sandwip_asif

১৮ বছর পেরিয়ে

সীতাকুণ্ড চ্যানেল পার হয়ে আমাদের ট্রলারটি সন্দ্বীপের নিকতবর্তী হতেই, দেখলাম অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ৩০-৩৫ জনের একটি দল দাঁড়িয়ে আছে। একজন বিজ্ঞান বক্তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এতদূরে ১৮-৩০ বছর বয়সের একদল তরুণ অপেক্ষা করতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। তখন সম্মান ও গর্ববোধ করেছিলাম। সেইসাথে কিছুটা মানসিকচাপও অনুভব করছিলাম। কারণ যখন কোনো সম্মান আসে তখন তার কাছ থেকে প্রত্যাশাও বেড়ে যায়। সন্দ্বীপে গিয়েছিলাম মূলত বিজ্ঞান বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। এই ভেবে ভালো লাগছিল যে, রাজধানী থেকে এতদুরের সমুদ্র পরিবেষ্টিত প্রাচীন জনপদের মানুষদের আমি বিজ্ঞানের কথা দিয়ে আলোড়িত করতে পেরেছি। কারণ ওদেরই আমন্ত্রনে ডিসকাশন প্রজেক্ট-এর পক্ষ থেকে পাঁচ জনের একটি দল নিয়ে স্‌ন্দ্বীপের উদ্দেশে যাত্রা করি। আমি (আসিফ), ইতি, শাহীন, মিটুল, জেনিথ। প্রথমে নারায়ণগঞ্জ থেকে চট্টগ্রামের বাসে উঠে সীতাকুণ্ডের বারফকুণ্ড বাজারের সামনে নামি, সেখানে সন্দ্বীপের আয়োজক কমিটির পাঠানো অপেক্ষামানরত দুজন গাইডের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। সময় মতো না পৌঁছানোর ফলে নিরাপদ মাধ্যম কুমিরা ঘাটের সি-ট্রাক পেতে ব্যর্থ হই। ফলে কুমিরা ঘাটে না গিয়ে সংক্ষিপ্ত তবে ঝুঁকিপূর্ণ একটি পথ অবলম্বন ছাড়া গত্যান্তর থাকে না। বাজার থেকে ৩ কিলোমিটার রিক্সায় আর এক কিলোমিটার বিশাল মাঠের মধ্যদিয়ে হেঁটে রুপালি সৈকতে পৌঁছই। সামনে রোদে ঝলমল সমুদ্রমোহনা আর ধোয়াশাচ্ছন্ন দিগন্ত। এক হাঁটু সমান কাঁদায় ডেবে সাম্পানে উঠি। সেই সাম্পানে সমুদ্র মোহনার মধ্য দিয়ে এক কিলোমিটার দূরে নোঙ্গর করা ট্রলারে উঠিয়ে দেয়, ট্রলার সন্দ্বীপের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। গাইডের সহায়তা ছাড়া এটা খুবই কঠিন হয়ে যেতো। আর সত্যি কথা বলতে কী শীত মৌসুম দেখেই এ পথে যাতায়াত সম্ভব হয়েছে। বর্ষার সময় ট্রলারে যাতায়াতের চিন্তা করা আর প্রাণ হাতের মুঠোয় নেওয়া একই কথা। এর বহু নজির আছে।

সন্দ্বীপ হলো আমাদের দেশের প্রাচীন জনপদগুলোর অন্যতম, প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি সময়ের। ১৯৯৫ এর পর বিদ্যুৎ থেকে হ্যারিকেনের আলোয় ফিরে যাওয়া এক দ্বীপ। অথচ তারাই ডিসকাশন প্রজেক্ট বিজ্ঞান সংস্থাকে আমন্ত্রণ করেছে বিজ্ঞানের একটি আধুনিক বিষয়ের উপর বক্তৃতা দিতে। যেখানে এই মূহুর্তে সমুদ্র গ্রাস করার আগে সবচেয়ে বড়ো হাজী এবিএম ডিগ্রি কলেজটিকে ভেঙ্গে এর ইট-বালু বিক্রি করা যায় কীনা, তার মরিয়া চেষ্টা চলছে; মূল শহরটির পুরোটাই পানির নিচে, গত দশ বছরে প্রায় একশত বর্গমাইল ভেঙ্গেছে। দ্বীপের সমস্ত ঐতিহ্য আর কীর্তি তলিয়ে গেছে। যেখানে মানুষেরা প্রতিদিনই সমুদ্রের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পিছিয়ে যাচ্ছে, মূল পাওয়ার হাউস ধ্বংস হয়ে যাবার পরে পুরো শহরে অন্ধকার নেমে এসেছে, যেখানে দুবার ভাঙ্গনের মুখে পড়েনি এমন পরিবারের সন্ধান মেলা ভার হবে, সেখানে এ ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন আশ্চর্য করে দেবার মতো বৈকি। যদিও জেনারেটর দিয়ে কিছুটা কাজ হয় কিন্তু তা অবশ্যই প্রয়োজন মেটার মতো নয়।

