলো নিয়ে; যদি প্রিন্সিপ্যালিটি অব মোনাকোর বাসিন্দা হন, বুক ফুলিয়ে রাখেন দুনিয়াকে জুয়োখেলায় নেতৃত্ব দেওয়ার দাবি নিয়ে।

কিন্তু যে-ব্যাপারগুলোয় নিজেকে তিনি অভিনন্দন জানান এগুলোই যে শুধু তার মধ্যে আছে এমন নয়। তিনি কি হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির একজন সদস্য নন? অন্য সব প্রাণীদের মধ্যে শুধু তাঁরই আছে এক অমর আত্মা, এবং তিনি যুক্তিবানও বটে; ভালো আর মন্দের ভেতরকার পার্থক্য জানেন তিনি, আর নামতাটাও তাঁর শেখা আছে। সদাপ্রভু কি তাঁকে তাঁর নিজের আদলে তৈরি করেন নি? আর সব কিছুই কি মানুষের সুবিধের জন্যেই সৃজিত হয় নি? সূর্য বানানো হয়েছে দিবাভাগ আলোকিত করতে, আর চাঁদের সৃষ্টি রাতে আলো দেওয়ার জন্যে-যদিও একটু খেয়াল করলেই চোখে পড়ে যে রাতের মাত্র অর্ধেকটা জুড়েই চাঁদ আলো দেয়। পৃথিবীর গাছের ফল সবই তো মানুষের খাওয়ার জন্যে। কিছু ধর্মতত্ত্ববিদদের মতে, এমনকি খরগোশের সাদা ল্যাজেরও কিছু উপযোগিতা আছে, এই ধরুন ওটা থাকলে শিকারিদের ওদের গুলি করে মারতে বেশ সুবিধে হয়। কিছুটা অসুবিধেও অবশ্য আছে: সিংহ আর বাঘগুলো বড্ড হিংস্র, গরমকালটা বেশিই গরম, আর শীতটা বেরহম ঠাণ্ডা। কিন্তু, সব তো শুরু হলো আদমের আপেলটা খাওয়ার পরপরই; এর আগে জানোয়ারগুলো সব ছিলো শাকাহারী, আর সর্বকালীন ঋতু ছিলো বসন্ত। যদি, আহা, আদম খুশি থাকতো পিচ আর নেক্টারিন, আঙুর আর নাশপাতি আর আনারস খেয়ে, ওই আশীর্বাদ এখনো আমাদের জন্যে বর্তমান থাকতো।

ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক আত্ম-গুরুত্বারোপই আমাদের বেশিরভাগ ধর্মীয় বিশ্বাসের উৎসভূমি। এমনকি পাপও আত্ম-গুরুত্বারোপ থেকে উদ্ভূত ধারণা। বোরো জানিয়েছেন এক ওয়েলশ যাজকের সাথে তাঁর একদা পরিচয় ঘটে যিনি সর্বদাই মন-খারাপ করে থাকতেন। সহৃদয় প্রশ্নের মাধ্যমে তিনি তাঁর দুঃখের কারণ খুলে বলেন: ঘটনা হচ্ছে সাত বছর বয়েসেই তিনি পবিত্র আত্মার প্রতি এক পাপকর্ম করে বসেন। বোরো বলেন: “হে প্রিয় বন্ধু, ওসব নিয়ে ভেবে নিজেকে কষ্ট দেবেন না। এরকম কাহিনি আমার আরো ডজনখানেক লোকের ব্যাপারে জানা আছে। ভাববেন না এই ঘটনায় আপনি বাকি মনুষ্যসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন; খোঁজ নিলে জানবেন, অনেকেই একই দুর্ঘটনায় নিপতিত।” সেই মুহূর্ত থেকেই ভদ্রলোকের রোগমুক্তি ঘটে। নিজেকে অনন্য ভেবেই তিনি পুলক অনুভব করছিলেন, কিন্তু একদঙ্গল পাপীর মধ্যে নিজেকে ফেলার মাঝে কোন আনন্দ নেই। বেশিরভাগ পাপীই বেশ আত্মকেন্দ্রিক; কিন্তু ধর্মতত্ত্ববিদেরা নিঃসন্দেহে এই অনুভূতি উপভোগ করেন যে, মানবজাতিই ঈশ্বরের ক্রোধের এবং তাঁর ভালোবাসারও বিশেষ লক্ষ্যবস্তু।

