হাতে তাদের মারণাস্ত্র,

চোখে অঙ্গীকার

সূর্যকে তারা বন্দী করবে,

এমন অহংকার।

 

 

বাইশে সেপ্টেম্বর, ঊনিশশো একাত্তর সাল।

 

জলদিয়া, চট্টগ্রাম।

 

রাত এগারোটা। চন্দ্রিমাহীন নিকষ কালো অন্ধকার একটি রাত। সাগরতীরে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রয়েছে আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত অল্প বয়েসি চারজন শক্তপোক্ত তরুণ। সবার পরনে সুইমিং কস্টিউম। গামছায় বাঁধা লিমপেট মাইন। ঘামে ভিজে গেছে সবারই দেহ। মুক্তোর মত স্বেদবিন্দুগুলি চিকচিক করছে তাঁদের কপাল আর কপোল। লক্ষ কোটি মাইল দূর থেকে ভেসে আসা নক্ষত্রের ম্লান আলো প্রতিফলিত হচ্ছে সেখানে। অজানা বিপদ আর রোমাঞ্চের আসন্ন সম্ভাবনায় তিরতির করে কাঁপছে চারজনেরই বুক। অন্ধকারে শিকারি চিতার মত জ্বলজ্বল করছে তাদের প্রত্যয়দৃপ্ত চোখগুলো। সুগভীর মনোযোগে উজ্জ্বল চোখগুলো তাকিয়ে রয়েছে গভীর সমুদ্রের দিকে।

 

দূরে, বহুদূরে বঙ্গোপসাগরের বুকে নোঙর করে রয়েছে তিনটে বিদেশি জাহাজ। দূরবর্তী সেই জাহাজগুলি থেকে ভেসে আসছে অস্পষ্ট আলোর আভা। সাগরের বুকে আলোকিত শহরের মত অলস ভেসে রয়েছে বিশাল জলযানগুলো। এই জলযানগুলোর একটিকে ডুবিয়ে দেবার কঠিন শপথ এবং ইস্পাতদৃঢ় সংকল্প নিয়ে সাগরতীরে জড়ো হয়েছে চারজনের এই ছোট্ট দলটা। শুধু এরাই নয়, একই সময়ে কাছাকাছি জায়গা থেকে আরো সাতজন তরুণও দুটো দলে ভাগ হয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে অন্য জাহাজ দুটোকেও সাগরের অতল তলে তলিয়ে দেবার জন্যে।

 

আমির হোসেন, জয়নাল আবেদীন কাজল, আব্দুর রশীদ এবং হোসেন ফরিদ নামের এই চার তরুণ, মুক্তিযুদ্ধের নৌ-কমান্ডো দলের সদস্য। ভারতীয় নৌবাহিনীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত নিবিড় নৌ কমান্ডো ট্রেনিং নিয়েছেন তাঁরা মে মাস থেকে। বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল যে পলাশির আম্রকাননে, সেখানেই ভাগীরথী নদীতে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনার জন্য অমানুষিক কঠোর ট্রেনিং করে এসেছেন তাঁরা।

 

মার্চ মাসে ফ্রান্সের ছোট্ট একটা শহর তুলনের সাবমেরিন ডকইয়ার্ডে সাবমেরিনারদের ট্রেনিং এর জন্য অবস্থান করছিল ফ্রান্স থেকে লিজ নেওয়া পাকিস্তানি সাবমেরিন ম্যাংরো। এর ক্রদের তেরোজন ছিলেন বাঙালি, বাকী আটাশজন পাঞ্জাবি। রেডিও-র সংবাদের মাধ্যমে পঁচিশে মার্চের ক্রাকডাউনের কথা জেনে যান বাঙালি সাবমেরিনাররা। ক্ষুব্ধ সাবমেরিনাররা প্রথমে সিদ্ধান্ত নেন ম্যাংরোকে হাইজ্যাক করে নিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন বা ম্যাংরোকে ধ্বংস করে ফেলবেন গভীর সাগরে নিয়ে এসে। পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন তাঁরা।

 