সন্দ্বীপের বিজ্ঞান ক্লাব অ্যান্ড্রোমিডার আমন্ত্রণেই আমাদের সেখানে যাওয়া। ক্লাবটির জন্মও এই অনুষ্ঠানটিকে ঘিরে। সন্দ্বীপের বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিকঅঙ্গনের লোকজন একত্রিত হয়ে এই অ্যান্ড্রোমিডা বিজ্ঞান ক্লাবটি গড়ে তোলে। আয়োজকরাই বক্তৃতার বিষয় ঠিক করে দেয়: বহির্জাগতিক প্রাণ ও নাক্ষত্রিক সভ্যতা বিষয়ক দ্বিতীয় পৃথিবীর সন্ধানে। বিভিন্ন পেশা এবং বয়সের লোকদের ইনভল্বমেন্ট দেখে মনে হয়েছে গত মাসখানেক ধরেই অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলেছে, বছরের শেষ বিকালটি (২০০৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর) তারা বিজ্ঞান সংস্থা ডিসকাশন প্রজেক্ট-এর বিজ্ঞান আলোচনা শুনে কাটাবে। পুরো ব্যাপারটি সম্ভব হয়েছে ডিসকাশন প্রজেক্ট-এর সাথে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে যুক্ত সন্দ্বীপের তপন কুমার বণিকের নিয়মিত যোগাযোগের কারণে।

যে সমস্ত প্রশ্ন নিয়ে এই বক্তৃতা অনুষ্ঠান আবর্তিত হয়েছিল তা ছিল: দূরের ওই নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে কখনও কি নিজের সঙ্গীকে খুঁজেছেন? এ মহাবিশ্বে আমরা কি একা? হতে কি পারে না অসংখ্য নক্ষত্রের অসংখ্য গ্রহ প্রাণের কোলাহলে মূখরিত? কিভাবে ড্রেক সমীকরণ ১০০কোটি গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণী থাকার গাণিতিক সম্ভাবনার কথা বলছে? এছাড়াও বহির্জাগতিক প্রাণের প্রকৃতি, সভ্যতার বিকাশ ও তার টিকে থাকাসহ এর ব্যাপারে সমপ্রতিক ঘটনাবলীগুলো স্থান পাবে। হাজার বছরের কৌতুহলী মানুষের মতো আসুন জেনে নেই দ্বিতীয় পৃথিবীর সন্ধানে।

অনুষ্ঠানটি হয়েছিল কবি আব্দুল হাকিম অডিটোরিয়ামে, যেটি সন্দ্বীপ উপজেলা পরিষদে অবস্থিত। আর তাতে ২৫০ জন দর্শকশ্রোতা ২৫ টাকা করে টিকিট কিনে অংশ নেয়। এদের মধ্যে নানা বয়সের নারী-পুরুষ ছিল। তারা অজস্র প্রশ্ন করেছে। যা সত্যিই আশ্চর্যজনক। শুধু তাই নয়, বিষয়টি নিয়ে পুরো সন্দ্বীপে এক ধরনের উৎসব-ভাব চলে এসেছিল। তারা সীতাকুণ্ড পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানের পোস্টার লাগিয়েছিল। এই বক্তৃতায় আমি পৃথিবীর বাইরে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা, তাদের খোঁজে প্রেরিত বিভিন্ন মহাকাশযান, সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ এবং মঙ্গলগ্রহে আবাসন নিয়ে আলোচনা করি। আলোচনা করি একটি নাক্ষত্রিক সভ্যতার পর্যায়ক্রম এবং তারা থাকলে এখনও কেন আসেনি। এগুলো আলোচনা করতে গিয়ে চলে আসে পৃথিবীর সভ্যতার এ পর্যায়ে উঠে আসার পেছনকার সর্পিল ও রক্তাত্ব পথ। এগুলোকে আলোচনা ও ব্যাখ্যা করার জন্য মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে স্লাইড ও ভিডিও ক্লিপস দেখাই।