স্বর্গ থেকে পতনের পরে
-মিল্টন আমাদের আশ্বস্ত করেন যে,

সেসময় থেকেই সূর্য ঘোরে, দেয় আলো,
পৃথিবীতে নেমে আসে শৈত্য আর তাপ অসহন,
আর উত্তর থেকে আসে ধেয়ে জরাজীর্ণ হিমেল ঋতু,
আসে দক্ষিণ থেকে সৌরায়নে গ্রীষ্মের খরতাপ।

ফলাফল যতোই খারাপ হোক, আদমের গর্বিত না হওয়ার কোন উপায় নেই কারণ এই বিশাল মহাজাগতিক কাণ্ডকারখানা স্রেফ তাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যেই করা। ধর্মতত্ত্বের মর্মবাণী বেহেশত বা জাহান্নামের দুটোর ব্যাপারেই নির্দ্বিধায় ধরে নেয় যে, সৃষ্ট প্রাণীকুলের মধ্যে মানুষই হচ্ছে এই মহাবিশ্বের সবসেরা। যেহেতু, ধর্মতত্ত্ববিদেরা সবাই মানুষ, এই স্বতঃসিদ্ধের কোন বিরোধিতা পাওয়া যায় নি।
যেহেতু বিবর্তন এখন হয়েছে ফ্যাশনেবল, মানুষকে মহিমান্বিত করার ব্যাপারটা নিয়েছে নতুন রূপ। আমাদের এখন শোনানো হয় যে বিবর্তন একটি মাত্র মহান ধারণার দিকে লক্ষ্যবদ্ধ ছিল: অযুত নিযুত বছর ধরে যখন স্রেফ কাদা বা ট্রাইলোবাইট ছিলো তখন থেকে, ডাইনোসর আর বিশাল ফার্ন, মৌমাছি আর বুনো ফুলের সেই যুগ থেকে, ঈশ্বর মঞ্চ তৈরি করছিলেন সেই বিশাল চূড়ান্ত নাটকীয় পরিণতির জন্যে। শেষমেষ, সময় হলো যখন, তিনি বানালেন মানব যাদের মধ্যে নিরো আর ক্যালিগুলা, হিটলার আর মুসোলিনির মতো নমুনাও এলো যাদের উজ্জ্বল মহত্ত্ব দীর্ঘ বেদনাময় অপেক্ষার পালার যৌক্তিকতা তুলে ধরে। আমার কথা শুনতে চাইলে বলবো সর্বশক্তিমানের চরম কর্ম হিসেবে আমাদের কাছে যেটা শ্রদ্ধেয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয় তার চাইতে আমি বরং অনন্ত ধ্বংসকেই কম অবিশ্বাস্য, এবং অবশ্যই কম হাস্যকর হিসেবে দেখি। আর ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমানই হন, কেন এতো লম্বা আর ক্লান্তিকর সূচনা ছাড়া এই উন্নত ফলাফলটায় তিনি পৌঁছাতে পারলেন না?

