আমাদের পাশের বাড়ির বেড়ায় অন্যান্য ঠাকুর দেবতার ছবির সাথে একটা যমপুরীর ছবিও টাঙ্গানো ছিল। চুরি করলে, পর নারী হরণ করলে, মানুষ খুন করলে বা মিথ্যা কথা বললে মৃত্যুর পর কি শাস্তি দেওয়া হবে এ সবের সচিত্র রূপ। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে আর এর মধ্যে একটা মানুষকে ফেলে দিয়েছে, আবার চরকার মধ্যে সূতার মত একজনকে ঘুরাচ্ছে। এসব ভয়াবহ শাস্তির ছবি আমার শিশুমনে দাগ কেটেছিল। রাতে ঘুমুতে গেলে সারাদিনে কোন মিথ্যা কথা বলার কথা মনে হলে এসব শাস্তির ভয়ে গা শিউরে উঠলেও অত্যন্ত প্রয়োজনে মায়ের সাথে বা সোনাকাকার সাথে দিনের বেলা মিথ্যা না বলে যে উপায় থাকত না! নগদ সামান্য শাস্তি কাটিয়ে ফেলতাম ভবিষ্যতের ভয়াবহ শাস্তিকে উপেক্ষা করে। কিন্তু রাতে ঘুমুতে গেলে চিন্তা হতো। মনে মনে শপথ নিতাম আর মিথ্যা না বলার।

‘অপ্রিয় সত্য কথা বলিতে নাই’ বলে তো সোনাকাকা ছোটভাইকে হস্তাক্ষর চর্চা করাচ্ছে; আবার ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ’ লেখা ও তো আগের দিন হাত ঘুরাতে দিয়েছিল। কোনটা সঠিক। কোনদিকে যে যাই? দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, সংশয়, চিন্তা, অস্বস্তি। অবশেষে সান্ত্বনা নিতাম দাদুর শোনানো—

‘একবার রাম নামে যত পাপ হরে
জীবের কি সাধ্য তত পাপ করে?’

কাজেই মনে মনে ঠাকুরকে ডেকে ঘুমিয়ে পরতাম। ছোটবেলায় এ লাইনগুলো আমাকে টুকটাক মিথ্যা কথা বলায় প্রভাবিত না করলেও ভয়ে সান্ত্বনা পেতাম।

এখন পাপ পূণ্যের লোভ ছাড়াই মিথ্যা বলি না। এ অনুভূতি মৃত্যুর পর কোন শাস্তির ভয়ে নয়, নিজের ভেতরের অস্বস্থিকে ছাড়াতে সত্য কথা বলি। তবে বড়বেলায়ও কোন কোন বিষয়ে সেই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংশয়, চিন্তা, অস্বস্তি কাটাতে পারিনি। কিছু কিছু বিষয়ে এখনো সংশয়ে থাকি। আছি। যেমন — ছেলেমেয়ের মঙ্গল কামনায় আমি সংশয়বাদী।

তবে নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে বাস্তবতার নিরিখে। পরজন্ম, মৃত্যুর পর হাশরের মাঠ বা স্বর্গের লোভ দেখিয়ে নয়।
ছোটবেলায় ভাত ফেললে অথবা খাবার সময় চারদিকে ভাত পড়লে ঠাকুরমা ও বোন বলতেন যতটা ভাত ফেলছিস ভগবান ততদিন ভাত না খাইয়ে রাখবে। ভাতে অভিশাপ দেবে। ছোটভাই বিদ্যুত তাৎক্ষণিক উত্তর দিত, এতদিন বাঁচলে ত? ভালই হবে ভাত ফেলে আয়ু বাড়ল।

কিন্তু আজকাল প্রায়ই দেখি মা থালায় ছেলেমেয়ে যা খাবে এর দ্বিগুন নেয়। স্বাভাবিকভাবেই অর্ধেক অপচয় করে আর অহংকারের সাথে ঘোষণা করে, আমার বাচ্চা খেতেই চায় না।
বিয়ে বাড়িতে গেলে এখনকার মত এত খাবার নষ্ট করতে দেখিনি। টেবিলে এমন থালা পাওয়া দুষ্কর যে থালায় উচ্ছ্বিষ্ট খাবার নেই। অথচ এখন টেবিলে সব দেওয়া থাকে। আর আগে সব পদই অন্য কেউ পরিবেশন করত।