এপ্রিল মাসের এক তারিখে ম্যাংরো পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে রওনা হবার কথা। আগের দিন বাঙালি তেরোজনের মধ্যে নয়জনই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ম্যাংরো থেকে পালিয়ে যান। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ভারতীয় দূতাবাসের সহায়তায় এদের মধ্যে আটজন পালিয়ে চলে আসেন ভারতে। এদেরকে হাতে পেয়েই ভারতীয় নৌবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় মুক্তিযোদ্ধা ছেলেদের নিয়ে একটি নৌ-কমান্ডো ইউনিট গঠন করার। বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে জড়ো করা হয় তিনশজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাকে। এটা যে একটি আত্মঘাতী মিশন সেটা জেনেও স্বেচ্ছায় এই অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত হয় তারা। পলাশিতে খোলা হয় ট্রেনিং ক্যাম্প। পাশের ভাগীরথী নদীই হচ্ছে কমান্ডোদের ট্রেনিং এর জায়গা।

 

প্রতিদিন ভোর পাঁচটা থেকে শুরু হতো ট্রেনিং। শেষ হতো রাত নয়টায়। পিটি, সাঁতার, জুডো, ক্যারাতি সবকিছুই শেখানো হতো সেই ট্রেনিং এ। জাহাজ ডুবানোর জন্য যুগোশ্লাভিয়া থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত দুই হাজার লিমপেটে মাইন কিনে এনেছিল ভারতীয় নৌবাহিনী। জলের নীচে ব্যবহারের জন্য এর কাঠামোগত পরিবর্তনও করেছিল ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা। লিমপেট মাইন বুকে বেঁধে ভ্গীরথীতে সাঁতারও কাটতে হতো কমান্ডোদের। এছাড়া কীভাবে এই মাইনের বিস্ফোরণ ঘটাতে হয় এবং সেইসাথে হালকা অস্ত্রের ব্যবহারও শিক্ষা দেওয়া হতে থাকে সেখানে। আক্রমণ রচনা এবং আত্মরক্ষার কৌশলও শিক্ষা দেওয়া হয় তাঁদেরকে।

 

এই কমান্ডোরা দেশের ভিতরে নারায়নগঞ্জ, চাঁদপুর, মংলা এবং চট্টগ্রামে প্রথম অপারেশন চালায় অগাস্ট মাসের ষোল তারিখে। এই অপারেশনের সাংকেতিক নাম ছিল অপারেশন জ্যাকপট। অপারেশন জ্যাকপটের প্রথম অভিযানেই নৌ-কমান্ডোরা ধ্বংস করে দিয়েছিল ছাব্বিশটি জাহাজকে।

 

চট্টগ্রামে দ্বিতীয় অপারেশন জ্যাকপটের অংশ হিসেবে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে তেইশজনের একটা দল হিসেবে গোপনে বাংলাদেশে ঢুকেছিল আমির হোসেন, হোসেন ফরিদদের দলটি। চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলোর মধ্য থেকে যতগুলোকে সম্ভব ডুবিয়ে দিয়ে বন্দরকে অকেজো করে দেওয়াটাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য।

 

পলাশি থেকে তাঁদেরকে সামরিক ট্রাকে করে নিয়ে আসা হয় কোলকাতায়। সেখান থেকে সামরিক বিমানে করে উড়িয়ে আনা হয় আগরতলায়। তারপর রাতের আঁধারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশের ভিতরে। সীমান্ত অতিক্রম করে অস্ত্রসস্ত্র এবং লিমপেট মাইন নিয়ে সারারাত হেঁটে হেঁটে কমান্ডোরা পৌঁছে যায় ইছাখালিতে। সেখান থেকে দেশি নৌকোয় চড়ে চলে আসে সীতাকুন্ডের সায়েরখালির বেইজ ক্যাম্পে। এই সমস্ত বেইজ ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাই কমান্ডোদের থাকা, খাওয়া, নিরাপত্তা এবং পথ পরিদর্শকের ভূমিকা পালন করতে থাকে। সীতাকুন্ড থেকে নিরাপত্তাজনিত কারণে কমান্ডোরা ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে চট্টগ্রামের দিকে যেতে থাকে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পথ ধরে। চট্টগ্রামের নিউমার্কেটের লাকী টেইলার্স ছিল মিলনস্থল। সেখানে পৌঁছোনোর নির্দেশ ছিল সবার উপরে। এখানে পৌঁছানোর পর থেকেই একেকজনকে নিয়ে যাওয়া হতে থাকে একেকটি গুপ্তিস্থানে। তাঁদের বহন করা লিমপেট মাইন এবং অস্ত্রসস্ত্রগুলো ভিন্নপথে পাঠিয়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। আমির হোসেনের গুপ্তিস্থান ছিল সিটি কলেজের ভিপি মনির হোসেনের বাড়িতে। অপারেশনের আগে আসকর দীঘির এক বাড়িতে জড়ো করা হয় দশজন কমান্ডোকে। ধরা পড়লেও হাজারো অত্যাচার নির্যাতনে অপারেশন জ্যাকপটের কথা স্বীকার করা হবে না বলে সেখানে কোরান হাতে নিয়ে শপথ নেয় তাঁরা। তারপর গ্রামবাসীর ছদ্মবেশে সাথে ছাগল নিয়ে কর্ণফুলির অপরপারে মুসন আউলিয়ার মাজারে যাবার অছিলায় নদী পাড়ি দেয় তারা। এই মাজারেই সারাদিন অবস্থান করেন তাঁরা। রাতের বেলা মাজার থেকে বেরিয়ে চলে আসেন সাগরপারে। এর মধ্যে সেখানে পৌঁছে গেছে লিমপেট মাইন, সুইমিং কস্টিউম এবং পায়ের ফিনসগুলো।