বিবর্তনের ধর্মতত্ত্ববিদেরা যেমনটা বলেন মানবজাতি ঠিক সেরকম মহান কি না, তার চাইতেও বড় ঝামেলা হচ্ছে এই গ্রহে প্রাণ আসলে মোটামুটি নিশ্চিতভাবে সাময়িক। পৃথিবী ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, কিংবা ক্রমান্বয়ে উবে যাবে আবহমণ্ডল, অথবা দেখা যাবে পানির অপর্যাপ্ততা, বা, স্যার জেমস জিন্স যেমন জ্ঞানময় ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, সূর্য বিস্ফোরিত হবে আর সব গ্রহগুলোই পরিণত হবে গ্যাসে। কোনটা যে আগে ঘটবে, কেউ ঠিক করে জানে না; তবে কারণ যাই হোক মানবজাতি ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাবে মৃত্যুর দিকে। গোঁড়া ধর্মতত্ত্ব অবশ্য এসবে তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না, কারণ মানুষ হচ্ছে অমর, আর দুনিয়ায় না থাকলেও বেহেশত বা জাহান্নাম কোথাও না কোথাও তারা থাকছেই। তাই যদি হয় তাহলে দুনিয়ার উন্নতির জন্যে আর মাথা ঘামানো কেন? যারা আদিম কাদাটে অবস্থা থেকে মানুষে উন্নীত হওয়ার ব্যাপারটায় এতো জোর দেয় তারা আসলে এই একঘেয়ে গোলকটায় বেশি গুরুত্বারোপ করে। তাদের মনে রাখা উচিত যে পৃথিবীতে জীবনটা আসলে স্রেফ ছায়াপথ আর অনন্ত হিমেল অবস্থার মাঝখানের, কিংবা হয়তো এক ছায়াপথ থেকে অন্য ছায়াপথের মাঝখানের ছোট্ট একটা মধ্যান্তর। সৌরজগতের ভবিষ্যৎ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে মানুষের গুরুত্ব, ধর্মতত্ত্ববিদদের অন্যতম অবিচ্ছেদ্য ডগমা, তেমন সমর্থন পায় না।

ভুয়া বিশ্বাসের পেছনে অবশ্য আত্ম-গুরুত্বারোপ ছাড়া অন্য উৎসও আছে। এর মধ্যে একটা হলো অবিশ্বাস্যের প্রতি প্রেম। একটা সময়ে আমি একজন বিজ্ঞানমনস্ক জাদুকরকে চিনতাম, যে একটা ছোট দর্শকমণ্ডলীর সামনে জাদু দেখাতো, আর প্রতিবার জাদু দেখানোর আগে সবাইকে আলাদা করে বলতো তারা কী দেখছে, সেটা যেন তারা লিখে রাখে। প্রায় সবসময় তারা আসল জাদুর বিবরণের চাইতে আরো দুর্দান্ত কিছু লিখতো, এবং সাধারণত এমন কিছু লিখতো যা কোন জাদুকরের পক্ষে কোনদিন অর্জন করা সম্ভব নয়; আর তারপরেও তারা ভাবতো নিজের চোখে যা দেখেছে, তাই তারা লিখছে। এই ধরনের ভ্রান্তিকরণ গুজবের চাইতেও বেশি সত্যি। ক, খ-কে বললো গত রাতে জনাব অমুক, বিখ্যাত মদ্যপানবিরোধী-কে সুরার গুণে কিঞ্চিৎ টালমাটাল অবস্থায় দেখেছে সে, খ, গ-কে জানালো যে ক ঐ ভালোমানুষটাকে দ্রব্যগুণে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় দেখেছে, গ, ঘ-কে বললো যে তাঁকে অজ্ঞান অবস্থায় নালা থেকে তোলা হয়েছে, ঘ জানালো ঙ-কে যে তিনি তো প্রতি প্রতি সন্ধ্যাতেই এমনি করে বাইরে বেড়ানোর জন্যে বিখ্যাত। এখানে অবশ্য, সত্যি কথা বলতে, আরেকটা উদ্দেশ্য দেখা দিলো, বিদ্বেষ। আমাদের প্রতিবেশীদের ব্যাপারে খারাপ কথাবার্তা ভাবতে আমাদের ভালো লাগে, আর তাদের নিয়ে সামান্যতম খারাপ প্রমাণ পেলেই সবচাইতে খারাপটা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে বসি। কিন্তু এরকম কোন উদ্দেশ্য না থাকলেও, অবিশ্বাস্য ব্যাপারগুলো খুব বেশি প্রেজুডিস না থাকলে ঠিকই মেনে নেওয়া হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত ইতিহাসের পুরোটাই প্রতিভা আর বিস্ময়ে ভর্তি, যা আধুনিক ঐতিহাসিকেরা প্রায়ই উপেক্ষা করে যান, এজন্যে নয় যে ঐতিহাসিকদের পছন্দের বিষয় সত্যের সাথে সেগুলোর সংলগ্নতা কম, বরং কারণটা হচ্ছে শিক্ষিতদের মধ্যে আধুনিক রুচি অনুসারে বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করা ছাড়া কোন কিছু মেনে নেওয়ার প্রশ্ন দূরেই সরে যাচ্ছে। সিজার মারা যাওয়ার আগের রাতের ঘটনা নিয়ে শেক্সপিয়ার আমাদের জানাচ্ছেন,

