মুক্তিযুদ্ধ এবং কয়েকটি পর্ব

মোজাফফর হোসেন


সময় : ২০১০, মার্চ
রাত একটা। বিছানা থেকে উঠে বসে মমতা রায়। শ্বেতা ও প্রিয়তি তখনো ঘুমায়নি। প্রিয়তি শ্বেতার মাস্তুতো দিদি। বয়সে শ্বেতা বছর দুয়েকের বড় হবে। অনেকদিন পর দেখা হল দুজনার। গল্প যেন ফুরাতেই চাইছে না!
উঠে পড়লে কেন কাকী? প্রশ্ন করে প্রিয়তি।
মমতা রায় কোন কথা না বলে বারান্দায় চলে যায়।
আবার সেই স্বপ্নটা দেখেছে বোধহয়! বলে শ্বেতা।
কোন স্বপ্নটা দিদি? প্রশ্ন করে প্রিয়তি।
খুবই ভয়ংকর একটা স্বপ্ন। অসংখ্য কালো কালো বুট কাকীকে দলে-পিষে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে চায়।
ওমা! সে কি বলছো দিদি! রোজ রাতে কি কাকী একই স্বপ্ন দেখে?
হ্যাঁ। তাই তো জানি।
আচ্ছা দিদি, কাকীর কি মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে?
না বোদহয়! মাথা খারাপ হলে কি মানুষ এমন চুপচাপ-শান্ত থাকতে পারে?
তবে…?
বাবা তো বলেন, যুদ্ধ থেকে কাকা আর না ফেরাতে শোকে কাকী এমন পাথর হয়ে গেছে।
তপন দাদা বিয়ে করে কাকীকে ঢাকায় নিয়ে গেলেই তো পারে?
কাকী যাবে দাদার কাছে? এ জন্মে সেটা আর দেখে যেতে পারবো না! দাদার বিয়েটারো একই দশা হবে।
আচ্ছা দিদি, একটা জিনিস কিছুতেই ভেবে পাই না, কাকী তপন দাদার সাথে এমন সৎ ছেলের মতন ব্যবহার করে কেন?
জানি না রে..!

মমতা রায় বারান্দায় রাখা চেয়ারটাতে জড় বস্তুর ন্যায় বসে থাকে। ঘন অন্ধকারের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ভেতর থেকে শ্বেতা-প্রিয়তির ফিসফাস শব্দ আর শোনা যায় না। সবাই ঘুমিয়ে পড়ে শুধু মমতা রায় একা বারান্দায়…! সে এখন প্রকৃতির একটা অংশ। থেকে থেকে শুধু চোখের পাতা নড়ে গাছের পাতার মতন করে।
প্রায় চল্লিশ বছর এইভাবে কাটিয়ে দিলেন তিনি। কতটা কষ্ট একটা মানুষকে বৃক্ষ বানিয়ে দিতে পারে- বিঙ্গান বলতে পারে না। কতটা কষ্ট একটা মানুষকে পাথর করে তোলে- কবিতা বলতে পারে না। তাই মমতার রায়ের বেদনাটা সকলের কাছে রহস্যই থেকে যায়।