 

গামছা দিয়ে বুকের সাথে একটা করে লিমপেট মাইন বেঁধে নেয় কমান্ডোরা। আগের দিনই একজন কমান্ডো রেকি করে গিয়েছে। তার তথ্য অনুযায়ী জাহাজগুলো তীর থেকে এক মাইল দূরে থাকার কথা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেই তথ্য ভুল। কমপক্ষে সাত-আট মাইল দূরে রয়েছে জাহাজগুলো। পানিতে নামার পূর্বমুহুর্তে নার্ভাস ব্রেকডাউনে আক্রান্ত হন আব্দুর রশীদ।  হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন তিনি। কোন কারণে মারা গেলে তার পরিবারকে দেখার আর কেউ থাকবে না বলে বার বার জানাতে থাকেন সবাইকে। ভীত-সন্ত্রস্ত সহযোদ্ধাকে তীরে রেখে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয় দলের বাকি সদস্যদের। ফলে, আব্দুর রশীদকে বাদ দিয়েই উত্তাল সাগরের বুকে নেমে আসে অন্য তিনজন সদস্য। একজনের হাতের মধ্যে আরেকজনের হাত ঢুকিয়ে নিঃশব্দে সাঁতার কাটতে থাকেন তাঁরা নির্দিষ্ট জাহাজের আলো লক্ষ্য করে।

 

বঙ্গোপসাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ এসে মুহুর্মুহু আঘাত করতে থাকে কমান্ডোদের। ভাগ্য ভাল যে তখন ভাটার সময়। অন্তর্মুখী স্রোতের টানে ভেসে যেতে থাকেন তাঁরা জাহাজের দিকে। কয়েকশ গজ সাঁতার কাটার পরে হঠাৎ করে আমির এবং ফরিদ টের পান যে, উত্তাল ঢেউয়ের ধাক্কায় কাজল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন তাঁদের কাছ থেকে কখন যেন। অন্ধকার সাগরপক্ষে শুরু হয় অনুসন্ধানের পালা। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরে অবশেষে পাওয়া যায় কাজলকে। পরিশ্রম আর ঢেউয়ের ধাক্কায় ক্লান্ত-শ্রান্ত তিনি। জাহাজ পর্যন্ত সাঁতরে যাবার মত অবস্থায় কাজল আছে বলে মনে হয় না তাঁদের কাছে। তাঁকে ডাঙায় ফিরে যাবার নির্দেশ দেন তাঁরা। আমির হোসেন আর হোসেন ফরিদ ভেসে চলেন গন্তব্যের দিকে।

 

প্রায় চার ঘন্টা সাঁতরানোর পরে নাগাল পান তাঁরা জাহাজের। ডুবসাঁতার দিয়ে জাহাজের খোলের সাথে লেপ্টে যান তাঁরা। ছুরি দিয়ে কিছুটা দূরত্ব রেখে খোলের দুটো যায়গা থেকে শ্যাওলা সরিয়ে লিমপেট মাইন দুটো লাগিয়ে দেন। মাইনের সাথে সংযুক্ত চুম্বকের কারণে নিঃশব্দে তা লেপ্টে যায় খোলের সাথে। তারপর একটা বড়সড় ডুবসাঁতার দিয়ে দুজনে সরে আসেন জাহাজ থেকে যতখানি দূরে সরে আসা যায় ততখানি। তীরের কাছে জ্বলা বাতিঘর দেখে দুজনেই রওনা দেন সেদিকপানে।

 