সাধারণ এক দাস, তাকে চেনো তুমি ভালোই
তুলে ধরেছে তার বাঁ হাত, জ্বলছে ওটা একাই একত্রে বিশটা মশালের মতো;
অথচ তার হাত টের পাচ্ছে না সে তাপ, আগুনে অস্পৃষ্ট।
এছাড়া-আমি তখনো তলোয়ার রাখি নি সাথে-ক্যাপিটোলের কাছে দেখা পেলাম এক সিংহের, সে তাকালো আমার দিকে, আর কিছু না বলেই চলে গেল আমার পাশ দিয়ে;
এবার উদয় হলো প্রায় শ’খানেক ভয়ঙ্করদর্শন নারী.
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তারা জানায় রাস্তায় তারা আগুনে আগাগোড়া জ্বলতে-থাকা মানুষদের হেঁটে যেতে দেখেছে।
(অনুবাদে শেক্সপিয়রের ইয়ে মেরে দেওয়ার জন্যে মাপ চাই)
শেক্সপিয়র এসব কেরামতি আবিষ্কার করেন নি; এগুলোর বিবরণ পেয়েছেন তিনি খ্যাতিমান ঐতিহাসিকদের লেখায়, তাঁদের মধ্যে তাঁরাও আছেন যাদের ওপর আমরা জুলিয়াস সিজার সম্পর্কিত সব তথ্যের জন্যে ঋণী। বিরাট কোন লোকের মৃত্যুতে বা বিশাল কোন রাষ্ট্রবিপ্লবের শুরুতে এসব ব্যাপার অহরহ ঘটে। এইতো কিছুদিন আগে ১৯১৪ সালে ‘এঞ্জেলস অব মন্স’-এর দর্শনে পুলকিত হয়ে উঠেছিলো ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। এধরনের অভিজ্ঞতাগুলো প্রায়ই আপনি শুনবেন অন্যের মারফত আর আধুনিক ঐতিহাসিকেরা এসব খারিজ করে দেন, বিশেষত, যেখানে ধর্মীয় গুরুত্বের ব্যাপারস্যাপার আছে।
প্রতিটা শক্তিময় আবেগেরই কিংবদন্তী তৈরির নিজস্ব প্রবণতা আছে। যখন আবেগটা ব্যক্তিগত থাকে, তখন যে-লোক এসব নিজে তৈরি করে নিজেই কিংবদন্তীগুলো বিশ্বাস করে, তাকে কমবেশি পাগলের দলে ফেলা হয়। কিন্তু, আবেগ যখন সামষ্টিক, যেমন যুদ্ধের সময়, তখন স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়া এসব মিথগুলো ঠিক করার আর কেউ থাকে না। এমনিভাবে সবসময়ই যূথবদ্ধ তীব্র উত্তেজনার দিনে ভিত্তিহীন গুজব বিশ্বাস করার প্রচুর লোক মেলে। ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইংল্যান্ডে প্রায় সবাই বিশ্বাস করতো যে পশ্চিমা ফ্রন্টে যাওয়ার পথে রুশি সেনাবাহিনী ইংল্যান্ড অতিক্রম করে গেছে। সবাই এমন কাউকে না কাউকে জানতো যে তাদের দেখেছে, কিন্তু এমন কাউকে পাওয়া যেতো না যে নিজেই ভঞ্জন করেছে চক্ষুকর্ণের বিবাদ।

(চলমান)