তপন রায় ঢাকার একটি বেসরকারী ফার্মে কর্মরত আছে। কিছুদিন হল জয়েন করেছে। তার যা স্বভাব তাতে এই চাকরিটাও কয়দিন থাকে তা নিশ্চিৎ করে বলা যাচ্ছে না।
তপন ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। বাংলাদেশের তথাকথিত রাজনীতির সাথে তার স্বভাবটা একেবারে যায় না। একদিন হঠাত করে ঘোষনা করলো সে রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছে। আড়ালে কেউ কেউ বলাবলি করলো, তাকেই নাকি দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অসম্ভব কিছু নয়। সবাই যেখানে গলা ফেড়ে বিরোধী দলের কুৎসা রটানোতে ব্যস্ত থাকে তপন রায় সেখানে অনুষ্ঠান করে নিজেদের দোষ-ত্রুটিগুলো দলের নেতা কর্মীদের সামনে তুলে ধরে। অনেকে তো ধরেই নিয়েছিলো সে বিরোধী দলের গুপ্পচর হিসেবে কর্মরত আছে। একবার শিবিরকর্মী ভেবে কারা যেন মারতেও গিয়েছিল। পরে জনলো সে ধর্মে রায়, মুক্তিযুদ্ধার সন্তান। এ অন্য ধাঁচের, একে দিয়ে রাজনীতি হবে না। ফলে দল থেকে বহিষ্কার। আবার এমনও হতে পারে, তপন রায় একজন স্পষ্টভাষী মানুষ। বাবা শহীদ মুক্তিযুদ্ধা মৃদুল রায় ছিলেন আপোষহীন দেশপ্রেমিক। সে বাবার মতন হতে চায়। তাই হয়ত সে নিজেই এই ভোগের রাজনীতি থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এখন সে শুধুই স্বপ্ন দেখে বাবার রক্তাক্ত মুখের এবং বিছানা ছাড়ে সুন্দর বাংলাদেশের প্রত্যাশায়। বাবাকে সে দেখেনি। কারো মুখে বাবার গল্পও শোনেনি খুব একটা। তপনের বাবা বাংলাদেশের খুব সাধারণদের মধ্যে একজন ছিলেন। তপনের বাবা যুদ্ধে গেলে ঠাকুরমা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন,
“ছেলেটা আমার কোনদিন একটি ঢিলও ছোড়েনি কারো দিকে। সেই ছেলে আজ বন্দুক হাতে তুলে নিল! ভগবান সহায় থেকো।”

