আমি অনেক সময়ই অনেক কিছুর খবর ইচ্ছে করেই রাখি না। কখনো কখনো দৈনিক পত্রিকারও মূল সংবাদ পড়ি না। যেমন— হাইতির ভূমিকম্পের পর পড়িনি। টিভির খবর দেখতে গিয়ে হাইতিতে বাচ্চাদের লাশ ঢিলিয়ে ঢিলিয়ে ফেলার দৃশ্য দুয়েক সেকেন্ড দেখার পর কয়েক দিন আর টিভির খবরও দেখিনি। লঞ্চডুবির ঘটনা পড়ি না। কিশোরীদের আত্মহত্যার ঘটনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে পারি না।

আমার ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে প্রতিদিন পত্রিকা রাখার মত সুযোগ-সুবিধা ছিল না। পত্রিকা গ্রামে পৌঁছতে হাড়িধোঁয়া নদী পার হতে হতো। কাজেই বাবা কাকারা হাতে করে মাঝে মাঝে পত্রিকা আনলে সংবাদ বা ইত্তেফাক আনতেন। তবে সংবাদই বেশি আসত। তাছাড়া, প্রতিদিন পত্রিকা পড়ার জন্যে অর্থ বরাদ্দ করার মত সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় হয়নি এবং দৈনিক পত্রিকা পড়ার প্রয়োজনও অনুভব করিনি। আমি বিয়ের পর ঢাকায় নিজের বাসায় সংবাদই রাখতাম। ছাপাটা একটু লেপ্টে যেত মাঝে মাঝে। তবুও সংবাদই ছিল প্রিয় পত্রিকা। ধারাবাহিকভাবে ভোরের কাগজ, আজকের কাগজ, প্রথম আলো, সমকাল বদলিয়েছি। নতুন পত্রিকা রাখি। বিজ্ঞাপন কম থাকে বলে একটা আকাট্য যুক্তি মনের মধ্যে পোষণ করি। সাথে সাহিত্য পাতাটাও গুরুত্ব দেই।

কিন্তু আগে এত মৃত্যুর খবর পাইনি। আজও মনে আছে- মহসীন হলে পাঁচ ছাত্র খুনের ঘটনা আমাদের গ্রামেও আলোড়ন তুলেছিল। ডাক্তার স্বামী ইকবালের সালেহা হত্যা। কী আলোচিত ঘটনা! আর এখন? সবাই পত্রিকা নিয়মিত পড়ি। কাজেই জানি সে ইতিহাস। কত সালেহাকে যে মারছে! মরছে কত মহিমা। রুমী, তৃষা, ইলোরা।

স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন। স্ত্রীর প্রেমিক ও স্ত্রী মিলে স্বামী খুন। স্ত্রী ও সন্তান খুন করে স্বামী পলাতক। লীগের সাথে দলের সংঘর্ষ। শিবিরের রগ কাটায় লীগের কর্মী নিহত। এক উচ্ছৃঙ্খল যুবক বাসায় গিয়ে এক ব্যবসায়ী ও তার স্ত্রীকে গুলি করে মারে। রয়াবের সাথে বন্দুক যুদ্ধে অমুক সন্ত্রাসী নিহত। তমুক (সরকারী দল কোন সময়েই নয়) রাজনৈতিক দলের সভায় বা মিছিলে পুলিশের লাঠি চার্জ। এসব খবরের আধিক্যে দৈনিক পত্রিকার প্রতি অনীহা বাড়ছে। তবে আমার মেয়ের একটা প্রস্তাব আছে এ নিয়ে। বাণিজ্য সংবাদ, বিশাল বাংলা বা লোকালয় (মফস্বল সংবাদ, পত্রিকাভেদে ভিন্ন নাম) এর মত মৃত্যুর পাতা বা এমন কোন নাম দিয়ে আলাদা পৃষ্ঠা বরাদ্দ করা। যে পাঠকের এসব খবরে আগ্রহ সে পড়ে নেবে।

আমাকে ছোটবেলা আমার মা ছড়া শোনানোর সুযোগ পাননি। আমরা বড় হয়েছি একান্নবর্তী পরিবারে। একটু বড় হলেই মায়ের বিছানা ছোট ভাইবোনদের ছেড়ে দিয়ে বদলি হয়েছি ঠাকুমা ও বোনের সাথে। কাজেই দিনের বেলা মা কদাচিৎ–
“বিলাত দেশটা মাটির সেটা সোনা রূপা নয়
আকাশ হতে রৌদ্র ঝরে মেঘ বৃষ্টি হয়”
জাতীয় কয়েকটা ছড়া শোনালেও দাদু, ঠাকুমা ও বোনের পরস্তাপই শৈশবের পুঁজি। সাথে কিছু লোকছড়া। পরস্তাপ মাঝে মাঝে ছড়াসহও শোনাত। যেমন—গোঁসাই,
“গাট্টি বোঁচকা পইড়া রইল
চোরামণি বিদায় হইল”।
চূড়ামণিও হতে পারে। আঞ্চলিক উচ্চারণের জন্যে আসল শব্দটি হারিয়ে গেছে।