এই বক্তৃতা অনুষ্ঠানে আমি অন্য যেকোনো অনুষ্ঠান অপেক্ষা অধিক ভিডিও ক্লিপস ও স্লাইড ব্যবহার করেছিলাম গ্রহ-নক্ষত্র, প্রাণিজগতের বিবর্তন নিয়ে। কিন্তু প্রশ্নোত্তর পর্বে ওদের কথাবার্তা শুনে মনে হলো ওরা যেন আরো কিছু চাচ্ছে। মঙ্গল ছাড়াও অন্যগ্রহে আবাসভূমি দেখতে চেয়েছিল। বিষয়টি প্রথমে দূর্বোধ্য লাগলেও পরদিন ওরা যখন সমুদ্রের তীর বাদ দিয়ে চরাঞ্চলে নিয়ে গেল তখন তাদের উদ্ভাসিত মুখ দেখে অনুভব করেছিলাম নতুন আবাসভূমি ওদের মনে এক ধরনের আশা জাগায়। সেটা হোক গ্রহ- গ্রহান্তরে তাতে ক্ষতি নেই। এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করে, ওরা (সন্দ্বীপবাসী) না করলেও অন্য কেউতো ব্যবহার করতে পারবে। পরিবেশ প্রেক্ষাপট মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে কিভাবে পরিবর্ত করে তাই দেখছিলাম। কারণ বারবার ভূমিভাঙ্গনের ফলে আবাসনের যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে তা ওদেরকে নিঃশব্দ ঘুনপোকার মতো ক্ষয় করে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য নব্বই দশকের শুরুতে নেদারল্যাণ্ডের একটি বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশ সরকারের নিকট “ভাঙ্গন রোধের সুপারিশ মালা” নামে এক প্রাক সম্ভাব্য রিপোর্ট পেশ করে। উক্ত রিপোর্টে সন্দ্বীপ ও চর পীরবক্সের মধ্যে দুটি ক্রসবাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে দ্বীপ রক্ষার পরামর্শ দেয়া হয়। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ৯০ হাজার এক জমির উন্নয়নসহ কমপক্ষে আরও ৪৫ হাজার একর জমি সাগর বক্ষ থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হত। প্রায় পৌঁনে চারশত কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের জন্য কানাডা, সুইডেন, হল্যাণ্ডসহ কয়েকটি দেশ ও দাতা সংস্থা এই পরিমাণ অর্থের যোগান দিতেও সম্মত হয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু রাজনৈতিক ডামাডোল ও স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে সম্ভব হয়নি। ২০০০ এর ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী সন্দ্বীপকে ভয়াবহ ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষার পরিকল্পনা করেছিলেন। উক্ত পরিকল্পনা ক্রসড্যাম প্রকল্পের অনুকূলে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। গত একদশক ধরে সন্দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে ভাঙ্গনে মাত্রা প্রচণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। রিটেইনিং দেয়াল দিয়ে  স্বল্প খরচে ঐতিহ্যবাহী এই দ্বীপটিকে মেঘনার এই অব্যাহত ভয়াবহ ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করা যেতো। কিন্তু এগুলো এখন অতীতের কথা। এর কিছুই বাস্তবায়িত হয় নি। এবং ভবিষ্যতেও হবার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। প্রায় আড়াই লক্ষাধিক মানুষ নিশ্চিত করুণ পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছে। ফলে ১৯৯২ সালের দিকে সন্দ্বীপের আয়তন ছিল ১৯৫ বর্গমাইল অথচ এখন মাত্র ৯৫ বর্গমাইলে এসে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের যে বিশাল চরে নিয়ে গিয়েছিল তা সন্দ্বীপের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত। এই চরই সবুজ চর নামে পরিচিত। তা ক্রমশই জেগে উঠে উড়ির চরের দিকে এগোচ্ছে। মানুষজন এখনই কাগজপত্র দেখিয়ে জায়গার দখল নিচ্ছে। নতুন করে বাঁচার সংগ্রামে অবতীর্ণ হচ্ছে। প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটা উঁচু- নিচু রাস্তা দিয়ে রহমতপুর, হাষিমপুর, কালাপানিয়া ইউনিয়ন পেরিয়ে সন্দ্বীপে ভয়াবহ ভাঙ্গনের পাশাপাশি নতুন জেগে ওঠা এই চর দেখাতে নিয়ে আসে। প্রাকৃতিকভাবে জেগে ওঠা এই চর সন্দ্বীপের অধিবাসীদের জন্য আবার আশার আলো জ্বালিয়েছে। সবুজচরের বিস্তৃর্ণ প্রান্তরে ওদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে এটাও তাদের নতুন একটি জগৎ, একটি দ্বিতীয় পৃথিবী। হয়তো এটাই তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে দ্বিতীয় পৃথিবী সন্ধানের মতো একটি আধুনিক বিষয় এবং আপাতভাবে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে।

সূত্র: ডিসকাশন প্রজেক্ট এর ৩১ ওপেন ডিসকাশন উপলক্ষে ২০০৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ২০০৪ সালের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত সন্দ্বীপে ছিলাম। হাজী এবিএম ডিগ্রি কলেজটি তার একমাসের মাথায় সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়।

ডিসকাশন প্রজেক্ট
রচনাকাল: ২০০৪ সাল

ক্যাপশন: সন্দ্বীপের তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে ডিসকাশন প্রজেক্টের কর্মীরা দ্বিতীয় পৃথিবীর সন্ধানে ছুটে চলেছে।