পূবের রক্তাক্ত সূর্যের দিকে তাকালে তপনের বাবার কথা মনে হয়। তপন অনুভব করে, বাবা সূর্যের চোখ দিয়ে বাংলাকে দেখে। স্বাধীনতা বিরোধী শত্রুরা যখন গাড়ীতে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে সংসদ ভবনের দিকে হেঁটে যায়, আবারো রক্তাক্ত হয় বাবার বুক। সূর্য যখন ঘরে ফিরে যায়, বাবা তখন অন্ধকারের চাদর মুড়িয়ে আবারো আসে। একদিকে ফুটপাতে লাশের মতন পড়ে থাকে মানুষ, অন্যদিকে, এমপি-মন্ত্রিদের বড় বড় অট্রালিকাগুলো মানুষের জন্য হাহাকার করে; তাদের একমাত্র ছেলেটা বিলেতে পড়াশুনা করছে। রিকশা চালক, মুক্তিযোদ্ধা মফিজ ক্লান্ত হয়ে রিকশাতেই ঘুমিয়ে পড়ে, ঘরে তার অপেক্ষা করছে অনেকগুলো প্রাণ, মফিজ মিঙা না আসলে যে রান্না হবে না! রাস্তার ওপারে বড়লোকের ছেলে মেয়েরা মাতাল হওয়ার জন্য ছুটে যায় নাইট হোটেলে। এপারে, পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য পঞ্চাশ বছরের দেহটাকে পালিশ করে খরিদ্দারের আশায় ঘুরে বেড়ায় সফেলারা। কয়েকজন পুলিশ নাইটগাডের সাথে কিসের যেন টাকা ভাগাভাগী করতে গিয়ে বিশ্রি ভাষায় গালি দেয়। হাসপাতাল থেকে গোঙানীর শব্দ আসে ময়নার মার, যৌতুকলোভী স্বামীর অত্যাচারে ঝলসে গেছে তার শরীর। ঐদিকে, গোলবৈঠকে ম্যামের বোতল সাজিয়ে, এক হাতে কালো রঙের পানীয় ধরে মার্চমাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ বিষয়ক কর্মসূচীর সূচি প্রণয়ন করছে বুদ্ধিজীবীরা। টেলিভিশন ও কাগজ মিডিয়া তাদের বিশেষ অনুষ্ঠান ও ক্রোড়পত্র নিয়ে ব্যস্ত। লজ্জায়, অপমানে অন্ধকারের সাথে মিশে যায় তপনের বাবা। তপনের ঘুম ভেঙ্গে যায় দুঃস্বপ্ন দেখার মত করে। তপন বারান্দায় যায়। দেখে বাবা বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে। তপন পাশের চেয়ারটিতে বসে।
বাবা তুমি? কতক্ষণ? আমাকে ডাকোনি কেন?
আচ্ছা তপন, তোদের ঘুম আসে?
ঘুম আসবে না কেন বাবা? ফোমের বিছানা, মাথার ওপর ইলেকট্রিক ফ্যান ঘুরছে বেদম। পেটভর্তি আয়েশী খাবার। ঘুম না এসে পারে!
আমরা কি তবে…?
কি হল বাবা, কিছু বলছ?
না, কিছু না।
বাবা, তোমার কি মন খারাপ? আজও ভালো কিছু কি চোখে পড়েনি তোমার? ঢাকায় কত বড় বড় বিল্ডিং হচ্ছে, সমস্ত দেশ সপিং কপ্লেক্স-এ ভরে যাচ্ছে, আরো কত কত উন্নয়নে ভরে যাচ্ছে দেশ! কিছুই কি চোখে পড়ে না তোমার?
আচ্ছা তপন, আমরা কি এসবের জন্যই যুদ্ধ করেছিলাম? অকাতরে প্রাণ দিলাম লক্ষ লক্ষ মানুষ?
চারিদিকে তাকালে তাই তো মনে হয়! জানো বাবা, তোমার জন্য একটা সুখবর আছে। এইবার বাংলা কলঙ্ক মুক্ত হবে- খুব শীঘ্রই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলেই কি কলঙ্কমুক্ত হবে দেশ? দেশ থেকে দুর্নীতি উবে যাবে? ফুটপাতে আশ্রয় নিতে হবে না কাউকে? ঘুষ-দলীয়করণ থাকবে না কোথাও? ধর্ষণ আর এসিডের শিকার হবে না আর কোন নারী? ঢাকা প্রথম শ্রেনীর বাসযোগ্য শহরের সার্টিফিকেট পাবে? গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির সমস্যা শেষ হয়ে যাবে চিরতরে? ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটবে কৃষক-শ্রমিক-মুটেদের?
তবে কি তুমি চাও না তাদের বিচার হোক?
যুদ্ধ গত হয়েছে কবে; এখনো বাতাসে লাসের গন্ধ, তাজা রক্তে ভরে গেছে বাংলার নদী। ড্রেন দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে রক্ত! রক্তের বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে কোন কোন শহর। আমি সত্যিকারের মুক্তি চাই। আমি এই দুঃসহ অভিশাপ বুকে করে নয়, মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে বাংলার মাঠে ঘাটে বিচরণ করতে চাই।

তপন কথা বলতে থাকে বাবার সাথে, কথা বলতে বলতে একসময় লক্ষ্য করে বাবা উঠে গেছেন। তপন দিনভর ভাবতে থাকে বাবার কথাগুলো। মাঝে মধ্যে তার ভাবনাগুলোর কথা জানায় বান্ধবী শ্রেয়াকে। শ্রেয়া তার গল্পের জীবনে এই আসে এই যায়। কখনো কখনো শ্রেয়ার হাত ধরে সে অনুভব করে সে এখন যুদ্ধ করছে, ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের দেয়ালে শক্ত করে পিঠ ঠেলে আছে। ক্ষয়ে যাচ্ছে তার পাও, ঘুন ধরেছে তার মেরুদন্ডে! নিঃশ্বাস দিয়ে মেশিনগানের আওয়াজ বের হচ্ছে। এই বিদঘুটে অনুভবের কোন হেতু খুঁজে পায় না তপন।

