জন্মদিনের উপহার

“২১-শে ফেব্রুয়ারী জন্মগ্রহণকারী সকল শিশুকে গল্পটি উৎসর্গ করা হল”

সবদার সাহেব আজ এই সাতসকালে মেয়েকে নিয়ে বের হয়েছেন। অবসর পেলেই তিনি মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন – রিকশায় চড়ে ঢাকা শহরের বন্ধ্যা বাতাসে গল্পের ফুলঝুরি মিশিয়ে দেন দু’জনে। গল্পের বিষয়বস্তুর অভাব হয়না তাদের; কখনো মাথার উপর উড়তে থাকা বিচ্ছিন্ন কাক, কখনো রাস্তার অসহায় ছেলেটা, কখনোবা যানবাহনের এক একটি চাকা, আরো কত কি! বাপ-মেয়ের এই আলাপচারিতায় মগ্ন থাকা, মান অভিমান যেন নব্য প্রেমিক-প্রেমিকাদের সখ্যতাকেও হার মানায়। সেলিনা আক্তার, সবদার সাহেবের স্ত্রী, তো প্রায় বলেন- “বাপ-মেয়ের সংসারে আমার অবস্থান অনাবশ্যক হয়ে উঠেছে; কাজের মেয়েরও তো একটা কদর থাকে পাছে চলে যায় এই ভয়ে। আমার অবস্থান যে পাকাপক্ক দুষ্টু চক্রের জানতে তা আর বাকি নেই।”

তবে আজকে, এই সাতসকালে তাদের বের হওয়ার উদ্দেশ্য ছিল একেবারে ভিন্ন – সবদার সাহেব তার মেয়ে সূচিকে স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেলিনা আক্তার গত বছরেই ভর্তি করাতে চেয়েছিলেন। বাপ-মেয়ে বেশ পরিকল্পনা করেই তা এক বছর পিছিয়ে নিলেন। রিক্শা বাক্ নিয়ে হাই রোডে উঠতেই ট্রাফিক পুলিশ হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলেন। সূচি তা দেখে বলল -“বাবা তুমি ট্রাফিক হলে না কেন? তুমি ইচ্ছে মত সব গাড়ী থামিয়ে দিতে পারতে আবার ইচ্ছে মত চলতে দিতে? আমার বড় বড় গাড়ী দেখলে খুব ভয় করে, তুমি ঢাকার সব বড় বড় গাড়ী থামিয়ে রাখতে!”
মেয়ের কথা শুনে সবদার সাহেব এমন ভান করলেন যেন ট্রাফিক পুলিশ না হয়ে বড় ভুল করে ফেলেছেন। অপরদিক থেকে ধেঁয়ে আসা মিছিলটি তাদের অতিক্রম করতে থাকে। সবাই শ্লোগান দিচ্ছে-
জিন্নার ঘোষনা… মানিনা… মানবো না….
উর্দু’কে রাষ্ট্র ভাষা .. মানি না… মানবো না ….

