পন্ডিত সীতারামজি মহারাজ গত ১৩ মে ২০১০ থেকে বাঁকুড়া শহরের দেবর্ষি হোটেলের ১০৪ নম্বর রুমে বসছিলেন। তিনি একটি লিফলেট প্রচারিত করেন যাতে তিনি দাবি করেন যে, শুধুমাত্র চেহারা এবং হাতের রেখা দেখে ভূত-ভবিষ্যত বলতে পারেন। প্রেমবিবাহ, ভৌতিক ঘটনা, মামলা মোকদ্দমা, মানসিক কষ্ট, মানসিক অবসাদ, স্ত্রী পুরুষের গুপ্তরোগ, সন্তান, ইত্যাদি কঠিন সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারেন। প্রতিটি খদ্দেরের কেবলমাত্র তিনটি ভবিষ্যতবাণী করবেন যার জন্য ফীজ ৫১ টাকা।
লিফলেট প্রচারিত হওয়ার পর থেকে ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র বাঁকুড়া শাখার কাছে অসংখ্য মানুষ জানতে চেয়েছেন সীতারামজি-র এই দাবি কতটা যুক্তিসঙ্গত। যেহেতু যুক্তিবাদী সমিতি তাদের কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠানে এবং পত্রপত্রিকায় বরাবর বলে এসেছে জ্যোতিষির ভবিষ্যতবাণী এক মহান ফাঁকিবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাছাড়া জ্যোতিষের তাত্ত্বিক দিকটিও ভুলে ভরা এবং সম্পূর্ণ অবিজ্ঞানসম্মত। তাই সীতারামজির প্রচারপত্র পেয়ে যুক্তিবাদী সমিতির কাছে শহরবাসী প্রশ্ন করবে এ অতি স্বাভাবিক। সেই কারনেই যুক্তিবাদী সমিতির সদস্যরা সীতারামের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
১৬ মে সকাল থেকে আমরা দেবর্ষি হোটেলের আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ি। যুক্তিবাদী সমিতির সদস্য বেলিয়াতোড়ের তরুন রক্ষিত, বয়স চল্লিশ ছুঁই, খুব সাধারন চেহারা-পোষাক, মুখে কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি, যায় তার বিবাহিত জীবনের অশান্তি কাটাতে। জ্যোতিষি বলেন যেহেতু ওদের বিবাহিত জীবনে সন্তান নেই, তাই অশান্তি হচ্ছে। সীতারাম তার কাছে ৫০০০ টাকা দাবি করে যন্ত্রম দেওয়ার জন্য এবং প্রতিশ্রুতি দেন এর ফলে ২০১০ সালের মধ্যেই সন্তান আসবে, অশান্তিও দূর হবে। মজার ঘটনা হল তরুন রক্ষিত বিয়েই করেনি। তাহলে কপাল দেখে সব জেনে যাওয়া জ্যোতিষি বুঝতে পারল না কেন সত্যিটা কি? অর্থাৎ কপাল দেখে অতীত ভবিষ্যত বলে দেওয়ার দাবী ধোপে টিকল না।
ভৈরবস্থানের চন্দ্র কর্মকার, বয়স চব্বিশ, চৌকস চেহারার, গিয়েছিলেন একটি মেয়ের ফোটো নিয়ে যাকে তিনি বিয়ে করতে চান। তাকেও সীতারাম বলেন ২৮০০ টাকা দিলে ওই সুন্দরী তরুনীর সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করে দেবেন। অথচ বাস্তবে চন্দ্র ঐ মেয়েটিকে চেনেই না। মেয়েটিও চন্দ্র কে কোনোদিনই দেখেনি। আমি আমার কোলকাতার কলেজের অ্যালবাম থেকে আমার এক বান্ধবীর ছবি চন্দ্রকে দিয়েছিলাম আগের দিন রাতে। মেয়েটি বর্তমানে বিবাহিত থাকে অনেক দূরে এবং চন্দ্র কর্মকারের চেয়ে প্রায় সাত বছরের বড়। বিয়ে বা প্রেমের কোনো প্রশ্নই নেই। এ প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প