এখনো বিয়ে হয়নি ওদের। শ্রেয়ার বাবা গোঁ ধরে আছেন, তপনের মায়ের সাথে কথা না হওয়া পর্যন্ত এ বিয়েতে তিনি কিছুতেই মত দেবেন না। এ দিকে তপনের বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। তাই আজকাল শ্রেয়া আর তপনের আলাপ যেখানেই শুরু হউক না কেন শেষটা গিয়ে বিয়েতে ঠেকে।
শ্রেয়া টিএসসিতে তপনের জন্য অপেক্ষা করছে প্রায় ঘন্টাখানেক হতে চলল। তপন আসে।
কি ব্যাপার তোমার পায়ের স্যান্ডেল গেল কোথায়?
হুমায়ুন স্যারের সাথে চুক্তি করে আসলাম, আজ থেকে আমিই হিমু।
কিন্তু, হিমুতো নিশাচর?
ঢাকা শহরে রাতে হাঁটা আর মোটেও নিরাপদ নয়।
যার পায়ে স্যান্ডেল নেয়, তার আবার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা কেন?
চোখ আর কিডনি তো আছে? শুনেছি মানুষের মাংসের সুয়াদ নাকি বেশ ভালো!
এবার তোমার ফাজলামো রেখে আসল কথাটি কি বল?
ছবির হাটের ওখান দিয়ে আসছিলাম। ওরা ওখানে একটি রাজাকারের পুত্তলিকা বানিয়ে রেখেছে; বুকে বড় বড় করে লেখা, আমি রাজাকার, বিশ্বাসঘাতক, আমার গায়ে থুতু ফেলো, আমাকে স্যান্ডেল ছুড়ে মারো। আজ রুটি খাবো বলে বের হয়েছিলাম। আট-নয়টা হোটেল ঘুরে কোথাও রুটি পাইনি, যদিও বা পেলাম পকেটে হাত দিয়ে দেখি ম্যানিব্যাগ ফেলে এসেছি। মেজাজটা তখন থেকেই খুব চড়ে ছিল, ছান্ডেল মারার সুযোগটা তাই হাতছাড়া করতে চাইলাম না; কিন্তু তখন কি আর জানতাম, স্যান্ডেল দুইটা ঐভাবে ড্রেনে গিয়ে পড়বে! ঢাকা পৃথিবীর দ্বিতীয় বাস অযোগ্য শহর হয়েছে কেন, জানো? এই উলঙ্গ ড্রেনিং সিস্টেমের কারণে। আমি আজই আবিষ্কার করলাম এটা। আমার ধারনা, নাইরোবিতে মানুষ চলতে ফিরতে সবসময় ড্রেনে পড়ে, এই জন্য ওরা প্রথম হয়েছে।
থামবে তুমি?
ভেবে দেখো, পরের বছর আমরা প্রথম হলাম। তুমি আর আমি একসাথে ড্রেনে পড়ে গেলাম! একটু দূরেই পড়ল আমাদের ধুতি পরা ভুড়ি মোটা ঐ স্যারটি! স্যার ড্রেনের মধ্যে ধুতি খুঁজছেন। তুমি খুঁজছ ওড়না। বেশ মজার হবে না?
বুঝেছি, ক্ষুধা একেবারে মাথায় চড়ে গিয়েছে। খাবে চলো।
বাঙ্গালী মেয়েরা এত বেশী মমতাময়ী বলেই তো পিছিয়ে রয়েছে। কেউ খায়নি শুনলেই এদের মাতৃত্ব মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
ভালো কথা বলেছো। বাবা তোমার মার সাথে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে চান।
বাবাকে বলো, আমার মার সাথে কথা বলে কোনো লাভ হবে না, সে খুবই আনরোমান্টিক প্রকৃতির!
ফাজলামো রেখে বলো বাবাকে কি বলব?
আজ সন্ধ্যায় আমি তাঁর সাথে কথা বলব।
সেই ভালো। খাবে চলো।

