ডায়রীর পাতা থেকে–

১৩/৩,
রাত ২-৪৭ মি.। ফেব্রুয়ারীতে মাকে চিকিৎসার জন্য ভারতে নেওয়া হল; মার অবস্থা তখন অবনতির পথে, সামনে আমার এস. এস. সি. পরীক্ষা – নিজেকে ভুলিয়ে রাখার একটা ভালো উপলক্ষ পেয়েছিলাম। সকালে মাকে মেহেরপুর ভারতের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি তখন মামুন ভাইয়ের কাছে পড়তাম; সেদিন পড়া শেষ না করেই চলে আসলাম। আমি মার পাশের সিটে সহযাত্রীর মত বসে ছিলাম – অনেক্ষণ। আমি খুব বেশি কথা বলার সুযোগ পাইনি, মা খুব টেনশনে ছিলেন। মার চোখে সেই প্রথম বারের মতন অনুভব করলাম বেঁচে থাকার ভয়ংকর আকুতি। আমি যখন গাড়ি থেকে নেমে আসলাম মা চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন – ভয় নেই, আমার কিছুই হবে না। আমার ভয় উবে গেল নিমেসেই। বাস ছেড়ে দিল – আমি পিছন পিছন সাইকেল চালিয়ে অনেকদূর গিয়েছিলাম।

বেশ কিছুদিন পর মা ভারত থেকে ফিরে আসলেন। ১লা এপ্রিল রাতে ডায়েরীতে লিখে রাখি- এ মাসেই আমার জীবনের খুব মূল্যবান কিছু একটা হারাতে যাচ্ছি, জানি না সেটা কি। এপ্রিল মাসের প্রাতটা দিন মার খুব কষ্টে গত হয়েছে – বিশেষ করে রাত। প্রতিদিন শেষ রাত অব্দি তল পেটের তীব্র ব্যাঁথায় প্রচন্ড-বিভৎস ভাবে চিৎকার করতেন। আমি এখনো অন্ধকারে কান পাতলে সেই ভয়ংকর শব্দ শুনতে পাই। আমি তখন থাকতাম ওপরের ঘরে; মা যতক্ষণ যন্ত্রনায় কাতরাতো আমি ততক্ষণ বারান্দায় বসে থাকতাম – নিশ্চুপ, বৃক্ষের মতন মৃতের ভান করে, পাশের ঘরে খালিদ (আমার ছোট ভাই) ঘুমানোর ভান করে পড়ে থাকতো। এত কষ্টের মাঝেও সৃষ্টিকর্তার ওপর এত বিশ্বাস আর আস্থা দেখে আমি আশ্চর্য না হয়ে পারতাম না। ব্যঁথা যত তীব্র হত মা বলত – আল্লাহ তুমি আমাকে দুনিয়াতে যত ইচ্ছা কষ্ট দাও তবু আমাকে গোরের আজাব থেকে মুক্তি দিয়ো । আমি দুনিয়ার কষ্ট সহ্য করতে পারবো কবরের আজাব পারব না। শারিরীক-মানুষিক কোন কষ্টই মানুষটাকে জয় করতে পারেনি; কোথায় থেকে যেন সৃষ্টিকর্তার ভুত এসে…! মাঝে মাঝে হারিকেনে কাপড় সেকে মার তলপেটে সেঁকে দিতাম – একটু শান্তি পেতেন, বোধহয়। একদিন প্রায় ভোর রাত অব্দি আমি আর বাবা মার পেট সেঁকে দিয়েছিলাম – এর বেশি কিছু করার সুযোগ আমি আর পাইনি, খুব সম্ভবত বাবাও।

এক সন্ধ্যায়, মা আমাকে আর খালিদকে ডেকে বললেন – আমি না থাকলে তোরা কি করবি’রে ! আমি ধমকের সুরে বলেছিলাম – কি সব আবোল-তাবোল বকো ! তুমি না থাকলে – তোমার সাথে সাথে আমরাও যাবো। আমার উত্তর শুনে হেসেছিলেন; বলেছিলেন – আমি মারা গেলে তোরা আমার পাশে কাদবিনা, আমি সহ্য করতে পারবো না। এ কথাগুলো হওয়ার কিছুদিন পর (২৫ তারিখে) মা আমাকে তার ড্রয়ারের চাবি দিয়ে বললেন – নে ড্রয়ারের চাবি টা রাখ্; কিছু টাকা আছে, তোর আব্বাকে জানাবিনা । কোন বোনের কাছে রেখে দিবি আর টুকটাক হাত খরচ লাগলে চেয়ে নিবি; ওরা নিজের টাকা সবসময় দিতে পারবে না। আর তোর বাবা আবার বিয়ে করতে চাইবে, তোরা কেউ বাধা দিবি না। তোদের কে আমি আল্লাহর কাছে রেখে গেলাম- এর থেকে নিশ্চিন্ত আর কিসেই বা হতে পারি! সেদিন মা যতক্ষণ কথা বললেন আমি আর একটা শব্দও করিনি, করতে পারিনি। শুধু মনে পড়ে রুমে দরজা লাগিয়ে অনেক্ষণ কেঁদেছিলাম সেদিন।