বলি। ২০০৯ এর ফেব্রুয়ারিতে গঙ্গাপ্রসাদ নামের এক ত্রিকালজ্ঞ জ্যোতিষি ধরতে গিয়ে আমি আমার বৌয়ের অবিবাহিত অবস্থার ছবি নিয়ে গিয়ে বলেছিলাম বাবাজী এর সাথে চেষ্টা করছি দীর্ঘদিন ধরে, মেয়েটি রাজি হচ্ছে না। একটু লাইন করে দিতে হবে। দেখলাম, সেই সবজান্তা বাবা আমার কপাল দেখে নয় আমার এবং ছবির মেয়ে সম্বন্ধে সব কিছু প্রশ্ন করে করে জানলেন। উত্তর দিলাম। কিছুক্ষণ আঁকিবুঁকি কেটে তার উত্তর ছিল এ মেয়ের ওপর অশুভ গ্রহের নজর আছে, তোমার সাথে বিয়ে কোনো মতেই সম্ভব নয়। আমি একটা যজ্ঞ করে তাবিজ দেব, তারপর তুমি ওকে পেতে পারো, তাও ২০১০ সালের এপ্রিলে। তার আগে মেয়েটি হ্যাঁ বলবেও না, বিয়ে হবেও না।ভাবুন আমার দু বছর আগের বিয়ে করা বৌ সম্বন্ধে বলছে কি।
যাই হোক, এখনকার প্রসঙ্গে আসি। সীতারামজির খদ্দেরদের মধ্যে ভ্যারাইটি আনতে একজন আদিবাসীকে পাঠিয়েছিলাম। হরিগ্রামের সুধীর হাঁসদা। সুধীরদার চেহারা দেখলে মনেই হয় এ ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানেনা। ব্যস। সীতারাম গেল উলটে। সুধীরদার বাড়ির অশান্তির কারন জানতে গেলে সীতারাম বলেন বাড়িতে নিশ্চই ভুতের উপদ্রব হয়েছে, ঝাড়তে হবে। খরচ হবে ৩৩০০ টাকা।
হেলনা শুশুনিয়ার গ্রামের যুবক তুহিন ব্যানার্জী পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক। সে এমন ভাবে সীতারামের কাছে উপস্থিত হয় যে হাত দেখে সীতারামের মতামত তুহিন বেকার সমস্যায় ভুগছে। তুহিনের বেকার সমস্যা কাটাতেও সে মোটা রকম দক্ষিণা দাবি করে।
সবচেয়ে উদ্বেগের যে, সীতারামজি ভৈরবস্থানের প্রশান্ত মন্ডলের মৃগী রোগের অসুস্থতা মন্ত্র দিয়ে সারাবার প্রতিশ্রুতি দেয়, যা কিন্তু স্পটতই আইনত অপরাধ। কেননা আমাদের দেশের ‘দ্য ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস অ্যাক্ট(অব্জেকশ্যনাবল অ্যাডভারটাইজমেণ্ট)-১৯৫৪’ অনুসারে মন্ত্র-টন্ত্র,তাবিজ-কবচ দিয়ে বা অলৌকিক উপায়ে রোগ সারানোর চেষ্টা করা বা সারাতে পারব এই দাবি করাটাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ প্রসঙ্গে প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের একটা কথা না বলে পারছিনা। এই মাত্র যে আইনটির কথা বললাম সেই দ্য ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস অ্যাক্ট টি পঞ্চাশ বছরের পূরোনো আইন হওয়া সত্বেও আমাদের দেশের প্রশাসন কোনোদিনই সেরকম ভাবে এর ব্যবহার করতে এগোয়নি। আমাদের মত কিছু সংগঠন মাঝে মাঝে প্রশাসনের দরজায় কড়া নেড়ে বলে ওহে এবার একে ধর। দেখ আইন তোমার সাথে আছে। তখন এর যৎসামান্য প্রয়োগ হয়। এছাড়াও জ্যোতিষিদের রুখতে আছে দ্য ড্রাগ অ্যান্ড কসমেটিক অ্যাক্ট-১৯৪০। এই আইন অনুসারে কোনো রোগের উপশম রূপে কোনো ওষুধ দিতে গেলে সেই ব্যক্তিকে ড্রাগ কন্ট্রোল দপ্তর থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। জ্যোতিষি, তান্ত্রিকরা