৩.
তপন রায় বেশ ভয়ে ভয়ে শ্রেয়ার বাবার রুমে প্রবেশ করে। স্কুলের হেড মাস্টারের রুমে এইভাবে প্রবেশ করত সে। শ্রেয়ার বাবাকে কেন জানি হেডমাস্টার হেডমাস্টার মনে হয়। খুব বেশি কথা বলেন না। এই ক্ষেত্রে তপনের উচিৎ মুরুব্বির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা কিন্তু, তপনের সাহসে কুলায় না, তাই নিরাপদ দূরত্ব থেকে হাত দুটো থুতনি বরাবর উঠিয়ে কাজটি সেরে নিল সে,
নমস্কার, কাকা।
নমস্কার। তোমার নতুন চাকুরীটা কেমন চলছে?
জ্বী, ভালো। শ্রেয়া বলছিল…
হ্যাঁ, দেখো, তোমাদের দুজনের যথেস্ট বয়স হয়েছে। আমরা আর অপেক্ষা করতে চাই না।
দেখুন, আমি পূর্বেও বলেছি- মা আমার কোন বিষয়ে কথা বলতে আসবেন না।
কিন্তু, তুমি তার একমাত্র সন্তান?
হুম, কিন্তু…৭১ এ জন্ম আমার। বাবার শোকে ততদিনে মা পাথর হয়ে গেছে। আমার প্রতি তার কোনদিনই আগ্রহ ছিল না। ঢাকায় এক কাকার বাসায় থেকে মানুষ হয়েছি। বুদ্ধি হবার পর খুব বেশি কথা হয়নি আমাদের। আমাকে দেখলে মা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই ডাক্তার বলেছেন, আমাকে তার কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকার জন্য। এখন আপনিই বলুন, আমি কি করতে পারি?
কিন্তু, অভিবাবক ছাড়া আমরাও তো আমাদের মেয়েকে কারো হাতে তুলে দিতে পারি না। আমরা একটি সমাজে বসবাস করি। সমাজের নিয়ম কানুন বলে তো একটা কথা আছে, নাকি? তুমি মুক্তিযুদ্ধার সন্তান, এ জন্য তোমাকে আমি বেশ পছন্দ করি। এখন বাকিটা তোমার উপর নির্ভর করছে।
জ্বী।
সপ্তাহ খানিকের মধ্যে একটা রেজাল্ট চাই।
জ্বী, আচ্ছা।


সময় : ১৯৭১, ডিসেম্বর
সবে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। দিন দশেক হল মমতা রায় শশুর বাড়ি এসেছেন। যুদ্ধ চলাকালে তিনি ফরিদপুরে পিতৃালয়ে ছিলেন। মমতা রায়ের স্বামী মৃদুল রায় তখনো যুদ্ধ থেকে ফেরেননি। ধরে নেওয়া হয়েছে আর ফিরবেন না। দেশের জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের মধ্যে মৃদুল রায়ের নাম অঘোষীত ভাবেই যুক্ত হয়ে গিয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আনন্দ ও স্বজন হারানোর বেদনা এমন ভাবে মিশে গেছে; দেখে বুঝার উপায় নেয়, কোনটা অর্জনের কান্না কোনটা হারানোর! আর পাঁচটা শহীদ পরিবারের মতন মৃদুল রায়ের বাড়িতেও শোকের আবহ বিরাজ করছে। মমতা রায় স্বামী শোকে বাকশূন্য হয়ে পড়েছে।
ইতোমধ্যে এলাকায় আরো একটি সংকট মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। মুসলমান ও হিন্দু পাড়াতে যে সকল মহিলারা ধর্ষিত হয়েছিল তাদের নিয়ে নানান কথা হচ্ছে। খন্ড খন্ড ভাবে তাদেরকে শশুরবাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে।
গতকাল হিন্দু পাড়া থেকে তিনজন মহিলাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।– খবরটি মৃদুল রায়ের ছোট ভাই সুশীল রায় এসে বলল।
“পাঠানদের বীর্জ যে সকল মহিলাদের গাত্রে প্রবেশ করিয়াছে, তাহাদের বাড়িতে রাখিলে চরম অকল্যাণ হইবে”-পুরোহিতের এই কথায় হিন্দু পাড়ার কেউই দ্বিমত পোষন করেনি।
তিনি আরো বলেছেন, “বাড়ি থেকে তো বটে, সম্ভব হলে এ দেশ থেকেই তাদেরকে বিতাড়িত করতে হবে।
সুশীল রায়ের মুখ থেকে কথাটি শোনার পর মমতা প্রতিবাদ করে বলেছিল, তবে যে দ্যাশ স্বাধীন হইল! এ কাদের স্বাধীনতা, কেমন স্বাধীনতা?
সুশীল রায় কোন কথা বলেনি। বোঝা গেল পুরোহিতের কথায় তারও সায় আছে।
পরদিন দুপুরে মমতার বমি করা দেখে শাশুড়ি জানতে চেয়েছিল, বৌ তোর কি হয়ছে?
মা আপনের ছেলের শ্যাষ চিহ্ন আমার ভেতরে।
কথাটি শুনে আনন্দে চিৎকার করে মমতার শাশুড়ি বলে ওঠে,
ওরে মায়ের পায়ে প্রসাদ দে। আমার খোকা ফিরে আসছে! আমার মৃদুল মরে নি!
রাতে খাবার খেতে খেতে ফিসফিস করে শাশুড়ি বলে,
বৌমা, ক’মাস হল?
পাঁচ মাস হবে মা।
খোকা তো তারও আগে…?
ওহো আপনাকে বলতে ভুলে গেছি, মাঝে ও দুইবার ফরিদপুর আসছিল।