প্লাকার্ডে লেখা : রাষ্ট্রভাষা মায়ের ভাষা
বাংলা চাই বাংলা চাই

সূচি বাবার কানে কানে বলল – “এরা খুব দুষ্টু মানুষ; তাই না বাবা?”
“না মা, এরা খুব ভালো মানুষ।”- সবদার সাহেব বললেন।
বাবার সায় না দেওয়াতে সূচি অভিমানের সুরে বলে – “কিন্তু মা যে বলেন যারা মিছিল করে তারা খুব খারাপ মানুষ।” বাবার বলা কথাটি মার নামে চালিয়ে বেশ স্বসি- পায় সে, তার বিশ্বাস মা খুব কমই জানে।
“তোমার মা ঠিকই বলে,”- সবদার সাহেব বলেন, “কিন্তু এরা সবাই আমাদের ভাষার জন্য মিছিল করছে। আমি এবং তুমি যে ভাষায় কথা বলছি সেই বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে এরা মিছিল করছে।”
“আমরা তো বাংলাতেই কথা বলি বাবা! এর জন্য মিছিল করার কি আছে?” সূচির চোখে মুখে বিম্ময়ের ছাপ।
“কিন’ মামনি ওরা চাই না আমরা বাংলাতে কথা বলি।” – সবদার সাহেব বললেন।
“ওরা কারা বাবা?”
“ওরা পাকিস্তানের মানুষ। ওরা চাই আমরা সবাই ওদের উর্দু ভাষাতেই কথা বলি?”
“ওরা খুব দুষ্টু তাই না বাবা! পাকিস্তান কোথায় বাবা? ”
“অনেক দূরে মা।”
“নিলু ভাইদের ৭ তলার ওপরে উঠিয়ে আমাকে একদিন দেখাবে ?” সূচি যেন বায়না ধরে বসে।
“ওখান থেকেও দেখা যায় না মামনি। সাত-সাগর-তের-নদী পার হয়ে ওখানে যেতে হয়। ওদের ওখানকার সূর্যও আমাদের এখান থেকে দেখা যায় না!”
“ওরা এতো দূরে থাকে তো আমরা ওদের ভাষায় কথা বলবো কেনো?” সূচির প্রশ্ন যেন শেষ হতে চায়না।
“বলব না মামনি- এজন্যই তো সকলে মিছিল করছে।”
“আচ্ছা বাবা, সবাইকে কি তাদের ভাষার জন্য এমন মিছিল করতে হয়?”
“না মা কাউকেই করতে হয় না, পৃথিবীর সবাই যে যার ভাষাতেই কথা বলে, এজন্য কাউকে মিছিল করতে হয় না। ”
“তাহলে আমরা মিছিল করবো কেনো?”
“মিছিল, প্রতিবাদ না করলে যে ওরা আমাদের ভাষা কেড়ে নিয়ে উর্দু ভাষাতে কথা বলতে বাধ্য করবে। ওরা যে অনেক শক্তিশালী মা!”
বাবার কথায় অনেকক্ষণ নিরব থাকে সূচি তারপর হঠাৎ করে বলে ওঠে -“ আচ্ছা বাবা বনের রাজা সিংহ তো সবচেয়ে শক্তিশালী। তাহলে কি সিংহ বনের সব পশুকেই তার ভাষাতেই কথা বলায়?”
সবদার সাহেব মেয়ের প্রশ্ন শুনে একটু নড়েচড়ে বসেন। তিনি বলেন -“না মা সব পশু পাখিরাই তাদের নিজ ভাষাতেই কথা বলে; আমরাও বলব। কেউ আমাদের ভাষাকে কেড়ে নিতে পারবে না।” মেয়ের সাথে সাথে নিজেকেও আস্বস্থ করেন তিনি। সূচি আর কোন কথা খুঁজে পায়না। ইতিমধ্যে রিক্শা বাড়ীর কাছে পৌঁছে যায়। বাপ মেয়ে পরস্পরের হাত ধরে বাড়ীতে প্রবেশ করে।

দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে সবদার সাহেব বের হয়েছেন। ঢাকার অবস্থা ভালো না। দফায় দফায় মিছিল হচ্ছে। মিছিলে লাঠি চার্জ করা হচ্ছে নৃশংস ভাবে। তবু বাঙালিরা দমবার পাত্র না। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা না দিয়ে ক্ষান্ত হবে না কেউই।
সেলিনা আক্তার রবীন্দ্র রচনাবলী হাতে করে বসে আছেন। প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় তিনি কাজ কর্ম সেরে বই পড়তে বসেন। এটা তার অনেক পুরানো অভ্যাস। নজরুল, শরৎ, বিভূতিভূষণ, রোকেয়া… যখন হাতের কাছে যাঁর বই পান তাঁর বই নিয়েই বসে পড়েন। কদিন ধরে রবীন্দ্রনাথ পড়ছেন তিনি। আজ কিছুতেই মন বসছে না পড়াতে। দূরের পোস্টারে লেখা- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ লেখাটি যেন রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি পাতার সাথে সেঁটে গেছে।
বেশ রাত করেই আজ সবদার সাহেব বাড়ি ফেরেন। হাত মুখ ধুয়ে তিনি স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে খেতে বসেন। সূচি অদ্ভুত ভঙ্গিমায় ডেকে ওঠে- “ভোলা আর ভুলু খেতে এসো।”
অমনি বাড়ীর পোষা কুকুর আর বিড়ালটি খাবার টেবিলের পাশে এসে বসে পড়ে। সেলিনা আক্তার পৃথক পৃথক পাত্রে ওদেরকেও খেতে দেন। খাবারের মাঝখানে সূচি বলে উঠে, “আচ্ছা বাবা ওরা যদি আমাদের ভাষাকে কেড়ে নেয় তাহলে ভোলা-ভুলু কি করবে? ওরা তো বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষা বোঝেই না!”
সবদার সাহেব কিছু বলতে যান। সেলিনা আক্তার ধমকের সুরে বলে ওঠে – “খাওয়ার সময় একদম কথা বলবে না। বাবাও হয়েছে তেমন! সংসারে মন নেই। সারাদিন মেয়ের সাথে বকর বকর। কাল যে ২১-শে ফেব্রুয়ারী মনে আছে?”