রোগের উপশম করতে যে আংটি, তাবিজ, কবচ দেন সেসবের কোনোটির লাইসেন্স নেই। তাই বিনা লাইসেন্সে এসব করা অপরাধ। গত ২০ বছরে আমাদের সমিতির পক্ষ থেকে কয়েক হাজার জ্যোতিষি, তান্ত্রিক, অলৌকিক বাবাজী-মাতাজী ধরেছি যাদের মধ্যে বিদেশী অলৌকিক বাবারাও রয়েছেন। দূঃখ লাগে তাদের মধ্যে খুব কম ক্ষেত্রেই প্রশাসনের তরফ থেকে আইনের সঠিক প্রয়োগ হয়েছে।
সেদিন দুপুরেই যুক্তিবাদী সমিতির হয়ে আমি, শ্যাম দাস, বুদ্ধ রায়, বাবাই, বাপি অধিকারী এবং যারা সীতারামের কাছে প্রতারিত হয়েছে সবাই দল বেঁধে সীতারামের কাছে যাই এবং সরাসরি প্রতারনা বিষয়ে অভিযোগ করি। মাথা ভর্তি কাঁচা-পাকা চুল, লম্বা দাড়ি, গেরুয়া বসন পরিহিত তান্ত্রিক চেহারার জ্যোতিষি সীতারাম যুক্তিবাদী সমিতির প্রশ্ন বানে ভেঙে পড়ে এবং সঠিক যুক্তিপূর্ন কোনো জবাবই সে পরিস্কার ভাবে দিতে পারেনি। ঘন্টা খানেকের জেরা জুরিতে জানা যায় তার আসল বাড়ী মহারাষ্ট্রে। বাঁকুড়ার এই হোটেলে তিনদিনে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা রোজগার করেছে। প্রায় পূরোটাই এসেছে মন্ত্র তাবিজ কবচ দিয়ে। সে এও স্বীকার করে যে তার খদ্দেরদের সে যতই মন্ত্র তাবিজ কবচে রোগ সারানোর কথা বলুকনা কেন তার নিজের অসুস্থতায় সবসময় ডাক্তারের কাছে যায়। তার পকেট থেকে বের হয় ট্যাবলেটের পাতা। সীতারাম যা যা বলছিল সব আমাদের কাছে লুকিয়ে রাখা ক্যামেরায় রেকর্ড হচ্ছিল। এরপর তরুন, চন্দ্র, সুধীর, প্রশান্ত মন্ডল সহ আমরা সবাই বাঁকুড়া সদর থানায় প্রতারনার অভিযোগ জানাতে যাই। থানাতে সে সময় অভিযোগ নেওয়ার জন্য যে পুলিশ অফিসার ছিলেন তিনি প্রথমে অভিযোগ নিতে চাননি উলটে জ্যোতিষিকে হেনস্থা করার জন্য যুক্তিবাদী সমিতির সদস্যদেরই হুমকি দেন। এ হবার কথা জানতাম। গত বছর বাঁকুড়ার এক তিনতারা হোটেলে বসা জ্যোতিষির প্রতারণা ফাঁসের পর থানায় অভিযোগ জানাতে এসে একই ব্যবহার পেয়েছিলাম। যাই হোক এবার বিস্তর জলঘোলার পরে আইসি-র হস্তক্ষেপে অভিযোগ নেওয়া হয়, যার ডায়েরী নং ১৩৭২-১৬/৫/২০১০। পুলিশ উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেও পুলিশি উদাসীনতায় সেদিনই বিকেলে সীতারাম পন্ডিত হোটেল থেকে পালাতে সক্ষম হয়।
গত কয়েক বছরে যতবার যুক্তিবাদীরা বাঁকুড়া জেলায় জ্যোতিষির মত প্রতারকদের হাতে নাতে ধরেছে বা ওদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে ততবারই প্রশাসন নিশ্চুপ থেকেছে। বাঁকুড়ার মানুষ চেয়েছে, তারা যুক্তিবাদীদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে লড়াই করেছে, জনসচেতনতায় অংশগ্রহণ করেছে বলেই আজকে জেলায় এসব প্রতারকদের জুলুম কিছুটা হলেও কমেছে। যেমন কিছুদিন আগের একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। বহুদিন ধরেই বাঁকুড়া রেলষ্টেশনের ওভারব্রীজের পাশে রেলের