সময় : ২০১০, মার্চ
তপন রায় চাকরি পরিবর্তন করেছে। এখন সে একটি দেশীয় উন্নয়নমূলক একটি সংস্থায় কাজ করছে। সংস্থায় জয়েন করেই সে ফিল্ডওয়ার্ক শুরু করেছে। ওরা এখন সরকারিভাবে বাংলাদেশের ৭১-এ ধর্ষিত মহিলাদের সেই বিভৎস স্মৃতি রেকর্ড করে বেড়াচ্ছে। প্রয়োজনে ছদ্মনামে প্রকাশ করা হবে এই স্মৃতি কথা। তপনের জোন হচ্ছে ফরিদপুর।
কাজের মাঝখানে হঠাতই তপন চাকুরী ছেড়ে ঢাকায় ফিরে আসে। কারো সাথে কোন যোগাযোগ না করেই চলে যায় কুষ্টিয়ায়।
তপনকে এভাবে বিনা নোটিশে হাজির হওয়া দেখে বাড়ির সকলে বেশ আশ্চর্য হয়। বহুদিন পর দাদাকে দেখে আনন্দে লাফাতে থাকে শ্বেতা। শ্বেতার বাবা সুশীল রায়কে একাকী কক্ষে ডাকে তপন,
কাকা, আমার বাবা কে?
কেন? আমার দাদা মৃনাল রায়!
ভগবানের দোহায় লাগে, সত্যি করে বলো কাকা?
আরে পাগল আমি তোকে মিথ্যা বলতে যাবো কেন?
তাহলে ফরিদপুরের ঘটনাটা তোমরা আমার কাছে গোপন করেছ কেন? আজ আমাকে জানতেই হবে, মা আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায় কেন?
রাতে মায়ের মুখোমুখি হয় তপন।
মা? আমি কে?
কোন কথা বলে না মমতা রায়?
দয়া করে আজ আর আপনি চুপ করে থাকবেন না। এই শেষ বারের মতন আমি আপনার মুখোমুখি হয়েছি। আজ আমি আমার অস্তিত্ত্বের প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে। মৃদুল রায়ের দোহায় লাগে, বলুন আমি কি তপন রায়?
না। মমতা রায় চেয়ারের হাতলটা শক্ত করে চেপে ধরে বলে।
তাহলে? আমি কে? আমার পরিচয় কি?
আমার দুঃস্বপ্ন! আমার জীবনের ভয়ঙ্কর একটি রাত! আমার দেহের কলুষিত রক্ত! আমার সারা জীবনের সংগ্রাম, বেঁচে থাকার একমাত্র গ্লাণি। মমতা রায় বিগাড়ের মত বলে চলে।
তপন রুম থেকে বেরিয়ে আসে। বাড়ির মানুষজন, স্যাঁতসেঁতে কলপাড়, একসাথে বড় হওয়া উঠানের কোনের আমগাছটি, লোনা ধরা বাড়ির দেয়াল, সবকিছু খুব অচেনা মনে হয় তপনের কাছে। তপন পা বাড়ায় শূন্যের দিকে; কোন বন্ধন নেই। কয়েকটা মুহূর্ত এসে মিথ্যা করে দিল তার জীবনের চল্লিশটা বছর। পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজে তপনের কোন পরিচয় থাকলো না। জাতীয়তাবাদ, বংশ, ধর্ম সবকিছু হারিয়ে তপন এখন নাথিংনেস এর সিমাহীন তলে তলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ!
বিষয়টি গ্রাম থেকে গ্রাম অতঃপর সমস্ত দেশ জানলো। তপনের বন্ধুরা যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। রাতারাতি আমেরিকা ফেরত এক ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে গেল শ্রেয়ার।