অপারেশনের আগে কথা ছিলো যে, অপারেশন শেষে নরমানস পয়েন্ট বাতিঘরকে নির্দেশনা ধরে নিয়ে ফিরে আসবেন কমান্ডোরা। দীর্ঘ পরিশ্রম আর বিপদের উত্তেজনায় ক্লান্ত  আমির হোসেন এবং হোসেন ফরিদ, দুজনেই বাতিঘরের নির্দেশনা ভুল করে বসেন। নরম্যানস পয়েন্ট বাতিঘরের পরিবর্তে আরো পশ্চিমে অবস্থিত পতেঙ্গা বাতিঘরকে লক্ষ্য হিসেবে ধরে নিয়ে তীরের দিকে রওয়ানা দেন তাঁরা। যাবার সময় যে রকম হাত ধরাধরি করে রওয়ানা দিয়েছিলেন সুনির্দিষ্ট জাহাজে মাইন লাগানোর জন্যে, ফেরার সময় সেই প্রয়োজনীয়তা না থাকার কারণে বিচ্ছিন্নভাবে সাঁতার কাটা শুরু করেন দুজনে।

 

আমির হোসেনের কাছে মনে হতে থাকে যে এটাই বোধ হয় তাঁর জীবনের শেষ দিন। ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন তিনি তখন। হাত পা ছুড়ে সাঁতার কাটার মত সামান্যতম শক্তিও বুঝি আর অবশিষ্ট নেই। প্রচন্ড ঢেউ এসে ভেঙে পড়ছে তার উপরে। অনিচ্ছাতেও লবন মেশানো জল ঢুকে যাচ্ছে পেটে। তারপরই বমি হয়ে তা আবার বেরিয়ে আসছে পেট থেকে। ভাগ্যিস জোয়ার শুরু হয়েছে তখন। নবযৌবনা ঢেউগুলো সোল্লাসে তাঁকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে তীরের দিকে। জীবনের আশা যখন ছেড়ে দিয়েছেন তিনি, ঠিক তখনই হঠাৎ করে পায়ের নীচে বালুর অস্তিত্ব টের পান। ক্লান্ত শ্রান্ত দেহটাকে টেনে নিয়ে আসেন ডাঙায়। তারপর ঘাসের উপর শুয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। সকালের আলো চোখে পড়তেই জ্ঞান ফিরে পান। টের পান যে নরম্যানস পয়েন্ট বাতিঘরের বদলে পতেঙ্গা বাতিঘর অনুসরণ করে কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম পাড়ে নৌঘাটিতে চলে এসেছেন তিনি। গামছা কোমরে পেঁচিয়ে সুইমিং স্যুটকে আড়াল করেন তিনি। গ্রামবাসীর মত ভাব নিয়ে হেঁটে যেতে থাকেন। কয়েকজন সৈন্য তাঁকে থামায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে একজন সৈন্য তার কোমরের গামছা ধরে টান দেয়। গামছার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে সুইমিং কস্টিউম। ভারতীয় ফ্রগম্যান মনে করে সাথে সাথেই ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্দি করে ফেলে তাঁকে সৈন্যরা। একজন সৈন্য তাঁর কান বরাবর ক্যারাতির চপ লাগায়। বিষম সেই আঘাতে গলগল করে কান দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসতে থাকে তাঁর। দুইজন সৈন্য তাঁকে মাটিতে উপুড় করে ফেলে দেয়। একজন পা দুটো চেপে ধরে। অন্যজন কোমরের উপর বসে গলার পিছনে হাত দিয়ে উলটো দিকে চাপ দিয়ে শিরদাঁড়া ভাঙার চেষ্টা করে। অজ্ঞান হয়ে যান তিনি। কিছুক্ষণ চেষ্টার পরে শিরদাঁড়া ভাঙতে না পেরে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে তুলে নেয় গাড়ীতে।

 

আমির হোসেনের মত হোসেন ফরিদও লক্ষ্য ভুল করেছিলেন। বিধস্ত অবস্থায় হাবুডুবু খেতে খেতে তিনি উঠেন গিয়ে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব পাড়ে, মেরিন একাডেমীর ভিতরে। একেবারে বাঘের ঘরে। ওখানে তখন পাকিস্তান আর্মির ক্যাম্প ছিল। তীরে পা রাখার সাথে সাথে পাকিস্তানী সৈন্যরা তাকে বন্দি করে ফেলে। নিয়ে যাওয়া হয় মেরিন একাডেমির প্রিন্সিপ্যালের অফিসের পাশে। সেখানে রাস্তার পাশে রাখা সুয়ারেজ পাইপের ভিতরে ফরিদের শরীরের নিম্ন অংশ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তারপর উর্ধাংশকে সর্বশক্তি দিয়ে উলটো দিকে চাপ দিয়ে ভেঙে ফেলা হয় তার মেরুদণ্ড। তীব্র যন্ত্রণায় মৃত্যুর আগ মুহুর্তে ও মারে মা বলে বিকট এক অমানুষিক আর্তচিৎকার দিয়ে উঠে ফরিদ। মায়ের একমাত্র সন্তানের মৃত্যু মুহুর্তেও হয়তো মমতাময়ী মাকেই মনে পড়ে গিয়েছিল। মেরুদন্ড ভাঙা ফরিদের লাশ নিতান্ত অবহেলা আর চরম ঘৃণায় পাকিস্তানিরা ছুড়ে ফেলে দেয় কর্ণফুলি নদীতে।