৩/২, রাত ১ টা
মা যেদিন মারা গেলেন –
প্রচন্ড গরমের আবহে কোথায় থেকে যেন থেকে থেকে ঠান্ডা হিমশীতল বাতাস আসছিল। আমাদের দুটো দো-তোলা বাড়ী; দুটো বাড়িই মার গোছানো অর্থ ও সাধনাই বানানো। অথচ মা মারা গেলেন ছোট্ট একটা স্টোর রুমে- যে রুমে আমরা যেতাম না খুব একটা। আমরা ছিলাম ৪ ভাই ৮ বোন; মা যখন শেষ বারের মতন আমাদের দেখতে চাইলেন – আমি এবং আমার দুটো বোন তার পাশে ছিলাম, বাবা ছিলেন রান্না ঘরে। বাবাকে দেখতে চাইলেন ঠিকই কিন্তু ততক্ষণে শেষবারের মতন কলেমা পড়া ও আল্লাহর নাম নেওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমি মার এক হাত শক্ত করে ধরলাম অন্যটি বাবা। মা যখন নিস্তব্ধ-নিথর হয়ে পড়ল – রান্না ঘর থেকে বিড়ালের মিউ মিউ শব্দ গেল থেমে, সানসেটে বসে থাকা পায়রা দুটো ঝটপট উড়ে গেল, বরই গাছের পাখিগুলোর কিচির-মিচির শব্দ থেমে গেল; ক্ষণিকের জন্য যেন পৃথিবীর সবকিছুই থেমে গেল, সহসা আমার বোনদের কান্নাই প্রকৃতি প্রাণ ফিরে পেল; আমি তখনো আশা হারাইনি।

২/৩, রাত ১ টা
আজ খুব করে মনে পড়ে – সেদিন রাতে চন্দ্রগ্রহণ ছিল, আমার জীবনে প্রথম বারের মত চন্দ্রগ্রহণ দেখা। আমি অনেক রাত পর্যন্ত সাদে বসে ছিলাম; মা ঐ মধ্যরাতে দেখতে এসেছিলেন আমি ঠিকমত মশারিটা টাঙিয়েছি কিনা। হঠাৎ করে পিছনে তাকিয়ে দেখি মা দাঁড়িয়ে। আমি মাকে চন্দ্রগ্রহণের অপরুপ দৃশ্যটা দেখাতেই মাও আমার পাশে বসে পড়লেন; তারপর আমরা দুজনেই শেষ রাত অব্দি বসে ছিলাম। মা আমার কাধে হাত রেখে বসে ছিলেন, আমরা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম – আমার জীবনে এই অর্জনের হিসাব কোনদিনই হয়ত আর মেলাতে পারবো না। আমরা বসে ছিলাম অনেক্ষণ, গ্রহণ লাগা চন্দ্র ততক্ষণে বিদায় নিয়েছে: আমরা টের পাইনি কিছুই – তেমন কথাও হয়নি আমাদের।

তারপর আর চন্দ্র গ্রহণ দেখা হয়নি আমাদের – না মার, না আমার। গ্রামের বাড়ী গেলে অনেক রাত অব্দি সাদে উঠে বসে থাকি; মাঝে মাঝে মাও এসে বসেন আমার সাথে; আগের মতই কোন কথা হয়না আমাদের। আমি চাঁদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। মাও থাকেন, তারপর একসময় চাঁদের সাথে মিশে যান। ঘরে ফেরেন মা, ঘরে ফিরি আমি। সবকিছু সেই আগের মতই আছে শুধু দু’জনের বাস এখন দু’ঘরে এছাড়া খুব একটা পরিবর্তন হয়নি আমাদের – না মার, না আমার। যখন আমি শহরে চলে আসি চাঁদের দিকে তাকাতে ভয় পাই – প্রচন্ড পাপের মধ্যে ডুবে থাকা এই আমি সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে চাই না কিছুতেই।

একটা মানুষ কতটা কষ্ট পেতে পারে–
নদী কি বলতে পারে?
কতটা কষ্ট পেলে একটা মানুষ বৃষ্টির মতন গলে পড়ে–
মেঘ কি বলতে পারে?
কতটা কষ্ট পেলে একটা মানুষ পাথর হয়ে যায়–
বিঙ্গান কি বলতে পারে?
কতটা কষ্ট মানুষকে নিথর করে দেয়-
কবিতা কি বলতে পারে?
কতটা কষ্ট পেলে একটা মানুষ বিলীন হয়ে যায় শূন্যে–
আকাশ কি বলতে পারে?
কতটা কষ্ট মানুষকে যিশু করে
মহাকাল কি বলতে পারে?

আর কতটা কষ্ট আমাদের মুক্তি দিতে পারবে–
বৃক্ষ কি বলতে পারে?