আপনি? ভেবেছিলাম আর আসবেন না!
এভাবে পর করে দিচ্ছিস কেন, বাবা? তুই তো আমারই সন্তান। তোর জন্যই তো আমি যুদ্ধ করেছিলাম। তোর জন্যই তো এই স্বাধীনতা।
তাহলে…?
আত্মার সম্পর্কের মাঝে কি দেয়াল দেয়া যায়?
বাবা, আমি এখন কি করবো? কোথায় যাবো?
দেশের বাইরে কোথাও চলে যা।
না। পারবো না বাবা। এ বাংলার মাঠ-গাছ-ফুল-পাখি-নদী-আকাশ এসব আমার আত্মার আত্মীয়। আমি এদেরকে ছেড়ে থাকতে পারবো না বাবা। আচ্ছা, আমি যদি তোমার মত করে এই প্রকৃতির মাঝে মিশে যাই?
কিন্তু…?
তোমার হাতে হাত রেখে আমি আমার সমস্ত বাংলাদেশ চষে বেড়াব। আমাকে নেবে তুমি?
আমি তোকে কেমন করে না করি!
বাবা?
হুম?
আমি এখন কার কাছে কৃপা প্রার্থনা করব, বলতে পারো? আমার ঈশ্বর কে, ভগবান নাকি আল্লাহ? নাকি এঁরাও আমাকে…?
যে নাম ধরে ইচ্ছে, যেভাবে ইচ্ছে ডাক। তার তো বিশেষ কোন সত্বা নেই।


পরদিন ভোরে তপনের রুম থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশটি ময়নাতদন্তের পর আত্মীয়-স্বজনদের জন্য রেখে দেওয়া হয়। তপনের কোন দাবীদার থাকে না। সরকারী ভাবে বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে দাফন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সমাজই তাদের তরিকা মত তপনের লাশ দাফনের বিরোধিতা করে। শেষ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার তীরে পুঁতে রাখা হয় তপনের দেহ।

অন্ধকারে বাংলাদেশের অলিতে গলিতে হেঁটে বেড়ায় তপন আর তপনের বাবা।
আমরা এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক, তাই না বাবা?
এই স্বাধীনতার জন্যই কি আমরা যুদ্ধ করেছিলাম?
সরকার, নির্দিষ্ট ভূ-খন্ড, সার্বভৌমত্ত ও জনগনের সমন্বয়ে একটি দেশ হয়। তোমরা তো একটি দেশ চেয়েছিলে, তাই না বাবা?
আমরা মুক্তি চেয়েছিলাম, মানব মুক্তি।
তাহলে যুদ্ধ থেমে গেল কেন? এই আড়ষ্ট বাংলায় তোমরা বিজয়ের মিছিল করলে কেন? তোমরা না মুক্তিযোদ্ধা!
এইভাবে প্রশ্নের পর প্রশ্ন নিয়ে বাংলাদেশে আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায় তপন আর মৃদুল রায়ের মত লক্ষ লক্ষ মুক্তিকামী আত্মা।