আমিও আমার ছেলেমেয়েকে অপচয় না করার শিক্ষা দিয়েছি। তবে ঠাকুমা বোনের মত অপরিপক্ক পরিসংখ্যান দেইনি। ক্ষুধার্তদেরকে অনুভব করতে বলেছি।
‘সুধার দেশের মানুষ কেন ক্ষুধায় মরে রে
রাণীর ছেলে মিথ্যা কেন ভিক্ষা করে রে’।
শুনিয়েছি। বুঝিয়েছি– এখনও পৃথিবীর কতজন মানুষ রাতে অনাহারে থেকে ঘুমাতে যায়। এসব বলে অপচয় রোধ করেছি। আমার ছেলেমেয়ে কখনোই খাবার অপচয় করে না। খাবার থালায় খাবার রেখে জল ঢালার কোন একটি ঘটনাও নেই। আমার ঠাকুমা বোনের চেয়ে আমার বিজ্ঞানমনস্কতা ও যৌক্তিকতা যে এগিয়ে থাকবে তা অবশ্য ঢোল পিটিয়ে বলার কিছু নেই।
তবুও ভেবে দেখার সময় এসেছে ছেলেমেয়েদের নৈতিকতাকে জাগিয়ে রাখতে নির্দ্বিধায় কোন পথটি অবলম্বন করা উচিত? পরকাল না ইহকাল হবে উদাহরণের বিষয়।

‘মায়ের নাম নিলে রসাতলে যায়
বাবার নাম নিলে দুধে ভাতে খায়।‘

এ প্রবচনে বিশ্বাসী বলেই হয়তো ছোটবেলায় বাবার নামের পাশাপাশি মায়ের নাম শেখায়নি আমাদের। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় আমার নিজ পরিবারে, আশেপাশের পরিবারে, স্কুলে এবং সর্বত্র শিশুদের শেখানো হতো —
তোমার নাম কি?
তোমার বাবার নাম কি?
বাড়ি কোথায়? অর্থাৎ ঠিকানা কি? আরেকটু শেখাতে গেলে দাদুর (পিতামহ) নাম কি?
এমনকি শিশুদের সাথে কথা বলতে গেলেও এ প্রশ্নগুলো করা হতো। সচেতন বা অবচেতনে কাজ করত শিশুটি হারিয়ে গেলে ঠিকানা বলতে পারবে আর পুর্ব পুরুষদের পরিচয় শেখানো। এখানে মাতৃকূল একেবারেই অদৃশ্য।
নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২৭/৮/২০০০ তারিখে জারিকৃত পরিপত্রের মাধ্যমে বাবার নামের পাশে মায়ের নাম লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
২০০৯ সালের আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে হাইকোর্ট বাবা ছাড়া শিশু শুধু মায়ের নাম দিয়েও পরিচয় প্রদানের রায় দিয়েছে । এ রায় আদায়ে নারী আন্দোলনের কর্মীদের লড়তে হয়েছে।

আজকাল বাবার নামের সাথে মায়ের নামও বাচ্চাদের শেখানো হয়। আমার বাচ্চারা তাদের বাবা ও মায়ের নাম একই সাথে শিখেছে। কিন্তু আমি আমার মায়ের নাম শিখেছি দাদু ও দিদিমা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসে মাকে ডাকার পর। এর আগে আমার মা গীতার মা হয়েই ছিলেন। কারণ আমি মা বাবার প্রথম সন্তান। আমিও এখন আমার শাশুড়ির কাছে স্বাক্ষরের মা। আমার নামটি সাধারণত আমার শ্বশুর বাড়িতে উচ্চারিত হয় না।

বাবা মায়ের নাম লেখালেখি নিয়ে এত পারিবারিক ও সামাজিক চর্চা—- আন্দোলন—- আইন— আদেশ—রায়, অথচ এক সময় আমাদের জীবনে এরও প্রয়োজন কমে আসে। ইনকাম টেক্সের কাগজ পূরণ করতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করলাম আমি গত এক বছরে একবারও আমার মা বাবার নাম উচ্চারণ করার কোন প্রয়োজন অনুভব করিনি। মা বাবার নাম আমার দাপ্তরিক কোন কাজে লাগেনি। নিজের মধ্যে কেন জানি এক প্রকার অপরাধবোধ কাজ করল।
যেমন বোধোদয় তেমনি এ্যাকশন। কার্যক্রম গ্রহণ। একটা ই-মেইল ঠিকানার পাস ওয়ার্ডে বাবার নাম আর অন্যটায় মায়ের নামে ব্যবহার করা শুরু করলাম। জটিল পাস ওয়ার্ডএর জন্যে সাথে অন্য কিছু অবশ্য যোগ করেছি। এখন প্রতিদিনই মা বাবাকে স্মরণ করি। জননী ও জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সি বা পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাহি পরমং তপঃ এসব শ্লোক এর প্রভাবে নয়; নির্ভেজাল ভালবাসায়, গভীরতম শ্রদ্ধায়, স্বতঃস্ফূর্ত কৃতজ্ঞতায় ও নিজের আবেগকে সম্মান করে।

মা বাবাকে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ স্মরণে রাখার এ কৌশল আবিষ্কারে আমি নিজেই নিজের বুদ্ধিতে অভিভূত।