 

ফরিদের সেই বিকট আর্তচিৎকার কানে গিয়েছিল মেরিন একাডেমির প্রশাসনিক কর্মকর্তার স্ত্রীর কানে। প্রশাসনিক কর্মকর্তার বাসা প্রিন্সিপ্যালের অফিসের পাশেই ছিল। এই ভদ্রমহিলা ফরিদের সেই যন্ত্রণাকাতর মৃত্যুর হাহাকার শুনে এমনই আতংকিত হয়ে পড়েছিলেন যে পরবর্তী ছয় মাস তিনি খেতে বা ঘুমোতে পারতেন না। সারাক্ষণই তার কানে বাজতো ফরিদের সেই মরণ চিৎকার।

 

 

মাত্র এক প্রজন্ম আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে সীমাহীন সাহস দেখিয়েছেন, যে দৃশ্যমান দেশপ্রেম দেখিয়েছেন তার তুলনা মেলা ভার। মৃত্যুকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে, তার কোলে মাথা রেখে তারা অনবরত জীবনের গল্প লিখে গিয়েছেন আমাদের জন্যে। একটি অসম যুদ্ধে যে বিপুল বিক্রম নিয়ে তারা লড়েছেন তার তুলনা ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া বিরল। এই সমস্ত অসমসাহসিক বীরদের কথা আমরা প্রায় সময় বলি ঠিকই, কিন্তু কখনোই সত্যিকার অর্থে উপলব্ধি করি না যে ঠিক কীসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাদেরকে, ঠিক কতখানি কষ্টসাধ্য ছিল তাদের যুদ্ধকালীন সময়গুলো, কতখানি জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছিল তাদেরকে বৈরী সময়ে।

 

একটি দেশকে জন্ম দিতে গিয়ে একাত্তরে কত কত অসংখ্য তরুণ প্রাণ হারিয়েছে এ দেশের কত কত অজানা অচেনা জায়গায়। দেশকে ভালবেসে লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে গিয়েছে ফরিদের মত কত শত তাজা প্রাণ। তাঁদের শরীরের রক্ত নির্যাস দিয়েই শ্যামল থেকে শ্যামলতর হয়েছে এই ভূখন্ড। এদের রক্ত ঋণে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছি আমরা চিরতরে।

 

আমাদের পূর্বপুরুষ এই সমস্ত বীরপ্রাণদের জন্যে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের উত্তরপুরুষদের বুকের সবটুকু ভালবাসা ঢেলে দিলেও শোধ হবে না তাঁদের রক্তের ঋণ।

 

 

জনাব আমির হোসেন, বীরপ্রতীক, আমার একজন খুব কাছের বন্ধু আনোয়ারের বাবা। বাইশে সেপ্টেম্বরের এই অপারেশনের পরে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েন তিনি। বন্দি অবস্থায় তাঁর উপর নিয়মিত প্রতিদিন অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাতো পাকিস্তানিরা এবং তাঁদের দোসর রাজাকারেরা। দেশ স্বাধীন হবার পরে মুক্তি পান। বাহাত্তর সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। দীর্ঘদিন সুনামের সাথে চাকুরি করার পরে পেটি অফিসার থাকা অবস্থায় চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অল্প কিছুদিন আগে অভিবাসন নিয়ে স্বপরিবারে ছেলের কাছে ক্যানাডায় চলে এসেছেন তিনি। শহীদ হোসেন ফরিদের গল্প তাঁর কাছ থেকেই শোনা আমার।

 

প্রবন্ধটির শিরোনাম নেওয়া হয়েছে হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি আগুনের পরশমণি-র টাইটেল সং থেকে। গানটিও হুমায়ুন আহমেদেরই লেখা। একারণে কৃতজ্ঞতা রইলো এই গুণী কথাশিল্পীর জন্যে।