“ওহো ভুলেই গিয়েছিলাম। কাল আমার একমাত্র সূচি মামনির জন্মদিন”- বলে সবদার সাহেব এঁটো হাত দিয়ে সেলিনা আক্তারের গাল টিপে দেয়। সেলিনা আক্তার ভালোলাগা ও বিরক্তির মিশ্র প্রতিক্রিয়া করে বলেন-“জন্মদিন আমার না তোমার মেয়ের!” সঙ্গে সঙ্গে তিনজনই খাবার টেবিলের নিয়ম ভঙ্গ করে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।
খাওয়া দাওয়া সেরে সবদার সাহেব প্রতিদিনকার মত কলেজের খাতা ও টুকটাক কাজ নিয়ে বসে পড়েন। কিন্তু কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারেন না তিনি। কাল তার মেয়ের জন্মদিন। জন্মদিনের সর্বোত্তম উপহার কি হতে পারে সেই ভাবনায় মন অসি’র হয়ে ওঠে তার। মা মেয়ে এতক্ষণে ঘুমিয়ে যাবার কথা। সবদার সাহেব সবকিছু গোছ-গাছ করে ঘুমাতে যান; যা তিনি কোনদিনই করেন না এবং খুব ভোরে সেলিনা আক্তারের এই কারণে বকাবকিতে তার ঘুম ভাঙ্গে। সবদার সাহেব মা এবং মেয়ের পাশে আসে- করে শুয়ে পড়েন। ১২ টা বাজতে তখনও ১০ মিনিট বাকী। সূচি বাবার হাতে মাথা উঠিয়ে দেয়। মেয়েটি যে এখনো ঘুমায়নি বুঝতে পারেন সবদার সাহেব।
“এখনো ঘুমাওনি কেন মামনি?” মেয়েকে আরও কাছে টেনে জিজ্ঞেস করেন তিনি।
“ঘুম আসছে না। আচ্ছা বাবা, ওরা কি আর আমাকে বাবা ডাকতে দেবে না? তুমি কি আমাকে আর মা বলবেনা?”
সবদার সাহেবের চোখে জল চলে আসে। সূচি যেদিন জন্মেছিল সে দিন তার চোখে জল এসেছিল, আজ দীর্ঘ ৭ বছর পর তার পুনরাবৃত্তি ঘটল। ঘড়ির কাটা ঢং ঢং করে জানান দিল তার পূর্ণতার কথা। সবদার সাহেব মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন -“ না মামনি ওরা যত শক্তিশালীই হোক না কেন আমি তোমাকে মা বলেই ডাকবো। মাথা তুলে দেখলেন সেলিনা আক্তারের চোখেও পানি ছল ছল করছে। তিনি সেলিনা আক্তারের মাথায় আলতো করে চুমু খেয়ে বললেন-“আর তোমাকে আমি আমার ভাঙ্গা ঘরের রাজরানী বলেই ডাকবো।”
পরদিন, ২১ শে ফেব্রুয়ারী। সবদার সাহেব সকালের নাস্তা সেরে মেয়ের জন্য উপহার কেনার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন; আজ আর মেয়েকে সঙ্গে নিলেন না; উপহারটা সম্পূর্ণ Surprise রাখবেন তিনি।

মা মেয়ে জন্মদিনের কেক নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। সূচি প্রতিবার রিক্শার শব্দ শুনে ছুটে যায় জানালায়- বাবা এলো বুঝি, কিন্তু প্রতিবারের মত সেবারও হতাশ হয়ে ফিরে এসে মাকে বলে -“মা, বাবা তো এখনো আসে না!”
এভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকাল যায়। এ্রতক্ষণে সেলিনা আক্তারের মনে হাজার রকমের দুশ্চিন্তা এসে আবাস গড়ে। এদিকে ঢাকার অবস্থাও ভালো না। ১১ দফা ভঙ্গ করে দেশবাসী ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানে আকাশ বাতাস ভারী করে তুলেছে। বিকেল ৪টার সময় খবর আসে- মিছিলে গুলি করা হয়েছে, সফিক, রফিক, সালাম, বরকত’সহ মারা পড়েছেন আরো অনেকে। সেলিনা আক্তার সূচিকে নিয়ে ছুটে যান সেখানে; লাশ ততক্ষণে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তিনি সংশয় ও সুপ্ত আশার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ফিরে আসেন। সেদিন আর সবদার সাহেব ফিরে আসেন না।
সেলিনা আক্তার ও সূচি অপেক্ষা করতে থাকে…। অপেক্ষা করতে থাকে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সেলিনা আক্তার তার স্বামীর অপেক্ষায় ছিলেন।
সূচির ভালো লাগে ভেবে – জন্মদিনে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান উপহারটি তাকে তার বাবা দিয়ে গিয়েছেন-তা হল ‘বাংলা’। ‘বাংলা’ নিয়েই বেঁচে থাকে সূচি; বাবার স্পর্শ, মমতা সব কিছুই বাংলার মাঝে খুঁজে পায় সে।

প্রকাশ: ধমনি ২০০৯ ফেব্রুয়ারি
প্রাঙ্গণ ২০১০ ফেব্রুয়ারি