জমিতে জ্যোতিষি ভৃগুর একটি আকাশ ছোঁয়া বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং ছিল। ভৃগু কোলকাতার হেভিওয়েট জ্যোতিষি। মাসে রোজগার কমপক্ষে আট দশ লাখ। সেই বিজ্ঞাপনে অন্যান্য জ্যোতিষির মত তিনিও অনেক গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠানগুলি করতে গিয়ে দেখেছি বাঁকুড়ার মানুষ বহুবার প্রশ্ন তুলেছেন সরকারি জমিতে কি করে জ্যোতিষের বিজ্ঞাপন থাকে? গত ১৫ ডিসেম্বর, ২০০৯ বাঁকুড়া ষ্টেশনের ম্যানেজার কে যুক্তিবাদী সমিতির তরফ থেকে আমি এ বিষয়ে চিঠি দিলাম। রেলের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে চিঠির প্রতিলিপি দেওয়া হয়েছিল। চিঠির মূল বক্তব্য ছিল যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের প্রফেশন ট্যাক্স শিডিউলে জ্যোতিষচর্চাকে আইনি পেশা রূপে মর্যাদা দেওয়া হয়নি, তাই এই বে-আইনি পেশার বিজ্ঞাপন রেলের সরকারী জমিতে কি করে ঠাঁই পায়? বেয়াদপ জ্যোতিষীদের শায়েস্তা করতে আমাদের দেশে কি কি আইন আছে সেগুলিও চিঠির সাথে জুড়ে দিয়েছিলাম। সাথে দিয়েছিলাম পশ্চিমবংগ সরকারের অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্যাক্স কমিশনার পদাধিকারী একজন অফিসারের একটি চিঠির ফোটোকপি।
এই ঘটনাটি কয়েকটি মহলে বেশ আলোচিত হলেও রেল কর্তৃপক্ষ কিন্তু চুপ। সমিতির বাঁকুড়া জেলা মুখপত্রে পরপর দুবার বিষয়টি উঠে আসে। এরপর একজন রাইট ট্যু ইনফর্মেশন অ্যাক্টে জানতে চায় আইনের কোন অধিকার বলে রেল সরকারী জমিতে বে-আইনি বিজ্ঞাপন দেয়। শেষ পর্যন্ত অনেক টালবাহানার পর ঐ রেল কর্তৃপক্ষ ওই বিজ্ঞাপনটি সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। এ জয় যুক্তিবাদের, এ জয় মানুষের।
শেষ করতে গিয়েও আরো একটি প্রসংঙ্গ উত্থাপন না করে পারছিনা। আমাদের সমিতির একটি চ্যালেঞ্জ আছে। কোনো জ্যোতিষি যদি কোনো আমাদের দেওয়া তিনটি ব্যাক্তির সম্বন্ধে হাত দেখে বা কোষ্ঠী বিচার করে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, মাসিক আয়, বিয়ের বছর, কটি সন্তান এরকম সহজ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে তাহলে মেনে নেব জ্যোতিষ শাস্ত্রের অভ্রান্ততা। এখানে আমরা ছাড় দিয়েও রেখেছি। যেমন ধরুন আয়ের ক্ষেত্রে ৫০০০ টাকা কমবেশি বললেও হেরে যাবো, বিয়ের বয়সে ৫ বছর কমবেশি চলবে। সেই লোক গুলির সঠিক তথ্য আমরা দিচ্ছি কিনা সেজন্য আইনত আমরা দায়ি থাকব এ প্রতিশ্রুতি থাকে। চ্যালেঞ্জে যারা আসে সবাই কচুকাটা হয়। কোলকাতার সবচেয়ে নামিদামি জ্যোতিষি মাতা জয়া গাঙ্গুলি ২০০১ সালে একটা টিভি প্রোগ্রামে আমাদের এই চ্যালেঞ্জ গ্রহন করে গোহারা হেরেছিল। সে ঘটনা আর একদিন বলব।
ঘটনাটা বলুন। অপেক্ষায় রইলাম।
হ্যাঁ। একদম ঠিক বলেছেন।
দারুন কাজ হচ্ছে। এই সব বাবাজিদের পৃষ্টপোষক আসলে যারা, তাদের মধ্যে এই আন্দোলনটা দরকার ছিল।