আমি কখনো আমার ছেলেমেয়েকে গান শুনাইনি। তারা চাইলে অনায়াসেই আবৃত্তি করতে পারে শামসুর রাহমানের “কখনো আমার মাকে” কবিতাটি।
“কখনও আমার মাকে কোন গান গাইতে শুনিনি৷
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনও ঘুম পাড়াতেন কিনা আজ মনেই পড়ে না ৷”

কারণ আমি তাদের কখনো ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে ঘুম পারাইনি। বলতাম গল্প, ছড়া আর কবিতা। উল্লেখ্য সবই বাংলা ভাষার। মাঝে মাঝে স্বরচিত ছড়াও। যেমন ছেলেকে শুনাতাম —
“সাকো মনি আর মামণি
গলায় গলায় ভাব
নারকেল গাছে যেমন থাকে
সবুজ রঙের ডাব”।

সেই গতানুগতিক Twinkle Twinkle little star ও শোনাইনি। ইংরেজি নিয়ে আদ্যিখেতা আমার কখনোই ছিল না। এখন ইংরেজি আমার অফিসের ভাষা। সহকর্মীদের অনেকেই বাসায় ইংরেজি দৈনিক রাখেন। শব্দ ভান্ডার বৃদ্ধি হয় তাতে। আমার এ নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। বহু কষ্টে চাকরি পাওয়া ও চালানোর মত ইংরেজি শিখেছি। যথেষ্ঠ এবং যথেষ্ঠ।

মেয়ে প্রায়ই আমাকে ইংরেজি এ বই সে বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করে। আমার ইংরেজি জানার দৌড়ের গতি এতই কম যে মাঝে মাঝে অবসন্ন লাগে। কারণ হঠাৎ কোন শব্দ না বুঝলে অভিধান খুঁজতে গেলে পড়ার গতি চলে যায়। তখন বিরক্ত লাগে। আমার মেয়ে নিজে বাংলা সাহিত্য থেকে বিশ্ব সাহিত্য পড়তে বেশি ভালবাসে এবং ২১ এর মেলাসহ নিজে কোন বই কিনলে অনুবাদ সাহিত্যের বই কিনে। আমার ছেলে ঠাট্টা করে বলে– তুই না জানি কবে বাংলা সাহিত্যের বই অনুবাদ করে দিতে বলবি।
১৯৯৭ সালে ইংল্যান্ডে চার মাস ছিলাম একটা শিক্ষা বিষয়ক কোর্স করতে। কোর্সের অংশ হিসেবে ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন। প্রায় সব বিদ্যালয়ের পরিদর্শনের সময়ই শিশুদেরই ভীষণ কৌতূহলের বিষয় ছিল আমার কপালের টিপ আর শাড়ি। তা হতে পারে শাড়িটি বা এটি পড়ার কৌশল যা তাদের অভিজ্ঞতায় নেই। কিন্তু অন্যান্য প্রশ্ন থাকত কৌতূহলোদ্দীপক।
কিন্তু আমাদের গ্রাম দেশে অফিসিয়াল পরিদর্শনে কোন সাদা চামড়ার বিদেশীকে নিয়ে গেলে গোটা মানুষটা সম্পর্কেই কৌতূহল। অজস্র প্রশ্ন– বাংলা বুঝে? কী খায়? যারা একটু আধটু ইংরেজি জানেন তারা কথোপকথনে ভীষণ আগ্রহী। বিশেষ করে হোয়াট ইজ ইওর নেম জাতীয় প্রশ্ন করবেনই? তখন যে উদ্দেশে যাওয়া তা ভেস্তে যাবার উপক্রম।

আমাদের সময় কোন সাদা চামড়ার বিদেশি নরসিংদী গেলে কিছু দুষ্ট ছেলে বাংলায় ‘সাদা বানর’ বলে চিল্লাত। তখন এ নিয়ে হাসাহাসি করতাম। একজন তো আবার ইংরেজী পান্ডিত্য প্রকাশের বেদনায় একবার হোয়াইট মানকি বলে চিল্লিয়ে হুলোস্থূলই বাঁধিয়েছিল। পরে বিদেশিকে বুঝাতে এলাকার মুরুব্বীদের হস্তক্ষেপ লেগেছিল। এখন বুঝি কী জঘন্যতম ছিল সে উচ্চারণ।